চিত্র- অর্ণব মিত্র
দূর দেশের লোক গল্প— ২৪৩
খরগোশের বিচারপর্ব
মরক্কো (এশিয়া)
চিন্ময় দাশ
অনেক কাল আগের কথা। একদিন সবে সকাল হয়েছে। একটা বাঘ বেরিয়েছে নিজের ডেরা ছেড়ে। পেটে কিছু দেওয়া দরকার। এজন্য শিকারের খোঁজে বেরিয়েছে বাঘমশাই।
বন শেষ হয়ে এসেছে। সামনে একটা গ্রাম। চলতে চলতে গ্রামটার দিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল বাঘ। তখনই ঝপাং। কূয়োর মত একটা গর্ত ছিল সামনে, খেয়াল করে দেখেনি। ধপাস করে তার মধ্যে গিয়ে পড়েছে বাঘ।
আর যায় কোথায়। হাজার কসরৎ করেও কিছু হচ্ছে না। উঠে আসবার কোনও উপায় নাই। বাঘ চিৎকার শুরু করে দিয়েছে—বাঁচাও, বাঁচাও।
কারও সাড়া নাই। বাঘ চেঁচাচ্ছে—কে কোথায় আছো, বাঁচাও আমাকে। দোহাই তোমাদের।
কোনও সাড়াশব্দ নাই। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। বাঘবাবাজী একবার চেঁচায়, একবার আঁচড়ে কামড়ে গর্ত বেয়ে উঠে আসবার চেষ্টা করে। কিন্তু যা ভারী শরীর। ওভাবে কি আর উঠে আসা যায় কখনো?
অসহায় অবস্থা বেচারার। সারাদিন চেঁচিয়েও কিছু ফল হোল না। আকাশ ছেড়ে সূর্যদেব চলে গেলেন। অন্ধকার নেমে এলো চরাচর জুড়ে। সব আশা শেষ। গর্তটার এক কোণে গুটিসুটি মেরে পড়ে রইল বাঘ।
পরদিন সকাল হোল। আবার আলো ফুটল চারদিকে। বাঘ চেঁচাল—বাঁচাও। কে কোথায় আছো, দয়া করে বাঁচাও আমাকে।
কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কারও দেখা নাই। বাঘ বুঝল, এইভাবে পড়ে থেকে, না খেয়ে, শুকিয়ে শুকিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে তাকে। হাল ছেড়ে দিয়েছে যখন, হঠাৎই একটা ছায়া নড়ে উঠল গর্তটার দেওয়ালে।
নিশ্চয় এসেছে কেউ না কেউ। বাঘ মাথা উঁচিয়ে দেখল একটা লোক। ভারি আশা জাগল মনে। আমার দুর্দশা দেখে, নিশ্চয় দয়া হবে মানুষটার। চিৎকার করে বলল—দোহাই তোমার, ভালোমানুষের পো। একটু দয়া কর আমাকে। তুলে দাও এই গর্ত থেকে।
উপরে লোকটা আসলে একজন কাঠুরিয়া। কাঠের খোঁজে বেরিয়েছে গ্রাম থেকে। বাঘের গলা শুনে, অবাক। উঁকি দিয়ে দেখে, সত্যি একটা বাঘ, গর্তে পড়ে গিয়েছে কোন রকমে। সে বলে উঠল—বাপরে, বাঘ! পালাই আমি।
বাঘ কাকুতি মিনতি শুরু করল। নানা কথা বলতে শুরু করল ইনিয়ে বিনিয়ে—দয়া করে তুলে দাও আমাকে। যতদিন বাঁচব, তোমার সেবা করে যাব। কথা দিলাম। এখানে পড়ে থাকলে, মারা পড়ব আমি।
কাঠুরিয়া হেসে উঠল এসব শুনে। বলল—না তুললে, তুমি মারা পড়বে, একথা ঠিক। আর, তোমাকে তুললে, আমি মারা পড়ব, সেকথাটাও ঠিক। বাঘের পেটে যেতে আমার সাধ নাই। আমি চললাম।
--দোহাই তোমার। চলে যেও না। বাঁচাও আমাকে। বাঘ চেঁচাতে লাগল।
বাঘের কাতর গলা শুনে, দয়া হোল কাঠুরিয়ার। একটা ফন্দীও এলো তার মনে। উপর থেকে চেঁচিয়ে বলল—তোমাকে বাঁচাতে পারি। তবে, একটা শর্ত আছে আমার।
শুনে বাঘ বেশ উৎফুল্ল। বলল—আমি সব শর্তে রাজি। বলো, কী শর্ত তোমার।
কাঠুরিয়া বলল—পেট চালাবার জন্য বনে ঢুকতেই হয় আমাকে, কাঠ কাটার জন্য। কোনদিন আমার উপর হামলা করবে না-- এই কথা দিতে হবে তোমাকে। তাহলে, আমি বাঁচিয়ে দেব তোমাকে।
--কথা দেওয়া কী বলছ গো। শুধু আমি নয়। বনের কোনও বাঘ কোনদিন তোমার ওপর হামলা করবে না। সে ব্যবস্থাও করে দেব আমি।
এই ব্যবস্থায় কাঠুরিয়া ভারি খুশি। বলল—একটু রোস। আমি হিল্লে করে দিচ্ছি তোমার।
কুড়ুল তো ঘাড়েই ছিল লোকটার। ঘুরে ঘুরে যুৎসই দেখে একটা গাছ কেটে এনে, গর্তটার ভিতর নামিয়ে দিল। বাঘকে বলল—এইটা বেয়ে বেয়ে উঠে এসো এবার।
আঁচড়ে কামড়ে উপরে উঠে এলো বাঘ। জীবন ফিরে পেয়েছে। মনে অপার আনন্দ। জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে মানুষটা। দু’চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল লোকটাকে। আস্ত জলজ্যান্ত একটা হৃষ্টপুষ্ট মানুষ। একেবারে তার থাবাদুটোর সামনে।
অমনি পেটের ভিতর খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠল বাঘের। দু’দিন কিছু পড়েনি পেটে। সামনে একটা লোক দেখে, জল চলে এসেছে জিভে। কাঠুরিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চলেছে বাঘ, লোকটা চিৎকার করে উঠল—আরে, দাঁড়াও, দাঁড়াও। করছোটা কী তুমি? তুমি না কথা দিয়েছিলে, আমার উপর হামলা করবে না?
--আরে, হাঁদারাম! পেটে আগুন জ্বলছে আমার। খিদের চোটে যদি মারাই যাই, কথা দেওয়ার মূল্যটা কী রইল?
কাঠুরিয়া বলল—এটা কিন্তু খুবই অন্যায় কাজ হচ্ছে। তুমি না বনের রাজা!
বাঘ হেসে উঠল—আরে, রাজা বলেই আমি জানি, আগে নিজের প্রাণ বাঁচাতে হবে। তার পরে অন্য সব কাজ।
--বনের সবাই কিন্তু বলবে, কাজটা তুমি অন্যায় করছ?
--কেউ বলবে না, অন্যায় করছি। প্রাণ বাঁচানোটা সবচেয়ে জরুরী কাজ।
কাঠুরিয়া বলল—বলে কি না, পরখ করে দেখা যাক। সামনের ঐ পাইন গাছটাকেই জিজ্ঞেস করা যাক।
বাঘ আপত্তি করল না—করো জিজ্ঞেস। কী বলে, দ্যাখো।
পাশেই ছিল বড়সড় একটা পাইন গাছ। বাঘ আর কাঠুরিয়া দুজনে তার কাছে গিয়ে হাজির। সব ঘটনা গাছকে খুলে বলে, কাঠুরিয়া বলল—এবার তুমিই বলো, বাঘ কি ঠিক করছে কাজটা? প্রাণ বাঁচালাম আমি। আর, আমাকেই কি না খাবে বলছে। কৃতজ্ঞতা বলে কিছু নাই?
বুড়ো পাইন হেসে উঠল—কোন মুখে তুমি কৃতজ্ঞতার কথা বলছ? তোমাদের, মানে মানুষের কোনও কৃতজ্ঞতা আছে? আমরা গাছেরা ছায়া দিই তোমাদের। গরমের হাত থেকে বাঁচতে, গাছের তলায় এসে জিরিয়ে নাও। আমরা বৃষ্টি এনে দিই আকাশ থেকে। তার বদলে, তোমরা কী দাও আমাদের? রান্না করবে, ঘর গরম করবে-- আমাদেরই ডাল কেটে নিয়ে যাও।
গাছটার বলার শেষ নাই—যেই দেখলে একটা গাছ বুড়ো হয়ে গেছে, অমনি কুড়ুল নিয়ে হাজির। কেটেই ফেললে গাছটাকে। তারপর ঘর বানাবে , জাহাজ বা নৌকা বানাবে, ঘরের আসবাব, খাট-পালঙ্ক, কড়ি-বরগা, আলমারি, চেয়ার-টেবিল—সবই তো বানাও কাঠ কেটেকুটে।
বলে, হা-হা করে হেসে উঠল গাছ—বেশি কথার দরকার কী? তোমার ঘাড়ের কুড়ুলটার দিকে তাকাও। হাতলটাও তো বানিয়েছ গাছের ডাল কেটে। তাই তো বলছি, আর যাই বলো, কৃতজ্ঞতার কথাটা বোল না তোমরা। মানুষের মুখে কৃতজ্ঞতার দোহাই মোটেই মানায় না।
বাঘের মুখে বেশ খুশির হাসি। বলল—কীহে, এবার খুশি তো? না কি আরও কাউকে জিজ্ঞেস করতে চাও।
কাঠুরিয়া চিন্তায় পড়ে গিয়েছে। কী উত্তর দেবে, বুঝে উঠতে পারছে না। ভয়ও হচ্ছে মনে। সেসময় একটা বুড়ো বলদ ধুঁকতে ধুঁকতে যাচ্ছিল সেদিক দিয়ে।
কাঠুরিয়া চেঁচিয়ে উঠল—একটু দাঁড়াও না, ভাই। আমাদের একটা বিবাদ মীমাংসা করে দিয়ে যাও।
কাঠুরিয়া আর বাঘ দুজনেই তার সামনে গিয়ে হাজির। পুরো ঘটনা বলদকে জানিয়ে, কাঠুরিয়া বলল—এবার তুমিই বলো, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে বাঘের? আমি উপকার করলাম। এখন আমাকেই খেতে চাইছে।
বলদ বাঘের দিকে চেয়ে, খেঁকিয়ে উঠল—তুমি হলে বনের রাজা। কিন্তু এমন বেকুব কেন তুমি? এখনও খেয়ে ফেলোনি লোকটাকে?
খুব ঘাবড়ে গেছে কাঠুরিয়া। কী বলছ তুমি? আমি তোমাকে বিচার করে দিতে দাঁড় করালাম। আর তুমি কি না …
বলদ হাসি মুখ করে বলল—বিচার করেই তো বললাম।
--এইটা তোমার বিচার হোল?
বলদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল—শোন তাহলে। তোমারই গোয়ালের কথা ভাবো। ধরো, একটা গাইগরু আছে তোমার। যেই গাইটা বিয়োল, বাছুরটাকে পেট ভরে খেতে না দিয়ে, বেশির ভাগ দুধ তোমার বাচ্চাদের জন্য কেড়ে নিলে। তারপর বাছুরটা যদি এঁড়ে হয়, তাহলে তো আর কথাই নাই। খেতে লাঙল চালাতে, গরুর গাড়িতে মাল বইতে—সেই বলদের কথাই মনে পড়ে তোমাদের। আর যেই বুড়ো হয়ে পড়ল, অমনি দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিলে। নয়ত তুলে দিলে কসাইর হাতে। মাংস খাবে সবাই ভাগাভাগি করে। এমনকি চামাড়াটাও বাদ দেবে না তোমরা। পায়ের জুতো বানিয়ে মসমসিয়ে ঘুরে বেড়াবে।
বলদ থামল একটু দম নিতে। কাঠুরিয়ার মুখে কথা জোগাচ্ছে না। বলদ আবার বলল—আমার দিকেই তাকিয়ে দেখো না। সারাজীবন মালিকের জন্য খাটাখাটুনি করলাম। বুড়ো হতেই, তাড়িয়ে দিয়েছে গোয়াল থেকে।
বাঘের দিকে তাকিয়ে, বলদ বলল—কোনও জবাবের দরকার নাই। এখুনি খেয়ে ফেলো একে।
বাঘ ভারি খুশি। সে বলল—আমি তো সেটাই করতে যাচ্ছি। কৃতজ্ঞতা তো অনেক দূরের কথা। দয়ারও যোগ্য নয় মানুষেরা। ঠিক আছে হে, ধন্যবাদ তোমাকে।
কাঠুরিয়া বুঝে গিয়েছে। আজ মরতেই হবে তাকে। সাক্ষাৎ যমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। মুখে আর কথা সরছে না বেচারার।
ঠিক তখনই একটা খরগোশকে দেখা গেল। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে সেখান দিয়ে। কাঠুরিয়া চিৎকার করে বলল—খরগোশ ভায়া, একটু দাঁড়াবে?
বাঘ চোখ কুঁচকে বলল—এ পুঁচকেটা কী করবে? একে বিচারক মানবে না কি তুমি?
--এই শেষবার। কথায় আছে না, বার বার তিন বার। কাঠুরিয়া বলল আবেদনের গলায়।
--ঠিক আছে। করো জিজ্ঞেস। কিন্তু নিজেই ভালো করে জানো, উত্তর কী হবে।
--দয়া করো আমাকে। এটাই শেষবার। আর কিছু চাইব না তোমার কাছে।
বাঘ মাথা নেড়ে, রাজি হয়ে গেল। বলল—তবে এটাই কিন্তু শেষ বার। মনে রেখো।
বাঘ আর কাঠুরিয়া দুজনে পুরো ঘটনাটা খুলে বলল খরগোশকে। চুপ করে শুনে গেল সে। বুঝতেও কিছু বাকি রইল না তার। বলল—সবই শুনলাম। বিচারও করে দেব। জেনে রাখো দুজনে, ন্যায্য বিচারই করব আমি। কিন্তু…
বাঘ ভুরু কুঁচকে বলল—এর আবার কিন্তু কী রে, হতভাগা? সব শুনলি, এবার বলে দে, তোর কী বিচার।
খরগোশ কিন্তু ঘাবড়াল না। সাহস করে বলল—বিচারের একটা ধারা আছে। তাছাড়া, এখানে আবার বনের রাজার বিরুদ্ধে অভিযোগ। বিচারটাও রাজকীয়ই হতে হবে। যাতে মান না যায় রাজামশাইর।
বাঘ এবার বেশ খুশিই হোল শুনেটুনে। বলল—ঠিক আছে। যা বলবার তাড়াতাড়ি বল। পেট চুঁইচুঁই করছে আমার। টানা দু’দিন হতে চলল, পেটে কিছু পড়েনি।
খরগোশ বলল—বিচার করবার আগে, বিবাদের গোড়ায় পৌঁছাতে হবে আমাকে। রাজামশাই যেখানে পড়ে গিয়েছিল, সেই গর্তটা কি অনেক দূরের কোথাও?
বাঘ বলল—না, না। দূর কোথায়? এই তো দু’পা দূরে। কিন্তু কেন বল তো? রাস্তা মেপে, কী করবি তুই?
--না, না। রাস্তা মাপব কেন? নিজের চোখে গর্তটা দেখা দরকার। তাছাড়া, এ আপনাকে কীভাবে একটা গর্ত থেকে তুলে আনল, সেটাও দেখতে চাই আমি।
তিনজন গর্তটার কাছে এসে হাজির হয়েছে। খরগোশের কান বেশ লম্বা। বিজ্ঞের মত কান চুলকে, গর্তটা দেখল চেয়ে চেয়ে। বলল—এবার দুজনে কে কোথায় ছিলে, সেটা দেখা দরকার।
বাঘের দেরি সইছে না আর। সে তরতর করে নীচে নেমে গেল গাছ বেয়ে। নেমেই বলল—এইভাবে ছিলাম আমরা। আমি এখানে গর্তের নীচে। আর ও ওপরে। এবার বল, তোর কী রায়।
খরগোশ আকাশ থেকে পড়বার ভান করে বলল—যদি এই অবস্থা ছিল, আপনি বাঁচাও বাঁচাও বলে চেঁচাতে গেলেন কেন? যেভাবে নেমে গেলেন, ওই ভাবেই তো তরতর করে উঠে আসতে পারতেন।
বাঘের আর সহ্য হোল না। ধ্মকে উঠল—দূর হতভাগা। এই তোর বুদ্ধি? এই মগজ নিয়ে বিচার করতে এসেছিস? গাছটা তো এ পরে এনেছে। আগে তো এখানে গাছ ছিল না।
খরগোশ কাঠুরিয়ার দিকে ঘুরে বলল—এটাই কি ঘটনা? পরে তুমি গিয়ে গাছটা এনেছ?
কাঠুরিয়া বলল—হ্যাঁ, তাই।
খরগোশ বলল—তাহলে তো মিটেই গেল। রাজামশাই ছিলেন নীচে, তুমি ছিলে গর্তের ওপরে। মাঝখানের এই গাছটা তখন ছিলই না। তাই তো?
বাঘ আর কাঠুরিয়া দুজনেই বলল—হ্যাঁ, তাই।
খরগোশ বলল—তাহলে, এক কাজ করো। আগে গাছটা তুলে নাও। দেখি ভালো করে, রাজামশাই ঠিক কী অবস্থায় ছিলেন? কেন বলো তো? আসলে, দুজনের মাঝখানে এই গাছটা এসে পড়েই তো বিচারের গোল বাধিয়েছে। গাছটা একবার তোল, সাথে সাথেই বিচার হয়ে যাবে। এবং ন্যায্য বিচার তখন সহজেই হয়ে যাবে।
বাঘের আর তর সইছে না। সে কাঠুরিয়ার ওপর গর্জে উঠল—হাঁদারামের মতো দাঁড়িয়ে দেখছোটা কী? গাছটা তুলে নাও না। আমার আর দেরী সইছে না, ছুঁচোর কেত্তন চলছে ফাঁকা পেটে। আর দেরি কোর না।
বিচারক মশাই কাঠুরিয়ার দিকে ফিরে, চোখ মটকে বলল—তোল, তোল। দেরী কোর না এক পলকও। আমারও গাজরের খেতে যেতে হবে। পেট আমারও খালি।
🍂
একটু হতভম্বই হয়ে গেছে কাঠুরিয়া। কিন্তু সে আর দেরি করল না। গাছটা টেনে ওপরে তুলে নিল। একেবারে পূর্বের অবস্থা এখন।
খরগোশ গর্তটার একেবারে মুখে গিয়ে দাঁড়াল। নীচের দিকে চেয়ে বলল—রাজামশাই, তাহলে, ঠিক এরকম অবস্থাই ছিলেন?
বাঘ বলল—এক্কেবারে ঠিক। অবস্থা এরকমটাই ছিল।
--তাহলে তো গোল মিটেই গেল। খরগোশ বলল—বেখেয়ালে রাজামশাই গর্তে পড়ে গেছলেন?
বাঘ বলল –হ্যাঁ।
বিপদে পড়ে, প্রাণ বাঁচাবার জন্য চেঁচাচ্ছিলেন?
–হ্যাঁ।
--তাই শুনে, এই লোকটা এসে দাঁড়িয়েছিল?
–হ্যাঁ।
--লোকটাকে আপনি উদ্ধার করে দিতে বলেছিলেন?
–হ্যাঁ।
--লোকটা ভয়ে রাজি হচ্ছিল না। তখন আপনি তাকে হামলা করবেন না বলে কথা দিয়েছিলেন।
–হ্যাঁ।
তাই শুনে, আপনাকে বিশ্বাস করে, লোকটা একটা গাছ কেটে এনে নামিয়ে দিয়েছিল?
–হ্যাঁ।
--আপনি গাছ বেয়ে উপরে উঠে এলেন। আপনার তখন ভয়াণক খিদে লেগেছে। আপনি ওকে খেতে গেলেন। তাই নিয়েই তো বিবাদ শুরু হোল।
–হ্যাঁ। এক্কেবারে তাই।
--তাহলে, দেখা যাচ্ছে, যতক্ষণ গাছটা ছিল না, কোন বিবাদ ছিল না। তাই তো?
–হ্যাঁ।
--তার মানে, বিবাদ শুরু হয়েছিল, গাছটা নামিয়ে দেওয়ার পর থেকে।
–হ্যাঁ। কিন্তু কতবার তোর কথায় হ্যাঁ-হ্যাঁ করব আমি। বিচার শেষ কর।
খরগোশ মুচকি হেসে বলল—বিচার তো শেষ হয়ে গিয়েছে, রাজামশাই। গাছটা আসাতেই বিবাদ শুরু হয়েছিল। গাছ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিবাদও দূরে সরে গিয়েছে।
বাঘ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে। বলল—তারপর? বল, কী বলছিস?
--ঠিক আছে, বলছি। রাজামশাই তাঁর নিজের জায়গায় থাকুন। গর্তে পড়ে গিয়ে যেমনটি ছিলেন। এই মাথামোটা লোকটা তার নিজের কাজে চলে যাক। এত বেলা হোল, একটা গাছও কাটা হয়নি তার। আমিও যাই আমার নিজের পেটের ধান্দায়। পেট কামড়াচ্ছে আমার।
0 Comments