জ্বলদর্চি

অলস রাজকুমারী সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস কথক- দীপক দাস, গ্ৰাম- যুগীশোল,থানা- নয়াগ্ৰাম, জেলা- ঝাড়গ্ৰাম

অলস রাজকুমারী
 
সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস 

কথক- দীপক দাস, গ্ৰাম- যুগীশোল,থানা- নয়াগ্ৰাম, জেলা- ঝাড়গ্ৰাম 

বহুবছর আগে রূপগড় নামে একটি রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের রাজা ছিলেন মুকুন্দরাম। রাজা মুকুন্দরামের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না, তাঁর ছিল একটিমাত্র কন্যা। সেই কন্যার নাম হল রূপবতী। রূপগড় ছিল খুবই সুন্দর এবং শান্তিপূর্ণ একটি রাজ্য। রাজা মুকুন্দরামের ইচ্ছে ছিল তাঁর অবর্তমানে তাঁর কন্যা রূপমতী এই রাজ্য সামলাবে। কিন্তু রাজকুমারী রূপমতী ছিলেন খুবই অলস প্রকৃতির মেয়ে। কোনো কাজের প্রতি তাঁর কোনো আগ্ৰহ ছিল না। এই নিয়ে রাজামশাই সবসময় চিন্তিত থাকতেন।

এইভাবে দিন কাটতে থাকে। একদিন রাজকুমারী নিজের ঘরে মধ্যে সমস্ত দাসদাসীদের নিয়ে সাজসজ্জায় ব্যস্ত ছিলেন।

সেইসময় রাজকুমারীর খাস দাসী এসে রাজকুমারীকে বলল-“রাজকুমারী আপনার পা ধোয়ার জন্য গোলাপ জল এনেছি।”

তখন রাজকুমারী বললেন-“গোলাপ জল! কেন দাসী, আমি তো পা ধোয়ার জন্য দুধ ব্যবহার করি। তা তো তুমি ভালো করেই জানো। তাহলে আজ দুধ কেন?”

দাসী বলে-“তা আমি জানি রাজকুমারী। কিন্তু রাজামশাই বললেন, দুধ হল খাওয়ার জিনিস তা এভাবে নষ্ট করবে না।”
🍂

রাজকুমারী বললেন-“কী বলছ কী, পিতা এই কথা বলেছেন?”

সেই মূহুর্তে সেখানে রাজামশাই এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন -“হ্যাঁ রাজকুমারী, আমি একথা বলেছি। কারণ আমাদের রাজ্যে এমন অনেক শিশু আছে, যারা ঠিকমতো দুধ খেতে পায় না। আর তুমি সেই দুধ নষ্ট করছো।”

রাজকুমারী তখন বলে-“কিন্তু পিতা দুধ ছাড়া তো আমার পায়ের পাতা নরম এবং সুন্দর হবে না।”

তখন রাজামশাই বলেন-“রাজকুমারী সুন্দরতা মানুষের বাইরের নয় অন্তরের জিনিস। আর তাই সুন্দর হতে হলে অন্তর থেকে সুন্দর হও।”

এছাড়া রাজামশাই এও বললেন-“আর হ্যাঁ রাজকুমারী, দুপুরে খাওয়ার পর তুমি আমার সঙ্গে রাজসভায় যাবে। তোমাকে এখন থেকেই রাজকার্য শিখতে হবে। কারণ আমার অবর্তমানে তুমিই এ রাজ্য চালাবে।”

তখন রাজকুমারী বললেন-“না পিতা, আমি যেতে পারব না। কারণ দুপুরে খাওয়ার পর আমি একটু ঘুমাবো। দুপুরে ঘুম না হলে আমার আবার শরীর খারাপ লাগে।”

রাজামশাই বলেন-“কিন্তু মা, রাজসভায় না গেলে তুমি রাজকার্য শিখবে কী করে?”

রাজকুমারী বললেন-“সে পরে দেখা যাবে পিতা।”

এরপর রাজামশাই আর কিছু না বলে সেই স্থান ত্যাগ করলেন। 

এদিকে রাজামশাই রাজসভায় পৌঁছাতেই মন্ত্রী রাজামশাইকে জিজ্ঞাসা করলেন-“মহারাজা রাজকুমারী এলেন না।”

রাজামশাই বললেন-“না।”

তখন মন্ত্রী বলেন-“কিন্তু রাজকুমারী রাজসভায় না এলে রাজকার্য শিখবেন কী করে? আর হ্যাঁ মহারাজা আর একটি কথা, রাজকার্য শেখার জন্য যেসকল শিক্ষক রাজকুমারী জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল রাজকুমারী তাদের কাছ থেকে কোনো শিক্ষাই গ্ৰহণ করেননি। এখন তাহলে কী করা যায় মহারাজ?”

রাজামশাই বললেন-“আমিও তাই ভাবছি মন্ত্রী। যে এখন কী করা যায়? রাজকুমারী যদি রাজকার্য না শেখে তো আমার অবর্তমানে এ রাজ্য কে দেখবে? আর তুমি তো জানো রাজকুমারী খুবই অলস। এই অলসতাও যে কীভাবে দূর করব কে জানে?”

তখন মন্ত্রী বলেন-“মহারাজ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। এই বুদ্ধি দিয়ে আমরা রাজকুমারীর অলসতা কাটাতে পারি।”

এরপর মন্ত্রী রাজামশাইকে তাঁর পরিকল্পনাটি বললেন। সব শুনে রাজামশাই এই পরিকল্পনায় সায় দিলেন।  

হঠাৎ একদিন মন্ত্রী এসে রাজকুমারীকে বললেন-“রাজকুমারী, রাজকুমারী তাড়াতাড়ি চলুন। মহারাজ হঠাৎ করেই জ্ঞান হারিয়েছেন।”

রাজকুমারী বললেন-“কী বলছেন কী মন্ত্রীমশাই, পিতার আবার কী হল? চলুন চলুন তাড়াতাড়ি চলুন।”

এরপর রাজকুমারী রাজামশাইয়ের ঘরে গেলেন।  সেখানে গিয়ে দেখেন রাজামশাই বিছানায় শুয়ে আছেন। আর তাঁর পাশে রাজবৈদ্য রাজামশাইকে
পরীক্ষা করছেন। 

রাজকুমারী এসে রাজবৈদ্যকে জিজ্ঞাসা করলেন-“রাজবৈদ্য পিতার কী হয়েছে?”

তখন বৈদ্যমশাই বলেন-“রাজকুমারী, রাজামশাইয়ের অনেক বড়ো একটা অসুখ হয়েছে। আর এই অসুখ ঠিক করার ঔষধ আছে ভিনরাজ্যে।”

রাজকুমারী তখন মন্ত্রীকে বললেন-“মন্ত্রীমশাই আপনি এর একটা ব্যবস্থা করূন।”

মন্ত্রী বলেন-“রাজকুমারী আমি নিজে ভিনরাজ্যে গিয়ে মহারাজের ঔষধ নিয়ে আসব। কিন্তু সেই কয়েকদিন আপনাকেই তাহলে রাজ্য সামলাতে হবে।”

এই শুনে রাজকুমারী একটু ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি মন্ত্রীকে বললেন-“কী বলছেন কী মন্ত্রীমশাই? আমি! আচ্ছা ঠিক আছে যখন অন্য কোনো উপায়  তখন আমিই নাহয় রাজ্য সামলাবো।”

এরপর মন্ত্রীমশাই ভিনরাজ্যে চলে গেলেন। আর এদিকে রাজকুমারীর রাজকার্য সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান না থাকার ফলে রূপগড় রাজ্যে দুর্দশা নেমে এল। রাজকোষ শূন্য হয়ে গেল। ঠিকমতো বেতন দিতে না পারায় রাজপ্রাসাদের সমস্ত দাসদাসী, রাজকর্মচারী সকলে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে চলে গেল। 

একমাত্র রাজকুমারীর খাস দাসী রয়ে গেল রাজপ্রাসাদে। এছাড়া রাজকুমারী রাজকন্যা হওয়া সত্ত্বেও নিজের হাতে রান্নাবান্না করতে হল। কিন্তু রাজকুমারী এত কষ্ট আর সহ্য করতে পারছিলেন না। 

একদিন রাজকুমারী বাগানে বসেছিলেন। সেখানে তিনি দেখলেন পুরো বাগানটাই আগাছায় ভরে গেছে। রাজপ্রাসাদে কোনো লোকজন না থাকার ফলে সমস্ত কিছু ধূলিমলিন হয়ে গেছে। 

এছাড়া রাজকুমারী তাঁর প্রিয় বাগানটির এহেন পরিস্থিতি দেখে মনে মনে ভাবেন-“আমার প্রিয় বাগানটাও আজ আগাছায় ভরে গেছে। এটাকে পরিষ্কার করা দরকার। কিন্তু এটা পরিষ্কার করবে কে? কেউ তো নেই। এবার যে কী হবে?”

এইসব ভাবতে ভাবতে রাজকুমারীর চোখে জল চলে এল। তিনি অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। 

সেই সময় সেখানে এক পরী এসে উপস্থিত হল। পরী রাজকুমারীকে বলল-“কী হয়েছে রাজকুমারী, তুমি কাঁদছ কেন?”

পরীকে দেখে রাজকুমারী বললেন-“তুমি কে? আর এখানে কী করছ?”

পরী বলে-“আমি ভিনদেশের এক পরী। এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তোমার কান্না শুনে এখানে এলাম। কী হয়েছে তোমার?”

তখন রাজকুমারী  পরীকে সব কথা বলেন। 

সব শুনে পরী বলে-“ও এই ব্যাপার। এই সমস্যা সমাধান করতে পারবে একজন পরিশ্রমী মেয়ে।”
এই বলে পরী অদৃশ্য হয়ে যায়।

তখন রাজকুমারী মনে মনে ভাবতে লাগলেন-“পরিশ্রমী মেয়ে, কিন্তু রাজপ্রাসাদে তো কোনো দাসদাসী নেই। তাহলে সে পরিশ্রমী মেয়েটাই বা কে?”

এইসব ভাবতে ভাবতে রাজকুমারীর বললেন-“তাহলে কী পরী আমার কথাই বলে গেল। আমাকেই কী তাহলে পরিশ্রমী হতে হবে? আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে আজ থেকে আমিই এ রাজ্যের হাল ধরব।”

এই বলে রাজকুমারী একা হাতে পুরো বাগানটাই পরিষ্কার করলেন। এমনকি নিজের হাতে রান্নাও করলেন। 

রান্না করতে দেখে দাসী বলল-“আমি সবজিগুলো কেটে দিল রাজকুমারী।”

রাজকুমারী বললেন-“না দাসী, আজ আমি নিজের হাতে রান্না করে সবাইকে খাওয়াব। আর একটা কথা দাসী। তুই গিয়ে আমার সমস্ত শিক্ষককে আজ থেকে আসতে বলবি। আজ থেকে আমার সমস্ত শিক্ষা শুরু হবে।”

দাসী বলে-“যথা আজ্ঞা রাজকুমারী।”

এরপর রাজকুমারী নিজের হাতে রান্না করে সবাইকে খাওয়ালেন। এমনকি প্রজাদের কাছ থেকে ধার্য করও আদায় করলেন।

রাজকুমারী এই রূপ দেখে রাজবৈদ্য বললেন-“ এ যেন আমাদের সাক্ষাৎ রাণীমা।”

এইসব দেখে রাজামশাইও খুব খুশি হলেন। আর এদিকে মন্ত্রীও ভিনদেশ থেকে ফিরে এলেন। 

মন্ত্রীকে দেখে রাজকুমারী বললেন-“মন্ত্রীমশাই,  আপনি পিতার ঔষধ এনেছেন?”

তখন রাজামশাই বললেন-“মা রূপমতী আমার কিছু হয়নি। আমি একদম সুস্থ আছি। তোমাকে পরিশ্রমী করে তোলার জন্য আমি, মন্ত্রী, রাজবৈদ্য আর দাসী মিলে এই পরিকল্পনা করেছি।আমাদের তুমি ক্ষমা করো মা।”

দাসী বলে-“আমাকে ক্ষমা করে দিন রাজকুমারী। সব জানা সত্ত্বেও আমি আপনাকে কিছু বলিনি।”

সব শুনে রাজকুমারী বললেন-“না না আপনারা কেন, বরং আমাকে আপনারা ক্ষমা করে দিন। আপনারা ঠিকই করেছেন। আমাকে পরিশ্রমী হতে শিখিয়েছেন। এছাড়া এও বুঝিয়েছেন যে সুন্দরতা আসলে বাইরের জিনিস নয়, তা হল অন্তরের জিনিস। এই কদিনে আমি তার বুঝেছি। আর এও বুঝেছি অলসতা কীভাবে মানুষকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দেয়। ধন্যবাদ আপনাদের সবাইকে আমাকে এগুলো ঠিক সময়ে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য।”

এরপর থেকে রূপগড় রাজ্য আবার হাসি খুশিতে ভরে উঠল। আর রূপগড়ের রাজকুমারী রূপমতীও পরিশ্রমী হয়ে উঠলেন।

Post a Comment

0 Comments