জ্বলদর্চি

বলরাম কবিকঙ্কণ (প্রাচীন কবি, মেদিনীপুর)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৬৮
বলরাম কবিকঙ্কণ (প্রাচীন কবি, মেদিনীপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চণ্ডীমঙ্গল রচনার শুরুতে বন্দনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন বলরাম কবিকঙ্কণের নাম। 
"বালীডাঙ্গার বন্দ্যোপাধ্যয় বাড়ীর চরণ।
প্রণাম করিয়া যত দেবদেবীগণ।।
জয়দেব বিদ্যাপতি বন্দোঁ কালীদাস।
আদি কবি বাল্মীকি বন্দিলু মুনি ব্যাস।
মাণিক দত্তেরে আমি করিয়ে বিনয়।
যাহা হৈতে হৈল গীত পথ পরিচয়।।
বন্দিলু গীতের গুরু শ্রীকবিকঙ্কণ।
প্রণাম করিয়া মাতা পিতার চরণ।।"

মুকুন্দরাম তাঁর কাব্যের বিষয় নির্বাচন করতে গিয়ে মেদিনীপুরের বাসিন্দা এই কবির কাছে ঋণী ছিলেন। কারও কারও মতে বলরাম কবিকঙ্কণ হলেন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর শিক্ষাগুরু। বলরামের গ্রন্থ থেকেই তিনি তাঁর কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। সেইজন্যই হয়তো কবি মুকুন্দরাম তাঁকে "গীতের গুরু” আখ্যায়িত করে বন্দনা করেছেন। 

যোগেশচন্দ্র বসু ব্যাখ্যা দিয়েছেন, "কিন্তু 'গীতের গুরু' উল্লেখ থাকায় মনে হয় যে, তাঁহারই গান মুকুন্দরামের আদর্শ হইয়াছিল। বলরামের চন্ডী তৎকালে মেদিনীপুর অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। মুকুন্দরাম সেই কাব্যখানির ছায়া অবলম্বনে তাঁহার চন্ডীকাব্য রচনা করেন। মুকুন্দরামের পূর্ব্বে যে কয়জন কবি চন্ডীর উপাখ্যান লইয়া কাব্য রচনায় ব্রতী হইয়াছিলন, তন্মধ্যে দ্বিজ জনার্দ্দন ও বলরাম কবিকঙ্কণের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।"

দ্বিজ জনার্দ্দন ও বলরাম কবিকঙ্কণের চন্ডীমঙ্গল একটি সামান্য ব্রতকথা মাত্র ছিল। বলরাম কবিকঙ্কণ রচিত সম্পূর্ণ গ্রন্থ এখন আর দেখতে পাওয়া যায় না। কোনও এক সময় এই কবির চণ্ডীমঙ্গল কাব্য ওড়িয়া ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। সেই ওড়িয়া ভাষার কাব্যটি সুবর্ণরৈখিক মেদিনীপুর অঞ্চলের কোনও কোনও বাড়িতে দুর্গোৎসবের সময় চণ্ডীপাঠের মতো চণ্ডীমঙ্গলের গায়ক দ্বারা গাওয়া হত।

বলরামের কাব্যের উপাখ্যান খুবই ছোট। এখানে কালকেতু ব্যাধের এবং শ্রীমন্ত সওদাগরের দুটি আলাদা কাহিনি নেই। দুটিই একসাথে সম্পৃক্ত। শ্রীমন্তের উপাখ্যানে মুকুন্দরাম কবি বলরামের তুলনায় অনেক বেশি কাহিনি লিখেছেন। এমনকি ধনপতির বিদেশ যাওয়ার কারণ সম্পর্কেও বলরাম আলাদা কাহিনি লিখেছেন। বলরামের চন্ডীমঙ্গলে ধনপতির কমলে কামিনী দর্শনের কথাও লেখা নেই। 

যোগেশচন্দ্র বসু লিখেছেন, "বলরামের চন্ডীর উক্ত উপাখ্যানটির সহিত মুকুন্দরামের কাব্যের উপাখ্যানগুলি মিলাইয়া দেখিলে আমরা স্পষ্ট দেখিতে পাই যে, মুকুন্দরাম বলরামের চন্ডী হইতে তাঁহার কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করিয়াছিলেন। তবে ঐ সকল উপাখ্যানের মধ্যে যে সকল ঘটনা তাঁহার নিকট নিতান্ত অস্বাভাবিক বলিয়া বোধ হইয়াছিল, তাহা তিনি গ্রহণ করেন নাই। বলরামের তুলিতে চন্ডীকাব্যের যে সকল ছায়াপাত হইয়াছিল, মুকুন্দর বর্ণবিন্যাস ক্রমে তাহারা সজীব সুন্দর চিত্র হইয়াছে। কাব্যমোদিগণ সে ছায়াপাত দেখিয়া পরিতৃপ্ত হইতে না পারেন, কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাস লেখকগণের নিকট উহার মূল্য অনেক।"

🍂

Post a Comment

0 Comments