জ্বলদর্চি

কথাসাহিত‍্যিক সাধন চট্টোপাধ‍্যায়-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সন্দীপ দত্ত


কথাসাহিত‍্যিক সাধন চট্টোপাধ‍্যায়-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন 

সন্দীপ দত্ত


সন্দীপ দত্ত: নমস্কার সাধনদা,'জ্বলদর্চি'পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনাকে প্রথমেই জানাই আন্তরিকভাবে স্বাগত। আধুনিক বাংলা কথাসাহিত‍্যে আপনার উজ্জ্বল অবদানের জন‍্য আপনাকে জানাই অনেক অভিনন্দন,শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।

সাধন চট্টোপাধ‍্যায়: তোমাকে আমার বুকভরা ভালবাসা জানাই সন্দীপ। তোমাকে তুমি দিয়েই বললাম। কেননা,আমার বয়েস এখন একাশি। তুমি আমার সন্তানের চেয়েও কম বয়েসের।

সন্দীপ: অবশ‍্যই তুমি দিয়ে বলবেন। আপনার মুখ থেকে তুমি শুনে অন্তর ভরে গেল আমার। আপনার মতো প্রণম‍্য মানুষের কাছ থেকে এটাই আশা করব। আপনাদের আশীর্বাদ পেলে আমি ধন‍্য হয়ে যাই। 

সাধন: নাগো,তুমি এখন ভাল লিখছ। অনেক পত্রিকাতেই তোমার লেখা দেখি। পড়িও। এভাবেই এগিয়ে চলো। একুশ শতকের তোমরা যারা নতুন প্রজন্মের কথাসাহিত‍্যিক,তোমাদের হাতেই তো দায়িত্ব থাকবে বাংলা কথাসাহিত‍্যকে আরও বলিষ্ঠ করে তোলার। আমার আশীর্বাদ তো রইলই।

সন্দীপ: আমার আন্তরিক প্রণাম নেবেন সাধনদা। এখন কেমন আছেন এবার বলুন।

সাধন: আমি ভাল আছি সন্দীপ। শরীর এবং মন দুটোতেই ভাল আছি। কেন ভাল আছি জানো? আসলে,মনের একেবারে ভেতরের স্তরে ডুব দিয়ে থাকি তো,তাই ভাল আছি। মনটাকে যদি ওপরের স্তরে নিয়ে আসি,সমাজ,রাষ্ট্রের দিকে তাকাই,কোত্থেকে হুট করে একটা অবসাদ চলে এসে মনটাকে চেপে ধরে। তখন খারাপ লাগে খুব। দৈনন্দিন সমাজজীবনের এই ঘর্ষণ থেকে রেহাই পেতে মনের গভীরের স্তরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করে। দেখেছি,ওই স্তর শরীর মন দুটোকেই ভাল রাখে। সবকিছু সজীব মনে হয়।

সন্দীপ: সাধনদা,আপনার বয়েস এখন একাশি বললেন। সেই হিসেবে ১৯৪৪ সালে আপনার জন্ম। আপনার জন্মের পর মাত্র তিন বছরের মাথায় দেশভাগ। শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলো আপনার কোথায় এবং কীভাবে কেটেছে?

সাধন: দেশভাগ মানে সে বড় যন্ত্রণার দিন গো সন্দীপ! শিকড় ছিঁড়ে গেল আমাদের। ওপার বাংলা থেকে চলে এলাম এপার বাংলায়। বলতে পারো,একরকম ভাসতে ভাসতে,এর সংসারে ওর সংসারে থাকতে থাকতে আমার ছেলেবেলার দিনগুলো কেটেছে। থাকতে হয়েছে কখনও আসাম,কখনও মধ‍্যপ্রদেশ,কখনও কলকাতায়। লেখাপড়াতেও এর প্রভাব পড়েছিল বেশ। অবশেষে থিতু হওয়া কলকাতার সোদপুরে।

সন্দীপ: লেখালেখির জগতে কীভাবে আসা? ছোট থেকেই কি স্বপ্ন ছিল সাহিত‍্যিক হবার?

সাধন: খুব ভাল প্রশ্ন করলে। ছোটবেলার স্বপ্ন যদি জিজ্ঞেস করো,তাহলে আমি বলব,ছোট থেকেই আমি বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন দেখতাম। সেই লক্ষ‍্য নিয়ে পদার্থবিদ‍্যা নিয়ে পড়াশুনো। সাহিত‍্যের কিছুই বুঝতাম না তখন। ভালও লাগত না। হঠাৎ হাতে পাওয়া একটা বই-ই আমার জীবনটাকে আমূল বদলে দিল।

সন্দীপ: সেটা কোন বই সাধনদা?

সাধন: কথাসাহিত‍্যিক বিমল মিত্রের লেখা বিখ‍্যাত উপন‍্যাস 'সাহেব-বিবি-গোলাম'। গরমের ছুটিতে লাইব্রেরিয়ান এই বইটি যখন আমার হাতে দেন,প্রথমে ইচ্ছেই জাগেনি খুলে দেখার। পড়া তো অনেক পরে। তারপর কী মনে হল,পাতা উল্টে পড়তে শুরু করলাম। একপাতা থেকে দু'পাতা,দু'পাতা থেকে চার পাতা,আস্তে আস্তে পাতার পর পাতা পড়লাম। যত পড়ি,ততই যেন চমকে উঠি। এ কী লেখা! সাহিত‍্য এত সুন্দর! ভাষাবিন‍্যাস,শব্দচয়ন এত মধুর হতে পারে! বাংলাসাহিত‍্যের এত শক্তি! সেই যে টান লাগল একটা,মনে হল,সাহিত‍্যকে জানতে হবে। আমার ভেতরে কেউ যেন বলে উঠল,এরকম তো আমিও লিখতে পারি। বিমল মিত্র আর কোনওদিন কেউ হবেন না ঠিকই,তবে লেখার তাগিদ এল একটা। মনে হল,আমাকেও লিখতে হবে। আমার লেখালেখির জগতে আসা এভাবেই। এর আর একটা অংশ মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় ও 'পদ্মা নদীর মাঝি'।

সন্দীপ: আর একটা অংশ মানে? মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের লেখাও আপনাকে প্রভাবিত করেছিল?

সাধন: দারুণভাবে। বললে তুমি বিশ্বাস করবে না সন্দীপ,মাত্র এক রাতের মধ‍্যেই আমি 'পদ্মা নদীর মাঝি'পড়ে শেষ করেছিলাম। পড়ার পর একটা ঘোর লেগে গিয়েছিল। মনে হল,আমি মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের প্রেমে পড়ে গেছি। তারপর মানিকের বহু লেখাই পড়ে ফেললাম গোগ্রাসে। মিল খুঁজে পেলাম,মানিকও পদার্থবিদ‍্যার ছাত্র,আমিও। ফলে প্রেমটা আরও আঁটোসাঁটো হল। মানিকের লেখা আমাকে এতটাই প্রভাবিত করল,ওই সময়টাতে আমি যা লিখছিলাম,সবগুলোই হুবহু মানিকের লেখার স্টাইলেই হয়ে যাচ্ছিল। মানিকের লেখা আমি এতটাই ভালবাসতাম,কেউ যদি আমার লেখা পড়ে মানিকের প্রশংসা করতেন,আমি খুব খুশি হতাম। তারপর একদিন কেউ যেন আমাকে বললেন,'তোমার লেখা পড়ে যদি মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়কে পাই,তাহলে তোমার লেখা আর তোমার থাকল কোথায়?' তখন বুঝলাম,লিখতে গেলে স্টাইল তৈরি করতে হয়। স্টাইলই লেখককে বাঁচিয়ে রাখে। সেই থেকে শুরু হল নিজেকে বদলানো। নিজেকে ভাঙা।

সন্দীপ: চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ‍্যায় থেকে সাধন চট্টোপাধ‍্যায় হতে ইচ্ছে হল কেন? এটা কি সেই মানিকপ্রেমেরই প্রভাব?

সাধন: হ‍্যাঁ,বলতে পারো। মানিকবাবু যেমন নিজের আসল নামটা সাহিত‍্যজগতে আনতে চাননি,মানিকবাবুকে ফলো করে আমিও সেই পথেই হাঁটলাম। পড়াশুনোর জগতের চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ‍্যায় নামটা পরিহার করে সাহিত‍্যজগতে লিখতে শুরু করলাম সাধন চট্টোপাধ‍্যায় নামে।

সন্দীপ: 'অগ্নিদগ্ধ'লেখার সাহস কীভাবে এল?

সাধন: দেখো সন্দীপ,সাহস বলব,না ঝুঁকি বলব,ঠিক বুঝতে পারছি না। 'অগ্নিদগ্ধ'আমার প্রথম লেখা এবং প্রথম উপন‍্যাস। অনেক লেখকেরই জীবনে প্রথম লেখা কোনও গল্প থাকে। কিন্তু আমি শুরু করলাম উপন‍্যাস দিয়ে,এবং সেটি এই 'অগ্নিদগ্ধ'। প্রথমে এটি একটি কাগজে ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। পরে গ্রন্থ হিসেবে আসে। ১৯৬৯-৭০-এর দিকের এই উপন‍্যাসটিতে তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক চেতনা,রাজনৈতিক আদর্শকে তুলে ধরা হয়েছে। বামপন্থী আন্দোলন,খাদ‍্য আন্দোলন ইত‍্যাদি এইসব বিষয়কে কেন্দ্র করেই এই উপন‍্যাস। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে রাষ্ট্রনৈতিক পরিবেশের যে পরিস্থিতি,তা লিখতে বসে মনে হয়েছিল,বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা চাপা আগুন থেকে গেছে। সেই আগুনটাকে কলম দিয়ে নামাতে হবে।

🍂

সন্দীপ:পাঠক সাধন চট্টোপাধ‍্যায় এবং লেখক সাধন চট্টোপাধ‍্যায়কে যদি পাশাপাশি রাখা হয়,আপনি কাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন?

সাধন: আমি পাঠক সাধন চট্টোপাধ‍্যায়কেই বেশি গুরুত্ব দেব। কেননা,পাঠক সাধন চট্টোপাধ‍্যায় কী পড়েনি? একদিকে আমেরিকান সাহিত‍্য,রাশিয়ান সাহিত‍্য,অন‍্যদিকে বঙ্কিম,রবীন্দ্রনাথ। সাহিত‍্যজগতে ঢোকার আগে থেকেই বই পড়ার অসম্ভব একটা নেশা ছিল তার। তখন মনোনিবেশ করত বিজ্ঞান ও অঙ্কের প্রতি,পরবর্তীকালে সেটি দখল নেয় সাহিত‍্য।

সন্দীপ: বিজ্ঞান এবং সাহিত‍্যের মধ‍্যে কোথাও কি মিল পেয়েছেন আপনি?

সাধন: হ‍্যাঁ,মিল আছে। বিজ্ঞানের মতো সাহিত‍্যেও পরিমিতিবোধ থাকা দরকার। বিজ্ঞানের মতো সাহিত‍্যও বিশ্লেষণধর্মী।

সন্দীপ: 'ধরিত্রী'র মতো উপন‍্যাস লিখতে হল কেন?

সাধন: স্কুলে শিক্ষকতা করতে এসে আমি বুঝলাম,বিভুতিভূষণের চিন্তায় যে শিক্ষককে আমরা পেয়েছি,কিংবা নরেন্দ্রনাথ মিত্র বা মানিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের 'টিচার'য়ে,সেই দিন এখন আর নেই। শিক্ষাপ্রদান এই বিষয়টার ওপরই ঘুণ ধরেছে। এই ভাবনা থেকেই 'ধরিত্রী'লেখা। বলতে পারো,শিক্ষাব‍্যবস্থার এই ডামাডোল পরিস্থিতিটাই আমায় নাড়িয়ে দেয়।

সন্দীপ: লেখকদের অবসরজীবন বলে কিছু থাকে কি? আপনার কী মনে হয়?

সাধন: সন্দীপ,তুমিও তো একজন লেখক। এই প্রশ্নটা আমি যদি তোমায় করি,তুমি উত্তর কী দেবে?

সন্দীপ: না,লেখকদের অবসরজীবন বলে কিছু হয় না। চিন্তা সারাক্ষণই মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে। কলম নিয়ে বসলেই যে কাজ,কলম বন্ধ করলে নয়,অন্তত লেখকদের জীবন এরকম নয়। ঘুমোনোর সময়টুকু বাদ দিয়ে সারাক্ষণই তাকে কাজ করতে হয়। লেখকদের অবসরজীবন থাকে না।

সাধন: একদম তাই। তুমি,আমি,আমরা যারা কথাসাহিত‍্যিক,আমাদের মাথার ভেতর গুবরে পোকার মতো একটা চিন্তা চলতেই থাকে। হয়তো বসে থাকি চুপচাপ,আসলে কিন্তু বসে নেই। সুতরাং,অবসরের প্রশ্ন আসে না।

সন্দীপ: কাহিনি এবং আখ‍্যানকে আপনি আলাদা হিসেবে দেখতে চান কেন?

সাধন: কাহিনি একবার পড়লেই আর দ্বিতীয়বার পড়তে ইচ্ছে করে না। আখ‍্যানের মধ‍্যে সেই দর্শনটি রয়েছে,যা পাঠককে নতুন করে ভাবতে শেখায়। ১৯১০ সালের রবীন্দ্রনাথের 'গোরা'কে জীবনে আমি যতবারই পড়েছি,প্রতিবারই দর্শন পাল্টে পাল্টে গেছে। নতুনভাবে ধরা দিয়েছে। কাহিনিতে এই জাদু নেই। একবার পাঠ করলেই খিদে মিটে যায়।

সন্দীপ: 'তেঁতুল পাতার ঝোল' লিখতে হল কেন?

সাধন: বর্তমান পরিস্থিতি,বিশেষ করে সমাজ ও রাষ্ট্র আমাদের দেশীয় শিক্ষানীতিটাকে কীভাবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগিয়ে মুনাফা লুটছে,এবং এতে শিক্ষকদের আচরণের কী পরিবর্তন ঘটছে,তা আমজনতার কাছে প্রকাশ করার জন‍্যই লিখতে হয়েছে 'তেঁতুল পাতার ঝোল'।

সন্দীপ: ৩২ বছরের 'জ্বলদর্চি'পত্রিকা আপনার কাছ থেকে কিছু সুপরামর্শ আশা করে। লিটল ম‍্যাগাজিনের এই অক্লান্ত,নির্ভীক পথ চলা দেখে আপনার কী মনে হয়?

সাধন: লিটল ম‍্যাগাজিনের যে আদর্শ থাকা দরকার,এখনকার বেশিরভাগ লিটল ম‍্যাগাজিনেরই সেটা নেই। এখন যাঁরা কাগজ করেন বা করছেন,ভাল লেখা সংগ্রহ করার দিক থেকে সরে গিয়ে তাঁরা নিজেদের সম্পাদক হিসেবে পরিচিতি বাড়ানোর দিকেই বেশি গুরুত্ব দেন। যেটা মোটেই কাম‍্য নয়। লিটল ম‍্যাগাজিন মানেই ভাল লেখা। এটা মাথায় রাখতে হবে। লিটল ম‍্যাগাজিনের লেখা মানেই বুদ্ধিদীপ্ত লেখা। এটা ভুলে গেলে চলবে না। কেননা,লিটল ম‍্যাগাজিন যাঁরা পড়েন,তাঁরা প্রায় প্রত‍্যেকেই বিদগ্ধ। জ্ঞানী। লিটল ম‍্যাগাজিন সকলের জন‍্য নয়। ঋত্বিক লিটল ম‍্যাগাজিনের এই আদর্শগত নীতি নিয়ে যথেষ্ট ভাবে।

সন্দীপ: এতক্ষণ ধরে আমার সঙ্গে কথা বলার জন‍্য আপনাকে অসংখ‍্য ধন‍্যবাদ সাধনদা। ভাল থাকবেন সবসময়। আরও লিখতে হবে আপনাকে। আমরা আপনার লেখা পড়ে আরও ঋদ্ধ হতে চাই।

সাধন: তুমিও খুব ভাল থেকো সন্দীপ।  আরও অনেক লেখো। আমার আন্তরিক শুভকামনা রইল তোমার জন‍্য।

Post a Comment

0 Comments