জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে(ষষ্ঠ পর্ব)/মলয় সরকার

বলিভার প্লাজায় বলিভারের মূর্তির সামনে সন্ধ্যায় নাচ গানের আসর

মার্কেজের খোঁজে
(ষষ্ঠ পর্ব)

মলয় সরকার


এই যে প্যালেঙ্কেরো মেয়েরা ,এখানে এই চলমান সভ্যতার সাথে তাল মিলিয়ে চলা এক জীবন্ত প্রতিবাদ 

অথচ তাদের সদম্ভ উপস্থিতি সভ্য সমাজের কাছে অনেক কিছু তুলে ধরে বৈ কি!

এদের বড় তীক্ষ্ণ ভাবে চোখে পড়ে কারণ, এদের গায়ের রঙ, যা চারিদিকের সাদা চামড়ার পাশে নিছক বেমানান বা বৈপরীত্য ঘোষণা করে।এ ছাড়া এদের স্বর্গীয় নিষ্পাপ সরল হাসি , যা আর সবায়ের মাঝে একান্তই দুর্লভ।আর এদের গাঢ় ঊজ্বল ঘাগরা দোলানো পোষাক মানুষকে এদের দিকে আকর্ষিত করবেই।

এবার বলি এদের কথা।

আগেই বলেছি স্পেনীয়রা এদেশে এসে কলম্বিয়ার কার্তাহেনাকে ব্যবহার করত পশ্চিম আফ্রিকা থেকে দাস ধরে এনে ক্রীতদাস ব্যবসার কেন্দ্র হিসাবে। প্রথমে তারা স্থানীয় কলম্বিয়ার আদি অধিবাসীদের ধরে দাস হিসাবে বিক্রী করত। পরে তারা আফ্রিকার কালো মানুষদের এনে এই ব্যবসা চালাত।এই দাসদের তারা বিক্রী করত মধ্য, পশ্চিম আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে।

আসলে আমি বুঝতে পারি না কাদের আমরা সভ্য বলব আর কাদের অসভ্য বলব। যারা পৃথিবীর বিবর্তনের ফলে স্বাভাবিক ভাবে বিদ্যা বুদ্ধিতে অন্যদের থেকে এগিয়ে গেছে, এবং ফলে পিছিয়ে থাকা স্বজাতীয়দের উপর অত্যাচার করছে,তারা সভ্য, না কি, যারা  নিজেদের সারল্যকে আঁকড়ে ধরে যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না,  তারা!
দেয়ালঘেরা শহরের বাইরে সমুদ্রতীরে সূর্যাস্ত

প্রায় ৪০০ বছর আগে একদিন এই দাসেরা বিদ্রোহ করে ভেঙে ফেলল তাদের বেড়ি, ছিঁড়ে ফেলল তাদের শৃঙ্খল। যদিও ব্যাপারটা সহজ ছিল না। কিন্তু আমি সে ইতিহাসে যাচ্ছি না। তারা এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে জঙ্গলে তাদের নিজস্ব বাসস্থান, তাদের গোষ্ঠী, সংস্কৃতি নিয়ে নিজস্ব স্বতন্ত্র সমাজ গড়ে তুলল।এদের অনেককেই আবার ধরে নিয়ে গেল স্পেনীয়রা, ভেঙে ফেলল তাদের ঘরবাড়ী।চলল অত্যাচার। কিন্তু এত সত্বেও তাদের থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে রেখেছিল এক দৃঢ়চেতা সমাজ, তার নাম San Basilio de Palenque।
কার্তাহেনা থেকে দক্ষিণ পূর্বদিকে  মাত্র ত্রিশ মাইল দূরে মন্তেস দ্য মারিয়া (Montes de Maria) পাহাড়ের কোলে ১৭১৩ সালে প্রথম একটা স্বাধীন সমাজ তৈরী হয়।এখানে তারা বহু কষ্টে বাঁচিয়ে রেখেছিল তাদের আদি আফ্রিকান সমাজের সংস্কৃতি ও রীতিনীতি।যদিও অন্যান্যরা নানা ভাবে তাদের রক্তের মিশ্রণ ঘটিয়ে নিজেদের স্বাধীন সত্বা হারিয়ে ফেলেছিল, এরা কিন্তু, শুধু তাদের সংস্কৃতি বা ধারা নয়, তাদের ভাষাকেও বাঁচিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। সেই ভাষার নাম প্যালেঙ্কে (Palenque) ।

🍂
ad

এবার, শুধু স্বাধীন হলেই তো হবে না,পেটের তাগিদটাও তো আছে এবং সেটাই প্রধান হয়ে দেখা দিল। তাই তারা আর কিছু না পেয়ে জঙ্গল থেকে তাদের উৎপন্ন করা তাজা ফল এনে কার্তাহেনার বাজারে জিনিসপত্রের বিনিময়ে বিক্রী করত।

ক্রমে এই ব্যবসাই তাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেল।ইতিহাস ঠিক সঠিক ভাবে বলে না,যে, কবে থেকে তারা ফলবিক্রেতা হয়ে উঠল। কিন্তু তারা, বিশেষ করে মহিলারা ধীরে ধীরে একদিন শহরের ঊজ্বল রঙীন আকর্ষণীয় ‘আইকন’ হয়ে উঠল।দেশের পতাকার রংকে তারা নিজেদের গায়ে জড়িয়ে রঙীন আর আকর্ষণীয় হয়ে উঠল।
অনেকে বলেন এক বান্টু ভাষাভাষী রাজা এই সমাজের সাহায্যে ছিলেন। যাই হোক, সব মিলে মিশে তাদের যে ভাষা তাকে ‘প্যালেঙ্কেরো’ ভাষা বলে।  আর তাদের নাচ গানের ছাপ পড়েছে আজকের কার্তাহেনার জীবন যাত্রাতেও। তাদের সেই গ্রাম আজ ইউনেস্কো স্বীকৃতি পাওয়া এক মূল্যবান সংস্কৃতি কেন্দ্র।
এই প্যালেঙ্কে মহিলা ফলবিক্রেতাদের কার্তাহেনার প্রায় সমস্ত প্লাজা বা চার্চের সামনে দেখা যায় রঙীন সুন্দর ফলের গামলা মাথায় দিয়ে। সারাদিন ওরা অদ্ভুত ব্যালেন্সের সঙ্গে এটি মাথায় নিয়ে ঘোরে এবং সমস্ত কাজ করে।

এবার ফিরে আসি আমার কলম্বিয়া সফরে প্রথমে কার্তাহেনা আসার কারণ বিশ্লেষণে ।
নোবেল পুরস্কারে ভূষিত বিখ্যাত সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, তাঁর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চিত্র পরিচালক Salvatore Basile কে বলেন, “I would say that I completed my education as a writer in Cartagena.”।  এছাড়া Love in The Time of Cholera র ভিতও এখানেই তৈরী হয়েছিল। তিনি তরুণ বয়সেই  এখানে অনেক দিন কাটিয়েছেন। এখানে তিনি একটি winter house তৈরী করেছেন। এখানে বলিভার প্লাজা ও অন্যান্য প্লাজায় ঘুরেছেন, সময় কাটিয়েছেন,পার্কের বেঞ্চে কত সময় শুয়ে শুয়ে গল্পের চরিত্রদের কথা ভেবেছেন, বসেছেন , লক্ষ্য করেছেন বিভিন্ন ঘটনা, যা তাঁর সাহিত্যকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেছে।যে শহরে, কার্তাহেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ( এখানে তিনি অল্পদিন পাঠও নিয়েছেন) লা মার্সেদ মনাস্ট্রীতে তাঁর শেষ বিশ্রামস্থল, সেই  ‘গ্যাবো’ র স্মৃতিধন্য শহর বলে চিহ্নিত এই কার্তাহেনাকেই বেছে নেওয়া আমার সফর শুরুর প্রথম পর্বে।

এর বৈচিত্র্য, এর আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য্য, মানুষের চলমান জীবনে যে প্রাণের প্রবহমানতা, তাদের সুখ দুঃখ হাসি কান্না, তাদের গর্ব, তাদের ঐতিহ্য, যা মার্কেজকে অনুপ্রাণিত করেছে , তাঁর সাহিত্য রচনায়, তাকে খুঁজতেই আমার এই যাত্রা।জানি না কতটা অনুধাবন করতে পারব।
বলিভার প্লাজায় দিনের বেলা, মার্কেজের আড্ডার জায়গা

এখানে যে প্লাজাটি দেখলাম, সেটি প্রায় সাড়ে বত্রিশ ভাজার আর এক সংস্করণ। সব বিক্রী হচ্ছে, লোকেরা মজা করে আড্ডা মারছে, খাচ্ছে , গান করছে। আর তার মাঝে ঘুরছে সেই রঙীন পরীরা তাদের মুখের অনাবিল নির্মল হাসি ছড়িয়ে একেবারে প্রজাপতির মত পাখনা মেলে। রাস্তায় চলেছে বড় বড় ঘোড়ার গাড়ি।এগুলো পর্যটকদের আনন্দ দেওয়ার জন্য।আমাদের ভিক্টোরিয়ার সামনে হাওয়া খাওয়া ঘোড়ার গাড়ির মত।এই সব প্লাজাগুলোই  আসলে সমস্ত শহরবাসীর সুখ দুঃখের সাথী,আনন্দ বিষাদ বন্ধুত্ব ইত্যাদির প্রকাশের প্রাণকেন্দ্র। তাই এই পার্কগুলোই ছিল তাঁর লক্ষ্য করার জায়গা। এখানেই ঘুরে বেড়াত তাঁর চরিত্ররা।

আসলে তিনি তো প্রধানতঃ ছিলেন সাংবাদিক। কাজেই সমস্ত ঘটনা, সমস্ত মনুষ্য চরিত্রের ভিতরের অন্তর্নিহিত অবস্থার বিশ্লেষণ ও অনুধাবনই ছিল তাঁর বিশেষত্ব।

আমি যত স্প্যানিশ ভাষাভাষী জায়গায় গিয়েছি , সব জায়গাতেই লক্ষ্য করেছি, ছোট বড় প্রত্যেক শহরে অবশ্যই থাকবে প্লাজা এবং তা–ও একটি নয় অনেকগুলি। শুধু তাই নয় সেগুলি সুসজ্জিত এবং প্রতিদিন তার যত্ন নেওয়া হয় ভালভাবেই। প্লাজায় থাকতে পারে ফোয়ারা, সুন্দর ফুলগাছের কেয়ারি বা ফুটন্ত ফুল, নানা মূর্তি , ভাস্কর্য, বসার ভাল এবং যথেষ্ট বেঞ্চ।আর স্প্যানিশরা যেহেতু গান বাজনা ভীষণই ভালবাসে, কাজেই বিকালের দিক থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে প্রায়ই ,হয়ত প্রতিদিনই চলে নাচ গান বাজনা ইত্যাদি।কিন্তু সাধারণ মানুষেরা কখনওই এই প্লাজার সৌন্দর্য্য নষ্ট তো করেই না, বরং তা রক্ষার চেষ্টা করে। এই প্লাজাগুলোই অবসর বিনোদন, নাচগানের ,ফুর্তির, খাওয়াদাওয়ার আড্ডা। বুঝি, তাই তিনি তাঁর চরিত্রদের খুঁজেছেন, এই সমস্ত প্লাজার আবহাওয়ায়।
ফল বিক্রেতা প্যালেঙ্কেরো মেয়ে

আমরা এখান থেকে এগোলাম। একটু এগিয়েই দেখি আর একটি বেশ সুন্দর প্লাজা। নাম Plaza de Bolivar। 

এই প্লাজাতে পা দিয়েই বুকটা ছাঁত করে উঠল।এই তো সেই প্লাজা , যেখানে সাহিত্যিক মার্কেজ জীবনের অনেক সময় এই পার্কের বেঞ্চিতে বসেছেন, এখানে হেঁটেছেন , শুয়ে শুয়ে মনের রেখাপটে বইয়ের চরিত্রদের , বিশেষ করে “নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ এর কল্পনার রূপ দিয়েছেন। এখানকার ধুলায়, নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর ছোঁয়া।চেষ্টা করি খুঁজে পেতে সব কিছু তাঁর মত করে ।তাঁর রচনায় তো ইতিহাসের সাথে ট্রাজেডি হাস্যরস, প্রেম, একাকীত্ব ইত্যাদি মিশে সাহিত্যের এক মাস্টারওয়ার্ক তৈরী হয়েছে।যাদুকরী বাস্তববাদে সিক্ত লেখাগুলি এমনই বিশ্বাসযোগ্যভাবে মিশে গিয়েছিল , যে আমরা নিশ্চিন্তভাবে সেই যাদুতে বিশ্বাসী হয়ে উঠি।

আমি তো ইতিহাসের পাতায় পাতায় পা দিয়ে বাস্তবের ছোঁয়া নিয়ে ঘুরে বেড়াই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। তাই যখনই কোন বিশেষ জায়গায় গিয়ে সেই জায়গার ইতিহাসকে স্মরণ করি, নিজেও তলিয়ে যাই সেই ইতিহাসের পটভূমিকায় আর আত্মস্থ করতে চেষ্টা করি, সেদিনের ঘটনাপঞ্জীর গুরুত্ব। উপস্থিত হই সেদিনের ইতিহাসের মুহুর্তটিতে। তাই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে কি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে পা দিলেই অনুভব করি সেই মহাপুরুষদের সান্নিধ্য। মনটা চলে যায় সেদিনের সেই চরম ক্ষণে।

ক্রমশঃ-
পথিকের তো পথ চলাই কাজ। আর সেই পথের দুধারে যা সঞ্চয় হল তাই সবায়ের কাছে বিলিয়ে দেওয়াতেই তার আনন্দ। পথিককে তো সঙ্গে কিছু রাখতে নেই। যা সঞ্চয় তাই বিলিয়ে দিয়ে শুধু পথকেই রাখতে হয় সঙ্গে।নইলে বোঝা হয়ে উঠবে ভারি, পথ চলা হবে দায়।চলুন নতুন পথে—

Post a Comment

0 Comments