কমলিকা ভট্টাচার্য
শরীরের বুনন অনেকদিন আগেই জবাব দিয়েছে। জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছি। মুখার্জি বাবুর ভালোবাসায় তার কোমর জড়িয়ে যে কতকাল হলো, তার হিসেব তো আমারও মনে নেই। তবে শান্তিপুরে জন্ম—লাল টুকটুকে, কী চমকদার চেহারাখানা ছিল! সঙ্গে ছিল আমার জমজ ভাই।
চন্দননগর লোকালে একদিন আলাদা হয়ে গেলাম ভাইয়ের থেকে। সঙ্গে করে মুখার্জি বাবু বাড়ি নিয়ে এলেন। মিথ্যা বলব না—অনেক আদর যত্নেই রেখেছিলেন।
আমিও তাকে যথাসম্ভব আরাম দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ঘাম থেকে সর্দি, সব মেখেছি। তেলচিটে হয়ে গরম সোডা জলে কষ্ট পেয়েছি, তবু মুখে ‘রা’টি কাটিনি।
আবার জ্বরের সময় জলপট্টি হয়েছি, কখনও গরমকালে থেকে হাতপাখা, কখনও বা ঝাড়ন।
আমি ছিলাম তার অত্যন্ত প্রিয়। সকাল থেকে রাত—প্রায় সময়ই আমাকে শরীরে জড়িয়ে রাখতেন। রাতে শোবার সময় মাথার কাছে রাখতেন।
🍂
তবে জীবনে ক্ষয় অবশ্যম্ভাবী।
আগের মতো লালিমা, জৌলুস—কোনোটাই আর নেই। তবু মুখার্জি বাবু আমাকে কখনও হেনস্থা করেননি। আজও আমি তার কাছে সেই একইরকম প্রিয়।
তাই অনেকদিন ধরে মুখার্জি গিন্নি ওনার উপর রাগ করেছেন, কিন্তু তিনি কথায় কান দেননি নতুন কাউকে আনেন নি।
আজ সকাল থেকে মনটা বড় কু ডাকছিল।
কাল গিন্নিমা বাজারে গিয়েছিলেন। উঠোনের রোদে পুড়তে পুড়তে এক ঝলক তার হাতে প্লাস্টিকের ভেতরে আমার নতুন জীবনের মত কিছু দেখেছিলাম।
মুখার্জি বাবু বাজারে গেছেন। গিন্নিমা কাজের মেয়ে দুলারিকে ডেকে বললেন,
— "বাবু এখন বাজারে গেছে, তাড়াতাড়ি ওটাকে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেল।"
দুলারি বলল,
— "কাকিমা, ছেড়ে ন্যাতা বানাই?"
মুখার্জি গিন্নি বললেন,
— "যা পারিস, কর।"
আমি টুকরো টুকরো হয়ে ঝাঁটা-বালতির ধারে পড়ে রইলাম। বাজার থেকে মুখার্জি বাবু ফিরে এসে আমার খোঁজ করতে লাগলেন।
আমি চিৎকার করে বলতে চাইলাম, “আমি এখানে " কিন্তু আমি যে গামছা!
আমার কথা উনি কী করে শুনবেন?
মুখার্জি গিন্নি এগিয়ে এসে নতুন গামছাখানি মুখার্জীবাবুর হাতে দিলেন।
মুখার্জিবাবু সেটিকে হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইলেন।
তারপর সেটি দিয়ে নিজের চোখের কোণ মুছে স্নানে গেলেন।
এর আগে এত বছর মুখার্জি বাবুর এত কাজে এসেছি—কিন্তু কোনোদিন চোখের জল মুছিনি।
2 Comments
সুন্দর লেখা, গামছার আত্মকথা!
ReplyDeleteখুব সুন্দর লেখা....দিদি,দেবুদা
ReplyDelete