জ্বলদর্চি

গাঁজা /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৮৫
গাঁজা

ভাস্করব্রত পতি

"এক টানেতে যেমন তেমন
দু'টানেতে রোগী
তিন টানেতে রাজা উজির
চার টানেতে সুখী। 
ছিলিম এর কি মহিমা বাবা... 
সুখী, সবাই সুখী। 
পাঁচ টানেতে মাটি ছেড়ে শূন্যে ওঠা যায়
ছ টানেতে আকাশেতে ভেসে থাকা যায়। 
সাত টানেতে তুমি হবে ব্রম্ভা বিষ্ণু কালী, 
আট টানেতে স্বর্গ নরক সবই পাবে খালি। 
দেখাব নাকি, খালি ভরি দেখাব নাকি... 
ন' টানের কি মহিমা! 
তুমি ব্রম্ভ ভোগী! 
সমুদ্র, এ যে সমুদ্র, চারিধারে সমুদ্র। 
সমুদ্র মন্থনে ওঠে অমৃতের ভান্ড
তাই নিয়ে দেবাসুরে তুলকালাম কান্ড। 
অমৃতেরই ছিটা পড়ে গজাল যে ঘাস
তাই থেকে পৃথিবীতে হল গাঁজার চাষ। 
ও গাঁজার চাষ রে দাদা
ওরে সেই গাঁজা খেয়ে এসে শিব
হলেন মহাযোগী। 
তিন টানেতে রাজা উজির, চার টানেতে সুখী। 
সবাই সুখী, ছিলিমে সুখী। 
ওরে ওরে এ এয়াসা বেয়সা দম নেহি... 
এ শালা গাঁজা কা দম হ্যায়।"
বিখ্যাত 'ত্রয়ী' সিনেমার জনপ্রিয় এই গানটি গেয়েছিলেন কিশোর কুমার এবং স্বপন চক্রবর্তী। এই গানে গাঁজা সেবনের অভিনয় করেছিলেন কেষ্ট মুখার্জী, মিঠুন চক্রবর্তী এবং সৌমিত্র ব্যানার্জী। গাঁজা নিয়ে এটি একটি অসাধারণ গান ছিল বাংলা সিনেমার ইতিহাসে। আসলে নিষিদ্ধ এই গাছ সম্পর্কে আমাদের সকলেরই কমবেশি আগ্রহ আছে। সেবনের ইচ্ছেও হয় অনেকের। কিন্তু আইন ও নিষেধাজ্ঞার নাগপাশে এই গাছ বাড়িতে রোপনের অনুমতি নেই। কোথাও কোথাও গোপনে এবং প্রশাসনের দৃষ্টি এড়িয়ে হয়তো চাষাবাদ চলে। নেশার দ্রব্য হলেও এই গাছের ভেষজগুণ অনস্বীকার্য। 
'এক টানেতে যেমন তেমন' গানের অভিনয়ে কেষ্ট মুখার্জী

"নিত্যানন্দকরী সদা শুভকরী ত্বং গঞ্জিকামঞ্জরী। 
ভঙ্গা কোমল পত্রতঃ চিরহরিৎ বর্ণা চ যোগপ্রদা॥ 
সা ত্বং চ্যুত রসা গণস্য সুখদা শৈবেষু সংপূজিতা। 
ত্রিমূর্তিং দধতে নিজাঙ্গবলতঃ শম্ভোহি ধ্যানপ্রদা॥"
অর্থাৎ তুমি তো শিব ও শিবভক্তের প্রিয় ও পূজিত মঞ্জরী স্বরূপা গঞ্জিকা। যার চিরহরিৎ বর্ণের কোমল পত্রগুলিকে ভঙ্গা নাম ধারণ করায়, যে বৃক্ষের নির্যাসই চাতরস নামে পরিচিত। যে মঞ্জরীর শক্তিতে শিবের ধ্যান, শিবের যোগ সাধিত হয়, সেই বৃক্ষই নিজ শক্তিতে ত্রিমূর্তি ধারণ ক'রে থাকে। সেটি নিত্যই আনন্দ ও শুভদা প্রদান করে। এই চাতরসই আমাদের পরিচিত 'চরস'। বিদেশে যা 'হাসিস' নামে খ্যাত। 

পশ্চিমবঙ্গে ছাড়াও চেন্নাই, পাঞ্জাব, আসাম, হিমালয়ের পাদদেশ, কাশ্মীর, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড এলাকায় এগুলি জন্মায়। মূলতঃ শীতের সময় হয়। লম্বায় ৭ - ৮ ফুট। পাতার কিনারাগুলি করাতের দাঁতের মত খাঁজকাটা। উপরের পাতায় তিনটি এবং নিচের পাতায় ৫ - ১১ টি হাতের আঙুলের মত বিভাজন আছে। তাই এটি 'ত্রিমূর্তি'। এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে গাছে ফুল আসে। এরপর ফল হয়। চ্যাপ্টা ফলের গায়ে কাঁটা থাকে। 

স্ত্রী ও পুরুষ ভেদে দু'রকমের গাছ হয়। স্ত্রী এবং পুরুষ উভয়প্রকার গাছের শুকনো পাতাকেই বলে 'সিদ্ধি' বা 'ভাং'। একটু কালচে সবুজ রঙের হয় তা। আর এই গাছের স্ত্রী পুষ্পমঞ্জরী থেকে মেলে 'গাঁজা'। যা কিনা দেবাদিদেব মহাদেবের খুব প্রিয়। প্রবাদে রয়েছে --
'ঘরে নেই ভাংভুজা। 
নিত্য করেন শিবপূজা।।'
এই গাছকে সংস্কৃতে 'সংবিদা মঞ্জরী'ও বলে।  আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য এই গাঁজা তৈরির বিবরণ দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, "মঞ্জরীগুলি খুবই ঘন সন্নিবিষ্ট, যখন এই মঞ্জরী পুষ্ট হয়, তখন একটা গন্ধ বেরোয়। তখন ওগুলিকে কেটে নিয়ে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা রৌদ্রে রেখে তারপর তাকে পা দিয়ে মাড়ানো হয়। আর ঐ বীজ, মঞ্জরী, পত্রগুলি ঐ চটচটে আঁঠার সঙ্গে জড়িয়ে জট পাকিয়ে যায়, এইটাই হ'লো গাঁজা।" এছাড়া এর স্ত্রীগাছের কাণ্ড, পাতা ও ফুল থেকে যে আঁঠালো রস পাওয়া যায়, তা হল 'চরস'। সেটিও নেশাকর দ্রব্য। বলতে গেলে আদ্যন্ত নেশায় ভরপুর। ইউরোপ ও আমেরিকায় এটি 'মারিজুয়ানা' নামে চেনা যায়। Cannabaceae পরিবারভুক্ত গাঁজার বিজ্ঞানসম্মত নাম Cannabis sativa। এছাড়াও আরও যেসব প্রজাতি রয়েছে --
Cannabis indica
Cannabis ruderalis

গাঁজার (ভাং) মধ্যযুগীয় নাম 'মাতুলী'। অর্থাৎ যা মত্ততা নিয়ে আসে। 
 মদ + উলচ্ (ঙীপ্ প্রত্যয় ক'রে) 
সংস্কৃতে বলে 'বিজয়া' এবং 'ভঙ্গা'। 'ভঙ্গ' থেকেই 'ভঙ্গা' হ'য়েছে। আসলে এর রসশক্তি দেহের অভ্যন্তরে গিয়ে আমাশয়ের জীবানুকে লঘুপাকের মাধ্যমে ভেঙে দেয়। শ্রবণা নক্ষত্রের উদয়ের সময় এই ভেষজের নতুন পাতা গজায়। এই উদয়কালকে বলা হয় শ্রাবণ মাসের উদয়কাল। তান্ত্রিকদের বিশ্বাস, এই পাতার রস খেলে যাবতীয় প্রতিকূল কামনা বাসনার বিজয় করা সম্ভব। সেজন্য এর অন্য নাম 'বিজয়া'। এই বিজয়ার রসাস্বাদনের মাধ্যমে দেহকে আস্বাদনসিক্ত করলেই দুর্গাপূজার অন্তিমপুণ্য সম্ভব। সেজন্য দুর্গাদশমীর অন্য নাম 'বিজয়া দশমী'। সেইদিন গাঁজাসেবন একটি উত্তম কাজ! শুধু বিজয়া দশমী নয়, যেকোনো পূজার (সরস্বতী, কালী, লক্ষ্মী, জগদ্ধাত্রী) শেষে বিসর্জনের সময় সিদ্ধি দিয়ে তৈরি করা হয় বিশেষ পানীয়। পশ্চিমবাংলার বুকে তা বেশ জনপ্রিয় বহুকাল থেকেই। পাকা কলা, বেলপাতা, গুড় বা চিনি, নারকেল গাছের শেকড় একসাথে বেটে মেশানো হয় সিদ্ধি। অদ্ভুত এই সুমিষ্ট সরবত খাওয়ার পর হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়ে প্রলাপ বকতে শুরু করে অনেকেই। আকাশে ওড়ার ভাব তৈরি হয় তখন। এটি সেবনের পর আমাদের পঞ্চেন্দ্রীয় উত্তেজনায় টগবগ করে নেশাতুর হয়ে পড়ে। হর্ষ ও আহ্লাদে ভরপুর হয়ে ওঠে মনপ্রাণ। সেজন্য একে বলে 'হর্ষিণী'। গাঁজা, সিদ্ধি, ভাং খেলে দারুণ আনন্দ পাওয়া যায়। শরীর মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তাই এটি 'ত্বরিতানন্দ'। এছাড়া একে গুজরাটিতে ভাংগো, চরস, তেলুগুতে করম ঘেন্টু বলেও ডাকা হয়। কেউ কেউ এর আরও নাম দিয়েছে 'জয়া' এবং 'চপলা'। 

অর্শ আক্রান্ত জায়গায় দুধের সঙ্গে গাঁজাকে বেটে প্রলেপ দিলে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়। আর মূলত দুধের সাথে গাঁজা খাওয়ার প্রচলন লক্ষ্য করা যায় বেশি। সিদ্ধি বেশ বেদনানাশক, কামোত্তেজক, মুত্রকারক, অবসাদক ও নিদ্রাকারক। শিশু ও বৃদ্ধদের অতিসারে, অম্ল অজীর্ণে, উৎসাহ হীনতায়, যৌন সম্ভোগে অতৃপ্তি, ধনুষ্টঙ্কার, ঠাণ্ডা লাগা, বাক্যে জড়তা, প্রস্রাব করতে দেরী হওয়া, গেঁটে বাত, পচা ঘা, অত্যধিক রজস্রাব নিরসনে এই গাছের ব্যবহার উপযোগী। 
গাঁজা সেবনের রকমারি কলকে

গোয়ার এক পর্তুগিজ ইহুদি চিকিৎসক গার্সিয়া দে অর্টা 'কলিকুইস ডস সিম্পল ই ড্রোগাস দা ইন্ডিয়া (১৫৬৩)' বইতে লিখেছেন পর্তুগিজ ও গুজরাটের বাহাদুর শাহ কর্তৃক ভাং ব্যবহারের কাহিনি। ভারতের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে গাঁজার ব্যবহার করা হত শরীরের ব্যাথা বেদনার উপশমের জন্য। এদের আঁশ থেকে সুতা ও দড়ি তৈরি হয়। বীজ থেকে তেল পাওয়া যায়। শিবরাত্রির মহাসন্ধিক্ষণ ও হোলি উৎসবের আনন্দঘন পরিবেশে ভাংয়ের সরবত একটি উপাদেয় খাদ্য। গরমকালে রাস্তাঘাটে, পাড়ায় পাড়ায় মাথায় কুলপির হাঁড়ি চাপিয়ে বিক্রি করতে দেখা যায় সিদ্ধি মেশানো কুলপি আইসক্রিম। আর এলাকার 'পাতাখোর'দের কাছে গাঁজার সুখটান তো অনির্বচনীয় অনুভূতি। কলকের মধ্যে বা সিগারেট ও বিড়ির সাথে গাঁজা মেশানো ধোঁয়া তৈরি করে এক আলাদা মৌতাত। এইসব গাঁজাখোরদের প্রায়শই নানা ধরনের কঠিন রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। প্রবাদে রয়েছে -- 'সিদ্ধি খেলে বুদ্ধি বাড়ে, গাঁজা খেলে লক্ষ্মী ছাড়ে।' ভারতের বুকে ভাং লস্যি আর ভাং ঠাণ্ডাই তো অসম্ভব জনপ্রিয়। আর ভাং খেয়ে ঘুঘুরামের পরিনতি কি হল, তা নিয়ে 'ঘুঘুরামের সিদ্ধিলাভ' কবিতায় সুনির্মল বসু লিখেছেন এক অসাধারণ ছড়া --

"পালোয়ান ঘুঘুরাম শুয়ে ছিল দাওয়াতে,
চোখ তার ঢুলুঢুলু ভাং বেটে খাওয়াতে।
হারুদের দারোয়ান, পালোয়ান নেহাতই,
খাসা তার বপুখান, ভাষা তার দেহাতী।
ভয় পেলে তোত্‌লায়, কথা যায় জড়িয়ে;
একটু সময় পেলে নেয় খালি গড়িয়ে।
কাজ নেই আজ তার, বাবু নেই বাড়িতে,
চ’লে গেছে কলিকাতা সন্ধ্যার গাড়িতে।
ঘুঘুরাম তাই আজ ভাং খেয়ে চুটিয়ে,
শুয়েছে দাওয়ার পরে দেহ তার লুটিয়ে।
ঝুরু ঝুরু হাওয়া বয়, খাওয়া হ’ল প্রচুরই,
মোটা মোটা রোটি আর মুচ্‌মুচে কচুরি।
মাঝে মাঝে মোচে তার তা'ও দেয় দু’হাতে,
ভাং খেয়ে, মনে তার রং ধরে উহাতে।
হারুর বাড়িতে নেই, চ’লে গেছে তাহারা,
ঘুঘুরাম একা তাই দেয় বাড়ি পাহারা।
সহসা ঘুমেতে তার চোখ এল জড়িয়ে,
নাক ডাকে খাটিয়াতে দেহখানা ছড়িয়ে।
নাক ডাকে ঘুঘুরাম, বাঘ ডাকে যেন রে,
ঘর দোর কেঁপে ওঠে মনে হয় হেন রে।
সহসা ঘুঘুর ঘুম ভাঙে রাত দু’পরে,
দেখে দুটো ভাঁটা চোখ দাওয়াটার উপরে।
কালো সাদা দাগ গায়ে প’ড়ে গেল নজরে
‘বা-বা-বা-বা বাঘ’ বলে তোত্‌লায় সজোরে।
নিঝুম নিথর গ্রাম, কেউ নাই জাগিয়া;
ঠকাঠক্ কাঁপে ঘুঘু দাঁতে দাঁত লাগিয়া।
থাবা ঘসে বাঘা ব’সে তেজ তার ভারি যে—
গুঁড়ি মেরে কাছে আসে লেজ তার নাড়ি’ যে।
কাঁপা গলা চাপা সুরে ঘুঘু বলে কাতরে, 
'দো দো দো দোহাই বাঘা, বনে ফিরে যা তো রে। 
আমি মা মানুষ নই, আমি ঘুঘু পাখী তো,
পিঁজরায় বসে আমি ঘু-ঘু-ঘু-ঘু ডাকি তো।'
কে শোনে ঘুঘুর কথা, রক্ষা কি আছে রে?
গুটি গুটি আসে বাঘা খাটিয়ার কাছে রে।
ঘুঘু চায় মিটিমিটি, কোথা আর পালাবে,
আরো যদি কাছে আসে লাঠি তার চালাবে।
আরে একি, বাঘা দেখি ভর দিয়ে দু’পায়ে,
কাছে এসে অবশেষে নাচে নানা উপায়ে!
খায় কভু ঘুরপাক ফ্যাঁচ্ ফ্যাঁচ্ আওয়াজে,
তারপর শুরু হয় ডিগবাজি খাওয়া যে!
ঘুঘুরাম হেসে ওঠে দেখে কেরামতি রে,
বাঘ বটে, তবু সেটা সুরসিক অতি রে।
সারা রাত কেঁদো বাঘ নেচে কুঁদে চেঁচায়ে
এখন ঘুমায় প’ড়ে লেজখানি পেঁচায়ে।
প্রভাতের ঝির্‌ঝিরে বায়ু গায়ে লাগিয়া,
সিদ্ধির ঘোর কাটে, ঘুঘু ওঠে জাগিয়া।
চেয়ে দেখে পাশে তার শুয়ে আছে হুলোটা,
সারা গায়ে লেগে আছে কাদা আর ধুলোটা।
পাশে তার প’ড়ে আছে সিদ্ধির বাটি যে,
এইবার ঘুঘুজীর মনে পড়ে খাঁটি যে --
বাঘ নয় হুলো ওটা, সিদ্ধির আমেজে,
বাঘ তারে ভেবে ভয়ে সারা রাত ঘামে যে।
হুলোটাও বাটি চেটে, নেশা তার ধরেছে
তারি ঝোঁকে সারা রাত নেচে কুঁদে মরেছে।
এখন ঘুমায় প’ড়ে সুখে মুখ গুঁ’জিয়া,
হেসে ওঠে ঘুঘুরাম ব্যাপারটা বুঝিয়া।"
🍂

Post a Comment

0 Comments