মার্কেজের খোঁজে
( চতুর্বিংশতি পর্ব)
মলয় সরকার
এর পর ১৯৫৪ সালে তিনি আবার বোগোটায় ফিরে আসেন ও ‘এল এক্সপেক্তাদরে’ লিখতে শুরু করেন।এর পরের বছরেই তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘La Hojrasca’ বা Leaf storm প্রকাশিত হয়।
জিপাকুরার চার্চে আমরা
এই সময় থেকেই তিনি কলম্বিয়ার কম্যুনিস্ট নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা শুরু করেন। তখন চলছে La violencia নামের ১৯৪৮-৫৮ এই দশ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধ, যাতে , আগেই বলেছি, প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিলেন।
এর নেতারা অনেকেই গোপন জগতের মানুষ ছিলেন।তাঁর গল্পে এঁরা অনেক ভাবেই এসেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন তাঁকে পরামর্শ দেন, যদি পুরোপুরি এই দলের সঙ্গে যুক্ত না হন, তাহলে তাঁর এর থেকে দূরে থাকাই উচিত।
এ পরামর্শ তিনি মেনে নেন, কিন্তু এঁদের প্রতি তাঁর একটা ভালবাসা থেকেই যায়।
১৯৫৫ সালে তাঁকে এল এক্সপেক্তাদরের পক্ষ থেকে ইউরোপে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তিনি পোল্যাণ্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, রোম ও প্যারিসেও যান।
এরপর যখন সরকার এল এক্সপেক্তাদর বন্ধ করে দেয়, তিনি প্যারিসেই থেকে যান। এখানেই তিনি তাঁর উপন্যাস ‘ No one writes to colonel’ ( কর্ণেলকে কেউ লেখে না) লেখেন।
তাঁর দাদু অর্থাৎ মা লুইসা সান্তিয়াগা মার্কেজের বাবা, কর্ণেল নিকোলাস মার্কেজ, ছিলেন বিখ্যাত “ হাজার দিনের যুদ্ধে”র ( ১৮৯৯-১৯৯২)এক প্রাক্তন কর্ণেল। এই দাদুই তাঁর উপন্যাসের কর্ণেল চরিত্রের নায়ক।ইনি লিবারাল পার্টির সদস্য ছিলেন এবং পরে পার্টি হেরে যায়।এই যুদ্ধে হাজার হাজার লোক মারা যায়।এদিকে গার্সিয়ার বাবা গাব্রিয়েল এলিজিও ছিলেন কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য।
এই রাজনৈতিক মতপার্থক্যের জন্য ও যেহেতু এলিজিও ডাক্তারীও পাশ করতে পারেন নি, তাঁর সাথে মেয়ের বিয়েতে প্রথমে আদৌ মত দেন নি। কিন্তু মায়ের সঙ্গে বাবার দুরন্ত ভালবাসার চাপে পড়ে বিয়ে দিতে বাধ্য হন।এই ঘটনাই ধরা আছে “ Love in the Time of Cholera” উপন্যাসে, যেটি ১৯৮৫ তে প্রকাশিত হয়েছিল।
জিপাকুরা ক্যাথেড্রালের সামনে ফাঁকা প্লাজা, দূরে আন্দিজের পাহাড়ের সারি
গ্যাবিটোর জন্মের পর তাঁর বাবা মা চলে যান প্রায় ২০০ মাইল দূরে রিওহাচায়, যখন তিনি রয়ে যান তাঁর দাদু (Colonel Nicolas Marquez ), দিদা (Tranquilina Iguaran de Marquez) ও তিন মাসীর কাছে।তাঁর দাদু তাঁকে নানা যুদ্ধের গল্প, ইউনাইটেড ফ্রুটস কোম্পানির হত্যাকাণ্ড এইসব গল্প বলতেন। এদিকে তাঁর দিদা তাঁকে নানা ভূত প্রেত যাদু ইত্যাদির অলৌকিক গল্প বলতেন। সম্ভবতঃ এখান থেকেও তাঁর গল্পের জাদুবাস্তবতার উপাদান সংগ্রহ হয়েছিল। তাঁর ভাই বোনেরাও অনেকেই এই অলৌকিক ঘটনায় পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন।
যখন তাঁর ন’ বছর বয়স তখন তিনি প্রথম তাঁর প্রায় অচেনা বাবা- মার কাছে থাকতে যান।আর তাঁর বাবা আর কখনও আরাকাতাকায় ফিরে আসেন নি। কাজেই এই ন’ বছরের পর তাঁরও আর আরাকাতাকায় বাস করা হয়ে ওঠে নি।কিন্তু এই আরাকাতাকা তাঁর মনে যে ছাপ রেখেছিল, তাতেই “নিঃসঙ্গতার একশ’ বছর “ উপন্যাসে বুয়েন্দিয়া পরিবারের বাসস্থান ‘মাকোন্দো’র সৃষ্টি হয়।
আরাকাতাকার অর্থনীতি অনেকখানিই, বোস্টনের ইউনাইটেড ফ্রুটস কোম্পানির উপর নির্ভরশীল ছিল। এদের যে অনেক কলা জমি ছিল তা নয়, তবে এরা কলাচাষীদের কাছ থেকে কলা কিনে ট্রেনে করে বন্দরে পাঠাত।শুধু কলা নয়, নানা ফলই তারা বিক্রি করত। অথচ চাষীরা কোম্পানির পক্ষ থেকে কোন সুযোগ সুবিধাই পেত না। তার ফলে চাষীদের মধ্যে জমছিল ক্ষোভের পাহাড়।তারই ফলশ্রুতিতে ১৯২৮ এ হয়েছিল সেই বিখ্যাত ধর্মঘট ও হত্যাকাণ্ড। এতে কলা শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনার দাবী জানাতে থাকে।প্রপ্সঙ্গত বলি, আজও কলা এবং নানা ফল আমেরিকাতে আসে এই কলম্বিয়াতেই।
এই বিখ্যাত কলা হত্যাকাণ্ড বা Banana Massacre সম্বন্ধে বলতে গেলে বলতে হয়, অনেক কথা। এটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরের ৫-৬ তারিখে কলম্বিয়ার সান্তা মার্তার কাছে সিয়েনাগা (Cienaga) তে। কর্মচারীদের পাওনা গণ্ডা নিয়ে ন্যায্য দাবীর সমর্থনে তারা একটা সম্মানজনক আলোচনা ও সিদ্ধান্তের দাবী ক’রে ১৯২৮ এর ১২ই নভেম্বর থেকে ধর্মঘট শুরু করে। বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে যাওয়াতেও ইউনাইটেড ফ্রুটস কোম্পানি কোন আলোচনা করতে অস্বীকার করে।পরিবর্তে বোগোটা থেকে সরকার শ্রমিকদের ঠাণ্ডা করার জন্য ৭০০ জন সৈন্য পাঠিয়ে দেন। ডিসেম্বরের ৫ তারিখে, যেখানে প্রায় ১৫০০ শ্রমিক পরিবার নিয়ে বাসা করে রয়েছে, সেখানে চারদিকের নীচু বাড়িগুলোর ছাদে মেসিন গান বসায় এবং সমস্ত বেরোনোর রাস্তা বন্ধ করে দেয়। তারপর তারা মাত্র পাঁচ মিনিটের একটা লোকদেখানো সতর্কতা দেয় জায়গা পরিত্যাগের জন্য। এরপরই তারা স্ত্রী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলের উপরেই গুলি চালায়।ফলশ্রুতিতে প্রায় ২০০০ শ্রমিকের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।( অসমর্থিত সুত্রের সংবাদ, প্রকৃতপক্ষে ৩০০০ এর বেশি এই সংখ্যা)। কলম্বিয়া সরকারও এই ফ্রুটস কোম্পানির স্বার্থে ও সাহায্যেই কাজ করেন। যদিও এই হত্যার সংখ্যার সরকার পক্ষ কখনই সত্য সংবাদ জানায় নি, মার্কেজের দাবী তিনহাজারেরও বেশি শ্রমিককে হত্যা করে রাতের অন্ধকারে ট্রেনে করে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।( কেউ বলে তাদের গণকবর দেওয়া হয়েছিল)।এই ঘটনাই স্থান পেয়েছে তাঁর “নিঃসঙ্গতার একশ বছর” উপন্যাসে।সরকার পক্ষও এর কোন খবর প্রচার করেনি কিংবা এর সত্যাসত্যও স্বীকার করেনি। এর পর প্রায় পাঁচ বছর খুব বৃষ্টি হয়েছিল। ফলে সব প্রমাণ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়।
🍂
একসময় তিনি চলে যান ক্যারাকাসে (Caracas) Momento নামে একটি পত্রিকার হয়ে কাজ করার জন্য। সেই সময়েই বিদ্রোহের ফলে উৎখাত হন কুখ্যাত ভেনেজুয়েলার স্বৈরাচারী শাসক Marcos Perez Jimenez। এখান থেকেই তাঁর মাথায় আসে এক ডিক্টেটরকে নিয়ে উপন্যাস
লেখার কথা। এরপর হাভানায় আর্মি মেজর Jesus Sosa Blanco র মিথ্যা মৃত্যুদণ্ড তাঁর ভবিষ্যৎ উপন্যাস “ The Autumn of the Patriarch” এর পটভূমিকা তৈরী করে।এটি ষোল বছর পরে ১৯৭৫ এ প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৫৮ সালে তিনি বিবাহ করেন মার্সিডিজ বার্চা ( Mercedes Barcha) কে। তাঁদের প্রথম সন্তান Rodrigo Garcia Barcha জন্মায় ২৪শে অগাস্ট ১৯৫৯এতে।(ইনি একজন টেলিভিশন ও ফিল্ম ডিরেক্টর)। এই সময় তিনি Prensa Latina পত্রিকার হয়ে কাজ করছিলেন।এর পর Gonzalo Garcia Barcha জন্মায় ১৯৬৪ তে।(ইনি একজন গ্রাফিক ডিজাইনার)।
বোগোটাতে বোতেরো মিউজিয়ামে ঢোকার মুখেই বোতেরোর শিল্প , পাশে বুলবুল
তখন আমেরিকা ও কিউবার মধ্যে সম্পর্কের বেশ অবনতি হয়।তাঁর গেরিলাদের সাথে সম্পর্ক ও সরকারের সাথে দৌত্যের জন্য নানা ভয় দেখানো ফোন পেতে থাকেন চারিদিক থেকে।
এরপর, ১৯৬৬ তে তিনি শেষ করলেন বিখ্যাত বই “ One hundred years of solitude” (নিঃসঙ্গতার একশ’ বছর)। এই বইটি সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, এটির জন্য স্ত্রী মার্সিডিজ তার হেয়ার ড্রায়ার ও ইলেক্ট্রিক হীটার বন্ধক দিয়ে এর পাণ্ডুলিপি প্রকাশক কে পোস্টে পাঠানোর খরচ জোগাড় করেন। সেটিও দু বারে পাঠাতে হয়, কারণ একদফায় পাঠানোর মত তাঁর পয়সা ছিল না। প্রকাশক এর আট হাজার কপি ছাপেন। এক সপ্তাহের মধ্যেই সেগুলি নিঃশেষিত হয়ে যায়, বইয়ের স্টল ও সাবওয়ে স্টেশন থেকেই। অবশ্য এর কথা মেক্সিকোর সাহিত্যিক কার্লোস ফুয়েন্তেস বইটির ব্যাপারে আগেই সমালোচনা করে রেখেছিলেন। এছাড়া মারিও ভার্গিজ লোসা ও জুলিও কর্তাজার ছিলেন এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।আজ বইটি প্রায় ত্রিশ বা তার বেশি ভাষায় অনূদিত হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তিনকোটির বেশি বিক্রী হয়েছে। এটিই তাঁকে খ্যাতির তুঙ্গে তুলে দেয়।
0 Comments