জ্বলদর্চি

যদি প্রেম দিলে না প্রাণে/পুলককান্তি কর

চিত্র- শুভম দাস

যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

পুলককান্তি কর

ফেসবুক খুলেই নদীর পাড়ে কাশফুলের ছবি দেখে মনটা শূন্য হয়ে গেল ত্রিদিব এর। শরৎ এসে গেল। বেশ কয়েক দিন ধরে আকাশের রোদ দেখেই পূজোর রেশ মনে লাগছিল তার, আজ যেন সেটা বেশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। শরতের রোদটা বেশ ঝকঝকে। পরিষ্কার আকাশ বড্ড বেশী নীল লাগে। গাছের পাতায় রোদ যেন ছিটকে পড়ে। বন্ধু-বান্ধবদের কাছে শুনেছে এই সময় সবার মনে বেশ আনন্দ হয়, সবার কাছে, বিশেষ করে যারা প্রবাসে থাকে তাদের বাড়ী ফেরার আনন্দটাই সব থেকে বেশী বোধ হয়। ত্রিদিবেরও দেশের বাড়ী আছে। তবু শরৎ তাকে আনন্দ দেয় না। এই রোদের উজ্জ্বলতার মধ্যে কোথায় যে ‘মন কেমন’ আছে – বেশ বুঝতে পারে সে। রিনির এই বছরের পি.এইচ.ডি'র কাজ শেষ হবার কথা। বোধহয় ওদের ছুটি আর উনচল্লিশ দিন পরেই পড়বে। 'বোধ হয়' টা এই কারণে, রিনির ফোন আসাও হয়ে গেল দিন চারেক। আজকাল আর সে  তেমন করে দিন গোনে না। তিরুপতি ইউনিভার্সিটি তে পি. এইচ. ডি করছে রিনি। ওদের তো ঠিক পুজোর ছুটি পড়ে না। ত্রিদিবের দেশের বাড়ী পশ্চিম মেদিনীপুর। হলদি নদীর পাড় ঘেঁষে যে কাশবনের সারি চলে গেছে ওদের গ্রামের বাড়ীর পথে – সেই রাস্তাটার কথা খুব মনে পড়লো তার। এই দৃশ্যটা ভাবলেই দুটো ছোট্ট বাচ্চা ছেলে মেয়ে দৌড়ে যাবার স্মৃতি মনে আসে। ওর নিজের তো বোন নেই। বোধ হয় ছোটবেলায় পথের পাঁচালী দেখার স্মৃতিটা এখনও মনে গেঁথে আছে। এখন অবশ্য ওই বাচ্চা মেয়েটার জায়গায় গুরপ্রীতের মুখটা ভেসে উঠলো। বাচ্চা বেলার গুরপ্রীত। পাঞ্জাবী মেয়েরা কি আমাদের বাঙালী মেয়েদের মতো এমনি করে বিনুনি বাঁধে লাল ফিতে দিয়ে? বেশ লম্বা, ফর্সা তরোয়ালের মতো চেহারা। এই তলোয়ার সামলাতে পারবে মনোজ? বাঁকুড়ার ছেলে, সরল সাদা সিধে। কী করে গুরপ্রীতের মন জয় করলি বাবা তুই? করলিই যদি, নতুন ক্যাচাল আবার কী নিয়ে? যাকগে যাক, ওদের কথা বেশী না ভাবাই ভালো। কী গান শুনবে বসে সে? ‘ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়?’ নাকি, ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ।’ ধূত্। এখন এত স্নিদ্ধ সুর শুনতে মন চাচ্ছে না। ‘ইয়াদ কিয়া দিল নে কাঁহা হ্যায় তুম, এ দিল বাহার হ্যায় কাঁহা তুম – রিনি তোমার কথা কেন মনে আসছে না? এবার এলে কি বাবা মার সাথে কথা বলে ফাইনাল করবে? পি.এইচ.ডি করতে যাবার আগেই রেজিস্ট্রি করে গিয়েছিল সে। ভয় কি ছিল? জীবন কী এভাবে আগে থেকে 'বুক' করে রাখা যায়? ভাবো ত্রিদিব। জীবন একটাই। 
-- দাদা, অফিস যাবেন না নাকি আজ? কাজের মেয়ে টুম্পা তাড়া দিল। 
কোনও মতে একটা হুঁ দিয়ে পেপারটা টেনে নিলো ত্রিদিব। 
-- আপনি তো সাড়ে আটটায় বেরোন দাদা, এখন তো পৌনে ন'টা। শরীর কি ঠিক নেই? 
-- আছে। তুই যা, খাবার টাবার গুলো ভরে দে। স্নান করেই বেরিয়ে যাবো। 
-- না খেয়েই যাবেন? 
-- অফিস গিয়েই খেয়ে নেব। তুই চিন্তা করিস না। 
আজ না গেলেই হত। মাস তিনেক আগের ত্রিদিব এমন মুডে কতদিন ছুটি নিয়েছে আচমকা। কিন্তু ইদানীং অফিসে না গেলে কেমন শূন্য লাগে তার। গুরপ্রীতের মুখটা একটিবার না দেখলে...। এখন তো মনে হয় সপ্তাহে রবিবার না হলেই ভালো হত। কিন্তু গুরপ্রীত তো বোঝে না। মাঝে মাঝেই ডুব দেয়। অবশ্য ওর কী দায়? মনোজ কি বলে কখনও, গুরপ্রীত না এলে অফিস অন্ধকার হয়ে যায়? সারাদিন ফাইল নড়ে না। হাসির তরঙ্গ ওঠে না কিউবিকলগুলোর কোণে। এমন ঝকঝকে দাঁতের সারি, কপালের উপর মাঝে মাঝেই আছড়ে পড়ছে 'লকস' – কী বলে যেন বাংলায় – ‘অলক দাম’? ‘চূর্ণ কুন্তল’? চূর্ণ হবে না, ওটা তো কুচো কুচো চুল... যাকগে যাক, বাংলা জেনে কী হবে! যাঃ ভাবনটাই গেল কেটে। 
🍂

শাওয়ারটা ছেড়ে আবার বিষন্ন হয়ে গেল ত্রিদিব। রিনি শাওয়ারে স্নান করা একদমই পছন্দ করে না। বালতিতে জল ভরে মগে মগে ছোটবেলার অভ্যাস। ওদের গ্রামে আর কার বাড়ীতে শাওয়ার ছিল। টিউব ওয়েলের পাশে একটু ঘেরা মতো জায়গায় আড়াল করেই মেয়েদের স্নান। গুরপ্রীত কী করে? ও কি পাঞ্জাবের কোনও গ্রামের মেয়ে? চালচলন দেখে তো মনে হয় না। পাঞ্জাবের গ্রামে কি কূয়ো থেকে জল তুলতে হয়? হিন্দি ফিল্ম টিল্মে ওরকমই তো দেখা যায় বোধ হয়। মন্দারমনির হোটেলে কি শাওয়ারে... 
বাথরুমের দরজা টোকা দিয়ে টুম্পা জানালো, নটা বেজে গেছে। কোনও রকমে গা মুছে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে অফিস চলে গেল ত্রিদিব। আজ আর ভিড় বাসে গুঁতোগুতি করবে না সে। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একটা ট্যাক্সি ধরলো সে। মনোজের বাগড়া দেওয়ার কারণ কী? ভিন্ন জাতের মেয়ে? ভিন্ন ভাষায় কথা বলে, তাই? নাকি ভোগ হয়ে গেল। এইতো বাবা শনিবারই মন্দারমনি বেড়াতে গেলি গুরপ্রীত কে নিয়ে। শুধু হাত ধরাধরি করে ছেড়ে দিলি নাকি? আজকাল অবশ্য হোটেলে ম্যারেজ রেজিস্ট্রি সার্টিফিকেট না দেখালে এক ঘরে থাকতে দেয় না। নিশ্চই বেশী ঘনিষ্ঠতা করতে পারেনি। তা হলে অন্য লোকেরা যে দীঘা টীঘায় পরকীয়া করতে যায়, তারা কী করে? টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে? মনোজ তো সরল ছেলে, টাকা অফার করতে পারবে? অবশ্য নেশা বড় সাংঘাতিক জিনিস বাবা। মানুষ অনেক চালাক চতুর হয়ে যায় এই অবস্থায় পড়লে। গুরপ্রীত খুব সংস্কারী মেয়ে। বিয়ের আগে নিশ্চই ওসব কিছু করবে না। আর তাই বা কী করে বলা যাবে। বিয়ের আগে একা পুরুষের সাথে তুই গেলি কী করে? এত যখন সংস্কার! দূর ছাই মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না এমন মেয়ের। ওই হাসিতে বিষ। ওর দৃষ্টিতে বিষ। ভালো মানুষের মতো দেখতে হলে কী হবে। ওই তো কদিন আগে মনোজের মোবাইলটা ওর হাতে ছিল। হঠাৎ একটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ এল চুমু খাওয়ার ইমোজি দিয়ে। উপরে গুরপ্রীতের নাম। শারীরিক ঘনিষ্ঠতা না থাকলে কেউ এমন ইমোটিকন পাঠাতে পারে? ত্রিদিব ট্যাক্সি ড্রাইভার কে বলল, গাড়ি ঘোরাও। নিউটাউন যাবো না, বাবুঘাটে চল। 
-- কী যে করেন আপনারা? আগে বললে আপনাকে তুলতাম না। 
-- মানে কী? আমি যেখানে যাবো, সেখানেই যাবেন। আপনার টাকা তো প্রিফিক্সড ছিল না। মিটার ঘুরছে, যতক্ষণ ঘুরবো তার টাকা দেব। 
-- আপনাদের তো টাকা নিয়েই মতলব। আমার অন্য জায়গায় যাওয়ার আছে। আমি যেতে পারবো না। 
-- আমি কিন্তু পুলিশে কমপ্ল্যান করবো। 
-- যা খুশি করুন। 
দিল ব্যাটা মুডটার বারো বাজিয়ে। এখন গঙ্গার পাড়ে গিয়ে কী হবে? আচ্ছা অফিসেই বা সে যাবে না কেন? গুরপ্রীতের উপর রাগ করে চাকরী করা ছেড়ে দেবে সে? ড্রাইভার কে বলল, ‘ঠিক আছে নিউটাউনই চলুন’। কামাই করার কোনও মানেই হয় না। গতকাল তো দিব্যি পাশ কাটিয়ে গেছে সে। নিজের মুখে গুরপ্রীত যদিও কিছু বলে নি, তবু ফেসবুকে দিব্যি মন্দারমনির ফটো দিয়েছে সে। হোয়াটসঅ্যাপের স্ট্যাটাসেও প্যারা গ্লাইডিং এর ভিডিও। কথায় কথায় মনোজ বলল যাবার কথা। গুরপ্রীত খেয়াল করেছে ত্রিদিবের এড়িয়ে যাওয়া। মুখে কিছু বলেনি। অবশ্য বললেই বা কী বলার ছিল ওর। কেউ তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে বেড়াতে যাবে কি না সেটা তো অন্যের খারাপ লাগার উপর নির্ভর করে না। আর ওরই বা খারাপ লাগে কেন? রিনির সাথে সম্পর্কটা জমছে না বলে? কোথায় যেন পড়েছিল, কোন মানুষের প্রতি এই ধরনের আকর্ষণটা একটা বিশেষ কেমিক্যাল লোচা। গুরপ্রীতকে এত কেন ভাল লাগে তার? কেন ও সামনে এলে নিজেকে নিমন্ত্রণ করতে পারে না সে? এত প্রগলভতা আসে কোথা থেকে? কেন বারবার ব্যাকুল হয়ে ওর প্রতি মন ছুটে যেতে চায়? পূর্ব জন্মে কি কোনও সম্পর্ক ছিল ওর সাথে? কে বা এসব কথা আজকাল বিশ্বাস করবে? নিজেকে মনে মনে খুব করে ধিক্কার দিল সে। তার কাছে শরীরের টান কি এত? কই রিনিকে তো সেভাবে ছুঁয়েই দেখে নি সে। ছোটবেলার প্রেম, রেজিস্ট্রিও হয়ে গেছে, কারোর তো আপত্তি করার কিছু ছিল না। তার প্রতি এত আকর্ষণ তো হয় না! দেখতে তো সে গুরপ্রীতের থেকে মন্দ নয়। লাবন্য ভরা মুখ, ঈষৎ শ্যামবর্ণ। এক ঢাল কালো চুল। নাকি ভালোবাসাটাই ছিল না কখনও? ত্রিদিব বি.এস.সি পাশ করেই একটা সরকারী ইন্সিওরেন্স কোম্পানিতে চাকরী পেয়ে গেছিলো। রিনি কি পড়াশুনো নিয়ে সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স ভুগছে আজকাল? সেও ফোন করে না। করলেও দায়সারা। এক ডাক্তার বন্ধু ত্রিদিবকে বলল, খুব ডিপ্রেশন। 
-- ওষুধ? 
-- ডিপ্রেশনের ওষুধ খেলে লাভের চেয়ে ক্ষতি হয় বেশী। মন যখন ব্রেনের বাইরে থাকে, তখন কেমিক্যাল দিয়ে কী লাভ? সমাজের মধ্যে থেকেই কিছু বিহেভিয়েরাল থেরাপি করতে হবে। 
সে থেরাপিও হয় নি। তবে গুরপ্রীতের সাথে একটু ঘনিষ্ঠতা হবার পর ইদানীং আর ডিপ্রেশন ছোঁয়না ওকে, তবে স্ট্রেস বেড়ে গেছে অনেকগুণ। 
আর স্ট্রেস বাড়বেই না ই বা কেন? যাকে ভালবাসতে ইচ্ছে হয় খুব, অথচ উপায় নেই – তখন স্ট্রেস তো হবেই। সর্বোপরি ভালোবাসার মানুষ যদি সেই ভালোবাসা না বোঝে সেটা বড় কষ্টের। এ ভালোবাসা সে বোঝাবেই বা কী করে? অন্যের বান্ধবী, নিজেরও রেজিস্ট্রি হয়ে আছে দু বছর। কে সেধে সেধে শুধু পরকীয়ার রাজী হয়। প্রত্যেকেরই তো ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা আছে। কাউকে দোষ দেওয়া যায় না। 
অফিসে ঢুকতেই মনোজ বলল, ‘কী ব্যাপার ত্রিদিব, এত দেরী? শরীর টরীর ঠিক আছে তো?’ 
-- হুঁ। 
-- এত শুকনো লাগছে কেন?
 মনে মনে উত্তর দিল ত্রিদিব, তোর মতো কি রসে বশে থাকি শালা? 
শুধু মনোজ নয়, অনেকেই প্রশ্নটা করলো আজ। ওকে কি খুব অন্যরকম দেখাচ্ছে কিছু? বাথরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের গালে ঠাস করে একটা চড় কষালো সে। একটা মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে বেড়াতে গেছিল বলে চোখ মুখের এমন অবস্থা হয়েছে তার? কী আছে তোর গুরপ্রীত? এক্সট্রা কী আছে তোর? শালি – লাম্প অফ ফ্লেশ। জানিস তুই আমার মতো শেলি কিটস বায়রন? নিদেন পক্ষে গুলজার। জাভেদ আখতার? অমন তলোয়ারের মতো চেহারা ছাড়া... হুঁ ভারি তো তলোয়ার! টাইট কুর্ত্তি আর জিন্স পরলে পরিষ্কার পেটিটা বোঝা যায়। যা, ওই ভারী ভারী খাম্বা পা নিয়ে মনোজের সাথে শো গে যা। ছিঃ ছিঃ ত্রিদিব। নিজের দোষ ঢাকতে মেয়েটাকে ছোট করছো কেন? ওর কী দায় তোমার মনকে খুশী করার? এতক্ষণ সে এসে কেন জিজ্ঞাসা করেনি, 'কী হয়েছে আপনার ত্রিদিব দা?' – এইজন্য? জিজ্ঞাসা করলেই বা কী উত্তর দিতে তুমি? না না, রাগ রাগ মুখ থাকাই ভালো। আমিই একটা পাঁঠা, গামবার্ট, হামবাগ। যে মেয়েটা পাত্তাই দেয় না তার জন্য এত উদ্বেল কেন আমি? যে অন্য ছেলের সাথে মনে মনে শোওয়ার স্বপ্ন দেখে, তাকে চলতে ফিরতে একটু ছুঁয়ে দিয়ে কী আনন্দ পাও বাবা ত্রিদিব পারভার্ট! পারভারসনের লিমিট নেই তোমার। নানান অছিলায় গুরপ্রীতের গা ছুঁয়ে মন পাবে তার? তার থেকে তোমার কেমিক্যাল লোচা হয়, তোমার থেকে তার হয় না। বোঝার চেষ্টা না করার মতো বুদ্ধিহীন তো তুমি হয়ে যাওনি বাবা। মুখ হাত ধুয়ে ভদ্র বাচ্চার মতো অফিসের কাজ করো। 
-- কী ব্যাপার ত্রিদিব দা, কাল থেকে দেখছি কথা বলছেন না আমার সাথে। কিছু হয়েছে? আই মিন আমি কি কিছু করেছি? 
ভাঙা ভাঙা উচ্চারণের গুরপ্রীতের কথায় ত্রিদিবের কানে যেন অমৃত বর্ষণ হল। কথা না বলাটা খেয়াল করেছে তা হলে। লোকে বলে না মেয়েদের ছ'টা ইন্দ্রিয়। তবে ওর মনের ভাবও কি বুঝতে আরে গুরপ্রীত? 
মুখে বলল, কই, সেরকম কিছু নয় তো। 
-- কালকেও দেখলাম, আপনি কোনও কথা বললেন না। 
-- তেমন কোনও দরকারী কথা ছিল না বোধ হয়। 
-- আপনি কি শুধু আমার সাথে দরকারী কথা বলেন? এদিক ওদিক অনেক গল্পও তো করেন। 
তুমিও তো করতে পারতে বাবা! কই করোনি তো? নাকি আমি পুরুষ বলে আগ বাড়িয়ে কথা বলার দায় শুধু আমার? নাকি করোনি, লুকোনো পাপবোধ থেকে? আবার বোকার মতো বেশী ভাবছো ত্রিদিব! ওর পাপবোধ হতে যাবে কেন? মন্দারমনিতে মনোজের সাথে যদি গিয়েই থাকে সেটা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার। হয়তো দুদিন বাদে বিয়ে হবে ওদের। তাছাড়া বিষয়টা তো ওরা লুকোয় নি। তুমি কোন রাজার ব্যাটা বীরেন্দ্র যে তোমার কাছে এর জন্য ওর পাপবোধ হবে? তুমি ধর্মরাজ? 
-- কী হল ত্রিদিব দা, কিছু বললেন না যে? 
-- কী বলব? 
-- জিজ্ঞাসা করলাম যে কথা। 
-- তোমাকে আমি এড়িয়ে যাচ্ছি না গুরপ্রীত। আমি কেবল আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছি। 
-- ঠিক বুঝলাম না ত্রিদিব দা। এত ভালো বাংলা আমার মাথায় ঠিক ঢোকে না। 
-- ও বুঝে কাজ নেই। আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না। 
-- আপনি কি কোনও কারণে অসন্তুষ্ট? 
অসংখ্য কারণ আছে, তবু বলব কী করে গুরপ্রীত? সে অধিকারই তো নেই আমার। 
-- আবার চুপ করে আছেন। মানে নিশ্চই কিছু একটা হয়েছে ত্রিদিব দা? 
-- আমি নিজের উপরই অসন্তুষ্ট গুরপ্রীত। 
-- কেন? কিছু ঘটেছে? 
-- সব কথা তোমাকে বুঝিয়ে বলা যাবে না। 
-- আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল ত্রিদিব দা। আপনি লাঞ্চ এর সময় আমাকে একটা কল করবেন? বাইরে গিয়ে বলবো। 
বুকের মধ্যে হঠাৎ যেন দামামা বেজে উঠল ত্রিদিবের। কী কথা তার সাথে? কী এমন গোপন কথা? 'কোথায় বলবে?' 
-- ওই সামনের সিগন্যালটা পেরোলে ডানদিকে একটা রেস্টুরেন্ট আছে না, ওটা এ সময়টা খালি থাকে বেশ। 
-- তোমার বোধহয় কলকাতার বড় সব রেস্টুরেন্ট ঘোরা হয়ে গেছে? 
-- যা বলেছেন। একটু কোথাও বেড়ানো মানে তো বাইরে খাওয়া। তাই এমন জায়গায় বেরোই যাতে পাশাপাশি কোথাও খাওয়াও হয়ে যায়। 
কী বলবে আজ গুরপ্রীত? মনোজের ব্যাপারে সরাসরি কোনওদিন কথা বলে নি ও। ত্রিদিবও নিজে থেকে এই বিষয়ে কথা এড়িয়ে যায়। এটা ঠিক বিড়ম্বিত করার ভয় নয়, নিজেরই কষ্ট হয়। যাকে মন পেতে চায় সে অন্য কারোর – এইটা বোধহয় কোনও পুরুষই নিতে পারে না। আগেকার দিন হলে এই নিয়ে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে যেত। আজকাল তো সে বাহানা নেই। অগত্যা মনের কষ্ট ছাড়া অন্য কোনও লাভ হয় না। 
স্যুপের প্লেটটা দিতে গিয়ে গুরপ্রীতের হাতটা ছুঁয়ে গেল ত্রিদিবের হাতে। রিনরিন করে উঠল যেন সারা গা। কী সুন্দর লাগছে ওকে। ঠিক যেন স্বর্গের অপ্সরা। একটা পাতিয়ালা সালোয়ার স্যুট পড়ে আছে সে। চুলগুলো আজ খোলা। সারা পিঠে যেন ঝাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। হাতে একটা হীরের আংটি পরে গুরপ্রীত। খুব সুন্দর দুটো কুঁড়ির মধ্যে ছোট ছোট দুটো হীরে যেন ঠিক দুটো চোখের তারা। আঙ্গুলগুলোর নাড়াচাড়ায় যেন সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছে ত্রিদিব। 
-- আপনাকে একটা বিষয় জিজ্ঞাসা করার ছিল ত্রিদিবদা। 
-- বলো। 
-- আমার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া দরকার। বাবা-মা আসবে মাস দুয়েকের জন্য। যদি আপনার ওদিকে পাওয়া যায় তবে অফিসটা কাছে হবে। 
-- দু-মাসের জন্য ঘর কেউ ভাড়া দেবে না প্রীত। 
-- না না। আমি এক বছরের কনট্রাক্ট ই করবো। পি.জিতে থাকতে আমার খুব অসুবিধা হচ্ছে আজকাল। আর তাছাড়া বাঙালী খাবার দাবারে তো ঠিক আমরা অভ্যস্ত নই। এত পাতলা রান্না ঠিক মুখে রুচছে না। 
এর থেকে আকাশ থেকে চাঁদ হাতে পড়লে কম আনন্দ হত। ওর পাশের ব্লকেই তো ফ্ল্যাট খালি আছে। ভাড়া তো তেমন বিশেষ না।  অ্যাফোর্ডেবল। কী ভালো হবে তখন। ও একটা গাড়ী কিনে নেবে। রোজ আসা-যাওয়া একসাথে। গাড়ীর থেকে মোটরবাইকই ভালো। বেশ সপ্তপদী মার্কা 'এই পথ যদি না শেষ হয়' ভাবতে ভাবতে যাওয়া যাবে। বেশ কষেই ওকে ধরে বসতে হবে, নইলে একটা ব্রেক...। মনটা খুশী হয়ে গেল ত্রিদিবের। 'আমার পাশের ব্লকেই তো খালি আছে ফ্ল্যাট। চাইলে কালকে গিয়ে দেখে আসতে পারো। আমি চাবিটা নিয়ে রাখবো। 
-- কত বড় ফ্ল্যাটটা? 
-- টু বেড রুম। আরামসে থাকতে পারবে। দক্ষিণ-পূর্ব খোলা। চারতলার উপর। প্রচুর আলো বাতাস পাবে। 
-- ভালোই হবে ত্রিদিব দা। আপনি পাশাপাশি থাকলে মনে ভরসা ও পাবো। 
সে কথা আর বলতে। আমি মনে মনে সর্বক্ষণ তোমাকে আগলে রাখবো প্রীত। একটা হাওয়ার ঝলকও আমার চোখ এড়িয়ে ঢুকতে পারবে না তোমার কাছে। 
-- তোমার বাবা মা আসছেন যে? 
চুপ করে রইল গুরপ্রীত। 
-- পার্সোনাল ব্যাপার হলে নাই বা বলতে পারো। 
এত সুন্দর করে ঈশ্বর কেন বানিয়েছে ওই চোখ দুটো? এত মায়াদার, এত ঘন কালো। এখানে একটু খানি আশ্রয় কি তুমি দিতে পারো না প্রীত? কী পাতলা ঠোঁট দুটো। এত লাল? একেই কি কালিদাস পক্ক বিম্বাধরোষ্ঠ বলেছেন? বিম্ব মানে তো কুঁদলি। পাকা কুঁদলি কেমন হয়? লাল? কী রস ওই ঠোঁটে। মনোজ, কী ভাগ্যবান ব্যাটা তুই। 
-- না না, পার্সোনাল কিছু না। ওঁরা আসছেন কিছুটা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। 
-- মানে? 
-- বাবা আসছেন আমার বিয়ের ব্যাপারে আমার মতামতকে অগ্রাহ্য করে ওঁর বিধান শোনাতে। আর মা আসছেন বাবার গুস্সা কন্ট্রোল করতে। 
-- তোমার বাবা কি খুব রাগী? 
-- হ্যাঁ। 
-- তিনি কি তোমার অ্যাফেয়ারের ব্যাপারে কিছু জানেন? মানে তুমি কি কিছু বলেছ? 
-- ওঁকে বলার সাহস পাইনি। মাকে বলেছি। বাবাও মায়ের থেকেই শুনেছেন। 
-- ওনাদের সমস্যাটা কী? 
-- ওই একই ব্যাপার। জাত, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস। এদেশে বধু হত্যা প্রচুর হয়। 
-- কিন্তু আমি তো জানি, সারা দেশের মধ্যে পাঞ্জাব হরিয়ানায় ডমোস্টিক ভায়োলেন্স সব থেকে বেশী। 
-- ওগুলো স্ট্যাটিসটিক্যাল হিসাব ত্রিদিবদা। মানুষ মেয়ের জন্য স্বজাতিকেই তো বেশী প্রেফার করবে। 
-- তা ঠিক। তুমি নিজে কী চাও? 
-- আমি জানি না ত্রিদিবদা। আপনি তো আমার দাদার মতো, ভালো মানুষ। আপনি আমায় একটু গাইড করুন না! 
'দাদা' সম্বোধন কি ওর 'পাত্তা' কেটে দেওয়ার চাল? গুরপ্রীত কি ওর দুর্বলতা ধরে ফেলেছে? তাই ওর মনের ভাব টা বুঝতে চাইছে? সাবধানে কথা বলো হে ত্রিদিব। 
-- কী ব্যাপারে গাইড করার কথা বলছ? 
-- এই মনোজের ব্যাপারে। বাবা মার কথাও তো সত্যি। কালচারের তফাৎ আছে, ফুড হ্যাবিটের তফাৎ আছে। 
-- দ্যাখো, ভালোবাসা থাকলে এগুলো কোনও ম্যাটার করে না। কত বিদেশী এসে ভারতীয়দের বিয়ে করে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে, আর তোমরা তো একদেশের। 
-- মনোজের বাড়ীতেও তো একই সমস্যা ত্রিদিব দা। ওর বাবা-মা মানছে না বলেই তো রিসেন্টলি ও একটু আমাকে অ্যাভয়েড করছে। 
-- তুমি নিজে কী চাইছ প্রীত? তুমি কি মনোজকে খুব ভালোবাসো? 
-- খুব বাসি কিনা জানিনা ত্রিদিব দা। ওকে আমার ভালো লাগে। তাই বলে কি ঝগড়া করি না? যখন ঝগড়া করি, খুব করি। দিনের শেষে কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবলে ওর কথাই মনে পড়ে। 
তোমার কোনও চান্সই নেই ত্রিদিব। এর কথা শুনে কোনও ভাবেই মনে হয় না তুমি সামান্য হলেও ওর মনে আছো। মিথ্যে আশা ত্যাগ করো। মনোজকে ছাড়লেও তোমার কোনও লাভ হবে না। তোমার অজানা কোনও ভ্রমর এমন ফুলের মধু খাবে। তার চেয়ে ফুল নিজেই যে ভ্রমরকে দিয়ে মধু বিলোতে চায় সেটাই তো ভালো সাজেশন হবে। বলতেও ভালো, শুনতেও ভালো। 
-- তাহলে আর ভাবছো কেন প্রীত। ঈশ্বরের নাম নিয়ে মনোজকে বিয়ে করো। বাবা-মা দুদিন কষ্ট পাবে, তারপর ঠিক মেনে নেবে। আমাদের রাজ্যে আকছার হয়, তোমাদেরও হবে। যতই হোক ওরা বাবা মা, কতদিন না মেনে থাকবে? 
নিজেকে বেশ বিপ্লবী বিপ্লবী মনে হলো ত্রিদিবের। বাঙালী মাত্রই বিপ্লব বিদ্রোহ ভালোবাসে। আগে প্র্যাকটিক্যালি করত এখন শুধু চিন্তায় আর মননে। 'একদিন যখন তোমার ছেলে মেয়ে হবে, তখন দেখো নাতে-নাতনীর মুখ চেয়ে কোনও পক্ষই দূরে থাকতে পারবে না'। 
বড় প্রগলভতায় পেয়েছে এখন ত্রিদিবকে। 'প্রেমের জয় শুধুমাত্র প্রেম দিয়ে হয় না, সংকল্প ও লাগে। অনেক প্ল্যানিং লাগে। ধরো তোমার বাবা যদি বলে... 
    বড় চিন্তা-ক্লিষ্ট লাগছে গুরপ্রীতের মুখটা। ত্রিদিব খেয়াল করলো ওর মুখটা হাক্সাগোনাল। বয়স হলে যদি ফ্যাটটা শুকিয়ে যায়, মুখটা করোটির মতো মনে হবে। লং হাতাটা গুটিয়ে খাচ্ছিল গুরপ্রীত। এই শনিবার মন্দারমনি যাবার আগের দিনই বোধহয় হাতে ওয়াক্সিং করিয়েছিল, একটু আধটু খোঁচা খোঁচা মত চুল গজিয়েছে ওখানে। এই চেষ্টাটা ওর দেখতে একদম ভালো লাগে না। রিনির তো এইসব বালাই নেই। ভগবান দত্ত। ওর ওয়াক্সিং লাগে না। গুরপ্রীতের চোখের কোনাটা চিকচিক করছে কেন? 
-- এমা, পাগল মেয়ে। কাঁদছো কেন? 
হঠাৎ ওর হাত দুটো বুকে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো গুরপ্রীত। 'আর পারছি না ত্রিদিব দা। আমি কোনও পক্ষকে হারাতে চাই না।' ইস! মনোজেরা কত ভাগ্যবান। কত ভাগ্যবান ওর বাবা-মা। সবার জন্য কত ভালোবাসা ওর। ওই ভালোবাসার এক কণাও কি ওর জন্য বরাদ্দ হতে পারতো না? আস্তে করে হাতটা ছাড়িয়ে ওয়েটারকে ডাকলো ত্রিদিব।

Post a Comment

0 Comments