সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস
কথক- চন্দ্রিমা দাস, গ্ৰাম- যুগীশোল, থানা- নয়াগ্ৰাম, জেলা- ঝাড়গ্ৰাম
অনেকদিন আগে গোপীনাথপুর নামে একটি গ্ৰামে একটি পুকুর ছিল। সেটি কোনো সাধারণ পুকুর ছিল না, তা ছিল জাদুর পুকুর। সেই পুকুরের অনেক বিশেষত্ত্ব ছিল। কিন্তু তারমধ্যে এই গ্ৰামের মানুষ একটাই জানত, আর সেটি হল - কারোর বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে এই পুকুর থেকে থালাবাসন চাইলে পুকুর তাকে থালাবাসন দিয়ে সাহায্য করত। কিন্তু শর্ত একটাই, গুণে গুণে পরিষ্কার করে সব থালাবাসন আবার ফিরিয়ে দিতে হবে।
একদিন গ্ৰামের একজন মহিলা তার ছেলেকে নিয়ে ওই জাদুর পুকুরের দিকে যাচ্ছিল। ছেলেটি তার মাকে জিজ্ঞাসা করে-“মা আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
তখন তার মা বলে-“বাবা, আমরা ওই জাদুর পুকুরের কাছে যাচ্ছি।”
ছেলেটি বলে-“কেন?
তখন তার মা বলে-“কালকে যে তোর জন্মদিন। আর তোর জন্মদিন উপলক্ষ্যে কাল আমাদের বাড়িতে ভোজ হবে। অনেক লোক খাওয়া দাওয়া করবে। তাই জাদুর পুকুরের কাছ থেকে থালাবাসন চাইতে যাচ্ছি।”
ছেলেটি তখন বলে-“মা, আমি কী কিছু চাইতে পারি?”
তখন তার মা বলে-“না বাবা, তুমি কোনো কিছু চাইবে না।”
তখন ছেলেটি বলে-“কেন মা?”
🍂
তার মা বলে-“জাদুর পুকুর আমাদের দরকারে থালাবাসন দেয় এই যথেষ্ট। এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়া ঠিক না।”
এরপর তারা দুজনে জাদুর পুকুরের কাছে পৌঁছায়।
জাদুর পুকুরের কাছে পৌঁছে ছেলেটির মা বলে-“হে জাদুর পুকুর, কাল আমাদের বাড়িতে অনুষ্ঠান আছে। আর সেখানে অনেক লোক খেতে আসবে। তাই অনেক থালাবাসনের দরকার। তুমি যদি কালকের জন্য আমাকে থালাবাসন দাও তাহলে আমি খুবই উপকৃত হব। আর তোমার শর্তানুসারে আমি সব থালাবাসন যথাযথভাবে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।”
তখন ছেলেটি বলে-“মা, আমাদের বাড়িতে অনুষ্ঠান তো কালকে। তাহলে তুমি জাদুর পুকুরের কাছে থালাবাসনের কথা আজ বলে যাচ্ছ কেন? কালকে বলতে পারতে।”
তার মা তখন বলে-“হ্যাঁ তা ঠিক কথা। কিন্তু বাবা, জাদুর পুকুরের কাছে আগেরদিন বলে গেলে সে পরেরদিন যথাসময়ে থালাবাসন পুকুর ঘাটে রেখে দেয়। তাই আগে থেকেই বলে যেতে হয়।”
ছেলেটি বলে-“মা, আমি কিছু চাইব?”
তার মা বলে-“না একদম না।”
এইবলে ছেলেটি ও তার মা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাস্তায় যেতে যেতে গ্ৰামের প্রধানের সঙ্গে তাদের দেখা হয়।
তাদের দেখে গ্ৰাম প্রধান বলে-“কী গো পলাশের মা, কোথায় গিয়েছিলে?”
তখন ছেলেটির মা বলে-“আজ্ঞে দাদা, জাদুর পুকুরের কাছে গিয়েছিলাম। আসলে কাল তো আমার ছেলের জন্মদিন। তাই থালাবাসন চাইতে গিয়েছিলাম।”
প্রধান বলেন-“ও…আচ্ছা। ঠিক আছে তাহলে আমি এখন আসি।”
তখন ছেলেটির মা বলে-“ কালকে কিন্তু আপনিও আসবেন দাদা। আর পরিবারের সবাইকে নিয়ে আসবেন।”
প্রধান তখন বলেন-“আচ্ছা ঠিক আছে।”
এরপর সবাই যে যার ঘরে চলে যায়। পরেরদিন ছেলেটির মা পুকুরের কাছে এসে দেখে জাদুর পুকুর তার বলা মতো সব থালাবাসন পুকুর পাড়ে রেখে দিয়েছে। ছেলেটির মা জাদুর পুকুরকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেই থালাবাসন গুলো নিয়ে চলে যায়।
এইভাবে জাদুর পুকুর গ্ৰামের মানুষের উপকার করতে থাকে।
একদিন এক বৃদ্ধ মানুষ ওই পুকুরের কাছে আসে। সেই বৃদ্ধের বাড়ি গোপীনাথপুরে নয়। গোপীনাথপুরের পাশের গ্ৰাম অমরনাথপুরে তার বাড়ি।
সেই বৃদ্ধ জাদুর পুকুরের কাছে এসে বলে-“হে জাদুর পুকুর। তুমি আমাকে দয়া করো। আমি খুব গরীব। লোকের কাছ থেকে ধার দেনা করে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছি। তুমি দয়া করে আমাকে যদি থালাবাসন দাও, তাহলে আমার খুব উপকার হয়। কারণ এতজন মানুষকে খাওয়াতে এত থালাবাসন লাগবে যে তা কেনার সামর্থ্য আমার নেই। তুমি যদি দয়া করো তাহলে আমি এ যাত্রায় বেঁচে যাই।”
সেইসময় সেখান দিয়ে গ্ৰামের প্রধান যাচ্ছিলেন। তিনি পুকুর পাড়ে ওই বৃদ্ধকে দেখে তার কাছে এলেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলেন-“কে তুমি? আর এই পুকুরের কাছে কী করছ?”
তখন বৃদ্ধ বলে-“আজ্ঞে, আমি রহিম। পাশের গ্ৰামে আমার বাড়ি। আমি এই পুকুরের কাছ থেকে থালাবাসন চাইতে এসেছি।”
প্রধান তখন বলেন-“কিন্তু রহিম ভাই, এই গ্ৰামে যে একটা নিয়ম আছে। তা হল, এই জাদুর পুকুরের থালাবাসন একমাত্র এই গ্ৰামের মানুষরাই ব্যবহার করতে পারে। অন্য কোনো গ্ৰামের মানুষ নয়।”
বৃদ্ধ বলে-“আমাকে দয়া করুন প্রধান মশাই। আমি খুব গরীব। এত থালাবাসন কেনার সামর্থ্য আমার নেই।”
তখন প্রধান বলেন-“আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু একটা কথা, অনুষ্ঠান শেষ হলে গুণে গুণে সব থালাবাসন তোমাকে ফেরত দিতে হবে। আর ফেরত দিতে না পারলে জাদুর পুকুর তোমার যে কী অবস্থা করবে তার তুমি ভাবতেও পারবে না।”
বৃদ্ধ বলে-“আজ্ঞে প্রধান মশাই, আমি যথাযথভাবে সব থালাবাসন ফেরত দিয়ে যাব।”
এইবলে বৃদ্ধ ও প্রধান সেখান থেকে চলে যায়।
বৃদ্ধ পরেরদিন এসে জাদুর পুকুরের কাছ থেকে থালাবাসন নিয়ে যায়। এরপর শান্তিপূর্ণভাবে বৃদ্ধের মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বৃদ্ধ সমস্ত থালাবাসন ধুয়ে পরিষ্কার করে গুনতে থাকে। কিন্তু গোনার সময় দেখে একটা থালা কম পড়ছে। তখন সে আরও ভালো করে গুণে। কিন্তু দেখে না সত্যিই একটা থালা কম পড়ছে। তখন বৃদ্ধ তার বউকে ডাকে।
তার বউ আসতে বৃদ্ধ রহিম তাকে বলে-“বউ, একটা থালা কম পড়ছে। কোথায় গেল বল তো!”
তখন বৃদ্ধের বউ বলে-“অনুষ্ঠান বাড়ি, কে নিয়ে গেছে জানব কেমন করে।”
বৃদ্ধ বলে-“কিন্তু আমাকে তো সব বাসন গুণে গুণে ফেরত দিতে হবে। আর তা না হলে গ্ৰামের মানুষের সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জাদুর পুকুরের রোষের উপরও পড়তে হবে।”
তখন তার বউ বলে-“কী আর করবে। অনুষ্ঠান বাড়ি কে নিয়ে গেছে তুমি জানবে কী করে। আর একটাই তো থালা ও কিছু হবে না।”
বৃদ্ধ বলে-“কিন্ত আমি গ্ৰামের মানুষদের এমনকি গ্ৰামের প্রধানকে কী বলব? আর ওরা যদি এই কথা জানতে পারে তো আমার অবস্থা যে কী হবে তার তুমি বুঝতে পারছ।”
তার বউ তখন বলে-“কেউ জানতে পারবে না। তুমি রাত্রিবেলা গিয়ে পুকুরের কাছে সব থালাবাসন রেখে দিয়ে আসবে। আর কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে সব বাসন ফেরত দিয়ে দিয়েছ।”
এরপর বৃদ্ধ আর কথা না বাড়িয়ে ওর বউ এর কথা মতো রাত্রিবেলা গিয়ে পুকুরের কাছে সব থালাবাসন দিয়ে আসে।
আর পুকুরকে উদ্দেশ্য করে বলে-“হে জাদুর পুকুর, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমার বিশ্বাস রাখতে পারলাম না। আর একটা কথা, যে তোমার বাসন নিয়েছে তুমি তার উপযুক্ত শাস্তি দাও।” এইবলে বৃদ্ধ সেখান থেকে চলে যায়।
কিছুদিন পর গ্ৰামের এক ভদ্রলোক ওই পুকুরের কাছে থালাবাসন চাইতে যায়। আর নিয়ম মাফিক পরেরদিন থালাবাসন আনতে যায়। কিন্তু গিয়ে দেখে পুকুর পাড়ে কোনো থালাবাসন নেই। সে রীতিমতো অবাক হয়ে যায়। সে সেখান থেকে এসে গ্ৰামের প্রধানকে এই কথা বলে।
তখন গ্ৰাম প্রধান বলেন-“তুমি তো জানো, পুকুরের কাছ থেকে আগে যে থালাবাসন নিয়ে গেছে সে ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত পুকুর আর থালাবাসন দেয় না।”
লোকটি তখন বলে-“কিন্ত কে নিয়ে গেছে?”
প্রধান বলেন-“পাশের গ্ৰামের রহিম ভাই নিয়ে গিয়েছিল। হয়তো সে এখনো ফেরত দেয়নি, তাই জাদুর পুকুর তোমাকে থালাবাসন দেয়নি। তুমি ওর বাড়ি গিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করো।”
এরপর লোকটি রহিমের বাড়িতে যায়। রহিমের বাড়ি গিয়ে রহিমকে ডাকতে থাকে-“রহিম চাচা ও রহিম চাচা, বাড়ি আছ নাকি?”
তখন বৃদ্ধ রহিম বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বলে-“কে তুমি বাছা।”
লোকটি বলে-“চাচা, আমি পাশের গ্ৰামে থাকি। তুমি জাদুর পুকুর থেকে যে থালাবাসন এনেছিলে তা কী ফেরত দিয়ে এসেছ?”
তখন বৃদ্ধ বলে-“হ্যাঁ বাবা, আমি তো সব ফেরত দিয়ে এসেছি।”
লোকটি বলে-“সব দিয়ে এসেছ! তাহলে জাদুর পুকুর আমাকে থালাবাসন দিল না কেন?”
সেইসময় ঘরের ভিতর থেকে একজনের গলার আওয়াজ শোনা যায়। সেই শুধু বলছে-“আর পারছি না গো, আর পারছি না। মরে গেলাম গো মরে গেলাম।”
তখন লোকটি বলে-“চাচা, ঘরের ভিতরে কে এমনভাবে চিৎকার করছে?”
বৃদ্ধ বলে-“তোমার চাচি বাবা, মেয়ের বিয়ের পর থেকে তোমার চাচির যে কী হল, কোনো ঔষধে কাজ হচ্ছে না। এখন একমাত্র উপরওয়ালার উপর ভরসা।”
লোকটি তখন বলে-“ও আচ্ছা। ঠিক আছে চাচা এখন তাহলে আমি আসি।”
বৃদ্ধ বলে-“একটু দাঁড়াও বাবা। তোমাকে আমি আরও একটা কথা বলিনি।”
লোকটি বলে-“কী কথা চাচা?”
বৃদ্ধ তখন সমস্ত ঘটনা লোকটিকে বলে।
সব শুনে লোকটি বলে-“কী বলছ কী চাচা! তুমি জানো না, ওই পুকুরের সব থালাবাসন হিসাব মতো ফেরত দিতে হয়। আর একটি কথা ওই পুকুরের জিনিস যে নিয়েছে ওর মৃত্যুও হতে পারে।”
তখন বৃদ্ধ বলে-“কিন্তু বাবা, আমি তো জানিই না, কে নিয়েছে।”
সেইসময় ঘরের ভিতর থেকে আবার গোঙানির শব্দ আসে। তখন বৃদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে ওই লোকটিও ঘরের ভিতরে যায়।
ঘরের ভিতর গিয়ে লোকটি বৃদ্ধের বউকে জিজ্ঞাসা করে-“আচ্ছা চাচি, তুমি সত্যি করে বলো তো, তুমি কী জান ওই থালাটা কে নিয়েছে?”
তখন বৃদ্ধের বউ বলে-“হ্যাঁ বাবা জানি। তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও। মরার সময় আমি আর মিথ্যা কথা বলব না। আসলে থালাটা আমিই নিয়েছি। তোমার চাচাকেও আমি একথা বলিনি।”
লোকটি তখন বলে-“কী বলছ কী চাচি! তুমি জানো না এরজন্য তোমার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।”
বৃদ্ধের বউ বলে-“জানি বাবা। আমাকে ক্ষমা করো। আসলে আমি লোভ সামলাতে পারিনি। আমি ভেবেছি এতগুলো থালাবাসন থেকে একটা কম পড়লে কিছু হবে না। যে পুকুর এত দয়ালু তার একটা থালা কম পড়লে কিছু হবে না, তাই আমি নিয়েছিলাম।”
তখন লোকটি বলে-“এখন বল তো, ওই থালাটা কী এখন তোমার কাছে আছে? যদি থাকে তো দিয়ে দাও। দেখি ওই থালাটা ফেরত দিলে যদি তুমি সুস্থ হও।”
বৃদ্ধের বউ বলে-“হ্যাঁ বাবা, ওই থালাটা আমার কাছে আছে। ওই যে দেখছ সামনে একটা বাক্স আছে, ওর ভিতরে থালাটা আছে।”
এরপর বৃদ্ধ বাক্স থেকে থালাটা বের করে লোকটিকে দেয়, আর বলে-“বাবা, তুমি একটু জাদুর পুকুরের কাছে গিয়ে বলবে ও যাতে তোমার চাচিকে ক্ষমা করে এবং সুস্থ করে দেয়।”
লোকটি বলে-“ঠিক আছে চাচা।”
এইবলে লোকটি থালাটি নিয়ে গ্ৰামে ফিরে আসে। আর গ্ৰামে এসে প্রধান থেকে শুরু করে সবাইকে কথাটি বলে। এরপর প্রধানের কথায় গ্ৰামের সবাই ওই পুকুর পাড়ে জোড়ো হয়।
গ্ৰামের সবাই বলে-“প্রধান মশাই, তাহলে আপনিই বলুন এখন আমাদের কী করা উচিত।”
প্রধান তখন বলেন-“আমরা সবাই জাদুর পুকুরের বিশ্বাস ভেঙেছি। আমাদের আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিল। এখন আমরা সবাই জাদুর পুকুরের কাছে ক্ষমা চেয়ে ওই থালাটি ফেরত দিয়ে দি।”
সেইসময় গ্ৰামের একজন মানুষ বলে-“আচ্ছা প্রধান মশাই, আর একটা কাজ করলে হয় না।”
প্রধান বললেন-“কী কাজ।”
তখন সে বলে-“আমরা যদি আর জাদুর পুকুরের থালাবাসন না ব্যবহার করি। কারণ দিন দিন মানুষের লোভ এত বাড়ছে যে, আজকের মতো ঘটনা আবার হতে পারে। তখন আমরা আবার জাদুর পুকুরের বিশ্বাস ভেঙে ফেলব। তাই আমরা যদি জাদুর পুকুরের কাছ থেকে থালাবাসন নেওয়া বন্ধ করি, তাহলে জাদুর পুকুরও কারোর কোনো ক্ষতি করবে না।”
প্রধান তখন বলেন-“হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথাই বলেছ। কী গ্ৰামবাসীরা তোমরা কী বলো?”
তখন গ্ৰামের সবাই বলে-“হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা সবাই একমত।”
0 Comments