বাড়ি ফেরা
বাড়ি—এ পৃথিবীর সবচেয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয়। দিনের শেষে ক্লান্ত মানুষ যেমন মাটির টানে ঘাসে শুয়ে পড়তে চায়, তেমনই ছোটবেলায় স্কুলে গেলে বাড়ি ফেরার জন্য এক অদ্ভুত টান জাগত মনে। খেলতে খেলতে সূর্য ডুবে গেলে যেন আকাশের ভেতর থেকে শোনা যেত মায়ের ডাক—“এবার ঘরে ফিরতে হবে।” শুধু মানুষ নয়, বাড়িটাই যেন হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করত। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা অসুস্থ মানুষ, হস্টেলে পড়তে থাকা ছাত্রছাত্রী, প্রবাসে কর্মরত শ্রমিক কিংবা সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এক সৈনিক—সবার মনের গভীরে একটাই আকুলতা, একদিন নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরতে হবে।
কিন্তু মণীশ বাড়ি ফিরতে চায় না।
স্কুল ছুটির ঘণ্টা বাজলে যখন সবাই বাঁধভাঙা নদীর মতো ছুটে যায় মা–বাবার বুকে, ধীরে ধীরে খালি হয়ে আসে স্কুলের গেট, তখন মণীশ লুকিয়ে পড়ে টেবিলের তলায়। ক্লাস টিচার ডেকে বলে—
“মণীশ, বেরিয়ে এসো, তোমার আন্টি এসেছে।”
অভিভাবকের বদলে যে পরিচারিকা এসে টেনে নিয়ে যেত তাকে, তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হাজারো অভিযোগ জমত ছোট্ট মণীশের মনে। কিন্তু কাউকে বলতে পারত না—সে যে বাড়ি ফিরতে চায় না। কারণ সেখানে নেই মায়ের স্নেহভরা খাবার, ঠাকুমার গল্প, বাবার সঙ্গে খেলাধুলার হাসিখুশি সময়। ছিল শুধু নিঃশব্দ দেওয়াল, ব্যস্ততার অচেনা ছায়া, আর একাকিত্বের ভারী শূন্যতা। রাত নামলে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে তার মনে হতো—অন্য সব শিশুর মতো যদি সেও ঘরে ফেরার উষ্ণতা পেত!
🍂
এই অমলিন শূন্যতার দগদগে ক্ষত নিয়ে কেটে গেছে তার শৈশব।
আরও বড় হলে যখন হোস্টেলে ভর্তির খবর আসে, মণীশ যেন হাতে চাঁদ পায়। আর প্রতিদিনের ঘরে ফেরার কষ্ট নেই! প্রথমদিকে ছুটি পেলে অগত্যা ফিরতে হত, তখনও ব্যস্ত মা–বাবার তার জন্য সময় ছিল না। বই পড়ে, ছবি এঁকে সে নিজের একটা রঙিন জগৎ তৈরি করেছিল। কিন্তু ষোলো বছর পেরোনোর পর আর কখনও বাড়ি ফেরেনি। হোস্টেলের জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল সে। ছবি আঁকতে তার ভীষণ ভালো লাগত, তাই ছুটি পেলেই কোনো না কোনো নাম-না-জানা শহরে কিংবা গ্রামে হারিয়ে যেত। তবে এক দিক থেকে সে ভাগ্যবান—মা–বাবার কাছ থেকে আদরমাখা সান্নিধ্য না পেলেও অর্থকষ্ট তাকে কোনোদিন ছুঁতে পারেনি।
হোস্টেলজীবনের সেই দশ বছর থেকে চব্বিশ বছর পার হয়ে যায়। তারপর চাকরি, তারপর বিয়ে—সেটাও বাবা–মায়ের পছন্দের মেয়েকেই।
তবে সঙ্গীতাকে সে ভালোবাসত, আর সঙ্গীতাও তাকে ভালোবাসত। দু’জনের মধ্যে এক অপরের প্রতি সম্মানের মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
আজকের দিনে ভালোবাসা মানে তো আর বাড়িতে বসে রান্না করে বরের জন্য অপেক্ষা করে থাকা নয়। সঙ্গীতাও ছিল চাকরিজীবী। বেশিরভাগ সন্ধ্যাতেই তারা দু’জনে বাইরে খেয়ে তবে বাড়ি ফিরত। মাসের বেশির ভাগ দিনই সঙ্গীতাকে কাজের সূত্রে শহরের বাইরে যেতে হত। তাই বিয়ের পরেও মণীশের মনে বাড়ি ফেরার নতুন করে কোনো তাগিদ জাগেনি। তবে বাড়িতে ফিরলে সে নিজের ডায়েরি লেখা আর ছবি আঁকায় ব্যস্ত থাকত—বলা যেতে পারে, তার বাড়ি ফেরার ইচ্ছেটুকুই ছিল সেই ডায়েরি আর ছবির পাতায়।
অফিসের আটাশ তলার কাঁচের জানলা দিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে হঠাৎ মণীশ চমকে ওঠে। সূর্যের লালাভ আভা যেন অভিমানী আকাশের রঙে ঢেকে গেছে। হঠাৎ মনে পড়ে যায় তার অসমাপ্ত ছবির কথা—যে রঙের খোঁজে সে কতদিন ধরে কত জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে! আজ যেন সেই রঙটাই খুঁজে পেল।
তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গুছিয়ে নিল সে। মনে পড়ল—আজ তো সঙ্গীতার বোম্বে যাওয়ার কথা। ব্যস্ততার মাঝে ফোন করা হয়ে ওঠেনি। এবার ফোন করতে গিয়ে দেখে, সুইচ অফ। কল লিস্টে তিনটি মিস কল—সবই সঙ্গীতার। ফের কল করতে গেলে জানল—সঙ্গীতার ফোনও সুইচড অফ।
মন খারাপের সঙ্গেই ফ্ল্যাটে ফিরে দরজা খুলে মণীশ একটু অবাক হয়। ঘরের সব আলো জ্বলছে।
তার ঘরে ফেরার শব্দে রান্নাঘর থেকে সঙ্গীতা বেরিয়ে এসে হাসি মুখে বলে—
“তুমি আজ তাড়াতাড়ি চলে এলে, ভালো করেছ। ফোন ধরছিলে না, আমি অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম।”
মণীশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে—
“তোমার তো আজ বম্বে যাওয়ার কথা ছিল, গেলে না?”
সঙ্গীতা হেসে বলে—
“ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি কফি বানিয়ে আনছি।”
কিছুক্ষণ সঙ্গীতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মণীশ। আজ যেন সে একেবারেই অন্যরকম—অপরূপ সুন্দর, ঠিক সেই আকাশের রঙের মতো। রান্নাঘরের আলোয় সঙ্গীতার গাল দুটো হালকা আভায় ঝলমল করছে, চোখে জমাট বেঁধে আছে অদ্ভুত এক আকর্ষণ, এক টান—যেন সে-ই বাড়ি ফেরার প্রকৃত প্রতীক।
মুহূর্তে মণীশের বুকের ভেতর এক প্রবল আকাঙ্ক্ষা দপ করে জ্বলে ওঠে। সারা শরীর অস্থির হয়ে ওঠে তাকে ছুঁয়ে দেখতে, বুকের ভেতর টেনে নিতে, সেই উষ্ণতায় ডুবে যেতে। মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তেই দু’হাত বাড়িয়ে সঙ্গীতাকে চেপে ধরবে, তার নিশ্বাসে নিজের নিশ্বাস মিশিয়ে দেবে, সমস্ত ক্লান্তি গলিয়ে দেবে তার শরীরের উষ্ণতায়।
চোখে চোখ রেখে যেন নিঃশব্দে বলতে চাইল—
“এবার তুমিই আমার বাড়ি।”
আঙুলগুলো অজান্তেই কেঁপে উঠছিল, যেন বাড়িয়ে দিলেই ছুঁয়ে ফেলতে পারবে তাকে। বুকের ভেতর দপদপ করছিল বাসনা, প্রতিটি নিঃশ্বাসে জমে উঠছিল তীব্র আকুলতা। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীজুড়ে আর কিছু নেই—সারা বিশ্ব সঙ্কুচিত হয়ে একমাত্র সঙ্গীতার ভেতরেই থেমে আছে।
তবু… সারা জীবনের অভ্যেস মতো নিজেকে সংযত রাখল সে। জোর করে কিছুই তো কোনোদিন চায়নি। তাই আজও থেমে রইল, শুধু চোখের গভীরে উথলে উঠতে দিল দগদগে আবেগ—এক অশ্রুত বিস্ফোরণ, যার সাড়া সঙ্গীতার চোখেও ধরা পড়ছিল।
সঙ্গীতা হেসে বলে—
“কি দেখছো? যাও, ফ্রেশ হয়ে নাও।”
স্টাডি রুমে ব্যাগ রাখতে গিয়ে হঠাৎ নজরে আসে টেবিলের উপর রাখা তার ডায়েরি, তার ওপরে রাখা দুটি খাম।
একটিতে সঙ্গীতার রেজিগনেশন লেটার। আরেকটিতে নতুন এক খবর—সে মা হতে চলেছে।
জীবনে প্রথমবার মণীশের চোখ ভিজে আসে।
সেই সময় সঙ্গীতা নিঃশব্দে এসে তার পাশে দাঁড়ায়, আলতো করে মাথা রাখে মণীশের কাঁধে। মৃদুস্বরে বলে—
“আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের সন্তানের বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি করতে হবে তো।”
সেদিন সারারাত জেগে রইল দু’জনে। একসঙ্গে তুলির টানে, রঙ মিশিয়ে শেষ করল মণীশের অসমাপ্ত ছবিটা।
1 Comments
দারুণ সুন্দর।
ReplyDelete