জ্বলদর্চি

তাড়কাকথা /মৌ দাশগুপ্ত আদক

তাড়কাকথা

মৌ দাশগুপ্ত আদক


বাল্মীকির রামায়ণ আমাদের “কবিপ্রথমপদ্ধতিঃ” অর্থাৎ আদিকাব্য।  রামায়ণ জুড়েই মানুষ আর রাক্ষসশক্তির দ্বৈরথ, যার সূচনা তাড়কাবধের মধ্য দিয়ে। কে এই তাড়কা?
মাতা হিড়িম্বা মন্দির,মেহুলা বা মেহলা ভ্যালি, চাম্বা, হিমাচলপ্রদেশ।

যক্ষরাজ সুকেতু নি:সন্তান ছিলেন। সন্তানপ্রাপ্তির জন্য দীর্ঘকাল তপস্যা করার পর একহাজার হাতির সমান বলযুক্ত কন্যালাভ করেন। নাম রাখা হয় তাড়কা। সাবালিকা তাড়কা বিয়ে করেন রাক্ষস জাম্বের পুত্র সুন্দকে। সমাজবিচ্যুত নবদম্পতি সংসার পাতেন সুন্দর-অরণ্যে। যাকে অগস্ত্যবনও বলা হত। পুত্র মারীচের জন্ম হয়।  শঙ্করদেবের “অঙ্কিয়া নট”-এ আছে, একদিন হরিণশিকারে যান সুন্দ, তাড়কা তখন দ্বিতীয়বার গর্ভবতী।আহত হরিণ ছুটতে- ছুটতে ঋষি অগস্ত্যের আশ্রমে আশ্রয় নেয়। সেখানেই আশ্রমিকদের প্রতিরোধের মধ্যে যজ্ঞকুন্ডে পুড়ে প্রাণ হারান সুন্দ-রাক্ষস। স্বামীকে খুঁজতে-খুঁজতে আশ্রমে এসে হাজির হন তাড়কা। প্রথমে ঋষিকে অনুরোধ করলেন তপোবলে সুন্দের প্রাণ ফিরিয়ে দেবার জন্য।  রাজি হলেন না অগস্ত্যঋষি। তাড়কা রেগে মুনির আশ্রম লণ্ডভণ্ড করলে ক্রোধে আত্মহারা ঋষি সপুত্র তাড়কাকে ভয়ালদর্শনা নরভোজী রাক্ষসী হবার অভিশাপ দিলেন। তাড়কার গর্ভিণী অবস্থা খেয়াল করে প্রতিবিধানও বলে দিলেন, যে, শ্রীরামচন্দ্রের হাতে মৃত্যু হলেই রাক্ষসজন্ম থেকে মুক্তি লাভ করবেন তাড়কা।

অভিশপ্ত তাড়কার প্রথম আঘাত গিয়ে পড়লো ঋষি অগস্ত্যর আশ্রমেই।এরপর আসন্নপ্রসবা তাড়কা আশ্রয় নিলেন পঞ্চবটি অরণ্যে। সেখানে রাজত্ব করেন রাবণের তুতোভাই খর-দুষণ। তারা আশ্রয় দিলেন তাড়কাকে। তারপর থেকে সুন্দর-অরণ্যের ঋষিরা যজ্ঞ করতে আরম্ভ করলেই রাক্ষসেরা এসে যজ্ঞের আগুনে রক্ত, অস্থি, মাংস, চর্বি নিক্ষেপ করে যজ্ঞ অপবিত্র করে দিতো । অবশেষ বিরক্ত হয়ে অগস্ত্য তাঁর আশ্রম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন । চলে গেলেন ঋষি গৌতম এবং ঋষি মাতঙ্গও। আশ্রমগুলি একের পর এক জনশুন্য হল। সুন্দরঅরণ্য ধীরেধীরে ভয়াল তাড়কাবনে পরিণত হল।খাদ্যের খোঁজে তাড়কার নেতৃত্বে  এরপর রাক্ষসরা অযোধ্যার নিকটবর্তী  ‘মলদ’ ও ‘কুরূষ’ নামক জনপদে হানা দিতে থাকলো । তাড়কা তখন আর একাকিনী নন, তাঁর সাথে আছেন দুই বীরপুত্র মারীচ ও সুবাহু। 

গুরু জ্ঞানলীলা কর্তৃক সম্প্রচারিত ভারতীয় টিভি সিরিয়াল রামায়ণে আবার সুন্দের উল্লেখ নেই, পরমাসুন্দরী যক্ষকন্যা তাড়কা তপস্যারত ঋষিঅগস্ত্যকে দেখে প্রেমমুগ্ধ হয়ে তাঁর তপস্যায় বিঘ্ন ঘটানোয় তাড়কাকে কুরূপা রাক্ষসী হবার অভিশাপ দেন ঋষি। মালয়ালম কাহিনীতেও আছে, যে মুনি ‘আগস্তিয়ার’কে দেখে প্রেমমুগ্ধ হন তাড়কা। বারবার অনুরোধেও তাড়কাকে বিবাহ করতে রাজি না হওয়ায় বলপ্রয়োগে উদ্যত হন যক্ষকন্যা, তখনই তিতিবিরক্ত হয়ে তাকে কুদর্শনা রাক্ষসী হবার অভিশাপ দেন অগস্ত্য। উত্তরভারতের কাহিনীতে তাড়কা ও সুন্দ উভয়েই রাক্ষস। রাক্ষস প্রকৃতির হওয়ায়, সুন্দ মুনি-ঋষিদের যজ্ঞ ধ্বংস করতেন, তপস্যায় বাধা সৃষ্টি করতেন। একদিন তিনি ঋষি অগস্ত্যের তপোবনে প্রবেশ করলে ঋষি সুন্দকে ব্রহ্মশাপে ভষ্মে পরিণত করেন। স্বামীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এসে ভয়ঙ্কর রূপধারণ করেন তাড়কা। নারীজাতি বলে তাড়কাকে হত্যা না করে কুরূপা রাক্ষসী হবার অভিশাপ দেন অগস্ত্য, সাথে বালক মারীচও অভিশাপগ্রস্ত হয়। উত্তরভারতে আরেকটি প্রচলিত উপকথায় আছে, তুতোবোন নিকষার আমন্ত্রণে লঙ্কাপুরী গেছিলেন তাড়কা, সেখানকার সুরম্য অট্টালিকা দেখে মুগ্ধ হয়ে স্বামীর কাছে আবদার করেন ওইরকম সুরম্য অট্টালিকা বানিয়ে দেবার। গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভাবস্থায় অনেক অদ্ভুত শখ হয়, সুন্দরাক্ষসের পক্ষে লঙ্কানগরীর মত মায়াপ্রাসাদ বানানো সম্ভব ছিল না বলে তিনি দৈবগুণসম্পন্ন ঋষি অগস্ত্যকে গিয়ে অনুরোধ করেন তপোবলে এক মায়াপ্রাসাদ বানিয়ে দেবার জন্য। স্বভাবতই এতদিনের কষ্টার্জিত তপোবল এভাবে নষ্ট করতে রাজি হন না অগস্ত্য, উভয়ের বিবাদে রুষ্ট ঋষি সুন্দকে ভষ্মে পরিণত করেন এবং তাড়কাকে সপুত্র রাক্ষসী হবার অভিশাপ দেন। এতদুর অব্ধি সব গল্পই মোটামুটি এক।

মধ্যপ্রদেশের গোন্ড-উপকথায় তাড়কা কিন্তু বনদেবী। আর্য মুনি-ঋষিরা বনের গাছ কেটে,পাথর সরিয়ে, জমি ফাঁকা করে গড়ে তোলেন আশ্রম,তপোবন। গাছ কেটে, কাঠ পুড়িয়ে যজ্ঞের নামে বনের সবুজ পরিবেশ নষ্ট করতে থাকেন, লোকজনের যাতায়াত বাড়ে। বন্যপশুদের, বনচারী-আদিবাসীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হতে থাকে, তাই তারা সুযোগ পেলেই আশ্রম আক্রমণ করে যজ্ঞপন্ড করে দিত।বনদেবী ছিলেন তাদের নেত্রী। স্বভাবতই ঋষিদের চোখে বনদেবী হয়ে ওঠেন উপদ্রবকারী দুরাত্মা, কুরূপা রাক্ষসী। 

 শ্রীলঙ্কার নাটক রাবণবধে তটকা-রাক্ষসীর উল্লেখ আছে বটে, তবে সে একজন মায়াবিনী, পুরুষদের রূপে ভুলিয়ে নিয়ে এসে খেয়ে ফেলাই তার কাজ। ইন্দোনেশিয়ান রামায়ণ কাকাওয়ানে তটকা বা তদকা ছিলেন শাপভ্রষ্ট অপ্সরা। 

খানিক্টা আলাদা চরিত্রের সন্ধান পাই থাই-রামায়ণ রামকিয়েনে,এখানে তাড়কার বদলে নাম পাওয়া যায় কাকরাণী কা-কানাসুনের, দুই পুত্র তার, মারিত আর স্বাহু। আর্য ঋষিমুনিদের অলৌকিক, অতিপ্রাকৃত কাজকর্মে ভয় পেয়ে রাক্ষসের রাজা তসকণ্ঠ ( রাবণ) কাকরাণীকে পাঠায় ঋষিদের আশীর্বাদধন্য অযুধ্যায়, রাজা তোসরথের রাজধানীতে। তখন বসিত আর বিস্বামিত মুনি তাদের শিষ্য রামলক্ষ্মণকে যুদ্ধে পাঠান। রামের যাদুতীরে পরাস্ত হন সবাই। এমনকি কা-কানাসুনেরও নিধন ঘটায় রামের যাদুবাণ। 

কেমন দেখতে ছিলেন তাড়কা? রামায়ণে রাক্ষসী তাড়কার যে রূপ বর্ণনা আছে, তার প্রতিছত্রে ঝরে পড়ছে অনার্য্যা রক্ষনারীর প্রতি অকারণ ঘৃণা। “মুখখানি তার হাঁড়ির মত, জালার মত ভুঁড়ি। গলায় ঝোলে মুন্ডমালা, চোখদুটি তার লাল, বোঁচাখাঁদা নাকটা যেন,থ্যাবড়া দুটো-গাল”। পরিধানে ব্রাহ্মনের চর্ম, কর্ণে ব্রাহ্মনের মুন্ড। 

রামায়ণে  রাক্ষসবাহিনীকে মন্দের প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, তাই রাক্ষসদের সবকিছুই মন্দ, নিন্দনীয়। তারা হিংস্র, বিকটদর্শন, মাংসভোজী।  তারা মানুষের ক্ষতিসাধন করেন, যাগযজ্ঞ পুজা-অর্চনা মানেন না, পুরাণকাররা প্রথম থেকেই শ্রোতাদের মনে রাক্ষসদের সম্পর্কে এক বিরূপধারণা গড়ে তুলেছেন। রামায়ণও ব্যতিক্রম নয়। সুন্দরী যক্ষকন্যাকে অগস্ত্যের অভিশাপে কুরূপা রাক্ষসী বানানো হল। মানুষ হত্যা করিয়েই ক্ষান্ত হলেননা রামায়ণলেখক, তাকে নরমাংসভোজীও বানিয়ে দিলেন। 

আদর্শ নারী কেমন হবেন? “বাল্যে পিতুর্বশে তিষ্ঠেৎ পাণিগ্রাহস্য যৌবনে।পুত্রাণাং ভর্তরি প্রেতে ন ভজেৎ স্ত্রী স্বতন্ত্রতাম।” নাহ, এর কোনটাই তাড়কার চরিত্রে দেখা যায় না। রাক্ষস সুন্দকে ভালবেসে অবহেলায় পরিবার-পরিজন, রাজসিংহাসন, বিলাসবৈভব ত্যাগ করলেন, স্বামীর অতর্কিত মৃত্যুতে ভেঙে পড়লেও দৈব-নির্ধারিত অঘটন বলে মেনে না নিয়ে রুখে দাঁড়ালেন, যুদ্ধ করলেন।একাকিনী দুই-পুত্রকে উপযুক্ত বীর করে তুললেন পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য।রাক্ষসসমাজে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ ছিল না, তবু সুন্দ-রাক্ষসের প্রতিই তাঁর প্রেম অটুট ছিল চিরকাল। একবারও কোথাও তাকে পুত্রমুখাপেক্ষী দেখানো হয়নি। বরঞ্চ তাঁর পুত্ররাই ছিলেন মাতৃ- আজ্ঞা অনুসারী। তিনি স্বাধীন, স্বয়ংসিদ্ধা। অথচ রামায়ণে তাড়কার যাবতীয় গুণ সুচতুরভাবে ঢেকে রাখা হল । 

তাড়কাবনের অদুরেই ছিল ঋষি বিশ্বামিত্রের আশ্রম। তারকা এবং তাঁর দুই পুত্র মারীচ-সুবাহু তাঁর যজ্ঞে ক্রমাগত বাধা সৃষ্টি করছিলেন, এদিকে ঋষি অগস্ত্যের অভিশাপে তাড়কাবধ যে শুধু শ্রীরামচন্দ্রের হাতেই সম্ভব। তাই, তিনি অযোধ্যানরেশ দশরথের কাছে সাহায্য চাইলেন, রাজা দশরথ  রাম-লক্ষ্মণকে বিশ্বামিত্রের সাথে পাঠালেন।

বিশ্বামিত্রের অভিপ্রায় ছিল তাড়কা বধ। কিন্তু নারীনিধন?যুগপুরুষের দ্বিধা জানতেন রাজর্ষি, বললেন তাড়কারাক্ষসী নারী হলেও একজন রাজপুত্র হিসেবে তাড়কাকে হত্যা করা শ্রীরামচন্দ্রের কর্তব্য, কারণ তিনি রামের প্রজাদের জন্য প্রাণঘাতী শত্রু । 

অত:পর ধনুকে জ্যা-রোপণ করলেন রাম। ধনুকের বজ্রনির্ঘোষ শুনে ভয়ংকর চেহারায় ছুটে এলেন তাড়কা, দূর থেকেই বিশাল-বিশাল পাথর,শাল আর শিশংপার ডাল নিক্ষেপ শুরু করলেন, ধূলোয় ঢেকে গেল আকাশ। এদিকে নেমে আসছে সন্ধ্যা। অন্ধকারে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবেন নিশাচর রাক্ষসী। রাম নিক্ষেপ করলেন অর্ধচন্দ্র বাণ। ডানহাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। লক্ষ্মণের বাণে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তাঁর বামহাতও। তবুও থামার নাম নেই তাড়কার। পায়ে করে পাথরের টুকরো, গাছের ডাল ছুঁড়ে মারতে লাগলেন, অবশেষে বজ্রবাণ নিক্ষেপ করলেন শ্রীরামচন্দ্র। চিরদিনের মত ধরাশায়ী হলেন তাড়কা।

কেন এই তাড়কা হত্যা? তাড়কাবনকে রাক্ষসমুক্ত করতে? সে অবশ্যই একটা কারণ। অগস্ত্যর বরে শ্রীরামচন্দ্র ছাড়া অন্য কারো হাতে বধ্য ছিলেন না তাড়কা, তাড়কাবধের মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হল, এসে গেছেন রঘুকুলতিলক, আর্যধর্মের বিরোধী হলে নারীশত্রুও রেহাই পাবেননা।    বশিষ্ঠমুনির শেখানো অস্ত্রজ্ঞানের প্রথম পরীক্ষাও হল তাড়কাবধ দিয়ে। এখন থেকে ধীরে-ধীরে রক্ষরাজবধের উপযুক্ত হিরো হয়ে উঠতে হবে রঘুকুলতিলক শ্রীরামচন্দ্রকে। রামায়ণের আক্ষরিক অর্থ ‘রামের যাত্রা’। অনার্য-সংস্কৃতিকে পর্য্যুদস্ত করে আর্যদের বিজয়কেতন ওড়ানোর যাত্রা। তাড়কাবধ দিয়েই সেই বিজয়যাত্রা শুরু হয়েছিল।

Post a Comment

0 Comments