জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে(একবিংশ পর্ব)/মলয় সরকার

মিউজিয়ামে জেনুদের তৈরী অলঙ্কার

মার্কেজের খোঁজে
(একবিংশ পর্ব)

মলয় সরকার



বারাঙ্কুইলার এই কষ্টকর পরিস্থিতি যা গ্যাবি ও তাঁর মা দুজনে মিলে একসঙ্গে সামলেছেন, তা তাঁদের দুজনকে এক নিবিড় বন্ধনে বেঁধে দেয়।তিনি এই সম্পর্ক সম্বন্ধে বলতেন, “a serious relationship…….. probably the most serious relationship I've ever had.”

এত দুঃখ কষ্ট সত্বেও মা,লুইসা তাঁকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন ,যাতে সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা নিতে পারে। এই ছেলেটিই ছিল পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও ভবিষ্যতের আশা। তাঁর স্কুলের হেডমাস্টার Juan Ventura Casalins তাঁর প্রতি আলাদা যত্ন নিতেন। এখানে তিনি নিজের একাকীত্ব কাটাতে Treasure island, The count of Monte Cristo ইত্যাদি বইতে ডুবে থাকতে লাগলেন।সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ তাঁর ছোটবেলা থেকেই।এখানে তিনি উপার্জনের জন্য দোকানের সাইন বোর্ড পেন্টিং করার কাজও করতে শুরু করলেন।কিছু উপার্জনও হল। তাঁর পেন্টিং করা দোকানের বোর্ড El Toquio, আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে।এ ছাড়া দোকানের বিজ্ঞপ্তিগুলো, যেমন, “ If you don't see it, just ask”, ‘The man who gives the credit is out looking for his money.” লিখতেন।এর পর একটি বাসের গায়ে লিখে ২৫ পেসো উপার্জনও করেন।
গাব্রিয়েল এলিজিও গার্সিয়া

তিনি ভাল গানও করতে পারতেন। এক প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে “ The Swan” এই গানটি গেয়েও পুরস্কৃত হন। 
একসময় তিনি এক ছাপাখানার হকারের কাজও করছিলেন। সেই সময়,হঠাৎ রাস্তায়  আরাকাতাকার এক বন্ধুর মা তাঁকে দেখে চিৎকার করে ওঠেন যে, লুইসাকে বলছি, দেখুক তাদের ছেলে পড়াশোনা ছেড়ে  রাস্তায় কেমন লিফ্লেট বিক্রি করছে। 

এই ঘটনার পর তিনি কাজটি ছেড়ে দেন।এই সময় তাঁর চেহারা ছিল রোগা পাতলা, কম খেতে পাওয়া শিশুর মত ও পাণ্ডুর।তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেছেন,  মা তাঁকে, যাতে টিবি না হয় তার জন্য, Scotts Emulsion নামের ওষুধ খাওয়াতেন। 

একদিন,  তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে, লুইসা স্বামীকে বললেন, তাঁর ভয় করছে, উনি যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন।কিন্তু তিনি ফিরে না আসার কথা বলাতে, লুইসা রাগ করে বললেন, হয় তিনি ফিরে আসবেন, নয়ত’ সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে উনি স্বামীর কাছে চলে যাবেন।

এই শুনে Gabriel Eligio এক সপ্তাহের মধ্যেই ফিরে আসেন।কিন্তু আবার তিনি নতুন কিছু করার চিন্তা করতে থাকেন।এক ওষুধের ব্যবসায়ীর কাছে কিছু ধার করে তিনি Sucre নামে একটি শহরে চলে যান। এই সময় লুইসা আবার এক নতুন সন্তানের অপেক্ষায়।

গ্যাবি,  ওইটুকু ছেলে তখন, একা যেন হঠাৎ বড় হয়ে গেলেন।তিনি মা ও ভাইবোনেদের নিয়ে, সমস্ত কাজ, যেমন, সমস্ত ব্যবস্থা করা, প্যাকিং, বুকিং, ট্রাকে মাল তোলা, জাহাজের টিকিট কাটা ইত্যাদি সবটাই, করে নদীর ধারে অনেক দূরে বাবার কাছে সুক্রেতে এলেন।

অনেক দিন পরে, লুইসা যখন ৮৮ বছরের, হাসতে হাসতে পুরানো দিনের কথা মনে করে বলতেন, সেদিনের কথা মনে পড়ে, যখন গ্যাবি, ওইটুকু ছেলে জাহাজে উঠে সমস্ত জিনিসের দায়িত্ব নিয়ে চলেছে, হঠাৎ ভাইবোনেদের গুনে আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল, একজন কম হচ্ছে। আসলে ও নিজেকে গুনতেই ভুলে গিয়েছিল।

১৯৩৯ সালের নভেম্বর মাসে যখন তাঁরা সুক্রেতে পৌঁছান, তখন সবচেয়ে ছোট ভাই গুস্তাভো মাত্র চার বছরের। 
অনেক দিন পর, তিনি তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘’ আমার সেদিনের কথা আজও মনে পড়ে, আমরা লঞ্চে করে সুক্রেতে যখন পৌঁছালাম, আমরা কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে নামছিলাম। তখন আমার মা কালো পোষাকে নিজেকে মুড়ে নামছিলেন আর তাঁর জামার হাতায় ছিল মুক্তোর মত বোতাম। তাঁর বয়স কত আর হবে, চৌঁত্রিশ মত।
🍂

তাঁর যে অবস্থা হয়েছিল তখন আমার মনে ছবির মত গেঁথে আছে। তাঁর মুখের উপর ছিল এক বিষাদের ছায়া। তিনি একজন কনভেন্টে পড়া শিক্ষিত এবং স্বচ্ছল ভাল পরিবারের আদরের মেয়ে ছিলেন।তিনি আঁকতে এবং পিয়ানো বাজাতেও জানতেন। তাঁকে হঠাৎ এরকম একটা পরিবেশে আসতে হল, যেখানে বিদ্যুতের আলো নেই, ঘরের মধ্যে সাপ ঢুকে আসছে, শীতকালে এমন বৃষ্টি হয় যে সব ডাঙ্গাজমি ডুবে যায় জলের তলায় আর মশার রাজত্ব বেড়ে ওঠে।’’

সুক্রে একটা ছোট্ট শহর, যেখানে মাত্র তিনহাজার লোকের বাস এবং যেখানে রেল বা বাসের যোগাযোগ নেই কোন ভাবেই।এটা আসলে একটা নদীর ভিতর জঙ্গল, যেখানে বহুদিন ধরে মানুষ বাস করে চাষবাস করে বাসযোগ্য করে তুলেছে। এখানে সাধারণত ইজিপ্ট সিরিয়া লেবানন ইটালি জার্মানি থেকে আগত লোকেদেরই বসতি ছিল। এখানেই একটি নতুন ঘর ভাড়া নিয়ে গাব্রিয়েল এলিজি , গ্যাবোর বাবা, তাঁর আবাস ও ফার্মাসীর ব্যবস্থা করেন।

এত বাধাবিপত্তির মধ্যেও, যদিও মার্কেজের পড়াশোনার প্রচণ্ড ক্ষতি হয়, বয়সের তুলনায় পিছিয়েও পড়েন, তবু প্রতি পরীক্ষায় দুর্দান্ত ভাল ফল তাঁর বরাবর হত।স্কুলে তাঁর রচনাশৈলী এবং সাহিত্যরচনার জন্য সকলের নজরে আসেন। তাঁর লেখা “ My foolish fancies” নামে মজাদার কবিতাটি বন্ধুদের সম্বন্ধে, স্কুলের নিয়মকানুন ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যাপারে রসিকতা করে রচিত হয়েছিল। এটি শিক্ষকরা বারবার বিভিন্ন সময়ে তাঁকে আবৃত্তি করতে বলে মজা পেতেন। এই সময় থেকেই নানা ছোট গল্প ও কবিতা তাঁর স্কুল ম্যাগাজিন , Juventus ( youth) এ প্রকাশিত হয়।এর ফলে তাঁকে বিশিষ্ট ছাত্রের মর্যাদা দেওয়া হয় ও কিছু সম্মানীয় কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এরপর যখন একবছর স্কুলে কাটিয়ে শীতের ছুটিতে বাড়ি এলেন, তখন তাঁর আর এক ভাই জন্মায়, যে রুগ্ন ছিল এবং প্রায় সাত বছর পর্যন্ত ভুগত। তাঁর এই, ঘর ছেড়ে থাকায়, বাবার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে নি। আসলে বাবাও এ ব্যাপারে খুব চেষ্টা করেন নি।তিনি কিন্তু তাঁর বোন মার্গটের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন বরাবর।

তাঁর এই সুক্রের জীবনযাত্রা অনেক খানিই ফুটে উঠেছে তাঁর নভেলগুলোতে। মাকোন্দো তেও এর ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়।তাঁর “In evil hour” এ তাঁর বাবার চরিত্রের ছাপ আছে।
লুইসা সান্তিয়াগা মার্কেজ, গ্যাবোর মা

এখানেই তাঁর বাবার ব্যবসা সবচেয়ে সফলতার মুখ দেখে।এখানে তিনি নিজের দোকান ছাড়াও ফার্মাসিস্ট ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক হিসাবে স্থানীয় চিকিৎসাকেন্দ্রেও কাজ করতেন।
এখানে এসে গ্যাবিটো এক বিরাট মানসিক ধাক্কা খান, যা তাঁর বাবার কৃতকর্মের ফল।
১৯৪০ সালে একদিন যখন লঞ্চে করে সুক্রে আসছিলেন, Carmen Rosa নামে একটি মেয়ের সাথে আলাপ হয়, যে নিজেকে তাঁর বোন বলে দাবী করে।সেই সন্ধ্যায় তিনি আবিষ্কার করেন যে, সে তাঁর বৈমাত্রেয় বোন। তিনি সেদিন,  বিশাল এক বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করেন যে, তিনি তাঁর বাবার জ্যেষ্ঠ সন্তান নন, কেবলমাত্র তাঁর মায়ের।

গার্সিয়ার বাবা গ্যাব্রিয়েল এলিজিও মোটেই পাশ করা ডাক্তার ছিলেন না। তবে অনেক পরে কার্তাহেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্ট টাইম কোর্সে পড়াশোনা করে খুব চেষ্টা করেছিলেন, ডাক্তার খেতাব পাওয়ার জন্য। কিন্তু অনেক চেষ্টা চরিত্র করে তিনি, Doctor of Natural Sciences এই খেতাবটি জোগাড় করতে পারেন।তবে তাঁর চরিত্র দোষও ছিল প্রবল। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে তিনি অনেক মেয়ের সংসর্গে আসেন। এজন্য কোর্ট কেসও হয়েছিল। তবে এই ভাবে তাঁর দু’ একটি সন্তানও হয়। এই নিয়ে লুইসার সঙ্গে তাঁর প্রচণ্ড ঝগড়া কথা-কাটাকাটি হয়। তবে তা’ সত্বেও শান্ত স্বভাবের লুইসা তাঁর সব সন্তানদের নিজের সন্তানের মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করেন।

ক্রমশঃ–
সঙ্গে থাকুন বন্ধুরা, আগামী দিনে–

Post a Comment

0 Comments