কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী-র সাক্ষাৎকার নিয়েছেন
সন্দীপ দত্ত
সন্দীপ দত্ত: নমস্কার স্বপ্নময়দা,'জ্বলদর্চি'পত্রিকার তরফ থেকে আপনাকে প্রথমেই জানাই আন্তরিকভাবে স্বাগত। আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের আপনি আজ একজন অন্যতম কান্ডারি। অসামান্য এই অবদানের জন্য অজস্র অভিনন্দন,শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। আগে বলুন,কেমন আছেন এখন? শুনলাম শরীর অসুস্থ!
স্বপ্নময় চক্রবর্তী: আপনাকেও অন্তর থেকে শুভেচ্ছা জানাই। শরীরটা সত্যিই ভাল নেই। চোখের সমস্যা হচ্ছে খুব। আগে একটা চোখ সমস্যায় ফেলেছিল। এখন আবার আর একটা চোখ। বাড়ি থেকে বেরোতে কষ্ট হয়। ব্যাঙ্কে যেতে কষ্ট হয়। গতকাল,বহুদিন পর ছেলের সঙ্গে একটু বেরিয়েছিলাম। শরীরের এই আক্রমন মনেও তো প্রভাব ফেলে। তাই মনটাও ভাল নেই। লিখতে পড়তে অসুবিধে হচ্ছে খুব। লেখা কমে গেছে।
সন্দীপ: আপনার ছেলেবেলা নিয়ে অনেক পাঠকই কৌতূহলী। কিছু বলুন।
স্বপ্নময়: ছেলেবেলার অনেক ঘটনা। ঠাকুরদার সাথে রোজ গোয়ালাঘরে যেতাম দুধ আনতে। ঠাকুমা আমাকে গঙ্গা দেখাতে নিয়ে যেতেন। স্কুলে বন্ধুরা যখন টিফিনে খাওয়ার জন্য পকেটে করে ডাঁসা পেয়ারা নিয়ে আসত আর বলত,ওগুলো সব দেশের বাড়ির পেয়ারা,আমার মনে তখন 'দেশ'শব্দটার উপর কৌতূহল হত খুব। দেশ কী জিনিস,আমি তো দেখিনি। দেশভাগের পরে আমার জন্ম। মনে পড়ছে,আমরা যে ঘরটাতে থাকতাম,প্রায়ই সেখানে চলে আসতেন আত্মীয়স্বজনেরা। গাদাগাদি করে থাকতে হত। আমাদের একটা কয়লার উনোন ছিল সেখানে রান্না করতেন মা। মায়ের কষ্ট দেখে কয়লার একটা টুকরো নিয়ে মেঝেতে আমি কী সব যেন লিখতাম। মা সেগুলো মুছে দিতেনস মনে পড়ছে,আমি আমার ঠাকুরদার কাছেই স্কুলজীবনে অঙ্ক শিখেছি। ঠাকুরদা আমাকে বাংলা,ইংরেজি,ভূগোলও পড়াতেন। ছেলেবেলার স্মৃতি তো প্রচুর থেকে যায় বুকে!
সন্দীপ: সাহিত্যজগতে কীভাবে এলেন? আপনার কেন মনে হল,লিখতে হবে?
স্বপ্নময়: কীভাবে এলাম,সেটা আবার এক স্মৃতি। ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে লেখতাম কিছু ছোটবেলায়। ঠাকুরদা সে লেখার প্রশংসা করতেন। বলা ভাল,উৎসাহটা ওখান থেকেই পাই। দু'একটা ছোটখাটো কবিতা এভাবেই লিখি। পরে বুঝেছি,ওগুলো কবিতা হয়নি মোটেই। কবিতা আলাদা জিনিস। সে যাই হোক,শিক্ষার পরিমন্ডল একটা ছিলই বাড়িতে। সেখান থেকেই হয়তো এসেছে কিছুটা। আমার পরবর্তী প্রজন্মও এল সাহিত্যে। আমার ছেলেও সাহিত্যিক। কার কথা বলছি বুঝতে পারছেন তো? অম্লানকুসুম চক্রবর্তী। প্রথমদিকে পরিচয় দিইনি কাউকে। নিজের পরিচয় নিজে তৈরি করাই ভাল। ইদানিং বলতে হচ্ছে।
সন্দীপ: আপনার লেখা প্রথম গল্পটি কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়? গল্পটির নাম মনে আছে?
স্বপ্নময়: বাগবাজার থেকে একটা কাগজ বের হত। নামটা.......হ্যাঁ,মনে পড়েছে। 'অমৃত'। তখন মণীন্দ্র রায় কাগজটা চালাতেন। শ্যামল গাঙ্গুলি তখনও আসেননি 'অমৃত'য়ে। ওই 'অমৃত'য়েই আমার 'বাঁধানো দাঁত'গল্পটি ছাপা হয়। ওটাই প্রথম গল্প। পরে আরও অনেকগুলো পত্রিকায় লেখা বের হল। 'চতুরঙ্গ',এক্ষণ','অনুষ্টুপ' যতদূর মনে পড়ছে।
সন্দীপ: অনেক পেশার সাথেই আপনি যুক্ত ছিলেন। অনেক অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছেন। 'আকাশবাণী'র অভিজ্ঞতা আপনার লেখালেখিতে কতখানি প্রভাব ফেলেছে?
স্বপ্নময়: 'আকাশবাণী'র অভিজ্ঞতা ততটা আমায় লিখিয়ে নেয়নি,যতটা ভূমি সংস্কার দপ্তরে চাকরিটা পাওয়ার পর হয়েছিল। সে বিচিত্র অভিজ্ঞতা! আমার লেখালেখিতে নতুন মোড় এল যেন। ধনী গরিবের মানে বুঝতে পারলাম। চোখের সামনে থেকে অনেক ধারণার পর্দা সরে গেল। কলকারখানার মালিকপক্ষ মানেই যে অনেক বড়লোক,বদলে গেল এ ধারণা। মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার ওই চাকরিটা আমার কলমটাকে আরও তীক্ষ্ম করল। গ্রাম চেনার,গ্রামের মানুষকে বুঝতে পারার একটা আলাদা অনুভূতি তৈরি হল।
সন্দীপ: উপন্যাসে কীভাবে আসা?
স্বপ্নময়: মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে গেলে মানুষের মনটাকে ধরতে তো ইচ্ছে হয়ই। কীভাবে আসা,এ প্রশ্নের উত্তর কী দিই আপনাকে? লিখতে লিখতেই লেখা হয়ে গেছে। তবে এটুকু বলব,শুরুতে আমায় ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার সুযোগ দেয়নি কেউ। সুনীলদা,শীর্ষেন্দুদা,সঞ্জীবদা যে সুযোগগুলো পেয়েছিলেন। ঋতুপর্ণ ঘোষ আমায় প্রথম সুযোগ দিল ধারাবাহিক লেখার। তারপর শৌনক লাহিড়িও দিল।
সন্দীপ: 'হলদে গোলাপ'সৃষ্টি করতে ইচ্ছে হল কেন?
স্বপ্নময়: জেন্ডার তত্ত্ব নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে থেকেই এই লেখা। যেখানে বিজ্ঞান জড়িয়ে আছে অনেকটাই। উপন্যাসটা পড়লেই পাঠক বুঝতে পারবেন,ফর্মটা এখানে আলাদা।
সন্দীপ: দুলাল থেকে দুলালী হয়ে ওঠার পেছনে যে কাহিনিটি রয়েছে এ উপন্যাসে,সম্পূর্ণটাই তো গবেষণাধর্মী?
স্বপ্নময়: ওই যে বললাম,বিজ্ঞানকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছি। গবেষণা তো আছেই।
সন্দীপ: 'জলের উপর পানি'আপনার অসাধারণ সব উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম,যা আপনাকে 'সাহিত্য আকাদেমি'র মতো পুরস্কার এনে দেয়। স্বীকৃতি কি সৃষ্টির পথটাকে গতিশীল করে তোলে?
স্বপ্নময়: অবশ্যই। তবে স্বীকৃতির পথ চেয়ে লেখক তো লেখেন না। লেখক লেখেন মানুষের মননকে জানবার জন্য। সমাজটাকে তিনি কতটা চিনতে পারলেন,আদৌও পারলেন কিনা,ভেতরের এই তাড়নাটাই তাঁকে লিখিয়ে নেয়। স্বীকৃতির পথ তো অনেক পরে। ওটা কাল বিচার করে। তবে হ্যাঁ,স্বীকৃতি লেখককে উজ্জীবিত করে এ কথা ঠিক। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে উল্টো হল। 'জলের উপর পানি'র পর শারীরিক কারণে লেখার গতি শ্লথ হল। আমি তো ল্যাপটপ ব্যবহার করি না। কাগজে কলমেই লিখি। অসুবিধে হচ্ছে খুব। চোখই আমায় কাবু করে দিল।
সন্দীপ: রম্যরচনাতেও আপনার যথেষ্ট দখল রয়েছে। হিমানীশ গোস্বামীর পর আজকের বাংলা রম্যসাহিত্য কতখানি বলিষ্ঠ?
স্বপ্নময়: রম্যসাহিত্য আমি কিছু লিখেছি ঠিকই,কিন্তু ওগুলো এখনও ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। বই হয়নি। কে করবে জানি না। হিমানীশ গোস্বামীর পর আজকের ভগীরথ মিশ্রর নাম করা যায়। ভগীরথ ছাড়াও রমানাথদার প্রসঙ্গ আসবে। রমানাথ রায়। খুব ভাল কলম।
সন্দীপ: অবসর জীবন আপনার কেমন করে কাটে? সত্যিই কি লেখকদের অবসর বলে থাকে কিছু?
স্বপ্নময়: আমি আমার বেশ কয়েকটি ভাল উপন্যাস 'হলদে গোলাপ','জলের উপর পানি'র মতো এগুলো সব অবসর জীবনেই লিখেছি। লেখকদের অবসর বলে সেভাবে কিছু হয় না। কলম যখন ধরেন না,তখন তিনি চিন্তা করেন।
সন্দীপ: অনুবাদ সাহিত্য একজন যেকোনও ভাষার সাহিত্যিককে কোনওভাবে কি প্রভাবিত করে?
স্বপ্নময়: হতে পারে,তবে এ ব্যাপারে আমি বিশদে কিছু বলতে পারব না। অনুবাদ সাহিত্য পড়ার সুযোগ আমার তেমন ঘটেনি। কিছু প্রভাব তো নিশ্চয়ই থাকে।
সন্দীপ: 'সাদা কাক'আজকের দিনে কতটা প্রাসঙ্গিক?
স্বপ্নময়: এর উত্তর তো পাঠকই ভাল দিতে পারবে। 'সাদা কাক'য়ের বিষয়টাই ছিল বাস্তবে খুব কাছ থেকে যাদের দেখেছি,তাদের নিয়ে বলা। চরিত্রগুলো প্রায় সবই আমার দেখা। এটুকুই বলতে পারি।
সন্দীপ: ৩২ বছরের 'জ্বলদর্চি'পত্রিকা আপনার কিছু সুপরামর্শ চায়। লিটল ম্যাগাজিনের এই অক্লান্ত,নির্ভীক পথ চলা দেখে আপনার কী মনে হয়?
স্বপ্নময়: সুপরামর্শ আমি আর কী দিই! 'জ্বলদর্চি'নিজের মতো করে এগোচ্ছে। কাগজটির মানও যথেষ্ট ভাল। অনেক ভাল ভাল লেখাই ছাপা হচ্ছে ওখানে। 'জ্বলদর্চি'এখন শুধু তো আর পশ্চিম বা পূর্ব মেদিনীপুরের নয়। মেদিনীপুর জেলা থেকে এখন যে ক'টা আদর্শ ম্যাগাজিন বের হয়,'জ্বলদর্চি'তার মধ্যে অন্যতম।
সন্দীপ: স্বপ্নময়দা,এতক্ষণ ধরে আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।আপনি ভাল থাকবেন সবসময়। আরও লিখতে হবে আপনাকে। আমরা আরও ঋদ্ধ হতে চাই আপনার সৃষ্টি পড়ে।
স্বপ্নময়: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। আপনিও ভাল থাকুন।
2 Comments
খুব ভালো লাগলো।এমন সুন্দর একটা স্বাক্ষাত কার পড়ে মুগ্ধ হলাম।
ReplyDeleteজানার ইচ্ছেটা আরও জাগিয়ে দিলে সন্দীপ।
ReplyDelete