জ্বলদর্চি

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি ( অষ্টম পর্ব) /চিত্রা ভট্টাচার্য্য

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি  ( অষ্টম পর্ব) 

চিত্রা ভট্টাচার্য্য

(প্রেমিক কবি নজরুল )

"জীবন তরীর  চলন্ত দাঁড় " ঠেলে এগিয়ে চলা নজরুলের  প্রাণে  স্বাভাবিক ছন্দেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্ৰেম এসেছিল নীরবে। তবু তার উন্মাদনায় কবি প্রেমের সাগরে ডুবে ছিলেন যেমন  একই সাথে তারই আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন । কবিহৃদয়ে তার আগমন ঘটেছিল সাগরের  লবণাক্ত সফেন উত্তাল তরঙ্গের মত ।  জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে যে প্রেমের নীরব সংকেতে, আকাঙ্ক্ষায় মন উন্মত্ত থাকে সে উপলব্ধি ও নজরুল করেছিলেন। তাই তিনি অনায়াসে লিখেছেন,
            
 "আজি হেথা রচি’ নব নীপ-মালা–
স্মরণ পারের প্রিয়া, একান্তে নিরালা
অকারণে !-জানি আমি জানি
তোমারে পাব না আমি। এই গান এই মালাখানি
রহিবে তাদেরি কন্ঠে- যাহাদেরে কভু
চাহি নাই, কুসুমে কাঁটার মত জড়ায়ে রহিল যারা তবু।"

 ‘ আমরা এই পৃথিবীতে প্রেমের পূজারী হয়ে থাকি।’
যিনি ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, খোঁপায় দেব তারার ফুল’ --

পার্থিব প্রেমের বিশ্বাসহীনতা ও ক্ষণস্থায়িত্বের অভিজ্ঞতা প্রেমিক নজরুলকে প্রেমের প্রতি নিরাসক্ত করে তুলেছিল। প্রেমের জন্য নারীর কাছ থেকে তিনি চেয়েছিলেন পূর্ণ আত্মসমর্পণ কিন্তু কোথাও তিনি তা পান নি। অমর এক প্রেমের জগতে আত্মার শান্তি খুঁজে ফিরেছিলেন, যেখানে প্রেম বিচ্ছেদের জ্বালায় কুলষিত হয়ে ওঠে না। অবশেষে তিনি তার কাঙ্ক্ষিত প্রেমকে সুন্দরতর আর এক জগতে খুঁজে ফিরেছেন,                                                                    যেখানে প্রেমে ছিলনা কোন নৈরাশ্য, কোন বেদনা। তা ছিল সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রেম। পার্থিব প্রেমকে বিদায় দিয়ে নজরুল লেখেন,
স্বপন ভেঙে নিশুত্ রাতে জাগবে হঠাৎ চমকে,
কাহার যেন চেনা-ছোঁওয়ায় উঠবে ও-বুকে ছমকে,-
জাগবে হঠাৎ চমকে !
ভাববে বুঝি আমিই এসে
ব’সনু বুকের কোলটি ঘেঁষে,   
 ধরতে গিয়ে দেখবে যখন
শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন!
বেদনাতে চোখ বুঁজবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে! ”

প্রেমবিষয়ক কাব্যেও তার বিক্ষুব্ধ মনের পরিচয় পাওয়া যায়। বঞ্চিত হওয়ার বেদনায় তিনি মানবিক হয়ে উঠেছেন।  নজরুলের কাব্যে  সুপ্ত প্রেমের চেতনা যেমন জেগে উঠেছে, তেমনি প্রকৃতি পরিবেশ ও পৃথিবীকে মায়াজালের স্পর্শে পূর্ণ করে তুলেছে। সময়ের প্রয়োজনেই তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বিদ্রোহী বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। মানুষকে তিনি ভালবাসতেন, তাই মানুষের মহত্তম বৃত্তি প্রেমকে তিনি আত্ম অনুভবে দীপ্ত করে তুলেছেন তাঁর কবিতার অধিকাংশ স্থানে ।বাংলা সাহিত্যের কাব্যাকাশে কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বিদ্রোহী কবি হিসেবে নন প্রেম প্রকৃতির কবি রূপে বিরাজিত এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর কবিতা ও গানে বারেবার ফুটেছে প্রেমের ফুল। আর প্রেমের গানে নজরুল জয় করেছেন অজস্র প্রেমিকের মন। তাঁর নিজেরই স্বীকারোক্তি :--
                        ''মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি,
                                  আর হাতে রণ -তূর্য্য’—

একদিকে কবির  সৃষ্টি  অনবদ্য সব প্রেমের কাব্যগীতি ও কবিতা । ভেসেছেন মানবিকঐশ্বর্য্য বুক ভরা ভাল বাসার জোয়ারে ,মায়াজালের বাঁধনে।  জড়িয়ে ছিলেন হৃদয়ের সাথে পরমা প্রকৃতিকে।অন্যদিকে সকল অন্যায় অবিচার অমানবিকতার বিরুদ্ধে অহর্নিশ প্রতিবাদের ঝঙ্কার তুলেছেন। কবির বিশাল হৃদয়ের দ্বার উন্মুক্ত ছিল  আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা আপামর নারী পুরুষের সুখদুঃখের সাতকাহনে। মহান এই কবিকে শুধু ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে আখ্যা দিলে নিঃসন্দেহে তার মানসকে খণ্ডিত করে দেখা হবে। কারণ তিনি দ্রোহের কবি যেমন সত্য, প্রেমের পূজারী  ,প্রকৃতির কবি রূপে ও ততটাই সত্য। নজরুলের হৃদয়ের গভীরে মহত্তম বৃত্তি প্রেমকে আত্ম-অনুভবে দীপ্ত করে তুলেছিল। চিরন্তন সেই বাণীতে এসেছে শাশ্বত কালের চাওয়া কোমল হূদয়ের আবেদন। প্রকৃতি ও মানব প্রেম সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ হয়ে তাঁর ধমনীতে ফল্গু ধারার মত প্রবাহিত হয়েছে।  মূলত জীবনের প্রতিপদক্ষেপে গভীর বঞ্চনাবোধে বিদ্রোহী হয়েছিলেন তিনি এবং বারংবার প্রিয়তমার থেকে অপ্রত্যাশিত আঘাতে প্রেমে ও  ছিলেন চিরবিরহী।  
🍂

 
  সারাটি জীবন দুঃখের অনলে পুড়লে ও  দমকা বাতাসের মত হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে সুখ যখন তার ঘরের দাওয়ায় ,নিভৃত কুটিরের দ্বারে এসে কড়া নেড়েছে তখন তিনি নির্বাক, নির্বিকার। তাঁর জীবনের পর্যালোচনায় দেখাযায়, শৈশব থেকে পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য সংগ্রামী কবি কৈশোরে যুদ্ধে গিয়েছেন। শৃঙ্খলিত দেশমাতৃকার মুক্তির বাসনায় উৎসর্গীকৃত প্রাণ । সারা বাংলার মানুষকে ব্রিটিশ রোষানল, অত্যাচারীর খড়্গহস্ত থেকে মুক্ত করতে নির্দ্বিধায় কলম চালিয়েছেন। তাঁর কবিসত্তাকে চিরজাগ্রত রেখেছে হূদয়ের গভীরে পুঞ্জীভূত অভিমান । প্রেমকে যত্নে লালন করেছেন স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে , হারানোর স্মৃতির মাঝে  নিত্যকালের সঙ্গী প্রিয়াকে খুঁজে ফিরেছেন।হূদয়ের গভীর মর্মবেদনায়  -কবিসত্তাকে চিরজাগ্রত করে তুলেছে। আঘাতে জর্জরিত বল্গাহারা নজরুল প্রিয়াবিরহকে একটা সময় মেনে নিয়েছিলেন এবং পরজন্মে  আবার মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় লিখেছিলেন—
‘পরজনমে দেখা হবে প্রিয় ভুলিও মোরে হেতা ভুলিও...’ 
বিরহী কবি চেয়েছিলেন তার প্রিয়ার খোঁপার বাঁধনকে উন্মুক্ত করতে। যে উন্মুক্ততায় প্রেমের কোনো সীমাবদ্ধতা থাকবে না। প্রেম হবে চিরন্তন, সার্বজনীন। প্রাত্যহিক জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে যে প্রেমের নীরব সংকেতে,   মন উন্মত্ত থাকে সে উপলব্ধিও নজরুল করেছিলেন। তাই তিনি অনায়াসে লিখেছেন,

‘ আমরা এই পৃথিবীতে প্রেমের পূজারী হয়ে থাকি/
 ’যিনি ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, খোঁপায় দেব তারার ফুল’ --

  যৌবনে যাদের ভালোবাসতে পারেননি, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন অবেলার ডাকের কবিতার মাধ্যমে । এই প্রসঙ্গের আলোচনায় স্বভাবতঃই কবি নজরুলের বঞ্চিত রূঢ় বাস্তব জীবনে প্রেমের ব্যর্থতা না পাওয়ার হতাশার কাহিনি মনে আলোড়ন তোলে। প্রেমিক কবির জীবনে প্রিয় দু’ই নারী -- একজন নার্গিস অন্য জন তাঁর স্ত্রী প্রমীলা। কবির প্রথম প্রেম যৌবনের বনে ঝরা ফুল ,স্বপ্নের সুন্দরী  -নার্গিস  তথা নজরুল -নার্গিস ট্র্যাজেডি। পৃথিবীর ইতিহাসে অশ্রু সজল এক ব্যর্থ প্রেমের কাহানি ।  তাঁর জীবনীকারদের মতে কবির হৃদয়ের দুই সারথী -" একজন চাঁদ তো অন্যজন ছিলেন নীল সরোবর।" 

 ভবঘুরে উদাস বাউল পথিক নজরুল ,অজানা পথের হাতছানিতে তাঁর চরৈবেতির আনন্দ। সেনাবাহিনীর চাকরি শেষে ২১ বছরের সদ্য যুবক কলকাতায় ফিরে এলেন। এবং মেসে থাকার সুবাদে আলী আকবর খানের সঙ্গে নিবিড়বন্ধুত্ব গড়ে ওঠায় কুমিল্লায় দৌলতপুরে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। বাগান ঘেরা বাঁধানো পুকুর ঘাটে বসে বাঁশের বাঁশিতে মনের আনন্দে সুর তুলতেন আত্মভোলা কবি। এক নিশুতি রাতে বাঁশির সুরে ষোড়শী নার্গিসের মনে বসন্তের সমীরণ হিল্লোল তোলে । হৃদকমলে জাগায় স্পন্দন। নার্গিস নজরুলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁর বাঁশির সুর-সুধায়  বিমোহিত হয়েছিলেন।  প্রেমিক কবি কে রূপসী প্রেয়সী মনের গোপন কথা নিবেদন  করলেন।  নজরুল নার্গিসকে নিয়ে বেশ কিছু আবেগঘন কবিতা লিখেছেন, যেখানে তার বিরহ, বেদনা এবং প্রেম-ভালোবাসার গভীরতা প্রকাশ পেয়েছে। দৌলতপুরে বসেই ১৬০টি গান এবং ১২০টি কবিতা রচনা করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলোর মধ্যে- ‘বেদনা-অভিমান’, ‘অবেলা’, ‘অনাদৃতা’, ‘পথিক প্রিয়া’, ‘বিদায় বেলা’ প্রভৃতি। অকপটে তাই বলাযায়  নজরুলের জীবনে যদি নার্গিস না আসতেন তাহলে হয়তো বাংলা সাহিত্য ভান্ডারের এই অমূল্য সম্পদ থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম। কবি "ছায়ানট", "পূরবের হাওয়া", "চক্রবাক" কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায় নার্গিসকে কেন্দ্র করে লিখেছেন। নার্গিসের প্রতি তার গভীর প্রেমের  প্রকাশ "বেদনা-অভিধা", "অ-বেলায়"কবিতায় দেখা গেছে। 
 
কুমিল্লায়  বিয়ের বাসর ঘরের থেকে প্রথম রাতে নজরুলের চলে যাবার পর তাঁর প্রিয়তমা  নার্গিসের কাছ থেকে  কবি একটি পত্র পেয়েছিলেন। এবং প্রায় পনেরো বছর পর সেই চিঠির উত্তর নজরুল দিয়েছিলেন একটি গানের মাধ্যমে। - 
“যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, কেন মনে রাখ তারে্। 
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে্।।” 

কিন্তু প্রেমিক কবি তাঁর নার্গিসকে কখনো ভোলেন নি। এতবছর পর প্রত্যুত্তরে লেখা কবির আবেগময় সে চিঠি নার্গিসের হৃদয় প্লাবন তুলেছিল । যে চিঠিখানা বিশ্বের সেরা প্রেমপত্রের একটি।  যেখানে তাঁদের পবিত্র প্রেমের ভালবাসার রূপ চির শাশ্বত হয়ে রয়েছে। এই চিঠির জন্য নার্গিস-নজরুলের প্রেমের উপাখ্যান বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব পেয়েছে । 
 
""কল্যানীয়াসু,                                                                                                                                                             তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নব বর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে।মেঘ মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল ।পনর বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি এক বারি ধারায় প্লাবন নেমেছিল– তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো ।আষাঢ়ের নবমেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার ।এই মেঘদূত বিরোহী যক্ষের বানী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তার প্রিয়ার কাছে ।এই মেঘ পুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চার ।এই আষাঢ় আমায় কল্পনার স্বর্গ লোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে । যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দেই । তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য । লোকের মুখে শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাকো,তাহলে আমায় ভুল বুঝবে- আর তা মিথ্যা ।
তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করিনা –এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি ।আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি আসীম বেদনা ! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি—তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি । তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না—আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না । তোমার যে কল্যান রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার আঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের সে আগুন- বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি ।তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি—আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি । অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয় । আমার আঘাত বর্বরের কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয়।আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জান বা শুনেছ জানিনা) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই ।

তোমার আজিকার রূপ কি জানিনা । আমি জানি তোমার সেই কিশোরি মুর্তিকে, যাকে দেবী মূর্তির মতো আমার হৃদয় বেদীতে অনন্ত প্রেম,অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম । সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলেনা। পাষান দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদিপাঠ জীবন ভ’রে সেখানেই চলেছে আমার পূজা আরতি। আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা,ব্যর্থ ; তাই তাকে পেতে চাইনে । জানিনে হয়ত সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব,অধিকতর বেদনা পাব,--তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি । 

দেখা? না-ই হ’ল এ ধূলির ধরায় । প্রেমের ফুল এ ধূলিতলে হয়ে যায় ম্লান দগ্ধ ,হতশ্রী ।তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালবাস আমাকে চাও ওখান থেকেই আমাকে পাবে ।লাইলি মজনুকে পায়নি, শিরি ফরহাদকে পায়নি, তবু তাদের মত করে কেউ কারো প্রিয়তমাকে পায়নি ।আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও প্রেম সত্য ।আত্মা অবিনশ্বর,আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারেনা । প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাকো, তাহলে তোমার মতো ভাগ্যবতী আর কে আছে ? তারি মায়া স্পর্শে তোমার সকল কিছু আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে । দুঃখ নিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই সেই দুঃখের অবসান হয়না।মানুষ ইচ্ছা করলে সাধনা দিয়ে, তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুল রূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে । যদি কোনো ভুল করে থাক জীবনে, এই জীবনেই তাকে সংশোধন করে যেতে হবে; তবেই পাবে আনন্দ মুক্তি; তবেই হবে সর্ব দুঃখের অবসান । নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা করো, স্বয়ংবিধাতা তোমার সহায় হবেন । আমি সংসার করছি, তবু চলে গেছি এই সংসারের বাধাকে অতক্রম করে উর্ধ্ব লোকে—সেখানে গেলে পৃ্থিবীর সকল অপূর্ণতা, সকল অপরাধ ক্ষমা সুন্দর চোখে পরম মনোহর মূর্তিতে দেখা যায় ।…হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনর বছর আগের কথা । তোমার জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি ।তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিলো জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুন মিনতি । মনে হয় যেন কালকের কথা । মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারলেননা। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল । সারা দিন রাত আমার চোখে ঘুম ছিল না । 

যাক আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষে রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করোনা । তোমাকে লিখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক ।যেখানেই থাকি বিশ্বাস করো আমার অক্ষয় আশির্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে । তুমি সুখি হও, শান্তি পাও— এই প্রার্থনা । আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই –এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ ।

ইতি—

নিত্য শুভার্থী—নজরুল ইসলাম।"                     
 ক্রমশঃ

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousJuly 28, 2025

    নৈসর্গিক প্রেম ও মানবীয় প্রেমের এক অসাধারণ সমাবর্তন দিক, কবি নজরুল ইসলামের জীবনের উপর তার প্রভাবের প্রেক্ষাপট লেখার মাধুর্যে প্রস্ফুটিত হয়েছ। ভীষণ ভালো লাগলো দিদি।

    ReplyDelete