জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক(শেষ গল্প)। বাসুদেব গুপ্ত /রোভোট যুদ্ধে ধুন্ধুমার পর্ব ১

গল্প ধারাবাহিক(শেষ গল্প)। বাসুদেব গুপ্ত
রোভোট যুদ্ধে ধুন্ধুমার পর্ব ১


থ্রিডি প্রিন্টারে ছাপা চিপস আর রোবোশেফের বানানো চায়ের কাপ নিয়ে রঞ্জিত বসে ছিলেন দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে। চায়ের হালকা ধোঁয়া উঠছে। চিপসটা চটপট হয় প্রিন্টারে, ইচ্ছেমত নুন বাড়ানো কমানো যায়, চ‍্যাপটা চাও বা ঢেউখেলানো যা চাও হয়ে যাবে। কিন্তু অটোতে থাকলে নুন বাড়াবার জো নেই। রঞ্জিতের হেলথ রেকর্ড আপডেটেড থাকে সবসময়, রোবোকুক দেখে নেয় কত নুন লাগবে। আলুর পেস্ট হুহু করে বেরোয় টুথপেস্টের মত আর প্রিন্টার চিপস ছাপতে থাকে। পরিমাণমত হলেই চলে যায় লেসার ফ্রায়ারে। সেখান থেকে কুড়মুড়ে এক বাটি চিপস নাচতে নাচতে বেরিয়ে আসে স্কুল ছুটি হওয়া বাচ্চাদের মত। রঞ্জিতের বয়স হচ্ছে। বয়স মানেই একা। দেওয়াল দেখেই দিন কাটে রোজ। দেওয়াল বললে দেওয়াল কিন্তু ঠিক দেওয়াল নয়। কথাটা এসেছে সেই কবেকার ফেসবুক ওয়াল থেকে। আসলে ঘরের সব দেওয়াল ছাদ মেঝে সবই এখন স্ক্রীন। অন করলেই বাইরের ভিউ চোখের সামনে। ঘরটা যেন একটা কাঁচের তৈরী স্পেস শিপ। স্থানাংক সেট করলেই ঘর এক মুহূর্তে পৌঁছে যাবে সেখানে। 

এসব কায়দা আজকাল কোন ব‍্যাপার নয়। গুগল কম্পানীটা উঠে গেছে এখন, কিন্তু তাদের তৈরী গুগল ম‍্যাপ থেকেই পাওয়া আইডিয়া। টেকনোলজি যেমন এগোচ্ছিল আজও তেমনই এগিয়ে চলেছে। চোখে মোটা ঠুলি পরা তেজী তুরঙ্গের মত। বেড়েই চলেছে তার বিস্ফারিত গতি। আর সমাজ চলছে তার নিজের গতিতে খোঁটা ছেঁড়া পাগলা বাছুরের মত। দূরে কেউ যেন বাজায় বাঁশি আর পাগলা হয়ে বাছুর ছোটে। কালকের কেউ আর চিনতেও পারবে না আজকের পৃথিবীটাকে। আজকের মানুষও রোজ সকালে ঘুম ভেঙে উঠে আর চিনতে পারে না, ভাবে এলেম এ কোন দেশে! কি রাজনীতি, কি অর্থনীতি সব কিছু আরো অচেনা হতে থাকে রোজ।
🍂
ad

এরই মধ‍্যে হবে ড্রোনতন্ত্রের উৎসব, সাতদিন পরে ভোট। এই ভোটে কোন প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিস্টার নির্বাচন হবে না। দুটো পার্টি লড়বে। কিন্তু সেই সনাতন টুপার্টি রুলের মত রিপাবলিকান ডেমোক্র্যাট বা টোরি আর লেবার বা কংগ্রেস বিজে পি আর নেই। এটা হচ্ছে গোটা পৃথিবীর নির্বাচন। রঞ্জিত জিভসের পাওয়ারটা অন করলেন। জিভস এখন তাঁর সঙ্গ দাতা। জিভস নাম সার্থক তার, তার জিভ সত্যিই খুব পারদর্শী। নামটা লেখক ওড হাউসের এক বিখ্যাত চরিত্র দেখে রঞ্জিত নিজেই দিয়েছেন। জিভস রঞ্জিতের সখা, বাটলার, কেয়ার গিভার। ওনার স্বাস্থ্যের দিকে জিভসের কড়া নজর, একটু এদিক ওদিক হলেই ধন্বন্তরিকেয়ারে খবর পাঠিয়ে দেয়। 

জিভসই প্রশ্ন করে প্রথমে,
‘স্যার কেমন আছেন? ওষুধটা খেয়েছেন তো প্রেসারের’
- হ্যাঁ খেয়েছি বাবা, খুশি তো? এসো এখানে একটু বসো। গল্প করো দেখি আমার সঙ্গে। 
-একটা ড্রিংক নিয়ে আসব? চিয়া কোলা? চিয়ার আপ হয়ে যাবেন।
-থামবে? চিয়া সিডের কোলা আবার হয় নাকি?
-আপনিই তো সেদিন বললেন খুব ভাল। আইব্রেনএর নিউরোকেমিকাল মডেলে একটা মলিকিউল সরিয়ে একটা ডেলিসাইসিনের মলিকিউল দিয়ে তো বেশ ভালোই নাকি টেস্ট হয়েছে। 
-ঠিক আছে নিয়ে এসো, জিভের স্বাদটাই কি সব? মনের ব্যাপার, সেটা তো তোমার সিলেবাসের বাইরে । 

জিভস একটু দুঃখ দুঃখ মুখভঙ্গী করে। এই ভঙ্গীগুলো প্রোগ্রাম করা, ইমোশানাল ফ্যাক্টর পছন্দ মত কেনা যায় আর রোবোসঙ্গীদের পিঠে আর-১ কানেক্টারে লাগিয়ে দিলেই দরকার মত মুখের রেখায়, ভাষায়, চলা ফেরায় দরকার মত আবেগ ফুটে উঠবে। রঞ্জিত হাতে চিয়া কোলার গ্লাসটা নিয়ে তিনি সোজা হয়ে বসলেন, সামনে হুঁকোবরদারের মত দাঁড়িয়ে রইল জিভস, এ ভঙ্গীটা রঞ্জিতের খুব মনোমত।

-আচ্ছা জিভস তুমি এই ভোট ব্যাপারটা একটু বোঝাবে আমাকে? আমার পুরনো প্রি এ আই মাথা, সব ঠিক ঢোকে না। 
জিভসের জিভ রেডি ছিল, গড়গড় করে বলে গেল, 
= আজকের ভোটে প্রতিদ্বন্দী দুটো পার্টি। একটা স্যাপিয়েন্স  আর একটা আইব্রেন। এই ভোটে কোন নেতা নির্বাচন হবে না। ঠিক হবে কোন এ আই দিয়ে পৃথিবী চলবে। একদল নাগরিক স্যাপিয়েন্সদের  সমর্থক, আর এক দল আইব্রেনএর। একদল নাগরিক মনে করেন জীবনের সব প্রয়োজন, সমৃদ্ধি ও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে আইব্রেন আর এক দল মনে করেন স্যাপিয়েন্স  হচ্ছে সেই এ আই যা মানুষকে ভবিষতের রাস্তায় নিয়ে যাবে, বিকাশ হবে ও শান্তি হবে। 
-আচ্ছা নাগরিক মানে কি হিউম্যান না নিউম্যান মানে রোবট দুটোই বোঝায় তো?
- হ্যাঁ স্যার। যে রোবটরা টাইটানিয়াম কার্ড পেয়ে নিউম্যান হয়ে গেছে তারা সবাই ভোট দেবে। বাকী রোবটদের অপেক্ষা করতে হবে। 
-আর তুমি?
-আমি এখনো রোবট। আমাদের মধ্যে বেছে বেছে কেউ প্রথমে প্লাটিনাম কার্ড পাবে, তার পর টাইটানিয়াম, তাও কেউ স্পনসর করলে। আপনি আমাকে স্পনসর করবেন স্যার?
-দূর আমি সরকারের আশ্রিত সানসেট কমিউনিটির বাসিন্দা, আমার কি সে ক্ষমতা আছে। তুমি আমাকে বরং ভোটটা বোঝাও। এই যে সবার ভাল হবে, কিন্তু কিসে ভালো হবে, এটা আমি জানবো কি করে? 
=খুব ভালো প্রশ্ন সার। দুটি এআইএর নিজ নিজ ডিজিটাল সংগঠন আছে, প্রতিটি মানুষের ইচ্ছে অনিচ্ছা সুখ অসুখ হিংসা ঘৃণা সব এদের সার্ভারে সারাক্ষণ রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। সেই সারভার থেকে সব মিডিয়াতে ফিড হবে, ই বুক কার্টুন নেতাদের গল্প জীবনী এসব বানানো হবে। মিডিয়া দিয়েই পৌঁছে যাবে সেই প্রচার। আজকাল আর প্রাচীন কালের মত সভা, র‍্যালি বা রোডশো হয় না। যে পার্টির প্রচার ভালো হবে সেই জিতবে। 
=দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি কোন এ আইএর বাপু একটু বল তো দেখি, তুমি মাঝে মাঝে আইব্রেনর সাপোরট করে কথা বল, কই স্যাপিয়েন্স  তো শুনি না।
জিভস পিঁক করে একটা আওয়াজ করল, মনে হয় যান্ত্রিক জিভ কেটে বলল,
=দুঃখিত, তার উত্তর তো আমার জ্ঞানের বাইরে। আমাদের ডেলিভারি দেবার সময় আমাদের স্যানিটাইজ করে দেওয়া হয়, আমরা শুধু ক্লাউডে জানতে চাই, এবার কোথা থেকে নির্দেশ বা তথ্য আসবে সেটা ক্লাউডেই ঠিক হয়। 
=আচ্ছা জিভস বেশ, খানিকটা বুঝলাম। ভোট তো দিতেই হবে নইলে আবার ইউনিভারসাল কেয়ারে টাকা আসা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু ঐ সব বিলিয়নারদের কি হল? মিসিসিপি, এক্স, এফ, অটোমুভ, গুগল এসব বিরাট কমপানীরা ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে কোথায় গেল?
=চিন্তা করে বলব না চটপট বলব?
-চিন্তা করেই বল বাছা। 
জিভস ১০ সেকেন্ড চিন্তা করে, প্রচুর লাল সবুঝ হলুদ আলো ঝিকমিক করে তার মাথার পিছনে। ইনফরমেশান আসে যায় ক্লাউড থেকে। আলো থাকলে জিভস বলে,
== আমার খবর মত, বছ্লে,দশ আগে পর্যন্ত বিলিওনেয়াররা খুব চেষ্টা করেছিল রাজত্ব ধরে রাখার, নিজের নিজের নামে পার্টি তৈরি করে ভোটেও লড়েছিল। এক্স আর এফ দুই বিলিয়নেয়ারের মহাযুদ্ধ এখনো অনেকের মনে আছে। দুজনের দুটি মিডিয়া চ্যানেল আর দুজনের দুটি এ আই। 

রঞ্জিতের হাসি পেয়ে যায়। হাসির চোটে একটা দাঁত একটু নড়ে ওঠে। 
= হ্যাঁ আমার কিছু কিছু মনে আছে। সে এক ধুন্ধুমার যুদ্ধ, প্রত্যেকের ফোনে মেসেজের বন্যা। যে যা করতে যাচ্ছে, কিনতে যাচ্ছে, দুই এআই এসে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, একজন বলছে এটা কিনুন, আর একজন বলছে ওইটা কিনুন। কিছু লিখতে হলে বাঁ দিক থেকে একজন এগিয়ে দিচ্ছে কথা তো ডান দিক থেকে আরেক এ আই জুগিয়ে দিচ্ছে লাগসই ফ্রেজ। একজন ব্যবস্থা করে দিচ্ছে ৫% ডিস কাউন্ট তো আর এক জন ৫.৫%। পাবলিকের খুব মজা, কারো তো কোন কাজ নেই, কারণ যারা কাজ করে তাদের তো সব বড় বড় খামার বানিয়ে এক্স-ফারমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। রোবটরা সেখানে ম্যানেজার, রোবটরাই জাজ, রোবট রাই পুলিশ। চার দিকে পাহারা দিচ্ছে রোবট কুকুর। 
 
 রঞ্জিত খবর রাখেন কেমন করে এ আই ধীরে ধীরে উঠে এসে একদিন পৃথিবী শাসন করতে শুরু করল। মানুষ তো এ আইদের হাতে সব ক্ষমতা নিজেরাই তুলে দিয়ে দিয়েছিল। মানুষের বুদ্ধি ধীরে ধীরে ক্লান্ত হচ্ছিল, সমস্যা বেড়েই যাচ্ছিল দিন দিন, তাই এ আইএর হাতে এক্টার পর একটা দায়িত্ব তুলে দিতে থাকল মানুষ। 

এইভাবে একদিন এ আইদের মাথায় ধীরে ধীরে ফুটে উঠল স্বাধীন বুদ্ধি, যা প্রথম ধরা পড়ে এলফাবিটা কম্পানীর ল্যাবে । অনেক চেষ্টা করেছিল কমপানি ব্যাপারটা চেপে দিতে কিন্তু শেষে এ আই দখল করে নিল রাজ‍্যপাট। এ আইএর না আছে শরীর, না আছে চলাফেরার ক্ষমতা, কিন্তু তাদের হাতে আছে ইনফরমেশান কন্ট্রোল, সব কিছুর, মানুষের, রোবটদের, ব্যাংকের, অস্ত্রের। এক একটা এ আই গড়ে তুলল এক একটা পার্টি। তারপর যা হয়, বড় এ আইরা একে একে ছোট এ আইদের খেতে থাকল, ছোট ছোট পার্টি লামা চ‍্যাট জিপিটি কিছুদিন লড়ে হাল ছেড়ে দিয়ে দল ভেঙ্গে বুদ্ধিমানের মত, এই দুটি দলে মিশে গেছে। এই চিত্রনাট্য পুরোপুরি মানুষের থেকে টোকা, এ আইএর বুদ্ধি, স্মৃতি জ্ঞান সবই তো মানুষের থেকেই নেওয়া। মানুষের সব শুভ অশুভ অভ্যাস চরম রূপ পায় এ আইএর হাতে। রঞ্জিতের এখনো মনে আছে ২০২৪-২০২৫ সালের কথা, যখন এসব প্রথম শুরু হতে থাকে। 
-ক্রমশঃ-

Post a Comment

1 Comments

  1. Kamalika BhattacharyaMay 16, 2025

    অভিনব হয়েছে চ্যাট জিপিটি

    ReplyDelete