জ্বলদর্চি

সমাধান /মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী

সমাধান

মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী


না, ভালো আর থাকা হল না মিনুর। ও প্রতিজ্ঞা করেছিল শৌভিকের সঙ্গে  আর তর্ক করবে না, ওর কথায় একদম  দুঃখ পাবে না। শুধু নিজস্ব ভালো লাগার বিষয়ে মগ্ন থাকবে। বয়স তো অনেক হল, কতদিন আর বেঁচে থাকা যাবে, এখন যতটুকু আনন্দ জীবন থেকে নেওয়া যায় সেই চেষ্টাই করবে!  কিন্তু শৌভিকের ওই কত্তা-কত্তা ভাবখানা আবার অসহ্য বিরক্তি জাগিয়ে তুললো মনে, নিরাসক্ত থাকা গেল না।

সংসার তো দু'জনেরই, কিন্তু এ সংসারে শৌভিক যা করবে যা বলবে, সেটাই চূড়ান্ত, কোনও প্রশ্ন করা যাবে না! ও শুধু নীরব আজ্ঞাবাহিকার মতো কর্তব্য করে যাবে। আর ও নিজে যা কিছু করতে চাইবে সেসব নিয়ে জবাবদিহি করতে হবে শৌভিকের কাছে। ও কি মাটির পুতুল নাকি!

মাঝে বেশ সুখে ছিল মিনু। আপনমনে নিজের ভাবে থাকত। বাইরের নবতরঙ্গ যত মনের ভেতরে গ্রহণ করা যায় ততই ঝামেলা! বরং নিরাসক্তভাবে শুধু নিজের কর্ম করে যাওয়ার মধ্যে একরকমের শান্তি আছে। থাকো বাবা চুপচাপ নিজের ভাবে, অন্যের ভাবে নাক গলিয়ে কাজ নেই। এসব থেকে নিজেকে যত বিযুক্ত রাখা যায়!

কিন্তু আজকে মনে একটা ধাক্কা খেয়ে নিজেকে কিছুতেই আর সেই  ছন্দে ফেরাতে পারছে না। সকালের কাজকর্মের পর একটু বসে বিষণ্ণমনে সেটাই ভাবছিল মিনু। এর শুরুটা অবশ্য গতকাল থেকেই! সবটা দোষ শৌভিককে দেওয়া যাবে না, মিনুর মনের ভেতরেও একটা জ্বলুনি হচ্ছিল হিংসের আগুনে। নিজের কাছে তো নিজেকে লুকোনো যায় না! 

🍂

ঘটনাটা হল, গতকাল সন্ধেবেলা ওরা গেছিল শৌভিকের বন্ধু প্রতাপদার বাড়িতে। প্রতাপদার স্ত্রী গ্রামের দিকে একটা ইস্কুলে পড়ায়। প্রতাপদা শৌভিকের অফিসেই চাকরি করে। যথেষ্ট স্বচ্ছলতা আছে ওদের। দু-চারবার এর আগেও ওদের বাড়িতে গেছে মিনুরা। মোটামুটি বড়ো বাড়ি, কিন্তু ভীষণ অগোছালো! সেই তুলনায় মিনুদের বাড়িটাই ছোটোখাটোর মধ্যে বেশ ছিমছাম। গতকাল বহুদিন বাদে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়ে মিনু হতভম্ব। প্রতাপদার মেয়ে-জামাই মিলে অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায় পুরোনো বাড়িটাকে সাজিয়ে তুলেছে, একেবারে চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য সেটা! প্রচুর টাকাপয়সা তো ছিলই, ফলে মনের মত ব্যবহার করা গেছে! চমকে গিয়েছিল মিনু! তারপর খুবই স্বাভাবিক থাকবার চেষ্টা করছিল, ওদের আন্তরিক আতিথেয়তায় ভালোও লাগছিল, অত মহার্ঘ জিনিসপত্রে সাজানো ঘরে বসে আরামও  হচ্ছিল, তবুও বুকের ভেতরে কোথাও ঈর্ষার চোরা ব্যথাও অনুভব করছিল একটা। এতটা অন্যরকম যে হয়ে যেতে পারে এই সাদামাটা বাড়িটা, মিনু ভাবতেই পারেনি! কতটা স্বচ্ছলতা থাকলে এমনটা করা সম্ভব!

অনেক হাসি-গল্প-খাওয়াদাওয়ার শেষে ওরা ফিরে এসেছিল বাড়িতে, এ বিষয়ে ওরা কেউ কারো সাথে আলোচনা করেনি কিছু তারপরে। মিনুর একটু খটকা লেগেছিল অবশ্য, শৌভিক অল্পেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে, এ ব্যাপারে ওর অনেক প্রশংসা করবার কথা ছিল, ও একটি শব্দও করেনি।

হঠাৎ আজ সকাল ন’টার দিকে কোনও পূর্ব আভাস-আলোচনা ছাড়াই শৌভিকের নির্দেশে হাফ ট্রাক বালি-পাথর চলে এলো বাড়িতে। এমনিতে মিনু জানত একটা মেরামতির কাজ আছে, কিন্তু এরকম বলা-কওয়া ছাড়া শুরু হয়ে যাবে তা ভাবতে পারেনি। ছোটো বাড়ি, বালি-পাথর রাখবার একটা জায়গা আগে থেকে না করে, অগোছালোভাবে এরকম কাজ শুরু করাটা মিনুর একদম পছন্দ হয়নি। ও একটু বলতে গেছিল যে গ্যারেজঘরের বাজে জিনিস সরিয়ে ওখানেই সিমেন্ট-বালি  আপাতত গুছিয়ে রাখা হোক, পরে কাজ হবে।  দীর্ঘদিন ধরে গ্যারেজে যে অকেজো জিনিসগুলো জমে রয়েছে ওগুলোও তো সরিয়ে ফেলা দরকার!

শৌভিকের এই একটা মস্ত বদভ্যেস! ও কোনও জিনিস ফেলতে দেয় না। পুরোনো পত্র-পত্রিকা, পুরোনো পেন, পুরোনো যন্ত্রপাতি, দিয়ার খেলনাবাটি সব জমিয়ে রাখা থাকে। জমতে জমতে পাহাড় হয়ে যায়, কিন্তু সরানো হয় না। সারাদিন মিনু সব গোছাতে থাকে, পরিত্যক্ত জিনিসগুলোও গোছাতে হয়। গুছোতে গুছোতে ও ক্লান্ত বোধ করে, কিন্তু সমাধান হয় না কোনও। ওগুলো নিয়ে কথা বললেই তুমুল অশান্তি শুরু হয়। মিনুর মনে হয় এটা কোনও বিশেষ রকমের মনের অসুখ, যার হয় সেও বুঝতে পারে না। কোনও একটা পত্রিকায় বোধহয় এ বিষয়ে পড়েছিল, এখন মনে নেই। 

সেই জমিয়ে রাখা আবর্জনা পরিষ্কারের কথাই ও বলেছিল। আর যায় কোথায়! সেই কর্তাসুলভ মেজাজে ধমকে উঠলো শৌভিক, যেটা মিনু একদমই পছন্দ করে না। ওর বক্তব্য ও যা করছে ঠিক করছে, মিনু যেন নাক গলাতে না আসে! জিভটা সুলসুল করছিল মিনুর, সেও তড়িঘড়ি বলে দিল, বাড়ির মেয়েদের মতামত নিতে হয়, দেখলে না প্রতাপদার বাড়ি! কেকা, ওদের মেয়ে পুকাই ----ওদের মতামতই বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল বলে বাড়িটা অত অভিনব হয়েছে ওদের। আর যাবে কোথায়! অগ্নিতে যেন ঘৃতাহুতি হল। চিড়বিড়িয়ে উঠলো শৌভিক। একটু বেশি রকমেরই উত্তেজিত হল। 

 বিষণ্ণমনে ওই দৃশ্যটা ভাবতে ভাবতে এবার মিনুর একটু সন্দেহ হল সবটা রাগ মিনুর ওপরেই নয় শৌভিকের, অন্য ব্যাপার, একটা হিংসে! বন্ধুর ঐশ্বর্যে বুকটা জ্বলছে বেচারির। যদিও সে খুবই উদার মনের মানুষ, কিন্তু একটা রক্ত-মাংসের মানুষ তো, অসূয়া সেও এড়াতে পারেনি।

এবার একটু হালকা বোধ করে মিনু। যাক বাবা, তার দলে আর একজনও আছে। বলতে নেই, মানুষ হিসেবে শৌভিককে নিজের থেকে একটু ওপরেই রাখে সে, তার যখন অমন অনুভূতি হচ্ছে, তবে মিনুর দোষ নেই। অমন একটু হিংসেটিংসে হয় কখনও সংসারে থাকলে! সেগুলো মন থেকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করাই ভাল। জগতের কোনও কিছুই তো বদলানো যায় না! শুধু নিজেকে ঠিক রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয়।

স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে শৌভিক আর ওর মিস্তিরিদের জন্য চায়ের জল চাপায় মিনু, শৌভিক আজ দেরি করে খাবে। এতক্ষণে সকালের রুটি-তরকারি হজম হয়ে গেছে। মোয়ার কৌটোটা নামিয়ে গুনে গুনে থালায় সাজায়। শৌভিকের ওপরে একটুও রাগ নেই আর ওর এখন, বরঞ্চ মায়াই হচ্ছে! আর ওই হিজিবিজি জিনিসগুলোর মধ্যে থেকে অনেকদিন আগে ওর বানানো ছোটো দুটো কাপড়ের পুতুল পাওয়া গেছে, সেগুলো দিয়ার প্রথম খেলনা! সেই পাওয়াটা অন্যরকম একটা ভালো লাগার অনুভূতি জাগিয়ে তুলছে পুরনো স্মৃতি মনে করে করে। হারমোনিয়ামটা অনেকদিন ধরে বাক্সবন্দী, সেটাকেও রোদ খাওয়াচ্ছে মিস্তিরিদের দিয়ে। আবার গলা সাধবে সকাল-বিকেল। ও গান ভালোই গাইত, আবার চর্চা করতে হবে সেসব।

 যতটুকু আছে, তার মধ্যেই ভালো থাকার অভ্যেসটা আবার শুরু করতে হবে মিনুর!

Post a Comment

0 Comments