জ্বলদর্চি

গণিতাচার্য আর্যভট্ট /প্রসূন কাঞ্জিলাল

গণিতাচার্য আর্যভট্ট
প্রসূন কাঞ্জিলাল 


বিজ্ঞান বলে যে, পৃথিবীতে জীবের ক্রমবির্তনের ধারায় মানুষ সর্বশেষে এসেছে। আবির্ভাবের উষালগ্নে মানুষ অরণ্যাচারী ছিল, তখন সে পোশাক পরতে ও কথা বলতে জানতো না। কাঁচা মাংস খেত। গাছের শাখায় ও পর্বতের গুহায় রাত্রি যাপন করত। কিন্তু আদিম পৃথিবীর হিংস্র শ্বাপদ-সঙ্কুল অরণ্যানীর মধ্যে বাস করেও আদিম মানুষ নিজের বুদ্ধির জোরে টিকে গিয়েছিল, সেই পৃথিবীর অন্য দশটা প্রাণীর মত সে ধরাপৃষ্ঠ থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এরপরে হাজার হাজার বছর ধরে আদিম মানুষের বিবর্তন চলেছিল। ক্রমশঃ তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির প্রসার ঘটেছিল ও চিন্তাধারার মধ্যে পরিবর্তন এসেছিল। তখন প্রবলতম অনুসন্ধিৎসা, সীমাহীন কৌতূহল, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে মানুষ তাঁর চারপাশের বস্তুরাশিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছিল।

 প্রথমে খুব সম্ভবতঃ ধরিত্রীর অনন্ত রূপরাশি এবং সীমাহীন মহাকাশ মানুষের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছিল। তাই মানুষ তখন ধারণা করেছিল যে, পৃথিবীটা আসলে থালার মত চ্যাপ্টা এবং সেটার একটা শেষপ্রান্ত নিশ্চই রয়েছে। আকাশের সূর্য, চন্দ্র ও তারাগুলো কোন একটি অদৃশ্য শক্তির নির্দেশে ক্রীতদাসের মত পৃথিবীকে পরিক্রমা করছে। সেই মানুষ সূর্য, পৃথিবী, দূরের নক্ষত্রমন্ডলী ইত্যাদি নিয়ে সম্ভব অসম্ভব কত কাহিনী কল্পনা করেছিল। সেগুলি প্রাচীন হিন্দু, মিশরীয়, গ্রীসীয় ও আসিরীয় পুরাণে আজও লিপিবদ্ধ রয়েছে। সেই কাহিনীগুলো খুব মজার কাহিনী।
প্রাচীন হিন্দুরা মনে করতেন যে, পৃথিবীর কেন্দ্রে পৃথিবীর ব্যাসের সমান উচ্চ একটি বিশাল পর্বত রয়েছে। সেই পর্বতের নাম হল — সুমেরু। সূর্যদেব তাঁর সপ্তাশ্ব রথে সুমেরুর চারপাশে নিয়ত পরিক্রমায় রত রয়েছেন। সূর্যদেব উত্তরে গেলে সুমেরুর ছায়া পড়ে দক্ষিণ দিক অন্ধকার হয়, আর তিনি ঘুরতে ঘুরতে দক্ষিণে গেলে সুমেরুর ছায়ায় উত্তর দিক অন্ধকার হয়।

🍂
ad

প্রাচীন গ্রীকরা মনে করতেন যে, গ্রীকদেশই হচ্ছে পৃথিবীর কেন্দ্র। আটলান্টিক মহাসাগরের অসীম জলরাশি পৃথিবীকে বেষ্টন করে রেখেছে। জুপিটারের আদেশে সূর্যদেবতা অ্যাপোলো তাঁর অশ্ববাহিত রথে চড়ে রোজই আকাশে চক্কর দিচ্ছেন। সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর পরে পরিশ্রান্ত সূর্যদেব আটলান্টিক মহাসাগরের শীতল জলে ডুব দিয়ে তাঁর দিনের ক্লান্তিকে দূর করেন।

একই বিষয়ে প্রাচীন মিশরবাসীদের কল্পনা একটু ভিন্ন ধরনের ছিল। তাঁরা মনে করতেন যে, পৃথিবী-দেবতা চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছেন এবং সূর্যদেবতা আকাশদেবীর পিঠের উপরে নৌকোয় চড়ে পূর্ব সমুদ্র থেকে পশ্চিম সমুদ্রে নিত্য ভ্রমণ করছেন। পশ্চিমে পৃথিবী-দেবতার মাথা রয়েছে। সূর্যদেবতা সেখানে পৌঁছলেই পৃথিবী-দেবতা তাঁকে নিজের হাত দিয়ে পূর্বাচলের শিখরে ঠেলে দেন। সেখানে খেয়া নৌকোয় পূর্ব সমুদ্র পার করে আবার তিনি আকাশদেবীর পিঠে নৌকোয় চেপে বসেন।

এমনি কত কষ্ট-কল্পনা সেকালের মানুষেরা করেছিলেন। হয়ত তখনও এসব বিষয় নিয়ে যুক্তিবাদী মানুষের মনে অবিশ্বাসের দোলা লাগত, কিন্তু এসব বিশ্বাস করে নেওয়া ছাড়া সেযুগে তাঁদের অন্য কোন উপায়ও ছিল না।

বর্তমান পোল্যান্ডের বিখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস মানুষের এইসব কল্পনার মূলে প্রথম কুঠারাঘাত করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে, অতদূর থেকে সূর্য, চন্দ্র ও তারাগুলো প্রত্যেকদিন একবার করে যে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে বেড়ায় — এটা যে নিতান্তই অসম্ভব ব্যাপার। বরং পৃথিবীর পক্ষে নিজের মেরুদণ্ডের উপরে দৈনিক একবার করে পাক খাওয়াটাই তাঁর কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল। তিনি ধারণা করেছিলেন যে, সূর্য ও তারাগুলো নিজেদের জায়গায় স্থির রয়েছে এবং পৃথিবীই একটা লাট্টুর মত পাক খাচ্ছে। তাই আকাশের জ্যোতিষ্কগুলোকে ঘুরতে দেখা যায়। কিন্তু তিনি তাঁর এই সিদ্ধান্তকে দীর্ঘকাল যাবৎ গোপন রেখে নিজের মৃত্যুর আগে স্বরচিত একটি পুস্তকে প্রকাশ করে গিয়েছিলেন। গোপন করবার কারণ ছিল যে, সেই সময়ে পুরোহিতেরাই দেশের সর্বেসর্বা ছিলেন। কোপার্নিকাসের মতবাদ সত্যি বলে প্রমাণিত হলে সেযুগের মানুষ আর দেবতাদের স্বীকার করতেন না এবং তাতে পুরোহিতরা তাঁর উপরে অসন্তুষ্ট হতেন। তাই নিজের জীবদ্দশায় পুরোহিতদের বিষনজরে পড়ে কোপার্নিকাস তাঁর নিজের জীবনকে বিপন্ন করতে রাজী হননি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল যে, তাঁর মতবাদটি প্রকাশিত হওয়ার পরেও সেকালের জনসাধারণ সেটার উপরে কোন ধরণের গুরুত্ব আরোপ করেননি। উল্টে টাইকোব্রাহে প্রমুখ কয়েকজন জ্যোতির্বিদ প্রবল আপত্তি তুলে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন যে, কোপার্নিকাসের মতবাদ যদি অভ্রান্ত হয় — তাহলে উর্ধ্ব থেকে পতিত লৌহখণ্ডকে পশ্চিম দিকে পড়তে দেখা যায় না কেন ?

এরপরে আরও কিছুকাল কেটে গিয়েছিল এবং পৃথিবীর মানুষ একরকমভাবে কোপার্নিকাসের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেই হঠাৎ একদিন পৃথিবীর এককোণ থেকে একজন আধপাগলা গোছের মানুষ বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন — সূর্য ঘোরে না, ঘোরে পৃথিবী। সেই ঘোষণার ফলে পৃথিবীর মানুষ তখন হতভম্ব হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলেন। সেটা ছিল ইংরেজি ১৬৩২ সাল — এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। সেবারেও মানুষ তাঁর কথা মেনে নেননি, তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের তুমুল ঝড় উঠেছিল। দাবি করা হয়েছিল — গ্যালিলিও ধর্মবিরোধী কথা বলেছেন, তাই তাঁকে শাস্তি দিতেই হবে; নইলে পৃথিবীর উপরে দেবতাদের রেষাগ্নি নেমে আসবে। কিন্তু গ্যালিলিও নিজের তৈরী দূরবীণটি চোখে লাগিয়ে দূরের গ্রহদের গতিবিধি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাই তিনি নির্ভয়ে জানিয়েছিলেন যে, তিনি কোন ভুল করেন নি। এরপরে সেযুগের মানুষ তাঁকে আর সহজে নিষ্কৃতি দিতে রাজি হননি। তাঁরা নিজেদের অভিযোগ নিয়ে রাজদ্বারে গিয়েছিলেন। তাঁদের অভিযোগ শুনে ক্রুদ্ধ রাজা সেদিন গ্যালিলিওকে কারারুদ্ধ করে বলেছিলেন যে, ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে তাঁর প্রাণদণ্ড হবে; তবে তিনি যদি তাঁর ধারণাকে ভ্রান্ত বলে স্বীকার করে নেন — তাহলে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হবে। সেদিন প্রাণের ভয়ে গ্যালিলিও শেষপর্যন্ত স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে — পৃথিবী ঘোরে না, ঘোরে সূর্য!

এরপরে আরও বহু বছর কেটে গিয়েছিল। তখন পৃথিবীর মানুষ আবার নতুন করে কোপার্নিকাস ও গ্যালিলিওর কথা ভাবতে শুরু করেছিল। শেষে খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহাবিজ্ঞানী নিউটন মহাকর্ষশক্তি এবং সেটার নিয়ম কানুন আবিষ্কার করেছিলেন। অবশেষে সব বিতর্কের অবসান ঘটেছিল; এবং সেই সাথে পৃথিবীর মানুষও গ্যালিলিও এবং কোপার্নিকাসের কথাকে অভ্রান্ত বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল যে, কোপার্নিকাসের কয়েক হাজার বছর আগে একজন ভারতীয় জ্যোতিষী একই তথ্য পরিবেশন করে বলেছিলেন —

“ চলা পৃথ্বি স্থিরাভিমি। ”

মানুষ সাধারণতঃ আকাশের নক্ষত্রগুলোকে পরিভ্রমণরত অবস্থায় দেখতে পায়। সে সম্বন্ধে তিনি একটি সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন যে, পূর্বদিকে গতিযুক্ত নৌকারূঢ় ব্যক্তি নদীর উভয় পার্শ্বস্থ বৃক্ষসমূহকে পশ্চিমদিকে যেতে দেখেন —

“অনুলোম গতি নৌস্থ' পশ্যত্য চলং বিলোমগং যদবৎ।
অচলানি ভানি তদবৎ সম পশ্চিম গানি লঙ্কায়াম॥”

সেই জ্যোতিষীর নাম ছিল — আর্যভট্ট। কোপার্নিকাসের সময়কার টাইকোব্রাহের মত বহু প্রাচীন হিন্দু জ্যোতির্বিদও সেদিন আর্যভট্টের মতামত নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। বরাহমিহির — যিনি আর্যভট্টের প্রায় সমসাময়িক ছিলেন, তিনি তাঁর ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’ গ্রন্থে প্রশ্ন করেছিলেন যে — পৃথিবী যদি আবর্তন করে তাহলে উড়ন্ত পাখীরা নিজের কুলায় কি করে ফিরে যায়? আর্যভট্টের শিষ্য লল্লও সেদিন তাঁর গুরুর মতামত নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। এরপরে খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞ ব্রহ্মগুপ্তও আর্যভট্টের কথা মেনে নিতে পারেননি। এমনকি খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ গণিতাচার্য ও জ্যোতিবিদ ভাস্করাচার্যও আর্যভট্টের মতামতের উপরে কোন গুরুত্ব আরোপ করেন নি। তাই মনে হয় যে, সেযুগের কোন ব্যক্তিই পৃথিবীর আবর্তনের কথা বিশ্বাস করতেন না।

আর্যভট্টের কাছে কোন যন্ত্র ছিল না। তবুও তিনি ধরতে পেরেছিলেন যে, গোলাকার পৃথিবী তার নিজের মেরুদণ্ডের উপরে পাক খেতে খেতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। চন্দ্রও যে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে — সেকথাও তাঁর অজানা ছিল না। সেই কারণে তিনিই সর্বপ্রথম সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন। অবশ্য আর্যভট্টের বহু আগে থেকেই প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতিষীরা এবং পাশ্চাত্যের বহু দেশের মানুষেরা গ্রহণের কারণ সম্পর্কে অবগত ছিলেন। এমনকি আর্কিমিডিসের আগেও পাশ্চাত্য দেশের বিজ্ঞানীরা হিসেব করে আগে থেকেই হিসেবে করে গ্রহণের সময় বলে দিতে পারতেন। কিন্তু গ্রহণের সঠিক ব্যাখ্যা — আর্যভট্টের আগে পৃথিবীর অন্য কোন বিজ্ঞানী দিতে পেরেছিলেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায় না। তিনিই প্রথম গ্রহণের কারণ হিসেবে পৃথিবী ও চাঁদের ছায়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন। চাঁদের যে নিজস্ব কোন আলো নেই এবং সেটি যে সূর্যের আলোয় আলোকিত হয় — একথাও তাঁর জানা ছিল।

পৃথিবী ও চন্দ্রের কক্ষতলের মধ্যে প্রায় পাঁচ ডিগ্রি কৌণিক ব্যবধান রয়েছে। উভয় কক্ষতল দুটি জায়গায় ছেদ করেছে। সেই ছেদবিন্দু দুটির মধ্যে একটির নাম হল — রাহু, এবং অপরটির নাম হল — কেতু। রাহু হচ্ছে উচ্চপাত বিন্দু এবং কেতু হচ্ছে নিম্নপাত বিন্দু। এই দুই বিন্দুর যে কোন একটিতে চন্দ্র পূর্ণিমায় থাকলে চন্দ্রগ্রহণ হবে, আর অমাবস্যায় থাকলে সূর্যগ্রহণ হবে। মোটামুটিভাবে গ্রহণের এই ব্যাখ্যাটিকে আজও সবাই স্বীকার করেন। আর্যভট্টের ধারণাও অনেকটা এই ধরণের ছিল।
ভারতীয় জ্যোতিষে রাহু ও কেতুর কল্পনা বহু প্রাচীন। সেখানে তাঁদের দৈত্যরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে দেখা যায়। তবে তাঁদের সাথে গ্রহণের সম্পর্ক যে অতি নিবিড় — সমুদ্রমন্থন নিয়ে প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনীটি থেকে সেকথা উপলব্ধি করতে কষ্ট হয় না। সেই কাহিনীটি সম্পর্কে সকলেই অবগত রয়েছেন বলে এখানে সেটার পুনরাবৃত্তি করবার কোন প্রয়োজন নেই। প্রাচীন পুরাণের সেই গল্পটি একটু অন্যভাবে রামায়ণ ও মহাভারতে বর্ণনা করা হয়েছিল। তবে প্রচলিত সেই গল্পটি যে আসলে রূপকমাত্র — সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এথেকে মনে হয় যে, বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় জ্যোতির্বিদরা গ্রহণের তথ্যাবলী সম্পর্কে অবগত ছিলেন। কিন্তু এখন সেই প্রকৃত তথ্য উদ্ধার করা আর সম্ভব নয়। 

তবে এমনও হতে পারে যে, গল্পটি পরবর্তীকালের একটা সংযোজনমাত্র ছিল। কেননা রামায়ণে সমুদ্রমন্থনের কথা থাকলেও সেখানে রাহুর কথা কিন্তু পাওয়া যায় না। বর্তমানে প্রায় সকলেই জানেন যে, গুপ্তযুগের ভারতে বহু প্রাচীন শাস্ত্র, পুরাণ ও উপপুরাণগুলি পুনর্লিখিত হয়েছিল। আর্যভট্টের আবির্ভাবকালও ছিল গুপ্তযুগ। হয়ত তাঁরই আবিষ্কারের উপরে ভিত্তি করে সেই গল্পের পরের অংশটি — অর্থাৎ, অমৃত নিয়ে দেবাসুর বিবাদ ও সেথেকে রাহু-কেতুর সৃষ্টি — রচনা করা হয়েছিল। অনেকের মতেই প্রাচীন ভারতীয় পুরাণ-উপপুরাণগুলোর বহু কাহিনীর অন্তরালে অনেক ঐতিহাসিক তথ্য ও আবিষ্কারের কাহিনী লুকিয়ে রয়েছে।

আর্যভট্ট সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত যা জানা গিয়েছে সেটা হল যে — বর্তমান সময় থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে গুপ্তযুগের ইতিহাস প্রসিদ্ধ পাটলিপুত্রের অনতিদূরে অবস্থিত কুসুমপুরে তাঁর জন্ম হয়েছিল। অনেকে আবার মনে করেন যে, তাঁর জন্মস্থান ছিল কেরলা, তবে তিনি কুসুমপুরে বাস করতেন। নিজের গ্রন্থের একটি শ্লোকে তিনি নিজেই লিখেছিলেন যে, কলিযুগের ৩৬০০ বর্ষে তাঁর বয়ঃক্রম ছিল তেইশ বছর। সেই সূত্র ধরে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে, ৩৯৮ শকাব্দ বা ৪৭৬ খৃষ্টাব্দ তাঁর জন্মকাল ছিল। যদিও নিজের লেখার সব জায়গাতেই তিনি কল্যব্দ ব্যবহার করেছিলেন, কোথাও শকাব্দ ব্যবহার করেন নি।
আর্যভট্ট তাঁর মৌলিক গবেষণার বিষয়গুলোকে আনুমানিক ৪৯৯ খৃষ্টাব্দে ‘আর্যভটীয়’ নামের একটা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সেটি বিস্তৃত কোন রচনা নয়, সেটি একটি সংক্ষিপ্ত ও সিদ্ধান্তমূলক গ্রন্থ। ‘আর্যভটীয়’ নামক গ্রন্থটি চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত। সমগ্র গ্রন্থটি প্রাচীন ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার এক অমূল্য সৃষ্টি। গ্রন্থটিতে মোট ১২১টি শ্লোক রয়েছে। গ্রন্থটির অধ্যায়গুলির নাম হল — কালক্রিয়া, গণিতপাদ, দশগীতিকা ও গোলপাদ। গণিতপাদে বিশুদ্ধ গণিত এবং অন্যান্য সমস্ত পাদে শুধুমাত্র জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ইতিহাস বলে যে, আর্যভট্টের সুখ্যাতি শুধুমাত্র ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, তৎকালীন ভারতের বাইরের প্রত্যেকটি সভ্যদেশেও তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রাচীন গ্রীকদের কাছে তিনি — ‘অর্দুবেরিয়স’, এবং আরবীয়দের কাছে – ‘আর্জভর’ — নামে পরিচিত ছিলেন। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক, জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞ অলবেরুনী বারবার তাঁর লেখায় — ‘কুসুমপুরের আর্যভট্ট’—কে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন বলে দেখা যায়। তখন দেশ-বিদেশে আর্যভট্টের সুনাম এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে, পরবর্তীকালে আরও কেউ কেউ আর্যভট্ট ছদ্মনামে জ্যোতিষশাস্ত্রের গ্রন্থ লিখেছিলেন। ইতিহাসে তাই একাধিক আর্যভট্টের পরিচয় পাওয়া যায়। সেই কারণেই কুসুমপুরের মহাজ্যোতিষী আর্যভট্টকে অনেকে — প্রথম আর্যভট্ট — বলে অভিহিত করে থাকেন।

জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানের মধ্যে — পৃথিরীর আহ্নিকগতির ব্যাখ্যা, বিশেষ কয়েকটি গ্রহের গতিবিধি, গ্রহণের কারণ ও পৃথিবীর গোলত্বের প্রমাণ — বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গ্রহের গতিপথ নির্দেশ করতে গিয়ে তিনি পরাবৃত্ততত্ত্বের কথা উল্লেখ করেছিলেন। বৃত্তের পরিধির সঙ্গে ব্যাসের সম্পর্ক নির্ণয় করাকে — গণিতে তাঁর সবথেকে বড় কীর্তি বলে মনে করা হয়। বৃত্ত — তা সেটা যত বড় কিংবা ছোট হোক, পরিধির পরিমাপকে ব্যাসের পরিমাপ দিয়ে ভাগ করলে প্রত্যেক ক্ষেত্রে একটা স্থির সংখ্যা পাওয়া যাবে। যেটার সাংখ্যমান হল ২২/৭ বা ৩.১৪২৮৫৭ (প্রায়)। 

বিখ্যাত আর্য গণিতবিদ, পদার্থবিদ এবং জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট ( ৪৭৬–৫৫০ খ্রিস্টাব্দ ) প্রথম বারের মত নিখুঁতভাবে পাই ( π) এর গাণিতিক মান প্রকাশ করেন এবং যিনি প্রথমবারের মত এটিও আবিস্কার করেছিলেন যে পাই এর মান নির্দিষ্ট নয় বরং এটি একটি অমূলদ তথা আসন্ন সংখ্যা।তার বিখ্যাত গ্রন্থ আর্যভাটিয়া এর দ্বিতীয় অধ্যয় গণিতপাদ এর দশ নং শ্লোক এ তিনি ৪৯৯ খ্রিষ্টাব্দে লিখেছিলেন ----

চতুরাধিকং শতম্ অষ্টগুনম্ দ্বষষ্টিস্তথা সহস্রাণাম্।
আয়ুতদ্বযবিস্কম্ভস্ব আসন্নো বৃত্তপরিণাহ।।

(আর্যভাটিয়া ২।১০)  

অর্থাৎ চতুরাধিকং শতম মানে যদি ১০০ এর ৪ বেশীকে(১০০+৪=১০৪) অষ্টগুনম বা ৮ গুন করে তাকে দ্ব ষষ্টি বা ৬২ এর সহস্রাণাম বা ১০০০ গুন = ৬২০০০ এর সাথে যোগ করা হয় তাহলে আয়ুতদ্ব বা ১০০০০ এর ২ গুন তথা ২০০০০ একক ব্যাস বিশিষ্ট বৃত্তের পরিধি পাওয়া যাবে।

এখানে বৃত্তের পরিধি হল (১০৪*৮+৬২০০০)এবং ব্যাস হল ২০০০০।

আমরা জানি π=পরিধি/ব্যাস ।
তাহলে এখানে পাই এর মান পাই -

(১০৪*৮+৬২০০০)/২০০০০=
৬২৮৩২/২০০০০

অর্থাৎ ৩.১৪১৬   !!!

এবং তিনি বলেও দিয়েছেন এই মান "আসন্নো" মানে এটি ।আসন্ন অর্থাৎ দশমিক এর পরে চলতেই থাকবে,এখানেই শেষ নয়।এমন একটি সংখ্যা — যেটিকে সেই আর্কিমিডিসের আমল থেকে এখনও পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ণয় করবার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

এছাড়াও, আর্যভট্ট ধ্বনিসংক্রান্ত সংখ্যার স্বরলিপির একটি সিস্টেম তৈরি করেছিলেন যেখানে সংখ্যাগুলিকে ব্যঞ্জনবর্ণ-স্বরবর্ণের মনোসিলেবল দ্বারা উপস্থাপন করা হয়েছিল। পরবর্তী ভাষ্যকার যেমন ব্রহ্মগুপ্ত তার কাজকে গণিতা ("গণিত"), কালক্রিয়া ("সময়ের গণনা") এবং গোলাপদা ("গোলাকার জ্যোতির্বিদ্যা") এ ভাগ করেছেন । তাঁর বিশুদ্ধ গণিত আলোচনা করে যেমন বর্গ এবং ঘনমূলের নির্ণয় , জ্যামিতিক পরিসংখ্যানগুলি তাদের বৈশিষ্ট্য এবং পরিমাপ সহ , গনোমনের ছায়ায় গাণিতিক অগ্রগতি সমস্যা , দ্বিঘাত সমীকরণ , রৈখিক এবং অনির্ধারিত সমীকরণ।আর্যভট্টের সাইন টেবিল এবং ত্রিকোণমিতির উপর তার কাজ ইসলামের স্বর্ণযুগে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল ।তার কাজগুলো আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং আল-খোয়ারিজমি এবং আল-জারকালিকে প্রভাবিত করেছে। তার গোলাকার জ্যোতির্বিদ্যায়, তিনি গোলাকার জ্যামিতিতে সমতল ত্রিকোণমিতি প্রয়োগ করেন এবং সৌর, চন্দ্রগ্রহণের হিসাব দেন। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে নক্ষত্রের আপাত পশ্চিমমুখী গতি গোলাকার পৃথিবীর তার নিজের অক্ষের আবর্তনের কারণে । আর্যভট্ট আরও উল্লেখ করেছেন যে চাঁদ এবং অন্যান্য গ্রহের উজ্জ্বলতা প্রতিফলিত সূর্যালোকের কারণে।

আর্যভট্টীয় বইটির গোলপাদ অংশে আর্যভট্ট উদাহরণের মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন যে পৃথিবী নিজ অক্ষের সাপেক্ষে ঘোরে। তিনি পৃথিবীর আক্ষিক গতির হিসাবও করেছিলেন। তার হিসেবে পৃথিবীর পরিধি ছিল ৩৯,৯৬৮ কিলোমিটার, যেটা সে সময় পর্যন্ত বের করা যেকোন পরিমাপের চেয়ে শুদ্ধতর (ভুল মাত্র ০.২%)। সৌর জগৎে গ্রহগুলোর কক্ষপথের আকৃতি তার ভাষ্যে ছিল উপবৃত্তাকৃতির, এক বছর সময়কালের প্রায় সঠিক একটি পরিমাপ করেছিলেন, সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণের সঠিক কারণ উল্লেখ করা এবং তার সময় নির্ধারণ করা।

প্রাচীন ভারতীয় গণিতের ইতিহাসে আর্যভট্টের হাত ধরেই ক্লাসিকাল যুগ (কিংবা স্বর্ণযুগ) শুরু হয়। গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত আর্যভট্টের বিভিন্ন কাজ মূলত দুটি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মাঝে ‘আর্যভট্টীয়’ একটি, যেটি উদ্ধার করা গিয়েছে। এটি রচিত চার খণ্ডে, মোট ১১৮টি স্তোত্রে। অন্য যে কাজটি সম্পর্কে জানা যায় সেটি হল ‘আর্য-সিদ্ধান্ত’। আর্য-সিদ্ধান্তের কোন পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া যায়নি, তবে বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত এবং প্রথম ভাস্করের কাজে এটির উল্লেখ মেলে।

আর্যভট্টের কাজের অধিকাংশই তিনি করেছিলেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেই তিনি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। শিক্ষাশেষে তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। কেউ কেউ বলেছেন, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসেবেও আর্যভট্ট দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

আর্যভট্টই প্রথম গণিতজ্ঞ ছিলেন, যিনি পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতের সাংখ্যমান চার দশমিক স্থান পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গণিতশাস্ত্রে তাঁর দ্বিতীয় অবদান হল ত্রিকোণমিতির ব্যবহার। এছাড়া বীজগণিত চর্চার সূত্রপাতও তাঁরই হাত ধরেই ঘটেছিল। প্রচূর্ণক বিষয়ে তিনিই প্রথম গাণিতিক ধারণাকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ গ্রীক বীজগণিতবেত্তাদের তুলনায় তিনি অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। আধুনিক গণিতের মূল উপাদানগুলি, যেমন — বর্গমূল ও ঘনমূল নির্ণয়, দ্বিঘাত সমীকরণ সমাধান, সমান্তর শ্রেণীর যোগফল নির্ণয় — প্রভৃতি আর্যভট্টেরই ঐতিহাসিক অবদান। গণিতে তাঁর মৌলিক আবিষ্কারগুলি পরবর্তীকালের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুবাদের মাধ্যমে বিদেশী গণিতজ্ঞদের হাতে পড়ে নব কলেবর প্রাপ্ত হয়েছিল। আর্যভট্ট ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের একটি পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছিলেন বলে জানা যায়।

আধুনিক কালে ভারতে যে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৮৫৭ সালে, সেটা বড় কথা নয়।ভারতবর্ষের শেষ আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়, নালন্দাবিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয়েছিল ১১৯৩ সালে ইখতিয়ারউদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজি  দ্বারা।নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগেও ভারতবর্ষে আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিলো তা নিশ্চয়ই আপনারা জানেন।এটা বড়ো কথা নয় ভারতবাসীর জন্য।

নালন্দা কে আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ের লিখছি কারণ ভারতীয় ছাড়াও তিব্বত, চীন, কোরিয়া ও মধ্য এশিয়ার পণ্ডিত ও ছাত্ররা এখানে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করতে আসতেন।এটা বড়ো কথা নয় ভারতবাসীর জন্য।

প্রাচীন ভারতবর্ষের শিক্ষার উৎকর্ষ তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশিলা প্রভৃতি বৃহদায়তন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলির স্থাপনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।এটাও বড়ো কথা নয় ভারতবাসীর জন্য।

১১৯৩ সাল থেকে শুরু করে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত, এই দীর্ঘ ৬৬৪ বছর ধরে ভারতবর্ষে  কোন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে নি।শিক্ষাই একমাত্র একটা দেশের উন্নতির মাপকাঠি ঠিক করে দেয়।এটা বড়ো কথা নয় ভারতবাসীর জন্য।এই দীর্ঘ সময়ে কোন কোন রাজা প্রজাদের পড়াশুনার খাতে কতো টাকা ব্যয় করেছেন তা কি লেখা আছে আমাদের স্কুলের ইতিহাসের বইতে? প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় গুপ্ত শাসক কুমারগুপ্ত দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।পরবর্তীকালে কনৌজের সম্রাট হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতায় চলে।পাল রাজবংশ ছাড়াও ইন্দোনেশিয়ার শৈলেন্দ্র রাজবংশও এই মহাবিহারের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।এটা বড়ো কথা নয় ভারতবাসীর জন্য।

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল এটাই যে এই দীর্ঘ সময় কোন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় না থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের কিছু ঐতিহাসিকদের মতে ভারতবর্ষের ইতিহাসের সবচেয়ে মহান ও স্বর্ণখোচিত সময় এইটা । এটাই ভারতবাসীর জন্য সবচেয়ে বড়ো কথা ।

গণিতকে বিজ্ঞানের রাণী বলা হয়, আর সেই গণিত — প্রাচীন ভারতবর্ষের আর্যভট্ট প্রমুখ গণিতজ্ঞের দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছিল। ১৮৭৪ খৃষ্টাব্দে গ্রন্থ আর্যভট্যিয় এর একটি অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। আধুনিক ভারতবর্ষের একটি কৃত্রিম উপগ্রহের নামকরণও তাঁর নামে করা হয়েছিল। তবে আর্যভট্টের বহু লেখা এখনও গবেষকদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে গিয়েছে। তাঁকে নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে ।।

Post a Comment

0 Comments