জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলের লোকগল্প: চালাক ছাগল/সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস/ কথক- শম্ভু দাস, গ্ৰাম- যুগীশোল, থানা- নয়াগ্ৰাম, জেলা- ঝাড়গ্ৰাম

জঙ্গলমহলের লোকগল্প 

চালাক ছাগল

সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস 

কথক- শম্ভু দাস, গ্ৰাম- যুগীশোল, থানা- নয়াগ্ৰাম, জেলা- ঝাড়গ্ৰাম 

নবাবপুর নামে একটি গ্ৰামে এক চাষির ঘরে মিনু নামে এক ছাগল ছিল। মিনুর তিনটি বাচ্চা ছিল। বাচ্চাদের নিয়ে মিনু খুবই চিন্তায় থাকত। কেননা গ্ৰামের সীমানাতে একটি ঘন জঙ্গল ছিল। ওর ভয় হত কখন না জানি বাচ্চারা খেলতে খেলতে ভুল করে জঙ্গলে চলে যাবে‌। আর কোনো বন্যপশুর শিকার হয়ে যাবে। এই ব্যাপারে চিন্তিত মিনু সবসময় বাচ্চাদের আগলে রাখত। যাতে বাচ্চারা ভুল করেও ওই জঙ্গলের দিকে না যায়। 

কিন্তু একদিন মিনুর তিনটি বাচ্চার মধ্যে একটি বাচ্চা তাদের জন্য ঘাস নিয়ে আসা লোকটির সঙ্গে তাদের মালিকের অর্থাৎ চাষির কথাবার্তা শুনে নেয়। 

লোকটি চাষিকে বলছিল-“জান ভাই কানাই, জঙ্গলের চারিদিকে কত কচি কচি ঘাস। যেন মনে হয় সব ঘাস কেটে নিয়ে আসি। যা ঘাস হয়েছে না সারাবছর কাটলেও মনে হয় শেষ হবে না।”

চাষি বলে-“কী বলছ কী ভাই, এত কচি ঘাস!

লোকটি বলে-“হ্যাঁ ভাই, তাহলে আর বলছি কী।”

তাদের এইসব কথা শুনে বাচ্চা ছাগলের সেই কচি ঘাস দেখার ইচ্ছা হয়। তখন সে সবার থেকে লুকিয়ে জঙ্গলের দিকে চলে যায়।

আর এদিকে মা মিনু এসে দেখে তিনটি বাচ্চার মধ্যে একটি বাচ্চা নেই। এরপর সে সব জায়গায় খুঁজে দেখে, কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না। তখন মিনু বুঝতে পারে যে তার বাচ্চা ওই জঙ্গলের দিকে গেছে। তাই সে সাত তাড়াতাড়ি জঙ্গলের দিকে যায়।

এদিকে বাচ্চা ছাগল খেলতে খেলতে সবেমাত্র জঙ্গলের একটু ভিতরে গেছে, তখনই তাকে কয়েকটি শেয়াল ঘিরে ফেলে। এতগুলো শেয়ালকে দেখে বাচ্চা ছাগল খুব ভয় পেয়ে যায়। আর ভয় পেয়ে সে জোরে জোরে তার মাকে ডাকতে থাকে। 

শেয়ালের দল বাচ্চা ছাগলকে দেখে খুবই খুশি হয়। তাদের মধ্যে একজন শেয়াল বলে-“আরে ভাই সব আজ আমাদের ভাগ্য খুব ভালো। আজ যে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম কে জানে? সকাল সকাল ছাগলের মাংস খাব। আঃ কী মজা।”

তখন আর একজন শেয়াল বলে -“হ্যাঁ ভাই, ঠিকই বলেছিস। বাচ্চা ছাগল, তার নরম নরম মাংস। উফ্ ভেবেই আমার জিভে জল আসছে।”

ঠিক সেইসময় সেখানে এসে উপস্থিত হয় ছাগলের মা অর্থাৎ মিনু।
🍂

মিনুকে দেখে শেয়ালের দল বলে-“আরে আরে এ কী দেখছি বাচ্চার সঙ্গে সঙ্গে মাও যে এসেছে। ভাই সব আজকে আমাদের মহাভোজ হবে। আমরা জমিয়ে ছাগলের মাংস খাব।” এইবলে তারা হাসতে থাকে।

এইসব শুনে মিনু ভয় না পেয়ে সাহসের সঙ্গে শেয়ালদের বলে-“থাক্ থাক্ এত হাসিস না। তা নাহলে সিংহ মহারাজ এসে তোদের মেরে ফেলবে।”

এই শুনে একজন শেয়াল বলে-“সিংহ মহারাজ! কেন কেন সিংহ মহারাজ আমাদের মারবে কেন?”

তখন মিনু বলে-“তোদের কী মনে হয় আমি আমার বাচ্চাকে এখানে একা রেখে চলে গিয়েছিলাম। না না তা নয় আসলে সিংহ মহারাজ হুকুম দিয়েছিলেন, যে আমরা যাতে এখান থেকে না যাই। যতক্ষণ না সিংহ মহারাজ আসেন আমাদের এখানে থাকতে হবে। তাই আমরা যাইনি। আর আমি আমার বাচ্চাকে এখানে রেখে ওই সামনে গিয়েছিলাম কিছু ঘাস আনতে। কারণ আমার বাচ্চার খুব খিদে পেয়েছিল। আর হ্যাঁ সিংহ মহারাজ আসার আগে তোরা যদি আমাদের খাস তাহলে কিন্তু মহারাজ তোদের ছাড়বে না।”

তখন শেয়ালের দল বলে-“হা হা হা, আরে সিংহ মহারাজ জানবেন কী করে যে আমরাই তোদের খেয়েছি?”

মিনু তখন বলে-“তোরা কী সিংহ মহারাজকে বোকা ভাবিস? উনি হলেন জঙ্গলের রাজা। ওই যে সামনে একটা হাতি দাঁড়িয়ে আছে, তোরা দেখতে পাচ্ছিস। উনি ওই হাতিকে আমাদের উপর নজর রাখতে বলেছেন। এরপরেও যদি তোরা আমাদের খেতে চাস তো খেতে পারিস।”

তখন শেয়ালের দল দেখে, সত্যিই তো সামনে হাতি দাঁড়িয়েছে। ওরা তখন ভাবে-“যদি আমরা ছাগল ও তার বাচ্চাকে খেয়ে ফেলি তাহলে সিংহ মহারাজ আমাদের মেরে ফেলবে।”এই ভেবে তারা সেখান থেকে চলে যায়।

শেয়ালরা সেখান থেকে চলে যেতেই বাচ্চা ও নিজের প্রাণ বেঁচে গেল ভেবে মিনু  বাচ্চাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে গ্ৰামের দিকে যেতে শুরু করে। কিছুটা এগোতেই ওদের সামনে সিংহ এসে পড়ে। তাদের দেখে সিংহ গর্জন করতে করতে আরও এগিয়ে আসে। সিংহকে দেখে বাচ্চা ছাগল ভয় পেয়ে মায়ের গায়ে একেবারে সেঁটে যায়। আর সিংহ এক লাফে ওদের সামনে চলে আসে।

ওদের দেখে সিংহ বলে-“আজ আমি তোদের খাব। হা হা হা।”

তখন ভয়ে কাঁপতে থাকা মিনু মনে সাহস এনে বলে-“দাঁড়ান সিংহ মহারাজ, আপনি আমাদের খেলে সিংহী মহারাণী খুব রাগ করবেন।”

সিংহ তখন বলে-“কোথায় সিংহী? তুই ছাগল হয়ে নিজেকে সিংহী ভাবছিস।”

মিনু বলে-“আরে না না মহারাজ, আমার এত দুঃসাহস হয়নি, যে নিজেকে সিংহী মনে করব। আমি তো আপনার সিংহী মহারাণীর কথা বলছি।”

তখন সিংহ বলে-“কেন সিংহী রাগ করবে কেন?”

মিনু বলে-“আপনি কী ভেবেছেন মহারাজ, আমি আমার বাচ্চাকে নিয়ে এই গভীর জঙ্গলে ঘুরতে এসেছি। না না মহারাজ আপনি ভুল ভাবছেন।  আসলে সিংহী মহারাণী আমাদের আপনার জন্য নিয়ে এসেছেন। তিনি আমাদের এখানে রেখে অন্য জায়গায় গেছেন। আর বলেছেন ফিরে এলে আপনি আর উনি মিলে আমাদের খাবেন।”

তখন সিংহ বলে-“তুই যে সত্যি কথা বলছিস তা আমি বিশ্বাস করব কী করে?”

মিনু তখন বলে-“ঠিক আছে তাহলে সিংহী মহারাণী আসার আগে আপনি আমাদের খেয়ে ফেলুন। তখন আমাদের উপরে নজর রাখা কাক সিংহী মহারাণীকে সব বলে দিবে।”

সিংহ বলে-“কাক! কোথায় কাক?”

মিনু বলে-“ওই যে সামনে ডুমুর গাছে বসে আছে। আমরা যাতে পালিয়ে না যাই তার জন্য মহারাণী ওই কাককে আমাদের উপর নজর রাখতে বলেছেন। আপনার যদি আমার কথায় বিশ্বাস না হয়, তাহলে কাককে এখান থেকে তাড়িয়ে দেখুন। দেখবেন ও এখান থেকে যায় কিনা।”

তখন সিংহ কাককে সেখান থেকে তাড়ানোর জন্য নানা চেষ্টা করে। কিন্তু কাক যায় না। তখন সিংহ ছাগলের কথায় বিশ্বাস করে। আর বলে-“সিংহী যখন একসঙ্গে খাবে বলেছে তখন ও আসুক তারপরে না হয় ভোজ হবে।”

এই বলে সিংহ সেখান থেকে চলে যায়। 

এরপর মিনু নিজেকে ও তার বাচ্চাকে সিংহের নাগাল থেকে বাঁচিয়ে গ্ৰামের উদ্দেশ্যে দৌঁড়াতে থাকে। কিন্তু কিছুটা এগোতেই সিংহীর সঙ্গে তাদের দেখা হয়। তাদের দেখে সিংহী গর্জে ওঠে। আর সিংহীকে এমনভাবে গর্জন করতে দেখে বাচ্চা ছাগল ভয়ে মায়ের পিছনে লুকিয়ে পড়ে।

তাদের দেখে সিংহী বলে-“বাঃ বাবা বাঃ, আজ সিংহ মহারাজ এইরকম দু-দুটো তাজা শিকার পেয়ে খুব খুশি হয়ে যাবেন।”

তখন মিনু ভয় না পেয়ে সিংহীকে বলে-“বাঃ স্বামী স্ত্রীর হবে তো আপনাদের মতো। দুজন দুজনকে সত্যি খুব ভালোবাসেন।”

সিংহী বলে-“তার মানে, তুমি কী বলতে চাইছ?”

মিনু বলে-“রোজ আপনি সিংহ মহারাজের জন্য শিকার নিয়ে যান। কিন্তু আজ মহারাজ আপনার জন্য আমাদের শিকার করার ফন্দি এঁটেছিলেন।”

তখন সিংহী বলে-“তাহলে করল না কেন?”

মিনু বলে-“তিনি বলেছেন সিংহী গুহাতে ফিরলে আমি তোমাদের শিকার করে নিয়ে আসব। তাজা তাজা মাংস ওকে খাওয়াব। প্রতিদিন সিংহী আমার জন্য শিকার আনে। কিন্তু আজ আমি ওর জন্য শিকার আনব।”

তখন সিংহী বলে-“সত্যি! সিংহ মহারাজ আমার জন্য এত ভেবেছেন?”

মিনু বলে-“হ্যাঁ হ্যাঁ সত্যি। আপনি আগে গুহাতে যান তো, মহারাজ ঠিকসময় এসে আমাদের নিয়ে যাবেন।”

তখন সিংহী বলে-“আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু তুমি যে সত্যি কথা বলছ তা আমি বিশ্বাস করব কী করে?”

মিনু তখন বলে-“এই যে দেখছেন সামনে একটি খরগোশ ঘাস খাচ্ছে। ওই খরগোশকে সিংহ মহারাজ আমাদের উপর নজর রাখতে বলেছেন। আমরা যেখানে যেখানে যাব এই খরগোশও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে যাবে। আর আমাদের খবর মহারাজকে দেবে।”

তখন সিংহী দেখে সত্যিই তো সামনে একটি খরগোশ ঘাস খাচ্ছে আর ছাগল চিৎকার করতেই কান খাড়া করে শুনছে। এইসব দেখে সিংহী ছাগলের কথায় বিশ্বাস করে মহানন্দে গুহায় চলে গেল। আর বলে গেল-“আমি এখুনি গিয়ে সিংহ মহারাজকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

সিংহী চলে যেতেই মিনু এদিক ওদিক ভালো করে দেখে বাচ্চাকে নিয়ে গ্ৰামের দিকে সেই যে দৌঁড় লাগাল আর পিছন ফিরে তাকালো না। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একেবারে চাষির উঠানে এসে থামল। মাকে ও ভাইকে দেখে বাকি বাচ্চারা খুব খুশি হল। 

তখন তিনটি বাচ্চার মধ্যে একটি বাচ্চা মিনুকে বলল-“মা তুমি জঙ্গলে একা একা গিয়েছিলে। আমরা তো খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যদি কোনো হিংস্র পশু তোমাকে ধরে ফেলত।”

এই কথা শুনে জঙ্গলের মধ্যে যাওয়া বাচ্চাটি বলে-“ধরত মানে, ধরে ফেলেছিল। শেয়াল, সিংহ ও সিংহী। কিন্তু মা ঠিক বুদ্ধি করে আমাকে ও নিজেকে রক্ষা করল।”

তখন অপর বাচ্চা বলল-“কী করে? মা কী ওদের সঙ্গে লড়াই করল? কিন্তু মায়ের এত শক্তি কোথায় ওদের সঙ্গে লড়াই করার? ওরা তো খুব শক্তিশালী।”

বাচ্চাদের কথা শুনে মিনু বলল-“বাচ্চারা লড়াই করতে শুধু শক্তি লাগে না, লাগে বুদ্ধি ও ধৈর্য্য। একটা কথা সবসময় মনে রাখবে, বিপদ আসলে কোনোদিন ভয় পাবে না। ধৈর্য্য, সময় এবং বুদ্ধি দিয়ে কাজ করবে। এইভাবে তুমি সব বিপদের সমাধান পেয়ে যাবে।”

Post a Comment

0 Comments