ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি (দ্বাদশ পর্ব )
চিত্রা ভট্টাচার্য্য
(প্রকৃতি প্রেমিক নজরুল )
''সৌন্দর্য অনেকখানি তার প্রকাশধর্মিতার ওপর নির্ভরশীল। ঋষিগণ বলেছেন, ‘জ্যের্তিময় আবরণ দ্বারা সত্যস্বরূপের মুখ আবৃত রহিয়াছে, হে জগতপোষক তাহা উন্মোচন কর। তোমার যে মধুর রূপ তাহা আমি সন্দর্শন করি। ’ (নন্দনতত্ত্বের সূত্র: অরুণ ভট্টাচার্য)।
''সুন্দরের সন্দর্শনে উন্মোচন অনিবার্য ব্যাপার। ' , এই উন্মোচনের উপায় কৌশলে যিনি সফল তিনিই হতে পারেন কবি কিংবা শিল্পী। '' উন্মোচনের পথপরিক্রমায় দুটি বিষয় এসে সামনে দাঁড়ায়। সাহিত্যকেন্দ্রিক পরিভাষায় যাকে ক্লাসিক ও রোমন্টিক নামে অভিহিত করা হয়। `Classic art portrays the finite, Romantic art the infinite.’ ক্লাসিক্যালরা ভাবনার অতিন্দ্রিয় জগতে বিচরণ না করে জগৎ ও জীবনকে বস্তুময়রূপে প্রকাশে আগ্রহী। অন্যদিকে রোমান্টিকরা জগৎ ও জীবনকে প্রকাশ করবার জন্যে ব্যঞ্জনা ও আভাসের আশ্রয় নেন। প্রকৃতিপ্রেমিক কবি নজরুলের অসীমের প্রতি এই সীমাহীন আকর্ষণ ও বিস্ময়বোধ রোম্যান্টিক ভাবনার মূলে কাজ করে।
কবি অনায়াসে লেখেন....
"তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সেকি মোর অপরাধ?
চাঁদেরে হেরিয়া কাঁদে চকোরিণী বলে না তো কিছু চাঁদ।।"
🍂
সহজ সরল নিবিড় ভালবাসায় জড়িয়ে থেকে রাঢ় বাংলার চুরুলিয়া গ্রামে অনাবিল সবুজ ,উদার নীলাকাশের তলে উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে একাত্ম হয়ে বেড়ে উঠেছিলেন কবি । তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও তাঁর কাব্য সাহিত্যের সৃষ্টিশীল জীবনের বিকাশে প্রকৃতি অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িয়ে আছে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী তিনি বাংলা সাহিত্যের আকাশে কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার,গায়ক ও একজন অভিনেতা রূপে আত্মপ্রকাশ করে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত আজো বিরাজমান। নিরালায় বসে ধ্যান মগ্ন কবি প্রকৃতির উপাদান দিয়েই রচনা করেছেন নিজের এবং মানব হৃদয়ের চিরন্তন রূপ।কবি তাঁর কাল্পনিক জগৎ কে কবিতায় প্রকাশ করেছেন আপন মনের মাধুরী মিশায়ে। মূলত তিনি প্রেম ও প্রকৃতির কবি তবুও তাঁকে আমরা জেনেছি 'বিদ্রোহী কবি নজরুল রূপে ! তাঁর কবিতা যেমন,আমাদের বিদ্রোহী হতে, সাম্যবাদী হতে শেখায় তেমনি প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে ও শেখায়। তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী সৌন্দর্যচেতা কবি।
প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসায়,মমত্ববোধে অনুরাগসম্পন্ন কবি তার রূপ রঙ রসে অবগাহন করেছেন, এবং তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তু কে ও ছন্দে ভাষার অলঙ্কারে অনবদ্য এক রূপসম্ভারে সাজিয়েছেন। প্রাকৃতিক যা কিছু সম্পদ ফুল,পাখি,নদ নদী, সমুদ্র ঝর্ণা পাহাড় পর্বত গিরিশৃঙ্গ বন, জঙ্গল মেঘ,বৃষ্টি তার অপরূপ প্রকাশ দেখেছি যেখানে তিনি উদার মুক্ত প্রকৃতিকে শুধুই সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি হিসেবেই দেখেননি, বরং তাকে জীবনের অঙ্গ এক উৎস ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে প্রকৃতির পূজারী পূজার অর্ঘ্যের অঞ্জলি দিয়েছেন। রোমান্টিক কবি নজরুলের প্রকৃতি প্রেম তাঁর আবেগ ও অনুভূতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা তাঁর প্রেম ও বিরহের অনুভূতিকে বিশেষ ভাবে নাড়া দিয়েছে। কবি নজরুল ও তাঁর প্রেম,আনন্দ, ও বেদনার প্রকাশে প্রকৃতির অনুষঙ্গ ব্যবহার করে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নিজের বেদনাকে বিশ্বজনীন করে তুলেছেন। যেমনটি তাঁর সংগীতেও পাওয়া যায়। এই প্রকৃতি প্রেম তাঁর রচনাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এক অদ্ভুত গভীরতায় পাঠক মন কে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে অপার্থিব এক নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যের জগতে ।
কবির কাব্য দর্শনে কবিতায় প্রেমে বিরহে যেন এক বিষাদসিন্ধু! তাঁর হৃদয়-বেদনায় একাত্ম হয়ে মিশেছিল আবহমান উদার প্রকৃতি। একই সাথে নটরাজের প্রলয় নৃত্যের মত অন্যায় অবিচার কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুদ্র তেজে বিদ্রোহের রণ দামামা বাজিয়ে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। তাঁর বিদ্রোহের অন্তরালে হৃদয়ে প্রবাহিত ছিল প্রকৃতির প্রেমের ধারায় মানব প্রেমের উপাখ্যান। একইসাথে প্রেয়সী প্রিয়ার রূপে প্রকৃতিকে বেঁধেছেন চুলের খোঁপায়। রঙে রূপে, রসে নিমজ্জিত হয়ে অপরূপা প্রকৃতিকে আবিষ্কার করেছেন জীবনের প্রতি পলে।প্রকৃতির উপাদান দিয়েই তিনি এঁকেছেন মানবিক চিরন্তন রূপের পদাবলী। প্রেম ও প্রকৃতির কবি হয়ে ও বাঙালির হৃদয়ে তিনি একম এবং অদ্বিতীয়ম রোম্যান্টিক বিদ্রোহী কবি !
নার্গিস তার কবিতায় কখনও প্রিয়তমা, কখনও ফুল হিসেবে এসেছে। নজরুল গেয়েছেন,‘বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে, ঝরা বন-গোলাপের বিলাপ শোনে’। নার্গিসকে লেখা এক চিঠিতে নজরুল লিখেছেন, ‘তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি, আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি’।
তার কবিতা-গানে নানাভাবে ফুলের প্রসঙ্গ এসেছে-
‘কে নিবি ফুল, কে নিবি ফুল,
টগর যূথী বেলি মালতী চাঁপা গোলাপ বকুল,
নার্গিস ইরানী গুল-''---
তাঁর প্রতিটি কবিতা থেকে যেন নানা ফুলের সুগন্ধ ভেসে আসে। ‘বনে মোর ফুটেছে হেনা চামেলি যূথী বেলি’,অথবা ‘সাত ভাই চম্পা জাগোরে, কেন বোন পারুল ডাকোরে’ এমন কি ঝিঙে ফুল নিয়ে কবি বলেছেন, ‘হলুদ বরণ ঝিঙে ফুলের কাছে, দেখনা কেমন দুটি ফিঙে নাচে’।
একই প্রকৃতিকে বারবার নানা রূপে আবিষ্কার করেছেন তিনি । দোলনচাঁপা, ঝিঙেফুল, ফণীমনসা, মহুয়া এসব নাম তাঁর রচনাকে আরো বেশি সুবাসিত করেছে। নজরুলের ‘ঝিঙেফুল’ কবিতায় প্রকৃতির প্রতি কবির গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধের প্রকাশ ঘটেছে। পৌষের বেলা শেষে সবুজ পাতার এদেশে জাফরান রং নিয়ে ঝিঙে ফুল মাচার ওপর ফুটে থাকে। এ সৌন্দর্যে মুগ্ধ কবি প্রজাপতির ডাকে আকাশে এমনকি স্বর্গের অলকাপুরীতেও যেতে চান না। এই মাটি মায়ের গভীর সান্নিধ্যেই থাকতে চান।
‘হলুদ গাঁদার ফুল রাঙা পলাশ ফুল,
এনে দে এনে দে নইলে বাঁধবো না বাঁধবো না চুল।
অথবা কিনে দে হাট থেকে, এনে দে মাঠ থেকে/বাবলা ফুল আমের মুকুল।
ফুল কিন্তু নিজে কিছু বলে না, সে তার সৌন্দর্যের স্পর্শে মন কে মোহিত করে। নজরুল তার লেখনীতে তুলে এনেছেন নিত্যপরিচিত , চারপাশের সব চেনা ফুল কে । ‘ফাল্গুনী’ কবিতার মাঝেও সজিনার ফুলকে উপস্থাপন করেছেন এভাবে-‘ডগমগ তরুপুরী, পথে পথে ফুল ঝরি, সজিনা ফুলে’।
তাঁর ঝিঙে ফুল ছড়ায় নজরুলের রূপসী বাংলার প্রকৃতির প্রতি ভালবাসায় লিখেছেন ---
‘ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল!
সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল
ঝিঙে ফুল।’
তাঁর কাব্য সাহিত্য সংগীতের আঙিনায় বারবার উল্লেখযোগ্য ভাবে দেখা দিয়েছে ; কামিনি, বেলী, সোনালু, হাস্নুহানা ,বনদেবী, চৈতালি-চাঁপা, গিরিমল্লিকা, কুন্দ, কাশ, দোলনচাঁপা, ফণীমনসা, রাঙা-জবা, শিউলি, সজনে, পদ্ম, শাপলা, শতদল, বাঁশ, সরিষা, কমল, গোলাপ, আম মুকুল, চন্দ্রমল্লিকা, মঞ্জরী, মালতী, ঢোলকলমী, পারিজাত, পারুল, ধুতুরা, সন্ধ্যামালতী, সন্ধ্যামণি, সোঁদাল, রঙ্গন , সূর্যমুখী, শিরীষ, গাঁদা, কদম, মাধবী, মহুয়া, কেয়া বা কেতকী, বকুল, দোপাটি, কনকচাঁপা, চন্দ্রহার, বল্লরী, নাগকেশর, ঝিঙে, অতসী,আরো কত জানা অজানা ফুলের নাম। নয়নতারা, অপরাজিতা, ঝুমকো লতা, অর্জুন, নার্গিস, রজনীগন্ধ্যা, জামরুল, মহুল, ডালিম, পলাশ, শিমুল, পিয়াল, টগর, জুঁই, চাঁপা, চামিলি, মল্লিকা, মোতিয়া, ভুঁই, লোধ, মৌরি, ডুমুর ও কুসুম যেখানেযত ফুলগাছ তারসব সৌরভ উজাড় হয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে আছে তাঁর কাব্যের বাগিচায়। বোধহয় বিশ্বের আর কোনো কবি সাহিত্যিক তাদের রচনায় এতো জানা--অজানা ফুলের ব্যবহার করেন নি।
ফুটবে আবার দোলন-চাঁপা চৈতি রাতের চাঁদনী
আকাশ-ছাওয়া তারায় তারায় বাজবে আমার কাঁদনী।
‘চৈতী হাওয়া’ কবিতায় কবির হৃদয়ের বিরহ বেদনাকে প্রকৃতির মধ্য দিয়ে এক অপরূপ নিবেদন করলেন ।
শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কালো জল
কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথায় নীলোৎপল?
(চৈতি হাওয়া: ছায়ানট)
কবি বিরহ কে মূর্ত করেছেন এবং এ বিরহ কবির ব্যক্তিসত্ত্বার। চৈতি হাওয়ায় বসন্তকালে স্বভাবতই প্রকৃতি পত্রে ,পুষ্পে পল্লবে নবরূপ ধারণ করে। ফুলফোটে পাখি ডাকে দখিনা বাতাস বয় প্রাণে শিহরণ জাগে। ঠিক এমন পরিবেশেই কবির সাথে প্রিয়ার প্রথম পরিচয়। এবং পরিচয় মধুময় হতে না হতেই বিরহ আনন্দ কে মলিন করে দেয়। কবিহৃদয় ব্যথা ভারে নিমজ্জিত হয়। কবি তার প্রিয়াকে ভোলেনি। স্মৃতিময় অতীত প্রকৃতির মাঝে অম্লান হয়েছিল। তাই চৈত্র মাসের মধুর পরিবেশে কবির চিত্ত একাধারে স্মৃতি ও বিরহ উভয় কেই মূর্ত করে তুলেছে। চৈতালি দিনের প্রেম কে স্মরণ করে কবির হাহাকার।
বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুমরে ওঠে মন
পেয়েছিলাম এমনি হাওয়ায় তোমার পরশন।
নজরুল ইসলাম তৎকালীন ঔপনিবেশিক শাসনের নিগূঢ় থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন। মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন সামাজিক ও মানসিক সীমাবদ্ধতা থেকে। ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন কালচালিত অচলায়তন। নজরুলের এসব বিদ্রোহের অন্তরালে প্রবাহিত ছিল প্রকৃতি প্রেম এবং মানব প্রেমের ফল্গুধারা। ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের সঙ্গে বিশেষ করে শেলি, বায়রণের সঙ্গে তাঁর একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। রোমান্টিক কবির মানস বিকাশ এবং প্রকাশ যখন বাধাগ্রস্ত হয় তখন তিনি হয়ে ওঠেন বিক্ষুব্ধ। নজরুল মানসে ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের ধরন ধারণের প্রজ্বল উপস্থিতি ছিল। শেলির সর্বপ্লাবী বিপুল গতিবেগ ও শাশ্বত বিস্ময়বোধ, কীটসের সুকুমার ইন্দ্রিয়ানুভূতি আর ওয়ার্ডসওয়াথের প্রকৃতি সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মবোধ নজরুলের অস্থির মানসিকতার মধ্যেও যার অভাব ছিল না। তার হৃদয়-বেদনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশেছিল প্রকৃতি, বিশেষ করে আবহমান বাংলার প্রকৃতি। তিনি তার নিজের এবং মানব মনের চিরন্তন আকুতিকে রূপ দিয়েছেন প্রকৃতির প্রতীক দিয়েই। মানুষের সুখ-দুঃখ হাসি কান্না বিরহ বেদনার সুর আবহমানকালের সময় তরঙ্গ অতিক্রম করে প্রকৃতির শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে। পৃথিবীতে মানবশিশুটির ভূমিষ্ট হওয়ার বহু আগে থেকেই মানুষের বসবাসের যোগ্য হয়ে প্রকৃতির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। জন্মের প্রথম লগ্নে চোখ মেলে শিশুটি আলোয় ভুবন ভরা এ পৃথিবী কে দেখেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে হাওয়ায় জলে বাতাসে মায়ার মন্ত্রে মমত্বে মাটির বুকেপা ফেলে তার বিকশিত হয়ে ওঠা , তার সুখ-দুঃখ হাসি কান্না বিরহ বেদনার সুর আবহমানকালের সময় তরঙ্গ অতিক্রম করে প্রকৃতির শরীরে প্রবাহিত হয়ে চলেছে ক্রমাগত । নিত্যসঙ্গী এই ভুবনের সাথে তার অবিস্মরণীয় সম্পর্ক।আপন সত্তার মতো প্রকৃতিকে জেনেছে, দেখেছে পরখ করেছে। কিন্তু প্রকৃতি যখন ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠে ,তার রুদ্ররূপের সামনে মানুষ বড়ো অসহায়। মানবীয় অনুভূতিপ্রবণ প্রিয় সত্তা হয়ে প্রকৃতির পরিবেশ কবির কলমে সেজে উঠেছে বারেবারে। কবিরা প্রকৃতিতে মানবত্ব আরোপ করেছেন তাকে করে তুলেছেন মানবীয় অনুভূতিশীল।
অগ্নি-বীণা’ এবং ‘দোলন-চাঁপা’ এ দুটি কাব্যগ্রন্থের কবিতা নজরুল ইসলাম প্রায় একই সময়ে রচনা করেন। ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যগ্রন্থে নজরুল যেখানে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুগের অগ্নিক্ষরা দিনের কবিতা রচনা করেছেন, সেখানে ‘দোলন-চাঁপা কাব্যগ্রন্থে কবি রচনা করছেন প্রেম ও প্রকৃতির শাশ্বত বাণী। বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়, যখন দেখি কবি লেখেন তাঁর এক হাতে বাঁশেরবাশরি আর হাতে রণতূর্য। ‘দোলন চাঁপা’ কাব্যগ্রন্থ বাঁশরির তানে রচিত।''ধরণী দিয়েছে তার গাঢ় বেদনার রাঙা মাটিরাঙ্গা ধূসর আঁচলখানি দিগন্তের কোলে কোলে টানি পাখি উড়ে যায় যেন কোন্ মেঘ-লোক হ’তে সন্ধ্যা-দীপ-জ্বালা গৃহ-পানে ঘর-ডাকা পথে। আকাশের অস্ত-বাতায়নে অনন্ত দিনের কোন বিরহিণী ক’নে জ্বালাইয়া কনক-প্রদীপখানি উদয়-পথের পানে যায় তার অশ্রু চোখ হানি।''
."হেমন্তের এমনি সন্ধ্যায় যুগ যুগ ধরে বুঝি হারায় উপুর হইয়া সেই স্তূপীকৃত বেদনার ভার মুখ গুজে পড়ে থাকে; ব্যথা গন্ধ তার গুমরিয়া গুমরিয়া কেঁদে কেঁদে যায় এমনি নীরবে শান্ত এমন সন্ধ্যায় ক্রমে নিশীথিনী আসে ছড়াইয়ান ধূলায় মলিন এলোচুল সন্ধ্যা তারা নিভে যায়, হারায় দিবসের কূল। (বেলাশেষে; দোলন-চাঁপা; নজরুল-রচনাবলি, ১ম খণ্ড, ১ম সংস্করণ, বা/এ, পৃ:-৫১)
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় প্রকৃতি শুধু একটি দৃশ্য নয়, বরং একটি জীবন্ত সত্তা, যা কবিকে আবেগ ও অনুভূতি দিয়ে সমৃদ্ধ করে এবং তাঁর কবিতার বিভিন্ন অংশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
0 Comments