জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে(ষোড়শ পর্ব)/মলয় সরকার

জিপাকিরাতে লবণ খনির প্রবেশপথ

মার্কেজের খোঁজে
(ষোড়শ পর্ব)

মলয় সরকার


জুলিয়া আমাদের দুই বুড়োবুড়িকে বাধ্য ছাত্রছাত্রীর মত অনেক কিছু ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল। ওর জন্যই দেখতে পেলাম, এই মিউজিয়ামে একটা ল্যাবোরেটরীও রয়েছে, যেখানে এই সমস্ত জিনিসগুলি কিভাবে তৈরী হয়েছে বা তার সম্বন্ধে বিশদে গবেষণা হয়, যা সাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
এখানে দেখি বিভিন্ন ঘরে এখনও জিনিসপত্র নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে, নানা আধুনিক যন্ত্রপাতি সহ। 
এখানে ঘুরতে ঘুরতে সত্যিই হারিয়ে গিয়েছিলাম অন্য এক জগতে।এখানে না এলে যে একটা বিরাট জগত না জানা থেকে যেত তা হলফ করা বলা যায়।

এখান থেকে বেরিয়ে দেখি দু তিনটি সুন্দরী মেয়ে ঘুরছে সাদা লেসের পা পর্যন্ত হাত ঢাকা জামা পরে। তাদের জামায় কলম্বিয়ার জাতীয় পতাকার রঙের ফ্রিল দেওয়া, মাথায় ফুল গোঁজা , তবে এরা সেই ঠিক প্যালেঙ্কেরো মেয়েদের মত নয়, মাথায় ফলের ঝুড়িও নেই আর ওদের মত কালোও নয়। সম্ভবতঃ এরা পর্যটকদের সাথে ছবি তোলার জন্য ঘুরছে। তাতে যা দু’ পয়সা পাওয়া যায়।
প্লাজা ডেল মিনেরো - আড্ডা মারার জায়গা

বের হয়ে আমরা খানিকক্ষণ বসলাম সামনের পার্কে। এই পার্কের নাম আগে ছিল Plaza de la Hierbas। যখন স্প্যানিশরা প্রথম এখানে আসে, তখন এখানে বসত বিশাল বাজার। একসময়ে এই অঞ্চল ছিল বোগোটার মধ্যমণি। এখানে তৈরী হয়েছিল বেশ কয়েকটি চার্চ, এবং সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং Avianca।  এ ছাড়া Banco de la Republica ও এর কাছেই।পরে এর নাম হয় Plaza de la San Francisco । এর মাঝে একটি ত্রিমুখী ফোয়ারা রয়েছে। চারধারে বসার অনেক জায়গা রয়েছে। আপাততঃ কিছু ভবঘুরে ধরণের লোক বসে রয়েছে ওখানে। এছাড়া জায়গাটি পরিষ্কার।চার ধার দিয়ে রয়েছে রাস্তা। লোক চলাচলও প্রচুর। আমরা খানিকক্ষণ বসলাম , গাছপালায় ঘেরা সুন্দর জায়গাটিতে, এতক্ষণ দাঁড়িয়ে জিনিসপত্র দেখে ক্লান্তি কাটানোর জন্য।মাঝে রয়েছে স্প্যানিশদের হাত থেকে নিজের দেশকে ছিনিয়ে আনার লড়াইয়ের এক কলম্বিয়ান বীর ফ্রান্সিস্কো পল সান্তান্দরের মূর্তি। তাঁর নামে একে  Plaza de Santanderও বলা হয়।
কিছুক্ষণ বসে ধীরে ধীরে এগোলাম বাড়ির দিকে । তখনও দেখি মার্কেজ কালচারাল সেন্টারে অনেক লোক বসে আলোচনায় ব্যস্ত।খুব ইচ্ছা করছিল এখানে ঢোকার। কিন্তু এটা তো রবীন্দ্র সদনের মত অডিটোরিয়াম।  ভিতরে ঢুকে আর কি পাব! 

আবার গিয়ে চা আর অল্প টিফিন খাওয়া হল সেই আমাদের সকালের চায়ের দোকানে। তারা তো আমাদের খাতির করে বসাতে ব্যস্ত। আমরা একদিনেই যেন তাদের কাছে বিরাট সম্মানিত অতিথি হয়ে গেছি।

পরদিন আমাদের যাওয়া এক বিচিত্র জায়গায়।এই জায়গাটি বোগোটার ৫০ কিমি উত্তরে। জায়গার নাম জিপাকিরা (Zipaquira)।এই অঞ্চলে বাস করত মুইস্কা আদিবাসীরা। তাদের রাজাকে বলা হত জিপা। জিপাকিরা নামটির অর্থ জিপার জায়গা বা দেশ। অর্থাৎ এই জায়গাটি বহু প্রাচীন।স্প্যানিশরা আসার বহু পূর্বে প্রায় খ্রীঃপূঃ পঞ্চম শতাব্দী থেকে মুইস্কারা এখানে এক রকসল্ট বা পাথুরে লবণের সন্ধান পায়। যার ফলে তারা এতদঞ্চলে অর্থনীতিতে উন্নত হতে পেরেছিল। তারা এই লবণ রপ্তানী করত দক্ষিণ আমেরিকার বহু স্থানে। ৬৬০ ফুট মাটির নীচে অবস্থিত এই লবণের খনি সারা পৃথিবীর কাছে এক বিস্ময়।আর তার চেয়েও বড় কথা, বোগোটাতে এসে মার্কেজের স্থান হয়েছিল এখানকারই স্কুলে, যে স্থান তিনি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন, নিজের কৃতিত্বে। আর এখানেই তাঁর লেখালিখির জগতে প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত হয়।

সাম্প্রতিক ভাবনা / মৌমিতা চ্যাটার্জী

আমাদের যাওয়া আজ একটি স্থানীয় ছেলের সঙ্গে গাড়িতে।সকালেই সঠিক সময়ে এসে গেল গাড়ি। এখানে গ্রিড ধরণের রাস্তাগুলো সোজা সুজি হওয়ায় তার আশেপাশে যে গলির মধ্যে যে বাড়ি, তাতে গাড়ী ঢোকা মুস্কিল। মাঝের গলিটুকু পায়ে হেঁটেই যেতে হয়, যদিও অল্পই।ড্রাইভার ছেলেটির নাম উইলিয়াম। ছেলেটিকে প্রথমেই বললাম, দেখ বাবা , আমরা তোমার সঙ্গে যাচ্ছি, তুমি কিন্তু আমাদের গাইডের কাজ করবে। যা তুমি দেখাবে তাই আমরা দেখব, যা দেখাবে না তা কিন্তু আমাদের জানা থেকে বাদ পড়ে যাবে। উইলিয়াম একটি কম বয়সী ছেলে।সে একেবারে সজোরে ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই।

গাড়ি তো আমাদের বাড়ির পাহাড়ী রাস্তার গলি রাস্তা ছেড়ে বেরিয়ে এল বিরাট চওড়া রাস্তায়। আমরা তো প্রথমে ভেবেছিলাম , এখানে সবই বুঝি এই রকম গলিঘুঁজি। তা নয়। ওটা হল আদি পুরানো স্প্যানিশ কলোনী, আর এর বাইরে রয়েছে বর্তমান শহর , যা,যথেষ্ট উন্নত ধরণের। 
এখানে একটা জিনিস, কার্তাহেনাতেও দেখেছি, এখানেও দেখলাম, দেওয়াল পেলেই ওরা নানা ধরণের সুদৃশ্য ছবি এঁকে রেখেছে। সেটা হয়ত বিজ্ঞাপন বা প্রতিবাদ বা নিছকই শিল্পকর্ম। একটু চড়া রঙ দিয়ে আঁকা বড় বড় ছবি রাস্তার বা বাড়ির দেওয়াল জুড়ে।ছবিগুলোর , বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ,নান্দনিকতা যথেষ্ট। আশ্চর্যের কথা, সেগুলোকে কিন্তু কেউ বিকৃত করে ছবির সৌন্দর্য নষ্ট করে নি।এর ফলে শহরটার একটা আলাদা সৌন্দর্য্য এসেছে চারিদিকে।

আমরা চললাম, উইলিয়ামের সঙ্গে বকবক করতে করতে। ও দেখাল এখানকার স্টেডিয়াম, বড় স্কুল, বাজার, ট্রান্সমিলানিও র‍্যাপিড বাসের রাস্তা। আমরাও দেখতে দেখতে চললাম নতুন যুগের নতুন শহরের রাস্তাঘাট , ঘরবাড়ি। জাতীয় রাস্তা ৪৫এ ধরে চলেছি সোজা জিপাকুরার দিকে। রাস্তা বেশ পরিচ্ছন্ন। মাঝে চওড়া বুলেভার্ডে গাছ লাগানো রয়েছে। সবাই নির্দিষ্ট লেন মেনে চলেছে। অহেতুক, এখানকার মত হর্ণ নেই। এটা অবশ্য পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। আওয়াজ দূষণ ভারতের মত, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার মত, মনে হয় কোথাও নেই। এর কারণ, এর জন্য কোন নিয়ম নেই, শাস্তিও নেই। কেউ কি বলবেন, চীন জাপান আমেরিকার থেকে ভারতের গাড়ি বেশি! তা নয়, ওটা আমাদের চরিত্রের দোষ, যা সারা পৃথিবীতে কোথাও নেই।এই দূষণ নিয়ে আমরা যত চেঁচাই, তার এক শতাংশও সত্যি, এর নিরসনে প্রয়োগ করি না।
যাক, এখানে এই জায়গাটায় অবশ্য মানুষের ভিড়ও অত নেই।দেখতে দেখতে আমরা ছাড়িয়ে এলাম বোগোটা শহর। এবার অনেকখানি ফাঁকার মধ্যে দিয়ে যাওয়া। দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের সারি। আমরা চলেছি সে দিকেই। উইলিয়াম বলল, ওই দূরে দেখুন আন্দিজ পর্বতমালা। আমাদের দেশের চারিদিকেই আন্দিজ।
🍂
ad

এই আন্দিজের যখন জন্ম হয় প্রকৃতির বুকে সেই ২৫কোটি বছর আগে, সেই তখনই জন্ম হয়েছিল এই পাথুরে নুনের বিশাল সম্ভারের, যা আবিষ্কার করেছিল, তৎকালীন আদিবাসী মুইস্কারা।এই জায়গাতেই পৃথিবীর আদিমতম আমেরিকান মানুষের সৃষ্টি হয়েছিল বলে মনে করা হয়।চারিদিকেই শুধু ফাঁকা মাঠ,   ছিন্নবিচ্ছিন্ন দু’ একটা ছোটখাট জনপদ আর দূরে পর্বতমালার সীমারেখার দিকে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। মাঝে মাঝে আসছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।
মিউজিও ডেল স্যাল্মুয়েরা বা খনি মিউজিয়াম , পিছনে খনি শ্রমিকের মূর্তি

একসময়ে আমরা একটা রাস্তার উপরে বানানো গেট অতিক্রম করলাম। বুঝলাম এসে গেছি আমাদের গন্তব্যে।জায়গাটির নাম জিপাকিরা (Zipaquirá)। আমরা ঢুকলাম একটি গলি মত রাস্তা দিয়ে তার মাথার উপরে লেখা রয়েছে প্লাজা ডেল মিনেরো (Plaza del Minero)। এগোলাম আমরা।
ওরা যেখানেই পারে প্লাজা বানায়, এটা স্পেনীয় রীতি। আসলে সব কিছুর সঙ্গেই ওদের আড্ডা, গান, মজা আর বিশ্রাম, সেই সঙ্গে সৌন্দর্য্য চাই ফোয়ারার বা গাছের। রাস্তা ঘাটে ওদের তরুণদের দেখি , মাঝে মাঝে বাজনা বাজিয়ে গান করছে।এই যে স্প্যানিশ গীটার, সে তো এদেরই।আমাদের দেশের অনেক সুরকারই এই স্পেনীয় সুর নিয়ে গানে সুর করেন।এই প্লাজা হল ওদের রাস্তাঘাটের একটা আবশ্যিক অঙ্গ।ওরা মনে করে, এতে কর্মক্ষমতা বাড়ে আর কাজ হয় আনন্দে। আমাদের ভিতরে এটা নেই। তাই সবাই সব কাজ করে দায়সারা ভাবে অবহেলায়,  পরের কাজ করে উপকার করে দিচ্ছি, এই মনোভাবে বা কাজের প্রতি অনীহায়। এতে সমস্ত কাজেরই ক্ষতি হয়।

গাড়ি রেখে আমাদের বলল উইলিয়াম, আপনারা দাঁড়ান, আমি টিকিট কেটে আনছি। আমরা চারিদিক তাকিয়ে দেখি, আশে পাশে পার্কের মত করা রয়েছে। সেখানে খেলছে বহু স্কুল ছাত্রছাত্রী। হয়ত তাদের কোন স্কুল থেকে শিক্ষকরা দেখাতে এনেছেন। এ ছাড়া রয়েছে একটা মুক্ত ক্যান্টিন, যার সামনে অনেক চেয়ার। অনেকেই টিফিন সারছেন।
এ ছাড়া রয়েছে একটি বড় খনিশ্রমিকের মূর্তি মাটিকাটায় রত।সামনে লেখা রয়েছে, Museo de la Salmuera।
একটু পরে টিকিট কেটে এনে উইলিয়াম আমাদের হাতে দিয়ে বলল, আপনারা এগিয়ে যান, ফেরার সময় বাইরে এসে আমাকে ডাকবেন, আমি সামনেই থাকব। কোন চিন্তা নেই।
ক্রমশঃ-
সঙ্গে থাকুন বন্ধুরা। পরদিন দেখব খনির ভিতরে কি রয়েছে–

Post a Comment

0 Comments