জ্বলদর্চি

দূরানুভূতি/কমলিকা ভট্টাচার্য

দূরানুভূতি

কমলিকা ভট্টাচার্য

অলোক যখন পৌঁছাল সেই জায়গায়, তখন সবে ভোর হয়েছে। পাহাড়ের গায়ে শিশির লেগে আছে, কুয়াশা ধীরে ধীরে নামছে ঢালের বুকে। অনেক বছর আগে, কর্মসূত্রে এই জায়গায় এসেছিল একবার। কিন্তু তখন তার চোখ ছিল পর্দা পরা। দায়িত্ব, কাজের চাপ, শহরের যান্ত্রিকতা—সব কিছুই ঢেকে রেখেছিল প্রকৃতির রঙ।

আজ সে একা এসেছে।
আজ তার চোখ খোলা।

চারদিক জুড়ে শুধুই সবুজ আর সবুজ। যতদূর চোখ যায়, পাহাড়ের ঢেউ, ঝর্ণার সাদা জলছবি, ঘাসের ওপর সূর্যের ঝলকানি—সবকিছু যেন এক অপূর্ব সুরে বাঁধা। বর্ষার মেঘ যেন ভালোবাসার গাঢ় চাদর মেলে দিয়েছে গোটা প্রকৃতির বুকে। পাখিরা গান গায়, ফুলেরা রঙ ছড়িয়ে বসে থাকে, আর বাতাসের মধ্যে একটা অদ্ভুত মাদকতা।

অলোক থমকে দাঁড়ায়। তার মনে হয়, সে যেন নিজেই হারিয়ে যাচ্ছে এইসবের মধ্যে। প্রকৃতি শুধু সুন্দর নয়—আজ যেন সে হয়ে উঠেছে রোমাঞ্চকর, উন্মাদ, জীবন্ত। যেন তার শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয়কে জাগিয়ে তুলছে এই অপরূপ দৃশ্য।

অলোক বুঝতে পারে, এই সৌন্দর্য শুধু চোখের নয়—এ এক দেহজ অনুভব।
এই বন, এই ঝর্ণা, এই সজল বাতাস—
এরা যেন লুকিয়ে থাকা কামনার মতো,
নতুন-চেনা ভালোবাসার স্পর্শের মতো।

পাহাড়ের ঢালে নেমে আসা মেঘ, গাছের পাতার ফাঁকে জলের ফোঁটা,
ভিজে মাটির গন্ধ—
এসব যেন শরীরের গভীর কোনো স্মৃতি জাগিয়ে তোলে।

প্রকৃতি এখানে কেবল ‘দেখার’ নয়,
তাকে অনুভব করতে হয়,
ঠিক যেমন একজন প্রেমিক বা প্রেমিকার নিঃশ্বাস কাছ থেকে ছুঁয়ে গেলে বুঝি—
এই অনুভব কেবল শরীরে নয়, আত্মাতেও বাজে।

এই অনুভব এমন, যা মানুষ কাউকে বলতে চায়।
ভাগ করে নিতে চায় নিঃশব্দ উল্লাস।
অলোকের মন বলে ওঠে—কেউ থাকলে!
এমন কেউ, যে এই পাগলামো বুঝবে।
🍂

হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় এক মুখ।

একজন মহিলা।
যার সঙ্গে তার তেমন বিশেষ সম্পর্ক ছিল না।
তবু যার চোখে সে একদিন দেখেছিল বোঝার ইচ্ছা।

তারা হয়তো খুব বেশি কথা বলেনি।
এক অফিস ক্যাফেটেরিয়ায়, চা-র কাপের পাশে, কয়েকটা স্মৃতি পড়ে আছে আজও।
সেই মেয়ে কথা বলত আকাশ নিয়ে, নদী নিয়ে, নিঃসঙ্গতা নিয়ে—
যেন সব তার মনের ভেতরের বাসিন্দা।

অলোক তাকে কোনোদিন কিছু বলেনি।
বলতে পারেনি।
কারণ সে ছিল সমাজের গণ্ডিতে বন্দি—বিবাহিতা।
অলোক তখন ব্যস্ত মানুষ, নিঃসঙ্গতায় ডুবে থেকেও নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল সকলের চোখের আড়ালে।

কিন্তু আজ, এই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে, বাতাসে ভেসে আসা সেই মুখটাই যেন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
তার মনে হচ্ছে, সে এখানে থাকলে—সে বুঝত।
সে কিছু জিজ্ঞেস করত না, শুধুই অনুভব করত।

হয়তো তারা একসঙ্গে বসে থাকত মাটির উপর, ঝর্ণার শব্দে হারিয়ে যেত তারা দুজনে, আর প্রকৃতি তাদের নিঃশব্দে জড়িয়ে ধরত।

কিন্তু সে নেই।
কেউ নেই।
শুধু পাহাড় আছে, ঝর্ণা আছে, আর আছে একাকী এক পুরুষ—
যে একদিন জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছে, প্রকৃতির মতো উদার ভালোবাসা কেউ কোনোদিন তাকে দেয়নি।

অলোক চোখ বন্ধ করে, একফোঁটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে তার নাম।
শুধু নাম।

এবং দূরে কোথাও যদি সে মেয়ে হঠাৎ একটা অচেনা টান অনুভব করে বুকের মধ্যে,
বৃষ্টির গন্ধে যদি অকারণে চোখ ভিজে ওঠে,
ঝর্ণার শব্দ শুনে যদি মনটা হালকা কেঁপে ওঠে—
তবে হয়তো সেটা অলোকের আত্মা,
আকাশের হাওয়ায় ভেসে তার কাছে পৌঁছতে চাইছে।
--

অমিত একের পর এক পাতা উল্টাতে থাকে। শুরুতে সে ভেবেছিল—এ কেবল প্রকৃতির গল্প। কিন্তু যতই পড়তে থাকে, ততই অবাক হয়ে দেখে, এ আসলে তার নিজের গল্প। তার নিজের না বলা কথা, নিজের দমিয়ে রাখা টান, নিজের নিঃসঙ্গতার প্রতিচ্ছবি।

অন্তরা—যে কখনো চোখে চোখ রেখে কিছু শোনেনি, তবু যেন শুনে ফেলেছিল মনের গোপন সুর। অলোকের নামে গল্প লিখলেও, সে আসলে অমিতের নিঃশ্বাস কাগজে তুলে দিয়েছিল।

শেষ পাতায় এসে থেমে যায় অমিতের চোখ।
“অলোক তার ঠোঁটের ফাঁকে উচ্চারণ করে শুধু এক নাম—রাধারাণী।”

অমিত স্তব্ধ।
সে নাম কোনোদিন কারও সামনে বলেনি। কেবল নিজের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিল অন্তরার জন্য। অথচ অন্তরা জানত। কীভাবে জানল? নাকি ভালোবাসাই এমন এক গোপন ভাষা, যেখানে না-বলা শব্দও পৌঁছে যায় প্রিয়জনের কাছে?

বইয়ের পিছনের কভারে লেখকের নামের পাশে লেখা—
রাধারাণী
জন্ম …. মৃত্যু ….

অমিত বুকের সাথে বইটা চেপে ধরে। 
তারপর জীবনে প্রথমবার ডাকে...
তার বুক ভরা চিৎকারে, পাহাড়ের নিস্তব্ধতা ভেঙে—

“রাধারাণী…!”

Post a Comment

4 Comments

  1. সুন্দর!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. কমলিকা ভট্টাচার্যAugust 25, 2025

      ধন্যবাদ

      Delete
  2. Banashri Roy chakraborttyAugust 25, 2025

    খুব সুন্দর দিদিভাই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কমলিকা ভট্টাচার্যAugust 25, 2025

      ধন্যবাদ, তোমার আরো লেখা পড়তে চাই।

      Delete