জ্বলদর্চি

নিকুঞ্জবিহারী মাইতি (স্বাধীনতা সংগ্রামী, খেজুরী) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৬৯

নিকুঞ্জবিহারী মাইতি (স্বাধীনতা সংগ্রামী, খেজুরী) 

ভাস্করব্রত পতি

নিকুঞ্জবিহারী মাইতি। একজন আদর্শ স্বাধীনতা সংগ্রামী, শিক্ষাব্রতী, ত্যাগব্রতী ও কবিমনের অধিকারী এই মানুষটি সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন 'মাস্টারমশাই' নামে।  স্বাধীনতার পর তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী। একসময় নন্দীগ্রামের ব্রজমোহন তিয়াড়ী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তখন বেতন ছিল মাসিক ১০০ টাকা। পরবর্তীতে ঐ চাকরি ছেড়ে মাত্র ৫০ টাকা বেতনে খেজুরীর কলাগেছিয়া জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হন। অবশেষে এই চাকরিও ছেড়ে দিয়ে সর্বসময়ের কংগ্রেস কর্মী হিসেবে নিঃস্বার্থ স্বদেশসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। এহেন ব্যক্তির কন্যা ছিলেন আভা মাইতি। তিনিও ছিলেন একজন স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ এবং এরাজ্যের শিল্প প্রতিমন্ত্রী।

স্বাভাবিকভাবেই পিতার কর্মতৎপরতা এবং গুণগত মান কন্যার ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়েছিল। ১৯৪২ এর ১৬ অক্টোবর দুর্গোৎসবের সপ্তমী তিথিতে ঘটে যাওয়া চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিল বিধ্বংসী ঘূর্ণীঝড় ও প্রলঙ্করী বন্যার মাধ্যমে। সেসময় জেলায় মানুষের মৃত্যু হয় ১৪,৪৪৩ জন। এছাড়াও গবাদি পশু ১,৮৮,০০০ টি, গৃহ ধ্বংস ৫,২৭,০০০ টি, গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৬০০ টি। সেই দুর্বিপাকে পড়া জেলাবাসীর পাশে পিতা ও পুত্রী দুজনেই দাঁড়িয়েছিলেন। 
নিকুঞ্জবিহারী মাইতির ওপর একটি গ্রন্থ প্রকাশ অনুষ্ঠান

খেজুরীর কলাগেছিয়া গ্রামে নিকুঞ্জবিহারী মাইতি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯২ সালের ২৬ শে সেপ্টেম্বর (৯ ই আশ্বিন ১২৯৯ সাল)। বাবার নাম বিশ্বনাথ মাইতি। তিনি ছিলেন ভগবানপুরের বিভীষণপুর মধ্য বাংলা বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ঘোরতর স্বদেশপ্রেমী এক শিক্ষাব্রতী মানুষ। আর মায়ের নাম সাবিত্রী মাইতি। 

ছোট থেকেই চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতে বড় হয়েছেন। বাবার যা বেতন ছিল, তা অত্যন্ত নগন্য। অভাবের মধ্যে নিজের জীবন অতিবাহিত করতে করতে তাঁর মনের মধ্যে সঞ্চারিত হয় মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। পরোপকারী মনোভাব জাগরিত হয়েছিল সাধারণ মানুষের জন্য। 

কাঁথি হাইস্কুলে ভর্তি হন ১৯০৮ সালে। ১৯১১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় এই বিদ্যালয় থেকে যে ১১ জন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিল, সেই ছাত্রদের তালিকায় তিনি ছিলেন অন্যতম ছাত্র। এরপর ১৯১৫ সালে সুদূর মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজী ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। সেসময়ই তিনি বিয়ে করে নেন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভের পরেই ১৯১৮ সালে তিনি নন্দীগ্রাম বি এম টি হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

১৯২০ সালে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন মহাত্মা গান্ধী। নিকুঞ্জবিহারী ছিলেন শান্তিকামী ব্যক্তি। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে পরিপুষ্ট। তিনি গান্ধীজীর ডাকে সামিল হলেন অসহযোগ আন্দোলনে। সেইসাথে খিলাফৎ আন্দোলনের সমর্থক হিসেবে নন্দীগ্রাম ও খেজুরীর বুকে খিলাফৎ সম্মেলনের আয়োজন করেন। তিনিই অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় অসহযোগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত প্রথম শিক্ষক হিসেবে নন্দীগ্রাম হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষকের চাকরি ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনে। যা সেই সময়ের বিচারে অত্যন্ত সদর্থক এবং বলীষ্ঠ পদক্ষেপ ছিল। এরপর ১৯২১ এর ১ লা মার্চ যোগদান করেন এই খেজুরীর কলাগেছিয়া জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক হিসেবে। এটি ছিল সে সময়কার বাংলার বুকে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ এবং প্রদর্শিত সত্যাগ্রহ ও অসহযোগ ভাবনায় প্রথম স্থাপিত জাতীয় বিদ্যালয়। যদিও তিনি এখানেও বেশিদিন থাকেননি। কয়েক মাস পরেই ডিসেম্বর মাসে এই বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধানশিক্ষক পরেশনাথ মাইতিকে বিদ্যালয়ের যাবতীয় দায়িত্ব তুলে দিয়ে কংগ্রেসের সর্বক্ষনের কর্মী হিসেবে নিজেকে যুক্ত করেন। 
নিকুঞ্জবিহারী মাইতি ও তাঁর স্ত্রী অহল্যা মাইতি

১৯২১ এর ২৪ শে ডিসেম্বর প্রিন্স অব ওয়েলসের কলকাতায় আগমন উপলক্ষে ১ লা ডিসেম্বর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে কলকাতায় পালিত হয় জোরদার হরতাল। সেখানে আন্দোলনকারী নেতৃত্ব ও স্বেচ্ছাসেবক সহ নিকুঞ্জবিহারী মাইতিকেও গ্রেফতার করে ব্রিটিশ পুলিশ। একবছর পর জেল থেকে বেরিয়ে ফের ১৮ দফা কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। নানা জনহিতকর কাজে তিনি ছিলেন সর্বাগ্রে। ১৯২৩ এর কেলেঘাই নদীর বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এলাকায়। সেসময় বন্ধু পদ্মলোচন সাহু এবং বিপীনবিহারী গায়েনের সঙ্গে বন্যা ও কলেরায় দুর্গত খেজুরী ভগবানপুরের জনগনের পাশে প্রত্যক্ষভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এছাড়াও ১৯২৫ সালে লোকাল বোর্ড নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি গ্রামাঞ্চলে পাকা রাস্তা নির্মাণে উদ্যোগী হন। ঠিক পরের বছর খড়গপুরে হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ শুরু হয়। সেসময় তিনি ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতৃত্ব এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 

১৯৩০ সালে গান্ধীজীর আহ্বানে জেলা জুড়ে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন হয়ে উঠলো ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে মারকাটারি লড়াই। ব্রিটিশের গুলিতে নিহত হলেন অসংখ্য মানুষ। সেই লড়াইতে প্রত্যক্ষভাবে সামিল হলেন নিকুঞ্জবিহারী মাইতি ও তাঁর স্ত্রী অহল্যা দেবী। ফের গ্রেফতার হলেন ১৯৩০ এর ২৫ শে এপ্রিল। এবার ১৫ মাসের জেল হল তাঁর। জেল যন্ত্রনার অবসান শেষে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়লেন সম্পূর্ণ নতুন এক কর্মসূচিতে। এবার তিনি অস্পৃশ্যতা বর্জনের কাজে নিয়োজিত করলেন নিজেকে। বেছে নিলেন নিজেরই জন্মস্থান খেজুরীর কলাগেছিয়াকে। একসাথে প্রায় ১৫০০ বিভিন্ন জাতের মানুষকে একসাথে বসিয়ে পংক্তি ভোজনের আয়োজন করলেন। সেখানে ছিলনা কোনও বাছবিচার। সে এক অভূতপূর্ব উদ্যোগ। এই অস্পৃশ্যতা বর্জনের জন্য সভার আয়োজন করলেন টিকাশী গ্রামে। ঠিক এই সময় শের খান চক গ্রামের শিব মন্দিরে উচ্চবর্ণের হিন্দু নয় বলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি কালাচাঁদ দাস ও অমৃতলাল দাসদের। তখন তিনি গিয়ে ঐ মন্দিরে আমরণ অনশন পালন করেন। 

আবারও আইন অমান্য আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন ১৯৩২ এ। এর পরের বছরের ২৬ শে জানুয়ারি কাঁথির দারুয়া ময়দান থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় ব্রিটিশবিরোধী কাজের জন্য। এবার ছয় মাসের জেল হয় তাঁর। আবার ১৯৪০ এর ৯ ই ডিসেম্বর গ্রেফতার হন। ফের ছয় মাসের জেল। ১৯৪২ এর ৯ ই আগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুনর্বার জেলে যেতে হয় তাঁকে। যেন কারাগারই হয়ে ওঠে তাঁর অন্যতম বসতবাটি। 

১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচনে তিনি বর্ধমানের উত্তর মিউনিসিপ্যাল নির্বাচন কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন এই মানুষটি। রাজনৈতিক পরিসরে অন্তর্ভুক্ত হলেন তিনি। ঠিক একবছর বাদে ভারত স্বাধীনতা পেলো। এরপর পশ্চিমবঙ্গে প্রাদেশিক সরকার গঠিত হল। প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে সেই প্রথম সরকারের মন্ত্রীসভায় তিনিই হলেন প্রথম শিক্ষামন্ত্রী। 

১৯৪৮ এর ২৩ শে জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। আর তিনি হলেন এই সরকারের উদ্বাস্তু, ত্রাণ, পুনর্বাসন এবং সমবায় দফতরের মন্ত্রী। তবে ১৯৫২ এর নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। ১৯৫০ সালে AICC এর সদস্যপদ পান। ১৯৫৫ সালে তিনি মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেসের সভাপতি পদে আসীন হন। ১৯৫৭ এর নির্বাচনে ঘাটাল লোকসভা থেকে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৬২ - ১৯৬৭ পর্যন্ত রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। অবশেষে ১৯৭০ এর ১৯ শে মে তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু এই মানুষটির দেশভক্তি ও ত্যাগ মেদিনীপুরের বুকে এক অনন্য ইতিহাস ও নজির তৈরি করে রেখেছে বলা যায়।

🍂

Post a Comment

0 Comments