জ্বলদর্চি

স্বাধীনতার ছুটি/কমলিকা ভট্টাচার্য

স্বাধীনতার ছুটি
কমলিকা ভট্টাচার্য 

আজ স্বাধীনতার ছুটি।
শহরের আকাশে স্বাধীনতার রঙ,
রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাজে দেশাত্মবোধের গান।
দেশপ্রেমে আজ সবাই জেগে—
তোমরা সবাই উৎসবে মেতে,
আমি বরং এই ফাঁকে
খুঁজে আসি ক্ষুদিরামকে।

সে তো বলেছিল—
"আসব ফিরে আবার"—
তাই প্রতি বছর এই দিনে
খুঁজি সব ঘর,
কোথায় হলো জন্ম তার।

তোমরা যখন এই একদিন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ,
তখন মনে ভরসা পাই—
এই একদিন আমারও ছুটি তাই,
দেখে আসি, কোথায় তাকে পাই।

জানলা দিয়ে মারি উঁকি—
ঘরে ঘরে মোবাইল হাতে
গেম খেলছে বাচ্চারা,
ল্যাপটপ–টিভি–সব জায়গায়
চলছে নোংরা ছবি।
না… এখানে নেই আমার ক্ষুদিরাম,
তার যে দেশ অন্তঃপ্রাণ।

আরেকটু এগোই—
চায়ের দোকানের পাশে
ধোঁয়ায় ডুবে মত্ত যুবকেরা
সময়ের স্রোত উড়িয়ে দিচ্ছে
আলসেমির আড্ডায়।
তবে কি এদের মাঝেই
ক্ষুদিরাম হারিয়ে গেছে?
আমার ভয় আরও বাড়ে।

না… এখানে নেই আমার ক্ষুদিরাম,
সে সহ্য করে না দেশের বদনাম।

শেষ চেষ্টা করি—
দূরে পতাকা উঠছে,
মুহূর্তটাকে বন্দী করছে ক্যামেরা,
ফেসবুকের অ্যালবামে জমা হচ্ছে হাসি
যেখানে লাইক–ই সত্য
আর দেশপ্রেম কেবল সাজানো মঞ্চ।

আমার বুক কেঁপে ওঠে,
চিৎকার করে কেঁদে উঠি—
"ক্ষুদিরাম, তুই কি জন্ম নিলি?
তুই যে গিয়েছিলি বলি!"

সূর্য ডুবে যায় ধীরে,
তিরঙ্গা মুড়ে নেয় দিনের ক্লান্তি।
সে বলে—
"স্বাধীনতা, তুই যে বড় ব্যস্ত,
তোর যে অনেক দায়িত্ব!
মিথ্যেতে হতে দিস না দেশকে নষ্ট।
আমি তিরঙ্গা,
আমার নিজের শপথ নিয়ে বলছি—
এই দেশেতেই, যেখানে সত্য লড়ে,
সেখানে নিশ্চয়ই দেখা পাবি ক্ষুদিরামের।"
****************
নিয়মে বাঁধা মুক্তি


আকাশের মেঘ আজ
বেঁকে বসে বলে—
আমি আর ভাসবো না,
আমার কি নেই কোনো স্বাধীনতা?

পাহাড় বলে—
আমি আর বোকা বোকা একভাবে দাঁড়াবো না,
আমার কি নেই কোনো স্বাধীনতা?

নদীর জল বলে—
বইতে বইতে আমি ক্লান্ত,
আমি আর বইবো না,
আমার কি নেই কোনো স্বাধীনতা?

বনের পশু বলে—
আমি রোদ, জল, ঝড়ে আর
জঙ্গলে থাকবো না,
আমাদের কি নেই কোনো স্বাধীনতা?

মাটি বলে—
দিতে দিতে নিঃস্ব আমি,
আমি আর ফসল ফলাবো না,
আমার কি নেই কোনো স্বাধীনতা?

গাছ বলে—
আমি আর অক্সিজেন দেবো না,
আমার কি নেই কোনো স্বাধীনতা?

হাওয়া বলে—
আমি একটু স্থির হয়ে বসতে চাই,
আমার কি নেই সেই স্বাধীনতা?
🍂

বৃষ্টি বলে—
আমি আর ঝরে ঝরে পড়বো না,
আমার কি নেই কোনো স্বাধীনতা?

পৃথিবী বলে—
আমি আর লাট্টুর মতো ঘুরবো না,
আমার কি নেই কোনো স্বাধীনতা?

সূর্য বলে—
আমি আর উঠবো না,
আমার কি নেই কোনো স্বাধীনতা?

স্বাধীনতা ধীরে ধীরে কয়—
“প্রশ্নগুলো থাকুক মানুষের অন্তরে
যারা স্বাধীনতার নামে করে স্বেচ্ছাচার,
ভেবে দেখুক—
নিয়মহীন উগ্রতা
হয় পতনের প্রথম সিঁড়ি।

স্বাধীনতা মানে বাঁধনহীন ব্যভিচার নয়,
এ তার আসল রূপ—
চিন্তার মুক্তি, মননের উন্মেষ,
যেখানে নিয়মই রক্ষা করে সৌন্দর্য।
সব কিছুর স্বাধীনতা
যদি ছিঁড়ে দেয় সৃষ্টির সুষমা,
তবে তা আনে প্রলয়—
আর প্রলয় কেবল ধ্বংসের ভাষা।”
****************
অন্যায়ের অন্ধকারে

অন্ধকারে যখন ন্যায়বোধের পতন,  
বেঁচে থাকে কেবল নির্দোষ প্রাণের ক্রন্দন।  
ছাই থেকে উঠে আসে স্মৃতিরা তীব্র,  
পুনরাবৃত্তির ভয়ে, সমাজ হয় কেবলি নির্বোধের দেশ।

না,  
এ কোনও বিপ্লবের জাগরণ নয়।  
এ কেবল এক সহজ, সাদাসিধে আত্মার কান্না,  
যে ভয়ে হারিয়েছে তার ইচ্ছার অধিকার,  
আর মরদেহে লুটিয়ে পড়ছে হিংসার অভিশাপ।

ভয়, একটানা ভয়ের শ্বাসে বাঁচতে হয়,  
যেখানে টিকে থাকা প্রাণই  যথেষ্ট প্রাপ্তি
 শব্দ, বাক্য, প্রতিটি বর্ণমালা  
একটি বিস্ময়বিহীন জ্বালাময় দৃশ্য হয়ে দূরে মিলিয়ে যায়।

অতঃপর,  
প্রতিবাদের আবরণ যদি ভাঙে,  
প্রকৃত অন্যায়ের মুখোমুখি হতে হয়,  
যেখানে শত শত মিথ্যার তদারকি
ভেঙে দেয় বিশ্বাসের দেয়াল।

তবু,  
অন্ধকারে একটি হেমলক পাত্র এসে  
জ্বেলে যায় আলোর শিখা,  
একটি মৃদু আশা নিয়ে,  
যদি কোনদিন শেষ হয় এই অন্যায়ের ছায়া...
সেদিন-ই যে আসল দিবস স্বাধীনতা।

Post a Comment

0 Comments