জ্বলদর্চি

নীল শিশু /কমলিকা ভট্টাচার্য




নীল শিশু

কমলিকা ভট্টাচার্য

ভগবান হাঁটছিলেন স্বর্গের উদ্যানে। হঠাৎ স্বর্গদ্বারের প্রহরী এসে বলল,
 প্রভু, এক শিশু আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। শিশুটি একটু... অদ্ভুত।

ভগবান কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
 অদ্ভুত? কেমন অদ্ভুত?
প্রহরী বলল,
গায়ের রং নীল, প্রভু।
ভগবান চমকে উঠে বললেন,
নীল রঙের শিশু? এখনই তাকে নিয়ে এসো।

শিশুটি এসে দাঁড়াতেই ভগবান জিজ্ঞেস করলেন,
তুমি কে? কেন দেখা করতে চাও?

শিশুটি কিছু বলল না। শুধু চোখ তুলে ইঙ্গিতে বলল
"তুমি তো অন্তর্যামী, আমার যন্ত্রণা দেখতে পাচ্ছ না?"

ভগবান শিশুটির মাথায় হাত রাখলেন। চোখের সামনে একের পর এক দৃশ্য ভেসে উঠল, এক জীবন্ত ছবি হয়ে।
---

অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান গোবিন্দ। সঙ্গে আনে তার আড়াই বছরের ছেলে গুন্টুর-কে। শিশুটি কালো, চোখ দুটো একটু ট্যারা, কথা বলতেও পারে না। শহরের মাপমতো "আদরযোগ্য" নয়—তার উপর গরীব।

সেই অ্যাপার্টমেন্টেই থাকেন চন্দ্রিমা। তিনি গুন্টুরকে খুব ভালোবাসেন। সুযোগ পেলেই ওর হাতে খাবার দেন, খেলনা দেন, জামাকাপড় এনে দেন। চন্দ্রিমা একসময় এমন বিশেষ শিশুদের নিয়ে কাজ করতেন, তাই ওর সঙ্গে কথা বলে ওকে কথা শেখানোর চেষ্টাও করেন।

গোবিন্দ সারাদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন। সবসময় সন্তানের পাশে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। গুন্টুর সারাদিন ফ্ল্যাটের এদিক-ওদিক ঘোরে।

কিন্তু কিছুদিন পরই ফ্ল্যাটের কিছু বাসিন্দা অভিযোগ করতে শুরু করল।
কাজের জায়গায় বাচ্চা আনা ঠিক নয়। গোবিন্দ বাচ্চার পেছনে সময় দিচ্ছে, ঠিকমতো ডিউটি করতে পারছে না।
🍂

একদিন গোবিন্দকে ডেকে বলা হল,
 যদি কাজ রাখতে চাও, বাচ্চাকে নিয়ে আসা যাবে না।

গোবিন্দ হাতজোড় করে বলল,
 বাড়িতে কেউ নেই, ছেলেটাকে দেখবে কে?

পেছনে বাবার প্যান্ট ধরে দাঁড়িয়ে ছিল গুন্টুর। সে কিছু বুঝছিল না, শুধু দেখছিল, তার জন্যেই সবাই বাবাকে বকছে। ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল সে।

চন্দ্রিমা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন সবাইকে। বলেছিলেন,
 “এও তো একটা শিশু! ওকে তাড়িয়ে দিয়ে কী লাভ?”

কিন্তু যে মা তার নিজের সন্তানকে ফেলে চলে গিয়েছে, মা যেখানে করুণাহীন, সেখানে বাইরের মানুষের সহানুভূতি আশা করাটা বোধহয় নেহাতই বাতুলতা।

চন্দ্রিমা একা কিছু করতে পারেননি। অবশেষে গোবিন্দকে ছেলেকে নিয়ে চলে যেতে হয়।

অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়ার সময় গুন্টুর একবার পেছন ফিরে চন্দ্রিমার দিকে তাকিয়েছিল।
তার চোখে ছিল অজস্র প্রশ্ন।
চন্দ্রিমা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিয়েছিলেন।
---

কয়েকটি ছোটখাটো কাজের আশায় শহরে কিছুদিন ছিল গোবিন্দ। কিন্তু সব জায়গাতেই গরীব মানুষের বাচ্চার জন্য ক্রেশ নেই।
চন্দ্রিমার সঙ্গে ফোনে মাঝেমধ্যে যোগাযোগ হতো। যতটা পারতেন, সাহায্য করতেন।

একদিন গোবিন্দ বলল,
“ম্যাডাম, গ্রামে চলে যাচ্ছি। পিসিমা আছেন, তিনিই গুন্টুরকে দেখবেন। এখানে আর কিছু হবে না।”

চন্দ্রিমা মনে মনে খুশি হয়েছিলেন।
ভাবলেন, শহরের নিষ্ঠুর অ্যাপার্টমেন্টের লাথি ঝাঁটা গালি খাওয়ার চেয়ে, গ্রামের একটু মানবিক পরিবেশেই ভালো কাটবে  গুন্টুরের শৈশব।
---

প্রায় দু’মাস পর একদিন গোবিন্দের ফোন।
চন্দ্রিমা উৎসাহ নিয়ে বললেন,“অনেকদিন পরে ফোন করলে গোবিন্দ! গুন্টুর কেমন আছে?”

ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ।
 “ম্যাডাম... গুন্টুর আর নেই। রাতে গরম লাগছিল, দরজাটা একটু খুলে রেখেছিলাম। একটা সাপ এসে কামড়ে দিল... হসপিটালে পৌঁছানোর আগেই সব শেষ। আমি-ই আমার ছেলেকে মেরে ফেললাম ম্যাডাম... আমি-ই ওকে মেরে ফেললাম…”

চন্দ্রিমার বুকের ভিতর ঢেউ খেলল, কিন্তু নিজেকে ধরে রাখলেন। বললেন,
 “না গোবিন্দ, তুমি ওকে মারোনি। এই সমাজ মেরেছে। যে সমাজ ওকে বোঝেনি, সেই মা যে ছেলেকে ফেলে গিয়েছিল, সেই অবহেলা, সেই অবজ্ঞা, সেই বঞ্চনা মেরেছে গুন্টুরকে। ঈশ্বর নিজের কাছে ডেকে নিয়েছেন ওকে।”
--------
ভগবান শিশুটির মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিলেন। গায়ের নীল বিষ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।

শিশুটি হালকা হেসে বলল,
“যেখানে ভালোবাসা নেই, সেখানে আমাকে আর পাঠিও না।”

ভগবানের মুখ গম্ভীর হল, অনুশোচনা ভরা স্বরে বললেন “আমারও যে মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়, খোকা…”

Post a Comment

0 Comments