জ্বলদর্চি

হলুদ ফ্রেম /পুলককান্তি কর

চিত্র- শুভম দাস 
হলুদ ফ্রেম
পুলককান্তি কর 

ফোনে ছেলেকে ঝগড়া করতে শুনে ভেতরে উঁকি মেরে দেখলেন ভাস্বতী। রানুকেই তো ফোন করছিল ও। এত উত্তেজনার কী হল? মুখ বাড়িয়ে বললেন, 'কী হয়েছে রে বুনু?' 
বুনু মানে মানিক এই কথার কোনও উত্তর দিল না। শুধু হাতটা তুলে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো - ভাস্বতী বুঝলেন না। আধঘন্টার মতো পরে থমথমে মুখে বাইরে এল মানিক। ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে বলল, 'ডিসগাস্টিং'।
-- কী ডিসগাস্টিং? প্রশ্ন করলেন ভাস্বতী।
-- ঐ রানুর বাবা মা।
--  ওঁরা আবার কী করলেন?
-- এতদিন বাদে ফ্যাঁকড়া তুলছে আমার সাথে রানুর বিয়ে দেবে না। ওর জন্য মেট্রিমনিয়ালে অ্যাড ট্যাডও নাকি দিতে শুরু করেছে।
-- কারণ ?
-- কারণ কিছুই না। এত দূরে নাকি মেয়ের বিয়ে দেবে না ।
-- এটা তো গত চার বছর আগেও বলতে পারতেন ওঁরা।
 -- চার বছর নয় মা, ওনারা জেনেছেন বছর দেড়েক হল।
-- বেশ তো দেড়ই সই। সেটাও তো কম নয়। 
-- আমিও তো তাই বলছি। দেড় বছর আগে যখন জেনেছে তখনই মানা করতে পারতো। এখন নক্সা করার কী দরকার?
--  ইস্যুটা নিশ্চই ওটা নয় বুনু। অন্য কোনও ব্যাপার আছে। ওই রানুকে ভালো করে জিজ্ঞাসা করে দেখ।
-- অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছি মা। ও কিছু জানে না। ও বলছে ও যতবারই কথাটা তুলেছে ওর বাবা বলেছে 'কলকাতার মেয়ের বিয়ে দেব না। এক মেয়ে তুই। আমাদের কিছু হলে একটু তো তোর হাতে জলও পাবো না'!
-- ভদ্রলোকের ভারী স্বার্থচিন্তা তো! তাহলে তো ঘরজামাই রাখতে হয়। মেয়ে জামাই বিদেশে সেটেলড হলে কী করতেন? চাকরী ছাড়িয়ে দিতেন?
-- বলতো মা আজকাল আগরতলা এমন কী দূর? ফ্লাইটে এক ঘন্টাও লাগে না। সেখান থেকে ওদের বাড়ী আরও ঘন্টা দুয়েক। আমাদের পশ্চিমবাংলাতেও মেদিনীপুর মুর্শিদাবাদে বিয়ে দিলে এর চেয়ে বেশী সময় লাগে। 
-- তুই বাবা রানুর সাথে ঝগড়া করছিস কেন? ও বেচারার তো এতে কোনও হাত নেই। 
-- হাত নেই যখন হাত ঝেড়ে ফেলতে অসুবিধাটা কোথায়? আমি বললাম মানছে না যখন বেশী তোয়াজ করার দরকার নেই। চলে এসো, রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে নেব। ও তাতেও রাজী না। 
-- এটা কি এক কথায় রাজী হওয়ার বিষয়, বুনু? যে বাবা-মা এতদিন এত কিছু করে বড় করলো তাকে, এক কথায় এভাবে ছেড়ে আসা যায় না। তুই সময় দে। দ্যাখ না কী হয়। 
-- রানু বলছে কোনও সম্ভাবনা নেই ওর বাবাকে মানানোর। মূল আপত্তিটা ওর বাবার। ইনফ্যাক্ট ওর মাও রানুর হয়ে ওর বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু লোকটা নাকি ভীষণ একগুঁয়ে। 
-- এই যে বলতিস, রানু খুব বাপ সোহাগী, ওর বাবা-মা খুব ভালো মানুষ? 
-- কোন ছেলে মেয়ে নিজের বাবা-মাকে লোকের সামনে খারাপ মানুষ বলবে মা? আমি তো নিজের চোখে দেখিনি কোনওদিন। আর তাছাড়া একগুঁয়ে লোক কি ভালো মানুষ হয় না? তুমিই তো বলতে বাপি নাকি খুব একগুঁয়ে ছিল। তুমি নাকি দেশ তুলে বাপিকে আওয়াজ দিতে! 
-- তা ঠিক বলেছিস। তোর বাপি এমনি খুব ভালো ছিল। কিন্তু কোনও বিষয়ে যদি গোঁ লাগতো সেটা না করে ছাড়তো না। 
🍂
ad

-- মা, এখন আমি কী করব? 
-- তুই রানুকে ভালো মতো জিজ্ঞাসা কর এই শেষ কদিনে ওদের বাড়ীতে কী এমন ঘটেছে যাতে করে ওর বাবার মত বদলে গেছে? 
-- জিজ্ঞাসা করেছি মা। রানু সে রকম কোনও কিছু আইডেনটিফাই করতে পারছে না। 
তুমি কি একটু রানুর সাথে কথা বলবে মা? 
-- সে আমি বলতেই পারি। তবে ওই রেজিস্ট্রি ম্যারেজের তোর ওই প্রস্তাবটা আমি ওকে দিতে পারবো না। 
-- সে না হয় নাই দিও। একটু বুঝে দেখার চেষ্টা করো তো, এটা রানুরই বানানো কোনও বাহানা কিনা? বাবার নাম দিয়ে নিজের ইচ্ছেটাই পূরণ করতে চাইছে না তো? 
-- এমন কথা বলছিস কেন, বুনু? নিজের ভালোবাসার মানুষের প্রতি যদি আজ থেকেই অবিশ্বাস আসে, বাকী জীবন কাটাবি কী করে? 
-- কী জানি মা। আজ আমি যখন ওর বাবা-মা নিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম ও এমন ভাবে ওদের প্রোটেক্ট করছিল আমার সন্দেহ হল। 
-- কেউ আমাকে নিয়ে কিছু বললে তুই বুঝি রেজিস্ট করবি না? 
-- তোমার ব্যাপার আর ওর বাবা এক হল? যে এরকম হিটলারি চালাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না? 
-- বাবা মা কে আমরা নিজেরা যা খুশি বলতে পারি। কিন্তু বাইরের কেউ কিছু বললে আমরা সহজে মানতে পারিনা, সে তার যত দোষই থাকুক। এটা স্বাভাবিক নিয়ম বুনু। এটা মানতে শেখ। 
-- সে ঠিক আছে। কিন্তু তুমি বলো মা, চার-পাঁচ বছরের রিলেশনের পরে কোনও মেয়েকে যদি তার বাবা-মা বলে সাইট থেকে ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেবে - তাতে সে এক কথায় মেনে নেবে? প্রতিবাদ করবে না? 
-- সে প্রতিবাদ করছে কিনা সেটা কি বাইরের থেকে বোঝা সম্ভব? এক একজনের প্রতিবাদের ভাষা এক এক রকম। 
-- কিন্তু সে যে প্রতিবাদ করছে এমনটা তো বুঝতে পারলাম না মা। আমি ভরসা পাবো কী বলে? 
-- তা ঠিক। তবে রানুকে তো আমার তেমন মেয়ে মনে হয় না বুনু। সাধারণ মেয়েরা রিলেশন ভাঙতে চায় না। 
-- আজকাল আর এইসব রুল চলে না মা। ওসব তোমাদের আমলে চলতো। আমাদের সাথে পড়তো আমাদের তিনটে বন্ধু শ্রীতমা, পর্না আর পল্লবী - এদের কথা তো তোমায় বলেছি মা। আমি যতদূর জানি এরা তিনজনই তাদের বয়ফ্রেন্ড কে ডিচ করেছে। 
-- এইযে একটা ক্লজ বললি না বুনু, ওইটাই ইমপর্টান্ট। 
-- কোন ক্লজ? 
-- ওই যে, আমি যতদূর জানি। তোর আমার জানার বাইরেও অনেক কথা থাকে যেটা শুধু সংশ্লিষ্ট ছেলেটি বা মেয়েটিই জানতে পারে। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে বা সাধারণ নিয়মে সবকিছু যাচাই না করাই ভালো। যাক এসব কথা। তুই ঠান্ডা হ। স্নান করে আয় তাড়াতাড়ি। 
অনেকক্ষণ ধরেই অফিসে ছটফট করছিল মানিক। পাঁচদিনের ছুটি নিয়ে ত্রিপুরা গেছে রানু - আজ আট দিন হয়ে গেল পাত্তা নেই। ছুটি এক্সটেন্ড করার জন্য কোনও মেল পাঠিয়েছে কিনা এতক্ষণ তারই খোঁজ খবর লাগাচ্ছিল সে। কোনও মেলও আসেনি। ফোন করলে ফোন তুলছে না। চাকরীটাই ছেড়ে দেবে না কি? অবশেষে মা কেই ফোনটা লাগালো সে। 'মা রানু অফিসে আসছে না, ফোনও তুলছে না। তুমি একবারে ট্রাই করবে?' 
-- শরীর টরীর খারাপ হল না কি রে? 
-- চিন্তা তো হয় মা। আমার মনে হয় ওর খড়ুশ বাপটা নিশ্চই কোনও ঝামেলা করেছে? 
-- আচ্ছা বুনু, ওদের বাড়ীটা এক্সাক্টলি কোথায় বলতে পারবি? 
-- উদয়পুর। 
-- উদয়পুর? বাবার নাম কী? 
-- তা তো জানি না। 
-- তোর অফিসে দ্যাখ না। ওর পার্সোনাল ফাইল টাইলে বাবার নাম নিশ্চই আছে। 
-- বাবার নাম নিয়ে তুমি কী করবে মা? 
-- আরে ওসব দিকে আমারও অনেক পরিচিত বন্ধুবান্ধব আছে। একটু খোঁজখবর নিতে পারব। 
একটু বাদে মানিক ফোন করে জানাল। রানুর বাবার নাম শাশ্বত দাস। ভাস্বতী জিজ্ঞাসা করলেন, শাশ্বত দাস? ঠিক জানিস তো? 
-- হ্যাঁ মা। 
-- ওনার কোনও ফটো টটো আছে? 
-- রানুর ফেসবুকটা সার্চ করে দেখলে হয়। ওতে থাকলেও থাকতে পারে। তুমি কি সার্চ করে দেখবে? 
-- আচ্ছা দেখবো'খন। তুই রানুর নাম্বারটা পাঠা। আমি একবার ফোন করে দেখি। 
ফোনটা কেটে ভাস্বতী রানুর প্রোফাইলটা ভালো করে সার্চ করে দেখলেন। তেমন কোনও ফটো নেই। শাশ্বত দাস নামের অনেক প্রোফাইল আছে - কোনোটা ঠিক জুতসই লাগালো না। অবশেষে তিনি রানুর ফোনে ফোন করলেন। 
-- হ্যালো। রানু বলছ? 
-- হ্যাঁ মাসীমা, বলুন। 
-- ওঃ। আমার নম্বর তোমার কাছে সেভ করা আছে? 
-- আছে। 
-- মা, তুমি বুনুর ফোন ধরছ না কেন? 
-- ও আপনাকে কিছু বলে নি? 
-- সবই বলেছে। কিন্তু তুমি ফোন না তুললে তো সমস্যার সমাধান হবে না। ও হাজার রকম আনতাপড়ি কথা ভাবছে। 
-- মাসিমা ও তো বুঝতেই চাইছে না। ফোন করে সেই একই কথা বকে যাচ্ছে। 'চলে এসো, রেজিস্ট্রি করে নেব।' আমি ওকে বলেছি সেটা সম্ভব নয়। 
-- বেশ তো। তোমার কথা স্পষ্ট করে ওকে বলে দাও, সময় চাও। কথা বন্ধ করে দেওয়াটা তো সমস্যার সমাধান করে না বরং আরও নতুন নতুন সমস্যার মুখ খুলে দেয়। 
-- আপনি তো মানিককে চেনেন মাসীমা। ও বড় বেশী কাতর হয়ে যায় যে কোনও ব্যাপারে। ও আপনার মতো ধীর স্থির তো নয়! আমি নিজের ব্যাপারটা নিয়ে জ্বলছি। তার ওপর মানিকের উৎপাৎ। 
-- দেখ মা তুমি যদি এই রিলেশনটা কনটিনিউ করো, তবে তো তোমাকে এসব মানিয়ে নিতে হবে। আজ এত বছর ওর সাথে মিশে যখন ওকে জীবনসঙ্গী হিসাবে স্থির করেছো তখন এই দুঃসময়টা দুজনে একসঙ্গে বুদ্ধি করে অতিক্রম করার চেষ্টা কর। একা একা লড়তে গেলে লড়াইটা কঠিন হবে। 
-- সেটা ঠিক মাসীমা। কিন্তু এখন ব্যাপারটা বড় বেশী ঘোরতর হয়ে পড়েছে। বাপি এমন গোঁ ধরে আছে আদৌ ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটাও ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
-- তুমি নিজেও কি রিলেশনটা ভাঙতে চাইছো মা? 
-- না মাসিমা। মানিক যেমনই হোক, আমি ওর বিকল্প হিসাবে কাউকে ভাবতে পারি না। আর তাছাড়া আমি মনে মনে আপনাকেও আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে নিয়েছি। কিন্তু আমি বাপিকেও কষ্ট দিতে চাই না। 
-- তোমার কষ্টটা বুঝি মা। আচ্ছা তুমি একটা কথা বলো তো  হঠাৎ করে তোমার বাপি এই বিয়ের এগেনস্টে গেলেন কেন? 
-- আমার মাথায় এখনও ঢোকেনি মাসিমা। আমি এতদিন এটাই জানার এবং বোঝার চেষ্টা করছি। 
-- তুমি মনে করে দেখো তো এবার যখন তুমি বাড়ীতে ফাইন্যাল কথা বলার জন্য বললে, তখন তোমার বাপি কী বললেন? 
-- তোমাদের ঠিকানা নাম টাম জানতে চাইলো। তোমাদের ফটো টটো তো দেখলাম। 
-- ওঃ। তারপর? 
-- ধরো এসব কথা রাত্রে শোবার আগে হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বাপি এসব কথা নিয়ে কিছু উচ্চবাচ্য করছে না। মাকে সুযোগ বুঝে জিজ্ঞাসা করতে মা বলল, বাপি বলছে এই বিয়েতে তার মত নেই।
-- তুমি মা কে জিজ্ঞাসা করোনি, মা কারণ কিছু জানে কিনা? 
-- মাও কিছু বুঝতে পারছে না। বাপি নানা রকম ফালতু অজুহাত দিচ্ছে - এতদূর! ঘটি বাড়ী! কলকাতার মানুষ খারাপ - এইসব। 
-- রানু হোয়াটসঅ্যাপে তোমার বাবা মার ফটোটা পাঠাবে? 
-- তা পাঠাতে পারি। কিন্তু আপনি আবার ফটো নিয়ে কী করবেন? 
-- আসলে আমি ভাবছি তোমার বাপির সাথে কথা বলবো। তার আগে তাঁর সম্বন্ধে একটু ধারণা করে নিতে চাই। 
-- আচ্ছা আমি এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি। 
-- তুমি কি চাকরীটা জয়েন করবে না? 
-- করব মাসিমা। গেলেই তো মানিকের সাথে একটা বোঝাপড়ার ব্যাপার আসবে। তার আগে আমি নিজেও পরিষ্কার করে নিতে চাই। 
-- বেশ। তুমি তোমার বাপির মোবাইল নাম্বারটাও পাঠিও তো! তবে আগে থেকে বলে রেখো না যে আমি ফোন করব। 
-- আচ্ছা। 
-- তোমার বাপি অফিসে কখন যান? 
-- সাড়ে নটায় বেরোয়। ফেরে সন্ধে ছ'টায়। 

   ভাস্বতী ইচ্ছে করেই অফিস টাইমে ফোনটা লাগালেন শাশ্বতকে। বাড়ীতে স্ত্রী আর মেয়ের সামনে হয়তো সব কথা খোলা মনে বলতে পারবেন না ভেবে। দুবার ফোনটা রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল। তৃতীয় বার ফোনটা ধরে শাশ্বত বললেন হ্যালো।
-- আমি কলকাতা থেকে ভাস্বতী মুখোপাধ্যায় কথা বলছি। আপনি শাশ্বত দাস বলছেন তো ?
-- ভাস্বতী মুখোপাধ্যায়, মানে ভাস্বতী মৈত্র? মানিকের মা? 
-- হ্যাঁ। ফোনটা করলাম, আপনার সাথে আমার কিছু কথা বলার ছিল। 
-- আমাকে আপনি আজ্ঞে করছো কেন ভাস্বতী? 
-- আমি যে শাশ্বতকে চিনতাম, আপনি তো সেই মানুষ নন! আপনাকে আমি চিনি না। 
-- এভাবে বলছো কেন? 
-- কীভাবে বলব? যে মানুষটা এম.এস.সির রেজাল্ট বেরোনোর পর বাড়ী ফিরে গিয়ে দিব্যি সব সম্পর্ক ভুলে যেতে পারে, মনেই করতে না চায় এতদিনের এতখানি কাছে যাওয়া - তার সম্বন্ধে কী বলব? আমার চেনা মানুষ? 
চুপ করে রইলেন শাশ্বত। ভাস্বতী বললেন, 'শুনুন আপনাকে বিব্রত করার জন্য আমি ফোনটা করিনি। আমি শুধু জানতে চাই, রানুর জীবনটা কেন নষ্ট করছেন? ও তো মানিককে ছেড়ে চলে যেতে চায় না।' 
-- ভাস্বতী, তুমি বলো জেনে বুঝে এই সম্পর্কে আমার কি মত দেওয়া উচিৎ? 
-- জেনে বুঝে মানে? 
-- আমার সাথে তোমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বিয়েটা হলে ওরা ভাই বোন হত। 
-- আদতে তো ওরা ভাই বোন নয়। মানিকের বাবা প্রনবেন্দু মুখোপাধ্যায়। 
-- তবু। তোমার সাথে আমার তো রিলেশন ছিল। 
-- বারবার রিলেশন ছিল বলে আওড়াচ্ছেন কেন? যে রিলেশনকে আপনি মর্যাদা দেননি বা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি - তার কোনও অস্তিত্ব আজকের দিনে বেঁচে নেই। আপনার অথবা আমার অপরাধের সাজা কেন ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দেবেন? 
-- প্লিজ ভাস্বতী, বারবার আপনি বলে আমাকে বিড়ম্বিত করো না।
-- আপনার কি আদৌ বিড়ম্বনা হয়? যেদিন আমার কষ্ট দেখে আমার মা কলকাতা থেকে উদয়পুর চলে গেছিলেন আপনার বাবার সাথে কথা বলতে, সেদিন আপনার বাবা যখন ওঁকে অসম্মান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন সেদিন আপনার বিড়ম্বনা  হয়নি? 
যখন আমার হোস্টেলে দিনের পর দিন আপনার জামা কাপড় অন্তর্বাস সমেত আমাকে কাচতে দিয়ে আসতেন, আমি সব জুনিয়র সিনিয়রদের সামনে সেগুলো ধুয়ে শুকিয়ে আয়রন করে আপনাকে পাঠিয়ে দিতাম- সবকিছু এক মুহূর্তে অস্বীকার করার আগে সেগুলো আপনাকে যখন বিড়ম্বিত করেনি আজকে সামান্য 'আপনি' শব্দ আপনাকে বিড়ম্বনা দেবে এটা ভাবাও কষ্ট কল্পনা। 
-- দ্যাখো ভাস্বতী, তখন আমার পরিস্থিতি ...
-- আমি তো কোনও ব্যাখ্যা চাইনি আপনার কাছে। আপনার কোনও আত্মপক্ষ সমর্থনের দরকার নেই। আজ আমার কাছে সে সব মূল্যহীন। এগুলোকে খুঁচিয়ে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলার দরকার নেই। 
-- সত্যি এসবের কোনও মূল্য নেই তোমার কাছে? 
-- আপনার কাছে কোনওদিনও কি এর মূল্য ছিল শাশ্বত বাবু? ছাড়ুন ওসব কথা। আমি অতীত নিয়ে বাঁচি না। মিছিমিছি বাচ্চাদের জীবনগুলো নিজের কৃতকর্মের জন্য বলি দেবেন না। 
-- কিন্তু ওরা যদি জানতে পারে? 
-- যে জিনিসের অস্তিত্বই নেই তা জানাবে কী করে? 
-- বিভিন্ন পারিবারিক গ্যাদারিংস এ আমাদের কমন কিছু বন্ধু বান্ধব তো আছে - তারা যদি আসে? 
-- সে সব গ্যাদারিংসএ কোনও এক পক্ষকে এড়িয়ে যেতে হবে। আমাদের তরফ থেকে হলে আপনি যাবেন না। আপনাদের তরফে হলে আমি আসবো না। 
-- কিন্তু এরপরও যদি কোনওভাবে... 
-- সত্যিকে কী ভাবে মুখ বন্ধ করবেন শাশ্বত বাবু? ওরা বড় হয়েছে। যদি সত্যিটা জানতে পারে তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে। 
-- খারাপ ভাববে তখন! 
-- আমরা যদি খারাপ কাজ করে থাকি তার কানসিকুয়েন্স আমাদের ফেস করতে শেখা উচিৎ। এটাও তো ভাবতে পারে ওদের খুশীর জন্য এই রিস্ক নিয়েও আমরা বিয়েতে মত দিয়েছি? 
-- আর একটা কথা ভাস্বতী। তুমি আমার থেকে প্রতারিত হয়েছ ভেবে আমার মেয়েটাকে কষ্ট দেবে না তো? 
-- আপনার কাছে এই ভাবনাটা মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। মানুষ তো অন্যকে নিজের ভাবনা অনুযায়ীই মাপে। 
-- মানে? 
-- মানে কিছুই না। আপনাকে এটা জানানোর জন্যই বলছি, আমি আমার ছেলের জন্য অলরেডি একটা ফ্ল্যাট কিনে রেখেছি। যেদিনই বৌভাত হবে সেদিন থেকে ওরা ওই ফ্ল্যাটেই থাকবে। আমি বাড়ীতে থাকবো। সুতরাং শাশুড়ী নিয়ে আপনার মেয়েকে ঘর করতে হবে না। 
-- কিন্তু তোমার ছেলে যদি না মানে? 
-- সব ছেলেই বউ এর বাধ্য হয় শাশ্বত বাবু। এরা এ জমানার ছেলে মেয়ে। শাশুড়ী ননদ এদের কাছে উটকো। মেয়েকে দরকার পড়লে তেমন করে মন্ত্র পড়িয়ে দেবেন যাতে সে ছেলের কান ভাঙিয়ে দিতে পারে। 
-- আমার মেয়েটা ভালো ভাস্বতী। ও তেমনটা নয়। 
-- সেটা মানিকের সৌভাগ্য। 
-- আমার স্ত্রীও কিন্তু কিছু জানে না ভাস্বতী। 
-- সেজন্যই তো আপনাকে অফিসে ফোন করলাম। আমার অন্য উদ্দেশ্য থাকলে বাড়ীতেও ফোন করতে পারতাম। 
-- তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ভাস্বতী। ঈশ্বর আসলে অনেক বিচক্ষণ। তিনি জানেন আমি কোনওভাবেই তোমার যোগ্য ছিলাম না। 
-- সেটা আমার সাথে ঘোরা এবং আরও অনেক কিছু করার আগে যদি আপনার এবং আপনার ঈশ্বরের মনে পড়তো, তাহলে আমাকে কিছু সমস্যা কম পোহাতে হত। 
-- তুমি কি এখনও আমার উপর রাগ পুষে আছো, ভাস্বতী? 
-- আমি তো আগেই আপনাকে বলেছি শাশ্বত বাবু, আমার এই অতীত নিয়ে আমি বেঁচে নেই। যখন এটা সত্যি ছিল, তখন ছিল। এখন এর ছায়াটুকুও আমাকে ছোঁয় না। 
    বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শাশ্বত। শুধু বললেন, তোমার দাম্পত্যে সমস্যা হয়নি? আইমিন... 
-- এসব প্রশ্ন কেন জিজ্ঞাসা করছেন শাশ্বত বাবু। ত্রিপুরা চলে গিয়ে যখন জানতেই চাননি আমি কেমন আছি, আমার কী করে চলবে, আজ জানতে চাইছেন কেন? রক্তের জোর কমে গেছে বলে? 
-- এটা আমার কৌতুহল। আমি যেমন রানুর মা কে তোমার কথা বলার সাহস পাইনি। কিন্তু তুমি তো অনেক স্ট্রেট ফরোয়ার্ড ছিলে... 
-- প্রণবেন্দু সবই জানতো। ও আসলে আমাদের ক্লাসে রমলা পড়তো - ওর দাদা। রমলা আমাদের বিষয়ে সবই জানতো। সুতরাং প্রণবেন্দুর অজানা থাকার কথা নয়। তবে ও নিজে থেকে আমাকে এই নিয়ে প্রশ্ন করে বিব্রত করতো না। যখন ওর সাথে বিয়ের কথাবার্তা এগোচ্ছিল, তখন আমি নিজে থেকেই আপনার কথা তুলেছিলাম। ও আমার ডান হাতটা মুঠোতে নিয়ে বলেছিল- 'থাক না ভাস্বতী, ফুরিয়ে যাওয়া কথাতে জল হাওয়া দিতে নেই।' 
হঠাৎ ভাস্বতীর খেয়াল হল কথা বলার ফাঁকে কখন লাইনটা কেটে গেছে। ভালোই হল। হঠাৎ শাশ্বতের অল্প বয়সের মুখটা মনে পড়লো তাঁর। বেশ লম্বা, ফর্সা চেহারা। কোঁকড়ানো চুল। রানু সেদিন যে ছবিটা পাঠিয়েছিল কেমন যেন বুড়োটে হয়ে গেছে। সেই চুলের বাহার নেই। মাথা জোড়া টাক। রঙটা পুড়ে প্রায় কালো। কত ধরনের বাজনা বাজাতে পারতো সে। ত্রিপুরার উপজাতিদের মধ্যে এই গুণটা আছে। কিন্তু ও কিভাবে যেন এতগুলো বাদ্যযন্ত্র রপ্ত করতে পেরেছিল। ভালো বাঁশিও বাজাতে পারতো সে। যেদিন সে প্রথমবার ভাস্বতীর শরীর ছুঁয়েছিল সেদিন বলেছিল- আজকেই তার সব সুরগুলো ছন্দ খুঁজে পেল। কে জানে আজকাল শাশ্বত আর বাজনা বাজায় কিনা! বাজালেও তাতে আর সুর লাগে কিনা! আজ আর এইসব কথায় ভাস্বতীর কিছু যায় আসে না। একটু জল খেয়ে ছেলের মোবাইলে রিঙটা বাজালেন তিনি।

Post a Comment

0 Comments