জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত /নীল যবনিকা। পর্ব ১

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত
নীল যবনিকা।  পর্ব ১

প্রজাতন্ত্র দিবস। সকাল আটটা। নীল আকাশ, কনকনে ঠান্ডা আর ঝকঝকে রোদ। পতপত করে পতাকা উড়ছে হিমেল হাওয়ায়। পতাকা উত্তোলন হবে, করবেন স্থানীয় বিধায়ক নির্ঝর সরকার। স্কুলের ছেলেমেয়েদের সাদা নীল পোষাকে বেশ লাগছিল, গরীব বস্তিবাসীদের যতটা বেশ লাগতে পারে। প্রোটিনের অভাব, অক্সিজেন পায় না ভালো,   কত বেশ আর হবে। পার্থ ভাবল।

পতাকা উঠল, জাতীয় সংগীত হলো। বাচ্চারা উঠে দাঁড়িয়ে গাইল, কেউ দুষ্টুমি করল না। বিধায়কের ফোনে মেসেজ এল, পার্থর এলো লিন্ডার একটা ইমোজি। নেতা চলে গেলেন, আরো অনেক জায়গায় উত্তোলন আছে, যাবার সময় মালাটা দিয়ে গেলেন একটি বাচ্চাকে, সে সেটা গলায় পরে বসে আছে, আর বেশ গর্বিত হয়ে দুপাশে দেখছে। 
এরপর পার্থর বাবা আশুতোষের বক্তৃতা। 
 
আশুতোষ এই পড়ালেখা সান্ধ্য বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। স্কুলছুট ছেলেমেয়েরা এখানে আসে সন্ধেবেলা মুড়ি খেতে খেতে নানারকম শেখে। উনি ছিলেন অর্থনীতির অধ্যাপক। তাঁর পেপার জার্নাল অফ ডেভলপমেন্টাল ইকনমিক্সেও বেরিয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতি নিয়ে নানারকম অদ্ভুত থিওরি আছে তাঁর। মাঝে মাঝেই অমর্ত্য সেন বা অভিজিত বিনায়কের উল্লেখ করেন। পার্থর মতে, আজকাল এসব পুরনো পাঁচালী আর চলে না। সে বিদেশে সেটলড, আমেরিকার নাগরিক। এদেশে কেউ তাকে চেনে না কিন্তু কম্পিউটার জগতে তার অনেক নাম। কৃত্রিম বুদ্ধির প্রবক্তা ও বেশ কিছু নতুন মডেলের আবিষ্কর্তা। তার আবিষ্কার করা এআই বলতে পারে, একজন নাগরিক আগামী দশ বছরে কি হবে। ক্রিমিনাল, নেতা না ফ্যাতাড়ু। 

পার্থ তার ল্যাপটপ দান করেছে স্কুলে। একটু পুরনো, কিন্তু নতুনের মতই ঝকঝকে, আর খুব শক্তিশালী। আশুতোষ স্যার সেটা চালালেন, মনিটরে ফুটে উঠল স্টারশিপ রকেটের ছবি, স্পেস এক্স কম্পানির। তার পাশে প্রতিষ্ঠাতার নিজের কোম্পানীর ইলেকট্রিক কারে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে হাতে একটা কিচেন সিংক। পাশে বিখ্যাত কোটেশান। আই ওয়ান্ট টু ডাই অন মার্স। 
পার্থর কফির সময় হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আশুতোষ বলেই চলেছেন। 
-- শিক্ষাই আমাদের মেরুদন্ড, শিক্ষাই আমাদের পায়ের বল। শিক্ষাই আমাদের দেশে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে। যত শিক্ষিত হব আমরা, তত কেটে যাবে আমাদের দুর্দশা, বেকারী, মারপিট, খুনোখুনি। সবার জন্য বাসস্থান হবে, সবাই দুবেলা পুষ্টিকর খাবার পাবে, এমনি এক স্বপ্ন নিয়ে এই পড়ালেখা বিদ্যালয়… আমাদের এমন এক দেশ গড়তে হবে যেখানে যারা এগিয়ে যাবার সুযোগ পায় না, তারাও সবাই হাতে হাত ধরবে। বড়বড় ধনী পুঁজিপতিদের আধিপত্য থাকবে না, সবাই পাবে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য শিক্ষা বাসস্থান। ডাক্তার ইঞ্জিনীয়ার, অফিসার হবার জন্য জন্য লাখ টাকার ডোনেশান দিতে হবে না…

বাচ্চারা খুব মন দিয়ে শুনছে। কি ছাই বুঝছে কে জানে। এই দেশে কিচ্ছু হবে না, সেটা ও বুঝে গেছে আজ থেকে ২০ বছর আগেই। শুধু দালাল আর লটারি কম্পানী, পলিটিক্স নিয়ে মারপিট চার দিকে, লাখ লাখ ইঞ্জিনীয়ার বসে আছে কবে দেশ থেকে পালাবে। দেশ যে ডুবে যাচ্ছে সেটা বুঝতে সময় লাগে না।

🍂
ad

--তুই কিছু বলবি?
পার্থর চটকা ভাঙতে ঘড়িতে দেখে পাক্কা এক ঘণ্টা চলেছে বাবার লেকচার। হাইতোলা কন্ট্রোল করে ওঠে, নাহ আজ কিছু বলা দরকার। কমপিউটারটা যথেষ্ট দামী, ওরও কিছু অধিকার জন্মায় মনের বাত বলতে। 

-আমার ছোট্ট ছোট্ট বন্ধুরা, আশুতোষ স্যারের বক্তৃতা তোমরা শুনলে। খুবই ভাল বলেছেন উনি। তবে আমার কিছু অন্য কথা বলার আছে। হয়ত ওনার ভাল লাগবে না। তবুও তোমরা ছোট, আমি চাই না তোমরা ভুল ধারণা নিয়ে বড় হও। উনি পুরনো কালের লোক, পুরনো কথা বলেন, কিন্তু ওগুলো সব দিবাস্বপ্ন। তোমরা নিশ্চয়ই ডারউইনের নাম শুনেছ।
একটি মেয়ে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল, 
-বিবর্তনবাদ। শুনেছি। বাঁদর থেকেই মানুষ হয়েছে।
পার্থ মৃদু হেসে হাত তুলে সম্মতি জানিয়ে শুরু করল,
- ডারউইন স্যার কি বলেছিলেন? সব জীব সবসময় লড়াই করছে সবার সঙ্গে। সারভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট। যার গায়ের জোর বেশি, যে অন্যকে দাবিয়ে ওপরে উঠতে পারবে, সেই থাকবে, বাকীরা সব  বিলুপ্ত হয়ে যাবে। জীবন মানেই প্রতিযোগিতা, কম্পিটিশান। এভাবেই চলে সব দেশ। আজ আমেরিকার দিকে তাকিয়ে দেখো। সেখানে এ সব ছিঁচকাদুনি চলে না। লড়তে হবে, জিততে হবে, যে ভাবে হোক। তাইতো আজ ঐ দেশ এত উন্নত। মহাকাশ জয় করছে, পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখছে সব দেশকে, কাউকে ট্যাঁ ফো করতে দিচ্ছে না। এরকম পারবেতো? 

আশুতোষ ছটফট করছিলেন, আর পারলেন না। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেন,
-পার্থ আমাদের এক দামী কম্পিউটার উপহার দিয়েছে, আমরা তার জন্য খুব কৃতজ্ঞ। তোমরা সবাই হাততালি দাও। 
হাততালি শেষ হতেই আশুতোষ বলতে থাকেন, 
--কিন্তু আমি ওর সঙ্গে একমত নই। মানুষের সভ্যতা তৈরি হয়েছে সমাজ গড়ে, পশুশিকার থেকে চাষবাস, সব কাজ অনেক মানুষ হাতে হাত দিয়েই করেছে বলেই আমরা আজ আমাদের সমাজের যা কিছু গলদ, কষ্ট সব একসঙ্গেই আমাদের দূর করতে হবে। আমেরিকায় আজ অর্ধেক মানুষ গরীব সেটা কি জানো? তারা ধার করে কলেজে পড়ে, সারা জীবন সেই ধার শোধ করে, গরীব মানুষ চিকিৎসার খরচ জোটাতে পারে না। এই কি আমাদের আদর্শ? এটমবোমা দিয়ে মানুষ খুন আমাদের লক্ষ্য?

পার্থ আর না থাকতে পেরে বলে,
-কি গরীব দেশের মত কথা বলছ বাবা। ভাবছো গান্ধী, বুদ্ধ যীশু এসে তোমাদের বড়লোক করে দেবে। এই করেই এত পিছনেই চলে যাচ্ছে তোমাদের দেশ। 
-তোমাদের দেশ মানে? তোর দেশ নয়?
-না বাবা। ভুলে যাচ্ছ আমি আমেরিকার নাগরিক। আমার দেশের সম্বন্ধে কুৎসা করলে তার প্রতিবাদ করা কিন্তু আমার একটা দায়িত্ব।
-কুৎসা? এতো সবাই জানে, অর্থনীতিটা আমি তোর থেকে ভালোই জানি। 
-ওটা অর্থনীতি নয়, গরীবদের নোংরা রাজনীতি। তোমার জন্য বাবা আমার দুঃখই হয়। কুয়োর মধ্যে ব্যাং হয়েই পড়ে রইলে। 
-ছিঃ, বাবাকে ব্যাং বলে মনে হল? তোর মা, এই ঝকঝকে বাচ্চাগুলো সব ব্যাং। বিদেশে গিয়ে তোর এমন অবনতি হবে ভাবতেও পারিনি।

ছোটরা অবাক হয়ে শোনে চোখ বড় বড় করে, খুব একটা বোঝে না, বোঝে বাবা আর ছেলের মধ্যে বিচ্ছিরি একটা ঝগড়া শুরু হয়েছে। কিছু সময় পরেই দেখা যায় পার্থ গটগট করে মঞ্চ থেকে নেমে চলে যাচ্ছে। আর আশুতোষ হাত নেড়ে ডাকছেন, ‘পার্থ শোন শোন…’

অন্ধকার ঘরে বসে আশুতোষের চোখে রীলের মত সব ঘুরে যায়। ঠান্ডার জন্য জানলা বন্ধ, ঘরটা একটা চাপা গর্তের মত লাগে। কুয়োর ব্যাং? টেবিলে পড়ে আছে না-কাটা কেক, আজ ছিল নীলিমার জন্মদিন, পার্থ অনলাইনে অরডার দিয়ে আনিয়েছিল, ব্ল্যাক ফরেস্ট, নীলিমারও খুব পছন্দ শুনে কথা ছিল, অনলাইনে বার্থডে হবে, রান্নার মাসী বলল বেলুন লাগাবে না তোমরা? 

কেক না-কাটা পড়ে আছে। পার্থ ফ্লাইট ধরে চলে গেছে বাঙ্গালোর, সেখানে তিনদিন থেকে চলে যাবে নিজের দেশে, হিউস্টনে। আশুতোষ কিনেছিলেন একগুচ্ছ রজনীগন্ধা, তার ওপর একটা টিকটিকি আরাম করে বসে আছে, হয়ত শিকারের অপেক্ষায়। 

নীলিমা বেডরুমে। আজ পরার কথা ছিল পঁচিশ বছর আগে হায়দ্রাবাদ থেকে কেনা গাদোয়াল শাড়ী, সাদা জমির ওপর ডিপ মেরুন রঙ্গের বর্ডার, তার সঙ্গে ম্যাচিং হায়দারাবাদী মুক্তোর সেট।
 
-তোমার জন্যই ছেলেটা কিছু না খেয়েই চলে গেল, বলে গেছে এমন বাবার সঙ্গে কোন সম্পর্কই রাখবে না। 
-আরে ঐ তো আমাকে ব্যাং বলে দিল
-বলল নাহয়, ছেলে তো, আর তাছাড়া ও এখন অন্য দেশের নাগরিক, কত নাম করেছে। 

যতই তাঁর অর্থনীতির জগতে নাম থাক, ক্ষুরধার যুক্তির জন্য, নীলিমার সঙ্গে কোনদিন তর্কে পারেন নি অধ্যাপক। অগত্যা দুজন দুঘরে, অনেকবার উশখুশ করেছেন নীলিমাকে বলতে, চলো আমরাই কেক কাটি, সাহস হয় নি। 
শেষে তাঁর শেষ মোক্ষম কথা বলে এঘরে শুয়ে আছেন। 
-আমি মরলেই তাহলে ও আসবে। প্রার্থনা করি তাড়াতাড়ি যেন যাই।‘
এই কথাতেও নীলিমার কোন সাড়া আসে নি। পুত্রস্নেহ না বিদেশী নাগরিকের প্রতি শ্রদ্ধা কে জানে। 

আশুতোষের প্রার্থনা বিধাতার কাছে আপলোড হল ঠিকই কিন্তু বিধাতা চিরকাল কৌতুকপ্রবণ। তিনি চাল চাললেন নিজের মত। 

-ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments