রাজকুমার সরকার
ঝাড়খণ্ডের এক ঐতিহাসিক ও ধার্মিক স্থান ভৈরব ধাম।ঝাড়খণ্ডের বোকারো জেলার চন্দনকেয়ারি ব্লকের ভোজুডি'র কাছে এই মন্দির যা এখন ভৈরব ধাম।চন্দনকেয়ারি থেকে ভৈরব ধামের দূরত্ব দশ কিলোমিটার। কিংবদন্তি আছে অজ্ঞাতবাসকালে পাণ্ডবরা মাতা কুন্তীসহ জঙ্গলঘেরা এই এলাকায় ছিল।মাতা কুন্তীর জলপিপাসা লাগে,ঘন জঙ্গল পরিবৃত এলাকা সামনে জল নেই জল পায় কোথায়;অর্জুন তীর নিক্ষেপ করে মাটি থেকে জল বের করেন। হয়ে যায় এক জলকুণ্ড।পরবর্তীতে এই জলকুণ্ড ঘিরেই এক ধার্মিক স্থান, যা আজকের ভৈরব ধাম।জলকুণ্ডটি দেবকুণ্ড বলে সমধিক খ্যাত। ঝকঝকে তকতকে কুণ্ডের জল দেখে মন প্রফুল্ল হয়ে উঠবে যে কোনো পর্যটকের। স্থানীয় মানুষদের কাছে এই কুণ্ডের জল মিনারেল ওয়াটার। দূর-দূরান্ত থেকে গ্রামের মেয়েছেলেরা হাঁড়ি, কলসী, বালতি নিয়ে প্রতিদিন আসেন কুণ্ডের জল নিতে।কুণ্ড থেকে জল নেওয়া নিষিদ্ধ। কুণ্ডের জল মগরা হয়ে বাইরে চলে যায় সেই জল তারা পানীয়জল হিসেবে ব্যবহার করেন। ঐতিহাসিক, আধ্যাত্মিক ও পুরাতত্ত্ব যেখানে মিলেমিশে একাকার ।
ভৈরব ধাম ঝাড়খণ্ডের একটি বিখ্যাত মন্দির যেটি এখন পর্যটন মানচিত্রে একটি পাকাপোক্ত স্থান দখল করে আছে।১৮৭২ সালে পুরাতাত্ত্বিক অন্বেষণে জানা যায় জায়গাটির প্রাচীনত্বের কথা।ভৈরবস্থানের ধারে কাছে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর অনেক প্রাচীন শিলামূর্ত্তি পাওয়া যায়।পালযুগের কিছু নিদর্শন এখনও বর্তমানে রয়েছে যা পর্যটকের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।এই কুণ্ডের জলের ঔষধি গুণ রয়েছে।
🍂
চামড়ার রোগ,গ্যাসট্রিক,শরীরের ব্যথা উপশম হয় এই কুণ্ডের জল খেলে।দূর দূর থেকে মানুষজন ছুটে আসেন কুণ্ডের জল নিতে।মন্দিরে পুজো হয় এই কুণ্ডের জলে।এই কুণ্ডের জল শুধু দেবসেবায় লাগে।কুণ্ড থেকে মগরা হয়ে জল বাইরে চলে যায় সেই জল সকলের কাজে লাগে।পুরোহিত জানালেন-- বাবার ডাক এলেই এ জায়গায় উপস্থিত হতে পারেন মানুষ।পাঁচটি মন্দির রয়েছে কুণ্ড লাগোয়া।পুরোহিত কাঞ্চন পাঠক জানালেন দ্বাপরযুগে পঞ্চপাণ্ডব এই এলাকায় বাস করেছিলেন।পুরোহিতকে প্রশ্ন করলাম কতদিন ধরে আপনি এখানে পুজো করছেন?
উনি উত্তরে জানালেন আমরা চার পাঁচ পুরুষ ধরে এই মন্দিরের পুজো করে চলেছি।এখানে বিবাহ হয়।সরকারী উদ্যোগে পর পর তিনবছর মেলা হয়েছে।এখানে এসেছেন কৈলাশ খের, কুমার শানুর মত গায়করা.....
করোনার পর থেকে সব বন্ধ আছে।আশ্চর্য হয়ে যাই এই কুণ্ডের কথা শুনে।এখানে প্রচণ্ড বর্ষাতেও কুণ্ডের জল বাড়ে না এবং বীভৎস গরমের দিনেও কুণ্ডের জল কমে না।সবকালে একই জল রয়েছে।অজস্র বড় বড় জানা- অজানা গাছ ঘিরে রেখেছে কুণ্ডটিকে।গাছেদের শিকড় বাকড়ে তৈরি হয়ে গেছে প্রকৃতির দোলনা।বাচ্চারা ঝুলছে খেলা করছে।অতীব মনোরম দৃশ্য চোখে পড়ল । একটি গাছের লতা দিয়ে তৈরি হৃদয় চিহ্ন। অদ্ভুত সুন্দর। স্থানীয় মানুষরা জানালো এই কুণ্ডের জলে কোনোদিন পোকা লাগে না।বৈশাখী পূর্ণিমার দিন এই কুণ্ডের জল একবার পরিস্কার করা হয়।কুণ্ড ঘিরেই অজস্র গাছ,গুল্ম অথচ একটিও পাখি দেখতে পেলাম না।কোনো চিৎকার চ্যাঁচামেচি নেই।হই হল্লা নেই। শুনশান নীরব চুপচাপ শান্ত মায়াময় পরিবেশ। এদিকে সেদিকে পঁচিশ তিরিশটি কুকুর আপনমনে যে যেদিকে পারছে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেউ নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে কুণ্ডের ধারে সিমেন্ট বাঁধানো ঘাটের পাড়ে।চরম আশ্চর্য হলাম এই ধামে একটিও ভিখারি নেই। কোনো পাণ্ডার উৎপাত নেই। শুধু পুরোহিত পুজো করেন।সূর্য ভগবানের মন্দির রয়েছে।রয়েছে দুর্গামাতার মন্দির,শিব মন্দির,হরি মন্দির। অজস্র দেবদেবী বিরাজ করছেন এখানে।এখানে খুব সুন্দর নিরিবিলিতে মনের আনন্দে কেটে যাবে একদিন। মন প্রফুল্ল হয়ে উঠবে।
দৈনন্দিন জীবনের হই হল্লা,দুশ্চিন্তা,ঝামেলা নিমেষেই গায়েব হয়ে যাবে এখানে এলে।শান্ত নিরিবিলি এক আশ্রমিক পরিবেশ আপনাকে নিয়ে যাবে এক মায়াময় লোকে।মন্দিরের ধারে পাশে সবুজ বনানীতে বসে শীতকালে বনভোজন।দূর দূরান্ত থেকে দলে দলে আসেন বনভোজনের আনন্দ নিতে।মন্দিরের বাইরে সারি সারি দোকান পাবেন না একটি মাত্র দোকান সেখানে আপনি পুজো সামগ্রী পেয়ে যাবেন। শিবরাত্রি ও মকর সংক্রান্তিতে বসে বিরাট মেলা।অনেক দূর দূর থেকে মানুষজন আসেন।
পথনির্দেশ: কোলকাতা থেকে যারা আসতে চাইলে খড়্গপুর আদ্রা হয়ে আসতে হবে।আদ্রা থেকে আদ্রা-খানুডি লাইনের ট্রেন ধরতে আসতে হবে।নামবেন ভোজুডি জংশন এ।নেমে বাঁদিকে দুই কিলোমিটার দূরে ভৈরবধাম।আদ্রা থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে রঘুনাথপুর সাঁওতালডি হয়েও আসা যায়।সাঁওতালডি থেকে গোয়েল নদী পার হলেই ভোজুডি আসা যায়।পশ্চিমবঙ্গে ও ঝাড়খণ্ডের সীমা ভাগ করছে এই গোয়েল নদী।আদ্রা থেকে ভোজুডি'র দূরত্ব চল্লিশ কিলোমিটার।যাঁরা পুরুলিয়া জেলা শহর থেকে আসতে চান তাঁরা বারমেসিয়া চন্দনকেয়ারি হয়ে আসতে পারেন।
0 Comments