জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন /পর্ব ৪৬/ মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া



ভাঙা আয়নার মন
 পর্ব ৪৬ 
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া


   |।  মটুক মাথায় দিয়া...| ||

           রিটায়ারমেন্টের পরপরই তাদের বাবার হার্টৈর সমস্যা দেখা দিল। বহুকাল নিয়ম মেনে ডায়েটিং, মর্নিং ওয়াক,হাই প্রেশারের ওষুধ রেগুলার চললেও
মাঝে মাঝে  বুকে ব্যাথা হচ্ছিল। কার্ডিওলজিস্ট ভবানীদা  ইকো, আ্যঞ্জিওর রিপোর্ট দেখে  ভুরু কুঁচকে বলল একটা ডিসিশন নেওয়ার সময় এসেছে।
             তাদের বাবা অবশ্য নিলো দুটো ডিসিশন।জুনে যদি ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হয় তবে এপ্রিলেই ঝিনির বিয়েটা সেরে ফেলা যাক।  চোদ্দোই এপ্রিল হলো পয়লা বৈশাখ নতুন বছরের শুরু,তায় আম্বেদকরের জন্মদিন ।এর চেয়ে শুভদিন আবার কী? আমি পলাশের সাথেও এই কথাই বলছি।
         আমরা সবেই হাউস স্টাফশিপ করছি বাপি। সমস্যা কী? বিয়ের পরেও তাইই করবে। 
        সমস্যা নেই তবে একটাই কথা,পলাশ বলল, আমাদের কোনো কিছু দিয়ে হেল্প করতে চাইবেন না। শূন্য থেকেই আমরা শুরু করতে চাই।
    ঝিনুক মা? হ্যাঁ বাপি। আমিও তাইই চাই। বাপি চুপ করে গেল। কিন্তু তার চোখে খুশির না অন্যকিছু ঝিকিয়ে উঠল যেন।
        ঘাবড়ানোর  আছে কী ?করবি তো একখানা সই,  
তা যা বিশ্রী হাতের লেখা কেউ পড়তেও পারবে না,ও তুই করেই ফেল,বাকিটা আমরা ম্যানেজ দিচ্ছি। দানি বললেও ঝিনির ভরসা হয় না মোটেও।তার জীবন, নিজের ওপর ছাড়া ভরসা করার জায়গা নেই, থাকার কথাও নয়। ভয় ভয় অস্বস্তিতে গা শিরশির  লাগে। মনের ভেতর  আরও একখানা মন বিনবিন করে এখন না,এখনই না। আরও খানিক সময় দরকার।
           তাদের বাড়ির বিয়েতে পুরোহিত ডাকা হয় না।মা বাবা  ওসব মানেও না। দু'বাড়ির আত্মীয় কুটুম আসে। রেজিস্ট্রার বাড়িতে এসে বড়দের সাক্ষী মেনে  সইসাবুদ করায়।মালা, সিঁদুর আর আংটি পরানো হয়। বড়রা আশীর্বাদ করে। বাবার কঠোর নিষেধ থাকে উপহার না আনার। তবু নিকট আত্মীয়রা কিছু না কিছু লুকিয়ে চুরিয়ে উপহার আনবেই।গান কবিতার স্টেজ হয় একখানা। সেখানে জম্পেশ আড্ডা দেয় সবাই।
       দানির বিয়ের কার্ডে শুভ বিবাহর জায়গায় লেখা ছিল মোহনার দিকে।পয়লা আষাঢ় বলে ছোড়দার বিয়ের নাম ছিল মেঘ বাসর আর ঝিনির বিয়ের কার্ডে লেখা হলো সুন্দরের ডাক। প্রচ্ছদ আঁকায় নামডাকওলা শমীকদা কার্ডে চমৎকার ছবি এঁকে দিলো।
         দাদাদের সাথে  ছোট বুলাদা,অহনাদি
চমৎকার ছবি এঁকে পোস্টারে ছড়া লিখে শান্ত ঝিকমিক আলো ফেলল ঘর দোরে। রজনীগন্ধার গোছা ছাড়াও মাটির কলসে কলসে আলপনা দিয়ে সোঁদাল আর কৃষ্ণচূড়ায় বাড়ি সাজালো।
     সব বিয়েবাড়িতেই নানান ঝঞ্ঝাট বাঁধে। ছোড়দা গানের স্টেজ নিয়েই থাকে আর দানি নার্ভাস হয়ে পড়ে বলে দাদাদের বিয়ের উটকো ঝামেলা 
কোমর বেঁধে সামলেছে সে। 

🍂
ad

            এবার সে চুপ করে বসে আছে আর সানা এসে এসে গুজগুজ করে তাকে শুনিয়ে যাচ্ছে  কোন বৌদি আবডালে ছেলেকে গরম মাছের পেটি জোর করে খাওয়াতে গিয়ে গলায় কাঁটা বাঁধিয়ে বসেছে।বরযাত্রীদের জন্য রাখা কোল্ড ড্রিংকস ফটাফট মেরে দিচ্ছে কেউ তো গয়নার আসল নকল নিয়ে ঝগড়া বেঁধেছে কাদের। পেট চেপে হাসে সানা।এতসব মজার ঘটনা শুনেও প্যাঁচা স্টাইলে বসে আছিস যে। বিয়ে বাড়ির এই দুশো মজা নিজের বিয়ের দিন জুৎ মতো এনজয় করা যায় না বুঝলি।
       এই যেমন খানিক আগেই বিলুদা বল্টুদার জুতো পরে চুল দাড়ি কেটে গরম জিলিপি খেয়ে হাটখোলা থেকে  ফিরল।  জুতো না পেয়ে বাপিকে বলতেও গেছিল বল্টুদা।সিলি ব্যাপারে নিয়ে কথা বলতে আসবি না বলে প্রবল ধমক খেয়ে সে লুচির মতোই ফুলছিল।জুতো যদি এতই দামি তো মাথায় নিয়ে ঘুরবি এবার থেকে বলে বিলুদা ওর নাকের ডগায় শিস দিতে দিতে ভিয়েনের দিকে চলে যাচ্ছে দেখে দুম করে ফেটে গেল বল্টুদা। রাঙা বউদি থামাতে গিয়ে বরের কাছে প্রকাণ্ড ধমক খেয়ে ছাদে উঠে বসল ।কাজেই  ছাদে উঠে হাঙ্গামা মেটাতে হলো তাকেই।
          এরম ছ্যাতরানো আলপনা কার হাতের কাজ?সিমেট্রিকাল হয়নি মোটেও বলে রাগমাগ করছিল ছোড়দা।কাজেই তুলি ধরে ফুলের ডাঁটিতে ফিনিশিং দিতে নামলে  মাগো মা কোথায় যাব গো!,অ পিসিমা অ জেঠাইমা!আজকালকার মেয়েগুনো লাজলজ্জার মাতা পুরো চিবিয়ে খেয়েছে গা! বিয়ের কনে কোথায় দুমড়ে মুচড়ে ঘরের এক কোনায় পড়ে থাকবে পুঁটলি পাকিয়ে তা না নিজের বিয়ের আলপনা কেমন নিজে দিচ্ছে দ্যাকো সে  বলে 
মহুল এসে  গামছা দিয়ে এক হাত ঘোমটা টেনে  কলাবৌ সেজে দাঁড়ালো।
           ক্যান রে ব্যাটা ইস্টুপিট,আলপনা তো তুইও পারিস।তা সকাল থেকে তোমায় বুকনি ছাড়া তো কুটো নেড়ে দুটো করতে দেকা যায়নি কো। আর বিয়ের কনে কি ভাঙা টিন নাকি যে দলামোচা হয়ে থাকবে বলেই গামছা সরিয়ে মহুলের কানে বিলুদার দুই পাক।
          পরদিন সকালে বাড়িতে হলুদ টলুদ মাখিয়ে নিজেরাও মেখে জাঠতুতো সোনা বৌদি
 রাঙা বৌদিরা এ ওর ঘাড়ে লুটিয়ে বাজে ইয়ার্কি দিচ্ছে। উলু দিয়ে সুধা মামী গান ধরল রাঙা পায়ে মাইয়া চলে মটুক মাথায় দিয়া... অমনিই সাদাকালো সিনেমার মায়াবী ফ্ল্যাশ ব্যাক তাকে বিষন্ন আর অস্থির করে তোলে।ফালতু হা হা হিহিতে  তার দিগদারি ধরে গেছ যখন,হন্তদন্ত দানি এসে সুকুমার সমগ্রটা কোথায় রে?বড় ঘরের আলমারিতে নয় তো পুবের ঘরের বড় বুক কেসে দ্যাখ।খুঁজে দিয়ে যা। কার্টুন ছবিগুলোর তলায় লিখতে হবে।এরা কী সব মাখাচ্ছে যে।আর মাখতে লাগবে না,চল।
        শুভ কাজে বাঁধা!ছোট পিসিমা তেড়ে এলো।কান ধরে বার করে দিচ্ছি পিসিমা!দিদি বৌদিরাও এককাট্টা।মেয়েদের ব্যারিকেডের ওপার থেকে অত্যন্ত বিরক্ত মুখে দানি চেঁচায়,ফুটফুটে জোছোনাতে টা বল দেখি, লিখে নিই।ঝিনিও ডিং মেরে উঁচু হয়ে মন্তর পড়ার মতো বলতে লাগলো "একা শুয়ে তেতালাতে খালি খালি খিদে কেন পায় রে..."।
         আর রাম ভজনের গিন্নিটা? ওটার পরে হলো বাপরে যেন সিংহীটা/বাসন মাজে ঝনাৎঝন/কাপড় কাচে দনাদ্দন...মা তার হাতে শাঁখা পলা পরাতে পরাতে বলল একটু সিরিয়াস হ বাপু। বিয়ের দিন একটু ভব্যি হয়ে থাক অন্তত।
          মা তো জানে না কাল রাতে ছোট খোকাদাকে ছাদে ডেকে নিয়ে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করেছে হাউস স্টাফশিপ শেষ হতে চলল।কোঠারি হসপিটালে সে আর পলাশ নন রেসিডেনসিয়াল মেডিকেল অফিসারের ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে। দুজনের সেই মাইনেতে কি সংসার চালানো যায়? পলাশ অবশ্য তিন চারটে নার্সিং হোমেও খেপ খাটে এখন থেকেই। স্যারকে আ্যসিস্ট করতে ঝিনিও যায় নার্সিং হোমে।কিন্তু  কলকাতায় কোনো ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে দুজনের সংসার চালাতে কত টাকা লাগে?এসব নিয়ে তার তো আইডিয়া নেই কোনোই। যদ্দুর জানে পলাশেরও নেই। তাছাড়া ও বড় বলে  ভাইবোনের লেখাপড়ার দায়িত্ব তো পলাশকেই নিতে হবে।এসব কথা তো কাউকে বলাই হয়নি।
         গড়গড়িয়ে চলবে।হ্যাঁ রে ঝিনি তুই তো এত হাবলা টাইপ ছিলি না।সংসার চালাতে টাকাকড়ি লাগে এসব উদ্ভট চিন্তা তোর মাথায় ঢোকালো কে? তালে চলে কিসে? নিজের বুকে দুই থাবড়া দিয়ে বলল ইচ্ছে দিয়ে!পাস করার পর থেকে ছোট কাকার কি তোকে টাকা পাঠাতে হয়েছে? না।তালে নতুন করে কী এমন ঘটল যে এইসব রাবিশ টেনশন মাথায় বেঁধে ঘুরছিস? চব্বিশ পঁচিশ বছরের দুজন তরতাজা ডাক্তারের  যদি এই চিন্তা হয় তবে জাতির ভবিষ্যৎ ভেবে মাথায় তো আমার আকাশ ভেঙে পড়ল।কটাৎ করে মাথায় চাঁটি দিয়ে ছোট খোকাদা যদিও দুই তুড়িতে সব উড়িয়ে দিয়েছে। তবু কী এক অস্বস্তিতে কাল রাতে ঘুমই এলো না।
          তার শুধু গতকালের সুখোমামার বাড়ির কথা মনে করে সে যেন নিজের নিরালায় খুঁজে নিতে চাইছিল আদর মাখানো সেই ভরসা।
         মামা বাড়ির দেশ গাঁয় বাড়ি বলে বাড়িতে ছোট খাটো কাঠের কাজের সুখোমিস্তিরি মাকে দিদি বলে। সেই সুবাদে সুখোমামা তাকে আইবুড়ো ভাতের নেমন্তন্ন দিয়েছে।মামীও এসে পইপই করে বলে গেছে। কলকাতা থেকে বাড়ি এলে সে অবশ্য সুখোমামার প্লাস্টারহীন টিনের চালের বাড়িতে একবার করে হানা দেয়। গুড়ের চা, কাঁকড়ার ঘিলুর বড়া,নারকেল কোরা দিয়ে চিংড়ির যা থাকে ঘরে চেয়ে চিন্তে খেয়ে আসে। সেলাই কল চালাতে চালাতে তাকে বড়া ভাজা শেখায়  সুধা মামী।
মামা বলে তুই হইলি মোর লক্ষী মা।এই যে  ঘরে আইসা পা দিছিস আর উদলা ঘরখান হাইস্যা ওঠছে বোঝোস? বাদ দাও মামা,মুড়ি খাবে তো বলো।মামী মুড়ি মাখছে।
         আইবুড়ো ভাতে গিয়ে অবশ্য একটু হকচকিয়ে গেল।বেশ ক'জন অচেনা লোক বারান্দার চৌকি আর বেঞ্চে বসে আছে। বোধহয় এ পাড়ার বাসিন্দা বা কাঠের কাজের অর্ডার দিতে এসেছে।
        শাড়িডা পইরা আয় বলে মামী তাকে ঘরে ডেকে একটা লাল পাড় সবুজ তাঁতের শাড়ি আর নিজের হাতে বানানো লাল ব্লাউজ ধরিয়ে দেয়। শাড়ি কিনেছো কেন ও মামী, বিয়েতে কিছু দেওয়া নেওয়া বারণ জানো না?
       থাম ছেমরি। যা কইতাছি হেইডা কর। মামী নিচু গলায় ধমক দিলে সে শাড়ি নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকল।
          শাড়ি পরে বেরোতেই মামী তার হাত ধরে শোবার বড় কামরাখানায় নিয়ে গেল। মাটির মেঝেতে শঙ্খ লতার আলপনা দেওয়া।আসন পেতে তার সামনে  পিলসুজে প্রদীপ জ্বলছে। পেতলের রেকাবিতে ধানদুব্বো রাখা। একটা বাটিতে পায়েস আর মিষ্টি। কাঁসার থালায় ভাতের চারধারে বাটি করে সাজানো সব ব্যঞ্জন। এইহানে বস। 
       মামা কই গেল?আইত্যাছে। বলতে বলতে মামা পাড়ার আরও কজন নিয়ে এসে পড়ল।ডাক দিছ সবাইরে?হয়।সে অবাক হয়ে দেখে পাড়ার মুরুব্বি গোছের লোক ছাড়াও বৌঝি কাচ্চা বাচ্চা মিলে পঁচিশ তিরিশ জন মানুষ হাজির।সুখোমামা ভাঙা মতো গলায় বলে মানুষ হইছে  মাইয়া আমাগো
ডাক্তার হইছে অহন কত মানষের চিকিচ্ছা করব।তয় কাইল মায় তো হউরবাড়ি যাইব।আফনেরা অরে আশীর্বাদ কইরা যান। অচেনা সব মানুষ এসে তাকে পায়েস বা মিষ্টি খাইয়ে ধানদুব্বো মাথায় দিচ্ছে।
বলছে সুখী হও। না চিনেই সবাইকে প্রণাম করছে সেও।
       সুখোমামাকে প্রণাম করতেই  মা জননী আমার ভালো থাহো,সবাই রে ভালো রাইখ্যো বলতে বলতে কেঁদে ফেলে ।
       চোখ দিয়ে  জল পড়ছে তারও।গলায় কিসের যে দলা পাকিয়ে আছে। কোনো কথাই বলতে পারছে না সে।সানাটাও কাঁদিস কেন এই ঝিনিদি বলে ফোঁপাচ্ছে।
        আফনেরা এট্টু মিষ্টিমুখ কইরা যায়েন বলে সুখোমামা আর মামী কলার পাতায় করে প্রসাদ দেওয়ার মতো লুচি আর পায়েস দিচ্ছে সবাইকে।মামী বলে এই কাঁসার বগি থালখান ওপার থিক্যা এইখান আনছিলাম কোনোমতে।বাপের বাড়ির থাল‌।বিয়ায় দিছিলো মোর মায়।আইজ তরে খাইতে দিয়া থালখানেরও বুক জুড়াইছে।
   কোন সুদূর সময় থেকে এই সব রূপকথার মতন  ভালবাসা অন্ন ব্যঞ্জনের সৌরভ মেখে তার সামনে এসে দাঁড়ালো যেন‌।বুকভর্তি সেই অপরূপ সুবাস আড়াআড়ি আলাদা করে দিচ্ছে তার আজকের জীবন থেকে আগামী কালের সময়কে। সেটা ভালো না মন্দ এই অনিশ্চয় দোলাচলে দিশেহারা লাগে তার।

Post a Comment

0 Comments