জ্বলদর্চি

দুঃখের প্রচ্ছদ নেই’ এক ভিন্ন সুখের স্বরলিপি / সালেহা খাতুন

দুঃখের প্রচ্ছদ নেই’ এক ভিন্ন সুখের স্বরলিপি
                                 
সালেহা খাতুন

সৌরভ আহমেদ সাকিবের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘দুঃখের প্রচ্ছদ নেই’। মোট একান্নটি কবিতা রয়েছে এতে। ইতোপূর্বে সৌরভের একটি নভেলেট বা উপন্যাসিকা  প্রকাশিত হয়েছে ‘ওগো দুখ জাগানিয়া’ নামে। স্বাভাবিকভাবেই পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কবি কি দুঃখবাদী? এর উত্তর অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়ে ‘দুঃখের প্রচ্ছদ নেই’ কাব্যগ্রন্থ পাঠে মগ্ন হলে দেখা যাবে দুঃখকে কবি একেবারে একালের চিত্রকল্পে ধরে দিয়েছেন – “দুঃখ পোর্ট করতে যে নেটওয়ার্ক ধরেছ, / তার নাম দিয়েছ কবিতা” কিংবা “দুঃখগুলো এনক্রিপট করে রাখছে ক্লোনাজেপাম”। তবে তিনি আশা করেন “অপরূপ এই জগতে স্বপ্নদ্রষ্টার চোখের ভিতর থেকে দুঃখের গান ঝরে যাবে একদিন।” অথচ দুঃখ একেবারে রেকারিং ডিপোজিটের মতো জমা হয়েছে তাঁর বিভিন্ন কবিতায়। ‘সিজোফ্রেনিক রাত’ কবিতায় পার্সিফোনের দুঃখের কথা তিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। আর দুঃখের বিপরীত মানচিত্র আঁকতে ইমরান হাশমি এবং মল্লিকা শেরওয়াতের  সিনেমার কথা মনে আসছে। আমরা জানি সুখ-দুঃখের পাশাপাশি অবস্থান অথচ এ কাব্যের কবি রামপ্রসাদের মতো বার বার দুঃখের বড়াই করলেও বোঝেন “অন্তহীন স্যাডনেস ঘরের পোষা পাখিটিকে ক্রমশ নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর মুখে”। ‘দেসদিমনার রুমাল’ কবিতায় তাই কবির ঘোষণা – “ আমার দুঃখের আর কোনো প্রচ্ছদ নেই / সরলতার নদী বয়ে চলেছে সোনালি জল নিয়ে / আমি আর প্রশ্ন রাখিনা – তুমি কোথায়”। কবির দুঃখের প্রচ্ছদ রইলো না ঠিকই তবে “ভ্যানগগের দুঃখ চুরি যাবে বলে”ও তাঁর কবিতার খাতার সূর্যমুখী ফুল ভীষণ কাতর হয়ে উঠেছে। ‘নৈশ পথিক’ কবিতায় তাই উল্লিখিত হয়েছে “ভ্যানগগের দুঃখের আবহমানতা”-র কথা,আর ‘স্বপ্নের ভিতর হরিণ ছুটে চলে’ কবিতায় আসছে গাছের দুঃখের কথা – “হাঁটতে হাঁটতে গাছের দুঃখের ভিতর শুয়ে পড়ি”। কবিতা খুঁড়ে খুঁড়ে দুঃখ সংগ্রহ করতে গিয়ে পাঠক চমকে উঠবেন ‘সাবানা আজমি’ কবিতায় এসে, যেখানে কবির উচ্চারণ – “অভিন্ন হৃদয়ের পাখিগুলো উড়ে যায় দুঃখসংগ্রাহকের মতো”। অভিজ্ঞতা বলে সৃজনশীল ব্যক্তিরা প্রায়ই দুঃখবিলাসী হন। অনেকসময়ই অজানা দুঃখে তাঁদের হৃদয় পরিপূর্ণ থাকে। এ কাব্যের কবিও ‘দুঃখিত হৃদযে’ জারিনের কাছে ফিরতে চেয়েছেন। কেননা ‘প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমিক বাঁশির দুঃখ জানে’।
🍂
ad

এ কাব্যে শুধু দুঃখই নয় ভাঙনের কথা, যন্ত্রণার কথাও আছে। আধুনিক সাহিত্যের একটি বিশেষ দিক হলো অমঙ্গলচেতনা। যেখানে জীবনের দুঃখ, কষ্ট, সংকট, ধ্বংসের দিকটি অধিক গুরুত্ব পায়। বুদ্ধদেব বসু, মোহিতলাল মজুমদারের কবিতায় যেমন জীবনের অন্ধকার দিক, নেতিবাচক দিক, মানবিক কামনা বাসনা, দেহাস্বাদনের কথা ইত্যাদির চিত্র প্রত্যক্ষ করা যায় এ কাব্যের বেশ কিছু কবিতায় তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। প্রসঙ্গত অরুণ মিত্রের ‘ভাঙনের মাটি’ কাব্যগ্রন্থের কথা উল্লেখ করা যায়। আধুনিক মানুষের মানসিক অবস্থাকে অরুণ মিত্র উৎসর্গ পৃষ্টাতেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন – “মানবদশায় বিচলিত সকল বন্ধুকে”। তিনি লিখেছেন – “একে কি বাস্তবিক বাঁচা বলে, / রাত্রি? তাই বুঝি আমায় বাঁচাতে চাও নানা ছলে। / কিন্তু আমি তো হাড়মজ্জায় অনুভব করি আমার নিঃশ্বাস / ভাঙনের কাছে সঁপে-দেওয়া, ভাঙনের ধারেই আমার বাস।” সৌরভ আহমেদ সাকিবের কবিতাতেও বারে বারে এসেছে ভাঙনের কথা। কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতার প্রথম পংক্তিতেই উচ্চারিত হয়েছে – “চারিদিকে অন্তহীন ভাঙচুর”। ‘মরিবার সাধ’ কবিতার প্রথম স্তবকেই আছে এই ভাঙনের কথা, নিজের ভেঙে যাওয়ার কথা – “বহুবার ভেঙে যাই” আর দ্বিতীয় স্তবকে বলছেন “ এই হিমমগ্ন সময়ের ঘুম ভাঙে না বলে রক্ত হয়ে ওঠে নীল”। এই ঘুম ভাঙার প্রসঙ্গটি একটু ঘুরিয়ে বলছেন ‘ডিপ্রেশন বিষয়ক ২’ কবিতায় – “ভেঙে যাচ্ছে ঘুমহীনতার দৃশ্যপট’। বিড়ম্বনার ভাস্কর্য ভেঙে পড়ছে অন্ধকারের ভিতর। এসেছে যন্ত্রণার কথা – “তীব্র এক যন্ত্রণা নেমে যাচ্ছে শিরদাঁড়া বেয়ে”। এসেছে অন্তহীন অন্ধকারের দিকে যাত্রা করার কথা। আত্মধ্বংসের স্বরূপের কথা। ‘মিডনাইট ক্রাইসিস’-এ ‘ক্রমশ হনন করতে ইচ্ছে করছে নিজেকে’। আর এই হননেচ্ছার অন্তরালে রয়েছে ডিপ্রেশন নামক ভয়ানক ব্যাধি। তার সঙ্গে সঙ্গীরূপে রয়েছে সিজোফ্রেনিযা, ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার, ইনসমনিয়া, ডিমেনসিয়া, ডিলিউশন ইত্যাদি ইত্যাদি। এ থেকে উত্তরণের পথও রয়েছে কবিতায়। আরোগ্যের নিমিত্তে ব্যবহৃত একাধিক ওষুধের নামও পাওয়া যায় এ কাব্যে। যেমন – ক্লোনাজেপাম, ওলানজাপাইন, গ্লুটামেট, লোরাজেপাম, নরপাইনফ্রাইন প্রভৃতি।

দুঃখ, ভাঙন, যন্ত্রণা আর আধি ব্যাধিতেই এ কাব্য পরিপূর্ণ একথা বললে তা হবে অর্ধসত্য। কবির পাঠপরিধির বিস্তার অবাক করার মতো এবং কাব্যে তার প্রয়োগও করেছেন যথাযথরূপে। প্রায়ই অনেকে অভিযোগ করেন - এখন  সবাই লেখক, পাঠকের সংখ্যা খুব কম। ‘কেউ কিছু পড়তে চায় না, সবাই শুধু লিখতে চায়’। ‘দুঃখের প্রচ্ছদ নেই’ কাব্যে পাঠক সৌরভ আহমেদ সাকিব এবং কবি সৌরভ আহমেদ সাকিব একাত্ম হয়ে গেছেন। প্রথম কবিতা ‘ভাগ্যান্বেষী’তে পাঠক মিউজিক কম্পোজার সের্গেই গ্রিসচুকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে যাবেন। এই কম্পোজারের Alone with myself, My sadness, Lonely love সত্যি সত্যিই এক মগ্নতায় নিয়ে যায় আমাদের। লেবানিজ আমেরিকান কবি কাহলিল জিবরানের ‘দ্য প্রোফেট’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র আল-মুস্তাফা এবং নারী চরিত্র আলমিত্রার কথা এসেছে ‘মরিবার সাধ’ কবিতায়। কবিতার শুরুতেই উদ্ধৃত হয়েছে কাহলিল জিবরানের ভালোবাসা সংক্রান্ত উক্তিটি – Love has no other desire but to fulfill itself. এসেছে গ্রিক পৌরাণিক চরিত্র বংশীবাদক অর্ফিয়াসের কথা। ক্ষণস্থায়ী প্রেম বা প্রেমের ব্যর্থতা প্রসঙ্গে অর্ফিয়াস এবং ইউরিদাইসের গল্পকথা অনেকেরই জানা। এর আগে বাংলা কবিতায়  নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নিজেকে ‘অর্ফিয়াসের বাঁশরী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ‘ডিপ্রেশন বিষয়ক ২’ কবিতায় জার্মান রূপকথার গল্প ‘র‌্যাপুনজেল’-এর উল্লেখে বুঝতে পারি কবি তাঁর ভালোবাসার ধনকে কঠিন পরিশ্রমের দ্বারা ফিরিয়ে আনবেনই। তবুও তিনি ভয় পান। তাই ‘পাপ-পুণ্য’ কবিতায় আবার এসেছে অর্ফিয়াস আর ইউরিদাইসের কথা – “প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমিক বাঁশির দুঃখ জানে / অর্ফিয়াসও জানে ইউরিদাইসকে হারানোর যন্ত্রণা / হে কবি, তুমিও জানো না আত্মধ্বংসের স্বরূপ?/ বলো, জানো না?” ‘শীতের দিনগুলি’ কবিতায় এসেছে কানাডিয়ান লেখক কোরি ডকটোরোর রচনা পাঠের কথা। তারই সঙ্গে এসেছে ১৯৭৬ এ রিলিজ হওয়া ঈগলের ক্লাসিক রক গান “Hotel California”-র লিরিক্সের একটি অংশ – “So I called up the Captain/Please bring me my wine.” ‘যুদ্ধের বিপরীতে প্রেমের গান’-এ অবশ্যম্ভাবীরূপে এসেছে ইংরেজ কবি শিল্পী আইজ্যাক রোজেনবার্গের কবিতার কথা। ‘চ্যাপলিনের হাসি’তে রয়েছে মার্কিন অভিনেত্রী ভার্জিনিয়া চেরিলের কথা।‘মিডনাইট ক্রাইসিস’-এ গ্রিক পৌরাণিক চরিত্র নার্সিসাস নামক সুদর্শন এক যুবকের কথা, যে জলে নিজের প্রতিম্বিব দেখে নিজেরই প্রেমে পড়ে যায়। রয়েছে গ্রিক চন্দ্রদেবী সেলিন ও এনডিমিয়নের কথা। এনডিমিয়ন একজন সুদর্শন রাখাল এবং শিকারী রাজা। দেবী সেলিন তাঁকে ভালোবাসতেন এবং প্রতি রাতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। দেবতা জিউসের কাছে সেলিন এনডিমিয়নের জন্য অনন্ত যৌবন প্রার্থনা করেন। কীটসের কবিতাতেও এঁদের কথা আছে। ‘প্যালেস্টাইনের শিশু’ কবিতায় স্বাভাবিক ভাবেই উঠে এসেছে ফিলিস্তিনীয় কবি মাহমুদ দারবিশের কথা। কবি আফশোস করেছেন, “আজ যদি দারবিশ বেঁচে থাকতো!” কেননা নিজ জন্মভূমিতে অবৈধ অভিবাসী হওয়ার মতো বঞ্চনার বিরুদ্ধে তিনি লড়েছিলেন। ইজরায়েলী সৈন্যরা তাঁকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। তবুও তিনি প্রতিবাদী কবিতা লিখে লড়ে গেছেন। ‘শনিবার’ কবিতায় এসে গেল জেমস জয়েসের ছোটোগল্প ‘Araby’- প্রসঙ্গ। শুরুতেই উদ্ধৃত হলো – “She asked me was I going to Araby". শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যানগগ এলেন ‘দহন’ কবিতায়। ভ্যানগগ নিজেও ডিলিউশনে ভুগতেন। অবসাদের সিনড্রোম ছিল তাঁর। ভারতীয় উর্দু কবি এবং গজল লেখক জিগার মোরাদাবাদীর ধ্রুপদী গজলের প্রসঙ্গও এসেছে এ কবিতায়। ‘ইনসমনিয়া’য় রুশ সাহিত্যের বিখ্যাত কবি বরিস পাস্তেরনাকের কবিতায় ডুবে থাকার কথা যেমন এসেছে তেমনি একটি ‘রূপকথা’য় ভারতীয় উর্দু এবং হিন্দি কথাসাহিত্যিক কৃষণ চন্দর কথা। ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যাণ্ড’-এর কথা রয়েছে ‘স্মৃতিচারণের বাঁশি’তে। এভাবে সন্ধান করতে থাকলে একটার পর একটা রেফারেন্স চলে আসবে কেননা ‘ক্ল্যাসিক্যাল কনসার্ট’-এ কবি নিজেই জানিয়েছেন এক অনন্ত গ্রন্থাগারে বইয়ের রাজ্যে তিনি অবস্থান করেন।

শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শনের নানান গ্রন্থপাঠের অভিঘাত এ কাব্যে রয়েছে। মধুসূদনের মতোই বিশ্বসাহিত্য সমুদ্র মন্থন করে ‘দুঃখের প্রচ্ছদ নেই’ কাব্যগ্রন্থ তিনি নির্মাণ করেছেন। বিষ্ণু দের মতো নানান আপাত অপরিচিত উপমার প্রয়োগ করে শব্দ নির্বাচনে ছ্যুঁৎমার্গ পরিত্যাগ করে পাঠককে নিয়ে গেছেন এক ভিন্ন সুখের জগতে। তিনি সজাগ থেকেছেন জখমের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, বিভেদকামিতার বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার জন্য। ‘ভারতবর্ষ বনাম ভালোবাসা’ কবিতায় তাই নির্মিত হতে দেখি সম্প্রীতির এক স্বরলিপি।

*কাব্যগ্রন্থ : দুঃখের প্রচ্ছদ নেই
*কবি : সৌরভ আহমেদ সাকিব
*প্রকাশক : রবি প্রকাশ
*প্রকাশকাল : ১০. ০৬. ২৫
*উৎসর্গ : অধ্যাপক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Post a Comment

1 Comments