সাঁঝের তারকা
সুদেব কুমার ঘোষ
আজ রবিবার। বাড়ি যাবনা বলে ঠিক করেছি। সারা সপ্তাহে কলেজে প্রচুর ক্লাস হয়েছে। তার প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রতিদিন গড়ে পাঁচটি ক্লাস থাকেই। দশটা থেকে পাঁচটা। সকালে ও সন্ধ্যায় ঠিক পড়া তৈরী হয়না। সোম থেকে শুক্র মেসে সবাই থাকলে পড়ার থেকে গল্প হয় বেশী। প্রতি সপ্তাহে বাড়ি গেলে সেখানেও ঠিক ঠিক পড়া হয় না। এইজন্য মাঝে মাঝে ছুটির দিনগুলিতে মেসে থেকে যায়। এই রবিবার ঠিক করেছি বাড়ি যাব না। মেসে আমি আর সুনীত। আমি গণিতে আর সুনীত পদার্থবিদ্যায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছি। অনার্স পেপার পাস পেপার সবই ক্লাস হয়। সবই চাপের পড়া। পড়াশোনার জন্যই দুজনে আজ রবিবার থেকে গেছি। আমি বেশী রাত জেগে পড়তে পারিনা। ভোরে উঠে পড়ি। আজও ভোরে উঠেছি। প্রায় আটটা বেজে গেছে। মশারির মধ্যে তখনও পড়া চলছে। মার্চ মাসের শেষ। তীব্র রোদ। সুনীত ভোরে উঠে পড়ছে। সকাল আটটার সময় আমার দরজার সামনে এসে বলল " ছুটির দিন বলেকি পড়েই যাবি নাকি ? মুখ-টুক ধুবিনা ? টিফিন করবিনা ? তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়েনে। বাইরে গিয়ে টিফিন করে আসব।"
মশারির ভিতর থেকে তার দিকে তাকালাম।
সুনীত আমার তাকানো দেখে আমার মনোভাব বুঝতে পেরেছে বোধহয়। বলল ,
"আরে প্রতিদিনইতো মুড়ি খাচ্ছিস। একদিন নাহয় একটু ভালোমন্দ খেলি। চল আজ চকে গিয়ে লুচি তরকারি আর চা খেয়ে আসব।"
আর বাক্যালাপ না করে মশারী গুটিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে রেডি হলাম। মেস থেকে গলি পথ দিয়ে কিছুটা গেলেই বড় রাস্তা। দু তিন মিনিট হাঁটলেই চক। মফস্বল শহরের চক। খুব বড় নয়। তথাপি সাধারণ মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায়। আমরা মানুদার চায়ের দোকানে উঠলাম। ছিমছাম দোকান। বেশ গুছানো। পরিপাটি। সকালে বিকালে মানুদা লুচি ভাজে। তাকে কৌটোতে বিভিন্ন রকমের বিস্কুট। বেঞ্চের উপর মুড়ির টিন। মানুদা চপও ভাজে। অনেকে চপ মুড়ি খায়। আমরা লুচির অর্ডার দিলাম। মানুদা আমাদের বসতে বললেন। বেলা লুচির ট্রেটি টেনে নিলেন । আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন "এ হপ্তায় বাড়ি যাওয়া হয়নি বুঝি ?"
আমি বললাম "পড়ার চাপ আছেতো। তাই এ সপ্তাহ বাড়ি যাইনি।"
🍂
মানুদা আমাদের চিনে গেছেন। দুবছর তো হয়ে গেলো। মাঝে মধ্যে আমরা মানুদার দোকানে এসেছি।
সুনীত খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে ওল্টাতে লাগল। আমি হেডিং গুলির ওপর চোখ রাখলাম।
ইতিমধ্যে মানুদার অ্যাসিস্ট্যান্ট দুটি প্লেটে করে লুচি তরকারি দিয়ে গেল। চা খেয়ে বিল মিটিয়ে মানুদার দোকান ত্যাগ করলাম।
মার্চ মাসের শেষ। গরম পড়েছে। বসন্তের বাতাস বইছে। দূর থেকে কোকিলের ডাক শোনা যাচ্ছে।আমাদের মেসটি পুকুর পাড়ের উপর। তার কোণে একটি নিম গাছ আছে। দুটো ছেলে নিম ডাল ভেঙে তার পাতা তুলছে। সুনীত উপদেশের সুরে তাদের বলল "ডাল ভাঙবিনা । কেবল পাতা তুল। গাছ ভাঙলে গাছটায় নষ্ট হয়ে যাবে। তখন আর পাতা পাবিনা।"
ছেলেগুলি বুঝল কি না কে জানে। ছেলেদুটি আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমরা চলে এলাম।
মেসে এসে দেখি মাসী চলে এসেছে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কি রান্না হবে ,কজনের মিল হবে এসব --- আমরা দুজনেই বুঝিয়ে দিলাম।
মাসীর সঙ্গে একটি মাঝ বয়সী মহিলা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাসী পরিচয় করিয়ে দিল। তাতে জানা গেল ভদ্রমহিলার নাম স্বপ্না দাস। এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী। মাসীর পাড়ায় বাড়ি। মাসীর সাথে গল্প করার জন্য এসেছেন।
স্বপ্নাদির কথা শুনে আমি একটু অবাক হলাম। কারণ ছোটবেলায় স্বপ্নাদির অভিনয় দেখেছি। সুন্দর অভিনয়। পাড়ায় পাড়ায় লোকের মুখে মুখে অন্যান্য নায়িকাদের সাথে স্বপ্নাদিরও নাম উচ্চারিত হত। গ্রিনরুমে এক চিলতে দেখার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। তখন গ্রিনরুম বলতে ছিল কোনো স্কুলঘর কিংবা কারো চন্ডী মন্ডপ। সাময়িক পর্দা টাঙিয়ে মেয়েদের গ্রীনরুম করা হতো। পর্দা সরিয়ে নায়িকাদের একটু দেখার জন্য ভিড় হত। এমনকি ঠেলাঠেলি পর্যন্ত হত। সেই স্বপ্নাদিকে চোখের সামনে দেখছি। ভাবতেও পারছিনা। মনে মনে একটু উত্তেজনাও বোধ করছি। চোখ মুখ উদ্ভাসিত। সুনীতের অবস্থাও তাই। আমরা দুজনে একই ব্লকের ছেলে। সুতরাং সুনীতও স্বপ্নাদিকে চেনে। অভিনয়ও দেখেছে। সুনীত বলল "আপনি বসুন। আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানার আছে।"
স্বপ্নাদি বিনয়ের সাথে বললেন , "আমি কী আর জানি ভাই যে তোমাদের জনাব ! তোমরা ভাই কলেজে পড়ছ। আমি তোমাদের থেকে বেশী কিছুই জানিনা। সত্যি বলতে কি আমি লেখাপড়া জানিনা।" বলে স্বপ্নাদি চুপ করে গেল।
আমি আর সুনীত দুজনেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।লেখাপড়া জানেনা অথচ পাঠ মুখস্থ করত কীভাবে ? অত সুন্দর অভিনয় বা করত কীভাবে ?
স্বপ্নাদি আমাদের মনের কথা বুঝতে পেরেছেন। হয়ত এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে আগে হতে হয়েছে।
স্বপ্নাদি মৃদু হেসে বললেন , "ভাবছো তো কীভাবে যাত্রার ডায়ালগ মুখস্থ করতাম ? নির্দেশকের ডায়ালগ শুনে শুনে কিছুটা মুখস্থ হত। প্রমটারের থেকেও কিছুটা ম্যানেজ করে নিতাম।"
আমরা দুজনেই "ও" বলে পরের প্রশ্নে চলে গেলাম। সুনীত বলল , "আপনি যাত্রা জগতে এলেন কীভাবে?"
"সে অনেক কথা।" স্বপ্নাদি বললেন।
সুনীত জেদের বশে বলল। "আমাদের খুব শুনতে ইচ্ছা করছে।"
আমিও সুনীতের সাথে সায় দিলাম। স্বপ্নাদি যা বললেন তার সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরলাম।
তারা তিন বোন। দু ভাই। বাবা খুব গরীব। বাবার একার রোজগারে দিন চলছিলনা। একদিন এক যাত্রা দলের অধিকারীর সাথে পরিচয় হল। তার কাছে কয়েকটা যাত্রার ডায়ালগ শুনে তাকে দলে নিয়ে নিল। প্রথমে ছোট রোলে কাজ করত। পরে নায়িকার রোল পেল। অশোক মুখার্জির সাথে জুটি বেঁধে গ্রাম গঞ্জ মাতিয়ে তুলত। যে অপেরায় স্বপ্না - অশোক জুটি থাকত সেই অপেরার রেট বেশী থাকত।
সুনীত কৌতূহলবশত আবার জিজ্ঞাসা করল , "আপনি অভিনয় জগৎ থেকে সরে এলেন কেন?"
স্বপ্নাদি বললেন "নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতে হলে কম বয়স দরকার। আমারতো এখন বয়স হয়েছে। নতুন নতুন নায়িকার উদয় হচ্ছে। তাই নায়িকার রোল ঠিকমতো পাচ্ছিলাম না। তাছাড়া এখন কলকাতার অপেরা এসেও আমাদের পাড়া গাঁয়ের যাত্রার জগৎকে প্রতিযোগিতায় ফেলে দিয়েছে। তাঁদের কৃতকৌশল , অভিনয় দক্ষতা আমাদের পাড়াগাঁয়ের যাত্রদালকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় ভিডিও , অর্কেস্ট্রা যাত্রা জগৎকে কোনঠাসা করে দিয়েছে। এই সব নানা কারণে যাত্রা করা ছেড়ে দিয়েছি।"
"আপনিতো সাইড রোলে অভিনয় করতে পারতেন ?" আমি ব্যগ্র ভাবে বললাম।
স্বপ্নাদি বললেন , " করতে পারতাম। কিন্তু নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করার পর আর ভালো লাগল না।নায়িকার ভূমিকায় আমার যে অভিনয় জনমানসে ছাপ ফেলেছি সেটাই রেখে যেতে চাই।" স্বপ্নাদি চুপ করে গেলেন।
মাসীর ডাল সাতলানোর সুবাস মেস থেকে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে। সবাই আমরা এক প্রস্থ হাঁচলাম। ইতিমধ্যে মেসের আরো দুজন বোর্ডার আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
দুজনেই চাকরি করেন। প্রথমজন সাহাদা । দ্বিতীয়জন রায়বাবু। তাদের বাড়ি অন্য ব্লকে হলেও স্বপ্নাদির নাম তারাও শুনেছেন। অভিনয়ও দেখেছেন। অভিনয়ের স্বপ্নাদি আর বর্তমানের স্বপ্না দির সাথে তারা ঠিক মেলাতে পারছিলেননা। তাঁরা চুপি চুপি মাসীর শরণাপন্ন হতে সব জানতে পারলেন। তাঁরাও কৌতূহলবশত জেরার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।
মাসী বলল , "এসেছে আমার সাথে গল্প করতে। কিন্তু তোমরাই তো আসর জমিয়ে দিলে দেখছি।"
আমি বললাম "মাসী, আমরা আজ একজন স্টারকে পেয়েছি। আমাদের পড়া ছেড়ে দিদির সাথে গল্প করছি।"
মাসী খুন্তি নাড়তে নাড়তে বলল , " ওদের জীবন খুবই কঠিন ! সংসার পর্যন্ত পেলনা!"
আমার এবং সুনীতের মুখ থেকে "কেন" এর দ্বিত্ত্ব ধ্বনি নিঃসৃত হল।
স্বপ্নাদি আর কোনো দ্বিধা না করে বলতে লাগলেন।
"বাইরে কাজ করতে গেলে মেয়েদের নানান সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মানসিক নিরপত্তার অভাব বোধ হয়। যাত্রা করতে করতে অনুভব করলাম একজন সঙ্গী দরকার। আর সেটি যাত্রার জগতেরই হলে ভালো হয়। অশোকের সঙ্গে জুটি বেঁধে একটির পর একটি পালা হিট করছে । অশোকের সাথে বিয়ে হল। নিরাপত্তা আরো সুদৃঢ় হল। আমরাও নতুন উদ্যমে অভিনয় শুরু করলাম। নাম টামও হল বেশ। বিহার উড়িষ্যার বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলেও অভিনয় করেছি। সুযোগ বুঝে অধিকারী মশাই অপেরার রেটও বাড়াতে শুরু করেছে। আমাদের রেটও অবশ্য বেড়েছিল। আমার ঘরেও মা বাবাকে টাকা পাঠাতে পারলাম আরো বেশি করে। "
স্বপ্নাদি একটু থামলেন। এই ফাঁকে সাহাদা প্রশ্ন করলেন , "অশোকবাবু যখন আপনাকে বিয়ে করলেন আপনি তার ঘরে গেলেননা কেন?"
স্বপ্নাদি মানসিকভাবে প্রস্তুত নিয়েছেন। এরা যা প্রশ্ন করবে তার সবই উত্তর দিয়ে যাবেন। মাসীর উদ্যেশ্যে বললেন , " দিদি , এক গ্লাস জল দাও।"
আমি বললাম , "দিদি , একটু মিষ্টি আনব।"
"না ভাই মিষ্টি লাগবেনা। তাছাড়া মিষ্টি খাওয়া বারণ । সুগার আছে।"
জল খেয়ে স্বপ্নাদি বললেন , "আগেই তো বলেছি যাত্রাদলে অভিনয় করার জন্য আমি বিয়ে করেছি।আমি জানতাম অশোকের ঘরে তার বউ আছে। আর এও জানতাম অশোকের ঘরে আমার ঠাঁই হবেনা।যাত্রা দলের অভিনেত্রীকে কেউ বাড়ির বউ করবেনা।অশোক ব্রাহ্মণ বাড়ির সন্তান। আমি নিচু জাতের মেয়ে। এটাকে আমাদের সমাজ এখনও মেনে নেয়নি। যদিও অশোক এসব মানেনি। আসলে আমরা শিল্পী । শিল্পীদের কোনো জাত থাকে না। আমাদের অভিনয় দেখে হাততালি দেয়। পুরস্কার দেয়। প্রশংসা করে। কিন্তু সমাজ আমাদের মতো মেয়েদের ঘরে বউ করে নিয়ে যাবে না। অশোকের বাবা মা বউ এসব মেনে নিতে রাজী নয়। অশোক একবার চেষ্টা করেছিল আমাকে ঘরে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু আমি বাধা দিলাম। আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেলে কারোর ভালো হবে না। তার চেয়ে যে যার শান্তিতে বসবাস করাই ভালো।"
রায়বাবু বললেন , "অশোকবাবু কি যাত্রা ছেড়ে দিয়েছেন ?"
স্বপ্নাদি বললেন , "হ্যাঁ সেও যাত্রা ছেড়ে দিয়েছে। দেখা সাক্ষাৎ হয়। সে অবশ্য খরচ - খরচা কিছু দিতে চায়।কিন্তু আমি নিতে চাইনি। আমি যা রোজগার করি আমার তাতে ভালো ভাবেই চলে যায়।"
সাহাদা বললেন , "এখন আপনি কি করেন?"
সপ্নাদি বললেন, "একটি ফ্যামিলিতে বাচ্চার দেখাশোনা করি। তাকে স্কুলে পোঁছে দেওয়া এবং আনা --- এই আমার কাজ। তবে সারাদিন থাকতে হয়। স্বামী - স্ত্রী দুজনেই চাকরি করেন। তারা দুজনেই খুব ভালো। কেন জানিনা আমার উপর তাদের খুব বিশ্বাস। আজ রবিবার। তাঁরা আছে বলেই আজ নিজের মতো করে ঘুরতে বেরিয়েছি।
নিজের একটি ছোট্ট বাড়ি আছে। সেখানেও থাকি। আবার তাদের বাড়িতেও থাকি।"
"আপনি সংস্কৃতি জগতের লোক। সংস্কৃতি এক বিরাট শিক্ষার ভান্ডার। আপনার কাছে অনেক জ্ঞানের ভান্ডার আছে। আপনি নাই বা লেখাপড়া শিখলেন। যাত্রাতে অভিনয় করে আপনি অনেক জ্ঞান অর্জন করেছেন। জীবনে চলার পথে এটা যথেষ্ট। এজন্য আপনাকে সবাই ভালোবাসে এবং সমীহ করে।" সুনীত মন্তব্য করল।
স্বপ্নাদি বললেন , " জানিনা ভাই।"
আমি বললাম "শেষ জীবন কি এভাবেই কাটাবেন?"
স্বপ্নাদি বললেন , "হ্যাঁ ভাই। এরা তো বলেছে তুমি সারাজীবন আমাদের বাড়িতে থাকতে পারো। আমার কিছু জমানো টাকা আছে। এঁরা তো নেবেন না। ভাবছি এই টাকা আমাদের রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করে যাব।"
0 Comments