জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে(পঞ্চবিংশতি পর্ব) /মলয় সরকার

মার্কেজের খোঁজে
(পঞ্চবিংশতি পর্ব)
বোগোটায় বোতেরো মিউজিয়ামের ভিতরের উদ্যান

মলয় সরকার


মার্কেজ বহু পত্রপত্রিকায় লিখেছেন ছোট গল্প নিবন্ধ ইত্যাদি। এ ছাড়া রিপোর্টার হিসাবেও লিখেছেন, লাটিন আমেরিকার বৈপ্লবিক ইতিহাস, এঙ্গোলার যুদ্ধ, ভিয়েতনামের যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে।তিনি বলতেন এই লেখার বিষয়ে, ( ১৯৬৬ সালে রিপোর্টারদের সেমিনারে বলেছিলেন),  “one must keep the reader hypnotised by tending to every detail, every word.” এটিই আসলে সমস্ত লেখকদের সাধনার জন্য বাণী।
বোগোটার প্লাজায় ঘুরে বেড়াচ্ছে লামার দল, কিছু খুদে সওয়ারীর আশায়

তাঁর ভীষণ বন্ধুত্ব ছিল কিউবার বিখ্যাত নেতা ফিদেল কাস্ট্রোর সঙ্গে।শুধু তাঁর সঙ্গেই নয়, বিখ্যাত বহু গেরিলা নেতাদের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর সম্পর্ক।বিখ্যাত নেতা Enrique Santos Calderon বলতেন, গার্সিয়ার ভিতরে কিন্তু লুকিয়ে আছে কম্যুনিষ্ট মনোভাব।
১৯৭৫ সালে এক ঘটনার মাধ্যমে তিনি কাস্ট্রোর সান্নিধ্য লাভ করেন ও পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন।

মার্কেজ বলেন, তিনি তার বন্ধুত্বকে কাজে লাগিয়েছেন, ফলে বহু কিউবার নেতা, যাঁরা বন্দী ছিলেন বহু বছর ধরে, তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন।তবে এগুলো তিনি করেছেন নিঃশব্দে এবং প্রচারের বাইরে। প্রায় দু’ হাজারের অধিক বন্দীদের বন্দীত্বের মোচন করেছেন কাস্ত্রোকে বুঝিয়ে।
বোগোটার পরিচ্ছন্ন রাস্তা ও সুন্দর চিত্র সহ বাড়ির দেওয়াল যা কেউ অবিকৃত করেনা

 কাস্ত্রো তাঁর এই বন্ধুকে যথেষ্ট মান্য করতেন, এবং তাঁর কথার মর্যাদা দিতেন, যদিও গার্সিয়া বলতেন, ওনার চেয়েও নাকি কাস্ত্রোর বেশি বন্ধুত্ব তাঁর স্ত্রী মার্সিডিসের সঙ্গে, এবং সে বললে কাস্ত্রো করতে পারে না এমন কিছু নেই।

তিনি দৌত্য করেছেন, কিউবা সরকারের এবং কাস্ত্রোর মধ্যে, ওদিকে কলম্বিয়া এবং আমেরিকা সরকারের মধ্যেও। এগুলিতে তাঁর বিশেষ গুরুত্ব ছিল। কাস্ত্রোর যেমন তিনি বন্ধু ছিলেন, আবার কিউবা সরকারের নীতিও জানতেন। তাই তিনি এই দু’য়ের মধ্যে তাল রক্ষা করে চলতেন।

মার্কেজের একটা বাড়ি ছিল হাভানার Siboney তে, যেটা ছিল কিউবার ধনী লোকেদের জায়গা। এই বাড়িটি তাঁকে দিয়েছিলেন কাস্ত্রো, যেটি ছিল সমুদ্রের ধারে এক বিলাসবহুল বাড়ী। কাস্ত্রো নিজেও এর খুব কাছাকাছিই থাকিতেন। মার্কেজ নিজে বলেছেন, কাস্ত্রো সম্ভবতঃ  পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন তাঁকেই।কিন্তু তা সত্বেও কাস্ত্রো তাঁর স্ত্রীর সঙ্গেও মার্কেজের পরিচয় করান নি।
🍂

প্রথম যে রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়, তিনি হলেন, General Omar Torrijos, যিনি ১৯৬৯ সালে পানামার  দখল  নেন।তিনি আবার মার্কেজের , The Autumn of the Patriarch বইটির খুব প্রশংসা করতেন। বলতেন, এতে একেবারে সত্যি কথা বলা হয়েছে, আমরা প্রত্যেকে এরকমই।

১৯৮১ সালে যখন তিনি আন্দাজ করেন যে তাঁকে M-19 গেরিলাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য গ্রেপ্তার করা হতে পারে, তিনি সস্ত্রীক মেক্সিকোতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং মেক্সিকো শহরে চলে যান।এতে অবশ্য তাঁর কলম্বিয়ার জনসংযোগের উপর আঘাত আসে।

 এরপরই তাঁর বন্ধু ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট  মিতেরঁর ডাকে প্যারিস যান এবং তাঁকে Legion de Honour এ ভূষিত করা হয়। তারপর তিনি সস্ত্রীক যান সুইডেনে, যেখানে তাঁকে নোবেল প্রাইজে সম্মানিত করা হয়।
এরপর কলম্বিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট Belisario Betancur তাঁকে বিশেষ সরকারি সুরক্ষা প্রদান করে কলম্বিয়ায় আমন্ত্রণ করেন। তিনি অনেকবার তাঁকে মন্ত্রীত্ব নিতে ও স্পেন এবং ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগের প্রস্তাব দেন। তিনি বার বারই সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। মার্কেজ বলতেন, রাজনৈতিক নেতা হওয়ার বা সেই ক্ষমতার প্রতি তাঁর লোভ নেই, তবে নেতারাই তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব লাভের চেষ্টা করতেন। 

ল্যাটিন আমেরিকার সমস্ত প্রেসিডেন্টই তাঁর বন্ধুত্ব লাভ করতে চাইতেন।তবে তিনি রাজনৈতিক শক্তির কাছাকাছি থাকতে চাইতেন।
আসলে মার্কেজ রাজনৈতিক ঘটনা বা অবস্থার খুব বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ করতে পারতেন,  যা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছাপা হত।Cambio পত্রিকার সম্পাদক বলেন, আমরা শুধুমাত্র খবর পরিবেশন করি না, তার অন্য মাত্রা দিতে চাই। আর সেটার দায়িত্ব নিয়েছেন গ্যাবো। এজন্য আমরা গর্বিত।

তিনি একসময় বিশিষ্ট কলম্বিয়ান গায়িকা শাকিরার ( যিনি টোকিও অলিম্পিকে প্রারম্ভিক গায়িকা ছিলেন) সম্বন্ধেও লেখেন।
তিনি বেশিরভাগ সময় তরুণ সম্পাদক ও রিপোর্টারদের সঙ্গে কাটাতে ভাল বাসতেন। এতে, তিনি মনে করতেন, বয়স ও মনটাকে সজীব রাখা যায়।
তাঁকে কলম্বিয়ার মানুষ অনেক সময়েই চাইত, কারণ বিপদের সময় দুই দেশের বা দুই শক্তির মধ্যে দৌত্য কার্য্য তিনি খুব ভালভাবে করতে পারতেন।তাঁকে আবার অনেকেই শোষিত নিপীড়িত শ্রেণীর মানুষদের কথা বলার জন্যও পছন্দ করতেন।

গার্সিয়ার লেখার যাদু বাস্তবতা নিয়ে অনেকেই নানা কথা বলেন, কিন্তু তিনি নিজে বলেন, তাঁর বইয়ের প্রতিটি কথা সত্য ও বাস্তব থেকে নেওয়া।

তিনি প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার কার্যকলাপের বিরূদ্ধে ছিলেন। তাঁর আমেরিকার বিরুদ্ধ মতাবলম্বী হওয়ার প্রধান কারণ শুরু ১৯২০ সালের ঘটনার পর থেকে, যখন আমেরিকার ইউনাইটেড ফ্রুটস কোম্পানি ক্যারিবিয়ান উপকূলে রাজত্ব চালাচ্ছে। ১৯২৭ সালে গার্সিয়া সেখানে জন্মগ্রহণ করে তাঁর দাদুর কাছে বড় হন সেখানেই হয়েছিল সেই হত্যাকাণ্ড।

 অবশ্য তাঁর তরুণ বয়সে La Violencia র সময় আরও অনেক বেশি হত্যা তিনি দেখেছেন। এই সময়কালটিতে প্রায় দুই বা আড়াই 'লক্ষ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়েছে বিভিন্ন শক্তির হাতে যখন চলেছিল এই দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ। তিনি এর পিছনের কারণ, আমেরিকাকে কখনও ক্ষমা করতে পারেন নি।
মন্সেরাটে পাহাড়ের উপরের চার্চের অভ্যন্তর

তিনি ভ্রমণ করেছেন বিভিন্ন দেশে, সর্বত্রই দেখেছেন শোষণ, ও রাজনৈতিক অত্যাচার। তিনি বলতেন, “ Democracy in developed countries is a product of their own development, not vice versa”। তিনি বিশ্বাস করতেন, লাটিন আমেরিকার মত অন্য সংস্কৃতির দেশে সোভিয়েত রাশিয়ার কম্যুনিজম সিস্টেম সরাসরি বসানোর চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। তিনি স্বপ্ন দেখতেন এক অখণ্ড লাটিন আমেরিকার। আর এই সূত্রেই তাঁর জীবনে ফিদেল কাস্ত্রোর উদয়।আর কাস্ত্রোর সঙ্গে তাঁর মিলের প্রধান কারণ উভয়েই আমেরিকা বিদ্বেষী। কলম্বিয়ার ড্রাগ পাচার এর কারণ হিসাবে আমেরিকাকে তিনি দায়ী করেন। তিনি একটি সংবাদপত্রে বলেন, “Columbia cannot give up its sovereignty and turn it over to a foreign nation.The next step would be to allow US troops into Colombia to fight drug trafficking –” 

এই ড্রাগ পাচার নিয়ে তিনি অনেক লড়াই করেছেন।তিনি ১৯৯৫ সালে মার্চে একটি কাগজে বলেন,”All the money Columbia invests in fighting drugs should be invested in US to research synthetic cocaine”। এর পিছনে যুক্ত কলম্বিয়ার নেতা ও বিদেশী শক্তি যারা এই ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার পিছনে মদত দিচ্ছে এবং যার ফলে কলম্বিয়ার নিরীহ সাধারণ মানুষের হত্যাকাণ্ড ও কলম্বিয়ার অর্থনৈতিক সংকট তাকে বার বার তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আক্রমণ করেন।


এবার আসি তাঁর সম্বন্ধে অন্য কিছু কথায়-

তিনি বোগোটাতে থাকাকালীন বেশ অভিজাত ধরণের জীবন যাপন করতেন। তাঁর গাড়িটি ছিল Lancia Thematic Turbo (১৯৯২) মডেলের ধূসর রঙের সেডান। তার জানালা দরজা ছিল বুলেট প্রুফ কাঁচের ও চেসিস ছিল বোম্বপ্রুফ। তাঁর যে ড্রাইভার- কাম-দেহরক্ষী ছিল, তার নাম Don Chepe, যে একজন ভূতপূর্ব গেরিলা যোদ্ধা ছিল।প্রায়  কুড়ি বছর সে তাঁর কাছে কাজ করেছিল। তাঁকে অনুসরণ করত সব সময় প্রায় ছয় জন সিক্রেট সার্ভিসের লোক।এটা ছিল তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপার, কারণ তখন এখানে প্রতিমাসে প্রায় দু'শ লোককে অপহরণ ও হাজার হাজার লোককে হত্যা করা হচ্ছিল। তখন গার্সিয়া মার্কেজ বামপন্থী গেরিলা ও সরকারের মধ্যে দৌত্য চালাচ্ছিলেন।
এই সময়েই প্রায় একই রকম কাজ করার জন্য প্রকাশ্য রাস্তায় একজন মোটর সাইকেলে এসে সামনে থেকে গুলি করে Jaime Garron  নামে এক রাজনৈতিক ব্যক্তিকে।

তখন সারা কলম্বিয়া মার্ক্সবাদী গেরিলাগ্রুপই মোটামুটি চালাচ্ছিল। তারা প্রায় সব সময়েই সরকারের বাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছিল। তাদের মদত জোগাচ্ছিলেন বড় বড় ভূস্বামী এবং ড্রাগ চোরাচালানের বড় চাঁইরা।
ফলে সুবিস্তীর্ণ আন্দিজ পর্বতমালার নীচে যে শান্ত চাষীসম্প্রদায়ের মানুষরা বাস করতেন, তাঁদের মধ্যে, পরবর্তী পনের বছরে, প্রায় পনের লক্ষ মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হন।

ক্রমশঃ-
সঙ্গে থাকুন, সুদীর্ঘ দিনের পথচলার বন্ধুরা। বুঝি, হয়ত বা আপনারাও ক্লান্ত এই পথশ্রমে। তাই শীঘ্র বিরতি টানার কথা মনে আসছে। তবুও আর কিছুদিন অন্ততঃ সঙ্গে থাকুন। দেখা হবে পরের পর্বে-

Post a Comment

0 Comments