জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -১৮৪

১৮৪ তম ছোটোবেলা

চিত্রগ্রাহক - রাজীব কুমার ঘোষ

জঙ্গল মহলের গল্প

আপদ বিদায়

চিন্ময় দাশ


অভাবি মানুষজনদের গ্রাম। গ্রামটা শেষ হলেই বন। বউ-ছেলেপুলে নিয়ে, সেই বনে থাকে এক শেয়াল।

একদিন দূপুর গড়িয়েছে। শেয়াল বেরিয়েছে শিকারে। কিন্তু কপাল এমনই মন্দ, কিছুই জুটছে না কোথাও। কী করা যায়, কী করা যায়? ঘরে বউ-ছেলেপুলে হাঁ করে বসে আছে। অন্তত তাদের জন্য তো কিছু জোগাড় করতেই হবে। 

কিন্তু ভাবলেই তো হল না! কোন কিছুই তো চোখে পড়ছে না। একটা বনমোরগ তো দূরের কথা, নেহাত একটা ধেড়ে ইঁদুরের লেজটুকুরও দেখা নাই।

ঘুরতে ঘুরতে বেলা চলে যায় যায়। সূজ্যিমামা ঢলে পড়েছে। মেজাজ বিগড়ে গেছে শেয়ালের। এমন সময় একটা কচর-মচর শব্দ। 

ভর সন্ধ্যেবেলা। এমন শব্দ আসে কোথা থেকে? একটু চমকে গেল শেয়াল। সুড়ুৎ করে একটা শালগাছের আড়ালে সেঁধিয়ে গেল।

শব্দটা এগিয়ে আসছে একটু একটু করে। শেয়াল দেখতে পেয়ে গেল, একটা গরুর গাড়ি আসছে নদীর দিক থেকে। গাড়িটা কাছে এলো যখন, লোকটাকেও দেখতে পাওয়া গেল।

গাঁয়ের কাছেই থাকে শেয়াল। বলতে গেলে, সবাইকেই চেনে সে। দেখল, গাড়িতে মাঝিপাড়ার একটা লোক। ডুলুং নদী থেকে মাছ ধরে ঘরে ফিরছে। বলদ দুটো চলেছে দুলকি চালে। লোকটাও গান ভাঁজছে গুনগুন করে। তার পিছনে গাড়িতে ভেজা জালের সাথে, মাছ ডাঁই করে রাখা।

শেয়ালের আনন্দ তখন ধরে কে? গোটা সংসারের মহাভো্জ হয়ে যাবে আজ। চোখ দুটো চকচক করে উঠল। আহা, কী সুখের দিন আজ তার! এখন কেবল একটা ফন্দি করা দরকার। 

 গাড়িটা এগিয়ে যেতেই, গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে এল শেয়াল। গুটি গুটি পায়ে গাড়ির পিছনে এসে হাজির হোল। তারপর ছোট্ট একটা লাফ। 

কিন্তু ঐ লাফটুকুই হোল। কাজের কাজ কিছুই হোল না। গাড়ি এগিয়ে গেল, ধপ করে শেয়াল পড়ে গেল মাটিতে। 

উঠে, আবার একটা লাফ। কিন্তু আবারও মাটিতে। আসলে, হয়েছে কী জোরে লাফ দিয়ে পড়লে, ঝাঁকুনিতে লোকটা টের পেয়ে যাবে। তাই আস্তে লাফাতে হচ্ছে। তাতেই মাটিতে গড়াগড়ি।

কী করা যায়, কী করা যায়? এমন সোনার সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। কিন্তু শেয়াল ভারি ধুরন্ধর জীব। গতরে না কুলালো তো কী হয়েছে? মগজ আছে না। মগজের জোরেই খাবার জোগাড় করতে হবে আজ।

আবার সুড়ুৎ করে বনে ঢুকে পড়ল শেয়াল। দৌড় পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল খানিকটা। রাস্তাটার একটা বাঁকের কাছে পৌঁছে, খেলা শুরু হল শেয়ালের।

খানিক বাদে লোকটা এসে পৌঁছেছে বাঁকের মুখে। দেখে কী, রাস্তার মাঝখানে একটা শেয়াল শুয়ে আছে। শুয়ে আছে তো শুয়েই আছে। নড়েও না, তো চড়েও না। গরুর গাড়ির চাকার শব্দেও ঘুম ভাঙে না হতভাগার! 

দু’একবার হুট-হাট শব্দও করল লোকটা। তাতেও হুঁশ নাই শেয়ালের। তখন গাড়ি থেকে নেমে, হাতের লাঠি দিয়ে খোঁচা লাগাল শেয়ালকে। মটকা মেরে পড়েই রইল শেয়াল। 

এবার লোকটার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। বুঝতে কিছু বাকি রইল না। নিশ্চয় নদীতে কাঁকড়া খেয়েছে ব্যাটা। তাতেই গলায় কাঁটা আটকে মারা পড়েছে। 

কী আনন্দ, কী আনন্দ। এমন সুযোগ জীবনে দু’বার পাওয়া যায় না। শেয়ালকে তুলে, গাড়িতে ছুঁড়ে দিল মাছগুলোর এক দিকে। গাড়িতে বসে গান জুড়ে দিল সে। মনে বেশ পুলক। শেয়ালের চামড়াটা কাজে লাগানো যাবে। সুন্দর একটা ঢোলক বানানো যাবে চামড়া দিয়ে। লোকটা ভাবছে আর গান গাইছে। গান গাইছে আর ভাবছে। 

এদিকে শেয়াল কিছুক্ষণ চুপটি করে পড়ে রইল। কিন্তু কতক্ষণ আর থাকা যায়? কী পাগল করা গন্ধ মাছের গায়ে! নাক মুখ মাথা ভরে উঠছে সেই মিষ্টি গন্ধে। চুপ করে থাকা যায়?  

এবার ভারি ধন্দে পড়ে গেল বেচারা। একবার ভাবল, কখন কী হয়! পেট ভরে খেয়ে নেওয়া যাক। সাথে সাথেই তার মন বলল—পেট ভারি হয়ে গেলে, তখন কী হবে? সংসারের বাকিদের খাবার নিয়ে যাবে কী করে?

কিন্তু শেয়ালের মাথা বলে কথা। সে করল কী, একটা একটা করে মাছ তুলছে, আর রাস্তার ধারে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে। 

লোকটা গানই গেয়ে যাচ্ছে। শেয়ালের কেরামতি সে ধরতেই পারেনি। গাড়ি চলেছে ক্যাঁচ-কোঁচ করতে করতে।

দরকার মত মাছ নেওয়া হয়ে গেল। এবার ঝুপ করে গাড়ি থেকে নেমে, সরে পড়ল শেয়াল। শুরু হোল তার মাছ কুড়ানো। একটা একটা করে মাছ তুলছে, আর পরেরটার দিকে এগিয়ে চলেছে। 

খানিক এগিয়েছে, আবার একটা শব্দ কানে এল। এবারের শব্দটা কেমন কচমচ। একটু বাদে ভারি বোঁটকা একটা গন্ধ। মাথায় কিছু ঢুকছে না তার। ব্যাপারটা কী?

একটু বাদে পুরোটা চোখে পড়ে গেল শেয়ালের। সন্ধ্যা নেমে গেছে তখন। গোল থালার মত চাঁদ উঠেছে আকাশে। তার ফিনফিনে আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ঘটনাটা। একটা ভোঁদড় বসে বসে তার ফেলে যাওয়া মাছ চিবাচ্ছে।

 মাথা গরম করল না শেয়াল। আগে হিসাবটা বুঝে নিতে হবে। তার পরে যা কিছু মোকাবিলা। ভোঁদড়ের সামনে এসে বলল—তা খুড়ো, কটা হোল? 

ভোঁদড় এতক্ষণ খাওয়াতেই মশগুল হয়ে ছিল। শেয়াল যে এসে পড়েছে, টের পায়নি। সে গলা তুলে বলল— কেন রে, কটা মাছ খেলাম, সে হিসেব তোকে দিতে হবে না কি? 

শেয়াল বলল—দিলে ভালো হোত। হিসাব-নিকাশে সুবিধা হোত। এই আর কী?

আসলে হয়েছে কী, ভোঁদড়ের তো নদীর ধারেই বাস। লোকটা নদীতে মাছ ধরছিল, পুরোটা সে দেখেছে। গাড়িতে মাছ চাপিয়ে সে লোক যখন ফিরে চলল, ভোঁদড় চলছিল গাড়ির পিছুপিছু। এক-আধটা মাছ তো পড়ে যেতেই পারে—এই আশায়।

খানিক দূর এসে, শেয়ালের পুরো কর্মকাণ্ড সে দেখেছে নিজের চোখে। তাতেই তার পোয়া বারো অবস্থা। শেয়াল যখন মাছ ফেলে ফেলে যাচ্ছে, পিছন পিছন ভোঁদড় চলেছে মাছ খেতে খেতে। এমন সুখ তো কল্পনাও করা যায় না। 

কিন্তু জেনেশুনে পরের মাছ পেটে পুরেছে, এটা তো স্বীকার করে নেওয়া চলবে না। ভোঁদড় বলল—কিসের হিসেব-নিকেশ? কিসের সুবিধা?

শেয়াল বলল—না চাইলে, বোল না। কিন্তু আমি বলছি কী, আজ না হয় আমার ফেলা মাছ পেটে পুরলে? কিন্তু কাল কোথায় পাবে। মাছে ফেললেই তোমার পেটে যাবে, জেনে গেছি। আর তো আমি কোনদিন মাছ ফেলব না। তখন কী হবে? 

ভোঁদড় বলল— কটা মাছ খেয়েছি, তোমাকে বললেই বা কী হবে?

--একবার বলে তো দ্যাখো। এমন ব্যবস্থা করে দেব তোমার, হাতে একেবারে স্বর্গ পেয়ে যাবে। 

শেয়ালের ধূর্তামি ভোঁদড় ধরবে কী করে? সে বলে ফেলল—মোট পাঁচটা খেয়েছি। মাপ করে দাও আমাকে। আর, কাল থেকে কী ব্যবস্থা হবে, সেইটা বরং বাতলে দাও তুমি। 

শেয়াল তাকে বুঝিয়ে বলল—ছেলেপুলে নাই লোকটার ঘরে। আমাকে পুষবে বলে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম চলেই যাই। পরে সংসারের কথা ভেবে, ফিরে এলাম। তুমি চলে যাও। না পোষালে, ক’দিন থেকে ফিরে আসবে। চুকে গেল ঝামেলা। 

ভোঁদড়ের বেশ আহ্লাদ হোল মনে। সে বলল—কী করতে হবে আমাকে? 

শেয়াল বলল—কিছুই না। কেবল মরার ভান করে লোকটার গাড়ির সামনে শুয়ে থাকবে কিছুক্ষণ। আমি যেমনটা করেছিলেম। তাতেই কেল্লা ফতে। কপালে কী জুটে যাবে, তা তুমি ভাববারও সময় পাবে না। 

ভোঁদড় বলল—যেতে বলছো? 

--ভালো কথা দিলাম কানে, না শোন মোর ঘন্টা জানে। এই বলে, যে কটা মাছ পেয়েছিল, তাই নিয়ে ঘরের রাস্তা ধরল শেয়াল। সেদিন সারা রাত ফূর্তিতে ঘুমই এল না শেয়ালের। কাল কী ঘটতে যাচ্ছে, সেই ভেবে জেগেই কাটিয়ে দিল রাতটা। 

পরদিন বিকেল হতেই বেরিয়ে পড়ল শেয়াল। লোকটার ঘরে ফিরবার সময় হয়েছে। রাস্তার ধারে গিয়ে ওৎ পেতে বসে রইল, কী ঘটে দেখবার জন্য।   

 গাড়ি আসবার শব্দ পাওয়া গেল। তক্কে তক্কে ছিল ভোঁদড়ও। সেই বাঁকের মুখে এসে, শুয়ে পড়ল সে। গাড়ি এসে দাঁডিয়ে গেল। রাগে শরীর রিরি করতে লাগল লোকটার। গতকাল একজন বেদম ঠকিয়ে গেছে। আজ আবার একজন। 

মনে মনে ভাবল, আজ আর সরে যা সরে যা নয়। গাড়ি থেকে নামানামি বা খোঁচাখুঁচিও নয়। একেবারে ভবলীলাই সাঙ্গ করে দেব হতচ্ছাড়ার। 

ভোঁদড় শুয়ে আছে মড়ার মতো। আড়চোখে দেখেও নিয়েছে গাড়ি এসে গেছে কাছেই। এবার আদর করে তুলে নিয়ে যাবে আমাকে। 

লোকটা করল কী, ভোঁদড়ের গায়ের কাছে এসেই, ভয়াণক একটা মোচড় লাগিয়ে দিল গরুর লেজে। আর যায় কোথায়? এমন লাফিয়ে উঠল গরুটা, গাড়ির একটা চাকা হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল ভোঁদড়ের উপর। যা হবার হয়ে গেল তাতে। একেবারে অক্কা পেয়ে গেল বেচারা। 

আড়ালে থেকে সব দেখছিল শেয়াল। আনন্দে লেজ নাড়তে নাড়তে বাড়ি ফিরে চলল সে। 

সেদিন থেকে, বিকেল হলেই, মাঝে মাঝেই নদীর পাড়ে গিয়ে হাজির হয় শেয়াল। ঘাপটি মেরে বসে থাকে বনের আড়ালে। ভেজা জাল আর মাছ তুলে দিয়ে, যেই গাড়িতে চড়ে বসে লোকটা, অমনি পিছনে টুক করে উঠে পড়ে শেয়াল। দরকার মতো মাছ ফেলতে ফেলতে যায়। 

কেউ চুরি করে খেয়ে নেবে, সে ভয় আর নাই শেয়ালের। আপদ বিদায় হয়ে গিয়েছে।

কথক ঃ শ্রী অভিমন্যু মহাকুর। 

সাকিন—ডাঙ্গরসারি, থানা—সাঁকরাইল, জেলা—ঝাড়গ্রাম। 

সাক্ষাৎকার ঃ মাঘ, ১৪৩১ সন।


🍂
ad

স্মৃতির আয়নায় আমার স্কুল
তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

আজ সকালে "আমি" সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লার "মুকুল"। গতজন্মের সে-ই বাড়িটা দেখতে যাবো তো। কি উত্তেজনা!... 
হ্যাঁ। গত জন্মই তো। ক্লাস ওয়ান থেকে আজ..
সে-ই ক্লাসরুম। ও-ই দ্যাখো ফেলুদা..ওটা আমাদের ক্লাস 10-C..ও-ই যে সোজাসুজি সাইড বেঞ্চটা দেখতে পাচ্ছো, ওখানেই বসতাম আমরা তিন বন্ধু, কখনো কখনো চার জন। সাইডে বসা হতো পালা করে। 
ও-ই ত্তো সে-ই ফোয়ারাটা..এখানে বসে আমি আর আমার বন্ধুরা টিফিন খেতাম। এই ফোয়ারার জলে তখন কত্ত লাল-নীল মাছ ছিলো, জানো তোপসেদা, আমি সেই মাছগুলোকে খেতে দিতাম,পাঁউরুটির গুঁড়ো, বিস্কুটের গুঁড়ো,আর দারোয়ান কাকু দেখতে পেলেই কী বকতো।হা..হা...হা...হা..
ও-ই দেখুন লালমোহন বাবু, সে-ই গাড়িবারান্দা। ওখানে  বেলার স্কুলের মানে সিনিয়র সেকশানে আমরা স্কুল শুরুর আগে প্রার্থনা করতাম।আমরা বলতাম "প্রেয়ার লাইন"। কত দিন চামড়ার জুতো পরে দাঁড়িয়েছি বলে শাস্তি পেতে হতো। নিয়ম ছিলোনা যে,কিন্তু জুতো খুলে যেতে গিয়ে ঘন্টা পড়ে যাবে তো! লেট লাইনে যেতে হবে..কী ঝক্কি। 
সে-ই অফিস ঘর। উমাদি...ফরাসি স্যার। 
সে-ই জল খাওয়ার কল.... যেখানে মুখ লাগিয়ে জল খেতে কি মজা..
সে-ই স্বপন দা.. সকালের স্কুলে,স্বপন দার মা ছিলো, যে আমার টিফিন বাক্স খুলে দিতো পারতাম না তো স্টিলের আঁট বাক্স যে!  আর স্বপনদা, বাইরে থেকে ঘুগনি, চুড়মুড় কিনে এনে দিতো। 
ওই - যে ছোট্ট সিমেন্ট করা স্টেজটা। ওখানেই প্রতি বছর আমাদের এনুয়াল ফাংশান হতো। যারা প্রাইজ পেতো তাদের কথাই আলাদা। বিরাট ব্যাপার। কিন্তু আমার আলাদাই আনন্দ। দু-তিন মাস ধরে রিহার্সাল। পড়াশোনা লাটে। ফাংশানের আগের দিন স্টেজ রিহার্সাল। লুচি আলুচচ্চড়ি খাওয়া বড়ো ছোট সবাই মিলে। ফাংশানের দিন দুপুর থেকে সাজগোজ করে আবার লুচি আলুর দম হ্যাঁ সেদিন চচ্চড়ি নয়।কি বিরাট প্রাপ্তি যে ছিলো সেসব। রাগী দিদিমণিদের স্নেহভরা চেহারায় পাওয়ার মুহূর্ত রাখা আছে আজও সযত্নে। 
  কিন্তু কই? আমি তো তাদের খুঁজে পাচ্ছিনা ফেলুদা?গাড়িবারান্দায় প্রার্থনা হয় না, সেই টিউবওয়েলটা নেই, নেই আরও অনেক অনেক কিছুই। স্কুলটা আর আগের মতো নেই,কেন? তোপসে দা? বড্ড কষ্ট হচ্ছে তো....কান্না পাচ্ছে...
তাই কি হয়..মুকুল। সব আছে।আমাদের সব কিছু স্মৃতি হয়ে আছে।
মুকুল.আগের মতো কি তুমিই  আছো?..নেই তো। তবে কেন আগের মতো নেই বলে কষ্ট হচ্ছে। তুমিও তো বুড়ি হয়েছো। তোমার স্কুলের বয়স কত হয়েছে জানো? ১০০ বছর।
শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহাসিক ঐতিহ্যশালী বিদ্যালয়ের প্রাক্তনী তুমি। 
সময় আমাদের কিচ্ছুটি ভোলায় না, শুধু শিখিয়ে দেয় কি করে কষ্ট গিলে হাসিমুখে থাকতে হয়।
স্কুল শুরুর ক্লাস ওয়ান থেকে আজও তুমি স্কুলের আর স্কুল তোমার।

ছড়া

রাজা সাজা 

রাজর্ষি মন্ডল 


নয় তো সোজা রাজা সাজা

সেই যে মাঠের পারে

মন্ত্রী সান্ত্রী সেনাপতি

সেথায় শুধুই হারে।


আদুড় গায়ে রাজ্য চালাই 

আকাশ ভরা জল

তার ওপারেই ইচ্ছে নদী

বইছে ছলাৎ ছল।


মিথ্যে মিথ্যে চালাই অসি 

বাতাস হেসেই মরে

সোনার কাঠি নাই বা পেলাম

রাজকন্যের তরে।


তোমরা বুঝি অবাক হলে

ছেলেমানুষ দেখে

মনের মাঝে রুপকথা পাই 

গল্প রাখি ঢেকে।


তাতেও দেখি আঁধার নামে

আর কিছু না বুঝে

মা যে আমার কোথায় গেল 

পাই না মা-কে খুঁজে।

অনুভব বোস

একাদশ শ্রেণি, প্রফুল্লনগর বয়েস সেকেন্ডারি স্কুল, উত্তর ২৪ পরগণা


শাস্তি 

অমিত মজুমদার 

     

গার্লস স্কুলের সামনে এসেই খুব জোরে ব্রেক কষে দাঁড়ালো টোটোটা। অবশ্য ড্রাইভারের এ ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। টোটোর ভেতরে সবাই স্কুল পড়ুয়া ছাত্র। আজ ছিলো মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন। পরীক্ষা শেষ হবার আনন্দে মশগুল হয়ে তারা বাড়ি ফিরছিলো। টোটো থামার ঝাঁকুনিতে তাদের আনন্দের ঘোর কেটেছে। একজন ছাত্র বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে ড্রাইভারকে বলে উঠলো, “গাড়ি থামালে কেনো?” 

         ড্রাইভার সামনের দিকে ঈশারা করে বললো, “ওই দেখো কেনো টোটো দাঁড় করিয়েছি।” 

        ছেলেগুলো দেখলো রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মেয়ে। তারা নিশ্চয়ই এই স্কুলের ছাত্রী। সবাই ইউনিফর্ম পরে আছে। টোটো থেকে একটা ছেলে উৎসাহের বশে বলে ফেললো,“এই রাস্তা ছাড়। দেখতেই তো পাচ্ছিস যে টোটোতে আর ওঠার জায়গা নেই।” 

        পাশ থেকে আর একটা ছেলে বললো,“যাও খুকি ক্লাসে যাও।” বলার সাথে সাথেই টোটোর ভেতরে সবাই হাসিতে ফেটে পড়লো। 

        কিন্তু মেয়েরা কেউই নিজের জায়গা থেকে সরলো না। একটা মেয়ে টোটোর কাছে এগিয়ে এসে বললো, “দাদা আমি অদিতি। আমি এই স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি।” 

        “ক্লাস নাইন। তোরা অনেক ছোটো। আমরা মাধ্যমিক দিয়ে ফেলেছি। তা আমরা কি করতে পারি তোদের স্কুলের জন্য?” 

        “বেশী কিছু করতে হবে না দাদা। তোমরা পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় খাতা আর বইয়ের পাতাগুলো কুটিকুটি করে ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলছো। সেই কাগজগুলো রাস্তা থেকে পরিস্কার করে দিতে হবে। রাস্তা আগের মতো ঝকঝকে করা চাই। আর যতক্ষণ পরিস্কার না করছো আমরা তোমাদের যেতে দেবো না।”  

        ছেলেগুলোর হাতে তখনও বই ধরা কেউ কেউ তখনও পাতা ছিঁড়ছিলো৷ রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। এদের সিট পড়েছিলো নীলকন্ঠপুর হাইস্কুলে। সেখান থেকেই এরা বইয়ের পাতা ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলতে ফেলতে আসছে। এই দৃশ্য এবছর নতুন নয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে। পরীক্ষা শেষের পর রাস্তার দুই ধারে শিলাবৃষ্টির শিলের মতো জমে যাচ্ছে কাগজের টুকরো। 

একটা ছেলে বললো, “ওই ঝামেলা করিস না। রাস্তা ছাড়।” 

        “দাদা রাস্তা পরিস্কার না করে দিলে কোনোভাবেই কাউকে ছাড়া হবে না। তাকিয়ে দেখো লোকজন জমে যাচ্ছে।” 

        বেশ কিছু লোকজন সত্যিই জমে গেছে। রাস্তা আটকাতেই পরপর টোটো দাঁড়িয়ে গেছে। এখন সব টোটোতেই পরীক্ষার্থী। মাধ্যমিক পরীক্ষা দুপুর দুটোতে শেষ হয়। সবাইকে ফিরতে হয়ে গার্লস স্কুলের সামনে দিয়েই। এটাই মেইন রাস্তা। মেয়েদের স্কুলে মাধ্যমিকের সেন্টার হয় না বলে ক্লাস চলে। স্কুলে এখন টিফিন টাইম। যদিও টিফিন শেষের ঘণ্টা বেজে গেছে। 

        একটা ছেলে বেশ কর্কশ গলায় বললো, “ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কী? রাস্তা ছেড়ে দে। নাহলে কিন্তু খুব বাজে হবে।” 

        “রাস্তা পরিস্কার না করলে আরও বাজে হবে। তোমাদের তো সাহস কম না। একটা স্কুলের সামনে এইভাবে নোংরা করার সাহস কীভাবে পাও?” 

        রাস্তায় চেঁচামেচি শুনে ওদের হেড মিস চলে এসেছেন রাস্তায়। তিনি দেখেই বুঝলেন কী হয়েছে। মেয়েদের নির্দেশ দিলেন ক্লাসে যাবার জন্য৷ কিন্তু মেয়েরা অবিচল। অদিতি বললো, “ম্যাম বই আমাদের সবচেয়ে পবিত্র জিনিস। অনেক ছেলেমেয়ে বইয়ের অভাবে পড়তে পারে না। আমাদের স্কুলেও অনেক মেয়ে এখনও সরকারি বই পায়নি। আপনাকে বললেই বলেন বই সাপ্লাই নেই। বই এলে দিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু বই আসে না। ওরা সেই বইগুলো ছিঁড়ে নষ্ট করেছে। সেইসঙ্গে খাতা ছিড়েছে। নকল করার জন্য মাইক্রো জেরক্স এনেছিলো। সেগুলো ছিঁড়েছে। রাস্তা ভীষণ নোংরা করেছে। আমাদের স্কুলের সামনে নোংরা করেছে। বাইরের কেউ সামনে দিয়ে গেলে সেই ভাববে আমাদের স্কুলের মেয়েরা খুব খারাপ। এটা হতে পারে না ম্যাম। আমাদের স্কুলের সামনে ফেলা কাগজগুলো ওদের পরিস্কার করতেই হবে।”  

        “ঠিক আছে অদিতি। মানছি তোমার কথা। এবারের মতো ওদের ছেড়ে দাও। ওরা তো পরীক্ষার্থী।” 

        “না ম্যাম ছাড়া যাবে না। এমনিতেই লোকজন বলে আমাদের প্রজন্ম গোল্লায় যাচ্ছে। আমরা কারো কথা শুনি না। আসলে এদের মতো কিছু ছেলেমেয়ের জন্য গোটা প্রজন্মের বদনাম হচ্ছে। এই রাস্তা ওদেরই পরিস্কার করতে হবে। এই শাস্তিটা ওদের দরকার। দাদারা শোনো। দেরী করলে তোমাদেরই বাড়ি ফিরতে দেরী হয়ে যাবে। চটপট হাত লাগাও।” 

        ছেলেগুলোর মধ্যে এরপরেও কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলো না। তবে একটা সমাধান হলো। মোটরসাইকেল নিয়ে দু’জন পুলিশ এসে দাঁড়ালো। তাদেরও ডিউটি পড়েছিলো মাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্রে। এখন ডিউটি শেষ করে ফিরছে। তাঁরাও গোটা রাস্তার ধারে কাগজ বর্ষণ দেখতে দেখতে এসেছে। এখনে এসেই বুঝে গেলো সমস্যাটা কী। একজন পুলিশ মোটরসাইকেল স্ট্যান্ড করে এগিয়ে এসে ছেলেগুলোকে বললো,“তোরা রাস্তা নোংরা করে খুব বাজে কাজ করেছিস। এবার কথা না বাড়িয়ে স্কুলের সামনে পরিস্কার করে দে। নইলে আমি তোদের স্কুলের হেডমাস্টারকে এখানে ডেকে নিয়ে আসছি। তারপর তার সামনেই তোদের দিয়ে রাস্তা পরিস্কার করাবো।” 

        যে ছেলেগুলো এতক্ষণ বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে কথা বলছিলো তারা পুলিশ দেখে হঠাৎই চুপসে গেলো। বাধ্য ছেলের মতো সবাই নেমে এলো টোটো থেকে। অদিতি বললো, “দাদা তাড়াতাড়ি করো। আমাদের ক্লাসে যেতে হবে। এমন আর কোরো না। বই ছিঁড়তে নেই।” 

        জ্ঞান শোনার মানসিকতা ছেলেগুলোর এই মুহূর্তে নেই। তবে তারা আর কথা না বাড়িয়ে স্কুলের সামনে রাস্তা পরিস্কার করার জন্য হাত লাগালো। 

        মেয়েরা রাস্তা ছেড়ে দিয়েছে। অদিতি এসে হেড মিসকে বললো,“ম্যাম আপনি আমাদের শিখিয়েছেন স্কুল পরিস্কার রাখতে। আমরা থাকতে বাইরের কেউ স্কুলের সামনে নোংরা করবে এটা কী হতে পারে?” 

        হেড মিস হাসলেন। সবাইকে ক্লাসে চলে যেতে বললেন। স্কুলের গেটে ঢোকার সময় অদিতি লক্ষ্য করলো ছেলেগুলোর মুখ বেশ থমথমে। রাস্তায় দাঁড়ানো বেশ কিছু লোক তাদের মোবাইলে ছেলেদের রাস্তা পরিস্কার করার ভিডিও তুলছে৷ এই অপ্রত্যাশিত শাস্তির দৃশ্য নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের মধ্যেই সোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে সবার সামনে চলে যাবে। এই ভয়টা এখন বোধহয় ছেলেগুলোও পাচ্ছে।


স্মৃতির আয়নায় আমার স্কুল

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়


আজ সকালে "আমি" সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লার "মুকুল"। গতজন্মের সে-ই বাড়িটা দেখতে যাবো তো। কি উত্তেজনা!... 

হ্যাঁ। গত জন্মই তো। ক্লাস ওয়ান থেকে আজ..

সে-ই ক্লাসরুম। ও-ই দ্যাখো ফেলুদা..ওটা আমাদের ক্লাস 10-C..ও-ই যে সোজাসুজি সাইড বেঞ্চটা দেখতে পাচ্ছো, ওখানেই বসতাম আমরা তিন বন্ধু, কখনো কখনো চার জন। সাইডে বসা হতো পালা করে। 

ও-ই ত্তো সে-ই ফোয়ারাটা..এখানে বসে আমি আর আমার বন্ধুরা টিফিন খেতাম। এই ফোয়ারার জলে তখন কত্ত লাল-নীল মাছ ছিলো, জানো তোপসেদা, আমি সেই মাছগুলোকে খেতে দিতাম,পাঁউরুটির গুঁড়ো, বিস্কুটের গুঁড়ো,আর দারোয়ান কাকু দেখতে পেলেই কী বকতো।হা..হা...হা...হা..

ও-ই দেখুন লালমোহন বাবু, সে-ই গাড়িবারান্দা। ওখানে  বেলার স্কুলের মানে সিনিয়র সেকশানে আমরা স্কুল শুরুর আগে প্রার্থনা করতাম।আমরা বলতাম "প্রেয়ার লাইন"। কত দিন চামড়ার জুতো পরে দাঁড়িয়েছি বলে শাস্তি পেতে হতো। নিয়ম ছিলোনা যে,কিন্তু জুতো খুলে যেতে গিয়ে ঘন্টা পড়ে যাবে তো! লেট লাইনে যেতে হবে..কী ঝক্কি। 

সে-ই অফিস ঘর। উমাদি...ফরাসি স্যার। 

সে-ই জল খাওয়ার কল.... যেখানে মুখ লাগিয়ে জল খেতে কি মজা..

সে-ই স্বপন দা.. সকালের স্কুলে,স্বপন দার মা ছিলো, যে আমার টিফিন বাক্স খুলে দিতো পারতাম না তো স্টিলের আঁট বাক্স যে!  আর স্বপনদা, বাইরে থেকে ঘুগনি, চুড়মুড় কিনে এনে দিতো। 

ওই - যে ছোট্ট সিমেন্ট করা স্টেজটা। ওখানেই প্রতি বছর আমাদের এনুয়াল ফাংশান হতো। যারা প্রাইজ পেতো তাদের কথাই আলাদা। বিরাট ব্যাপার। কিন্তু আমার আলাদাই আনন্দ। দু-তিন মাস ধরে রিহার্সাল। পড়াশোনা লাটে। ফাংশানের আগের দিন স্টেজ রিহার্সাল। লুচি আলুচচ্চড়ি খাওয়া বড়ো ছোট সবাই মিলে। ফাংশানের দিন দুপুর থেকে সাজগোজ করে আবার লুচি আলুর দম হ্যাঁ সেদিন চচ্চড়ি নয়।কি বিরাট প্রাপ্তি যে ছিলো সেসব। রাগী দিদিমণিদের স্নেহভরা চেহারায় পাওয়ার মুহূর্ত রাখা আছে আজও সযত্নে। 

  কিন্তু কই? আমি তো তাদের খুঁজে পাচ্ছিনা ফেলুদা?গাড়িবারান্দায় প্রার্থনা হয় না, সেই টিউবওয়েলটা নেই, নেই আরও অনেক অনেক কিছুই। স্কুলটা আর আগের মতো নেই,কেন? তোপসে দা? বড্ড কষ্ট হচ্ছে তো....কান্না পাচ্ছে...

তাই কি হয়..মুকুল। সব আছে।আমাদের সব কিছু স্মৃতি হয়ে আছে।

মুকুল.আগের মতো কি তুমিই  আছো?..নেই তো। তবে কেন আগের মতো নেই বলে কষ্ট হচ্ছে। তুমিও তো বুড়ি হয়েছো। তোমার স্কুলের বয়স কত হয়েছে জানো? ১০০ বছর।

শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহাসিক ঐতিহ্যশালী বিদ্যালয়ের প্রাক্তনী তুমি। 

সময় আমাদের কিচ্ছুটি ভোলায় না, শুধু শিখিয়ে দেয় কি করে কষ্ট গিলে হাসিমুখে থাকতে হয়।

স্কুল শুরুর ক্লাস ওয়ান থেকে আজও তুমি স্কুলের আর স্কুল তোমার।




 মা

শ্রেয়া দত্ত,

দ্বাদশ শ্রেণি,

পি এম শ্রী স্কুল জওহর নবোদয় বিদ্যালয়,

পশ্চিম মেদিনীপুর


ছোটোবেলায় ধরলে সে হাত

          চলতে পিছু পিছু

জীবনটা তো মানুষে ভরা

         ছাড়লো সবাই সাথ টুকু

জীবনেতে পথ দেখালে

         দাঁড়ালে ঢাল হয়ে

অভিমান করলেও জানি

        রইবে পাশেই বন্ধু হয়ে 

চাইছি শুধু পূর্ণ করতে

        তোমার সব ইচ্ছা

তোমার মুখে হাসি দেখেই 

       ভরবে আমার ইচ্ছা।


সকালবেলা

পল্লবী পাত্র

অষ্টম শ্রেণি

পি এম শ্রী স্কুল জওহর নবোদয় বিদ্যালয়

পশ্চিম মেদিনীপুর


মিষ্টি সকাল, শান্ত মন

       ঘুমিয়েছিলাম এতক্ষণ।

কষ্ট করে খুললাম আঁখি

       পাখিরা এখন ঘুমায় না কি!

পাখিরা সব গাইছে গান,

      জুড়িয়ে যায় মন প্রাণ

বাচ্চারা সব করছে খেলা

      জানে না বুঝি পড়তে হবে

                        সকালবেলা।



Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousJuly 06, 2025

    শেয়ালকে নিয়ে গল্পটি ভালো লাগল।

    ReplyDelete