স্বাগতা পাণ্ডে
স্বাগতা পাণ্ডে: আশির দশক থেকে আপনার অভিনয় জগতের যাত্রা শুরু। এই শুরুর অনুপ্রেরণা কিভাবে?
গৌতম হালদার: অনুপ্রেরণা তো জীবন দেয়। আর সেটা অজান্তেই দেয়। যা দেখেছি ,যা দেখছি, যা শুনছি, চারপাশে যা ঘটছে, ছোটবেলার সাধারণ সাধারণ ভাল লাগার মুহূর্ত, খারাপ লাগার মুহূর্ত সেগুলো মনের ভেতর নানাভাবে কাজ করে। প্রত্যেক মানুষেরই মনে হয় সেওলো কোথাও একটা প্রকাশ করতে পারলে ভাল হয়, কেউ ববন্ধুর কাছে প্রকাশ করে, কেউ প্রিয়জনদের কাছে প্রকাশ করে, সেটাই এভাবে এসেছে যে, আরও যদি বেশি মানুষের কাছে প্রকাশ করা যায়। চারিদিকের চলমান জীবনকে দেখে আমার যা মনে হয়, তা যদি অন্যের মনে হওয়ার সাথে মেলে, আর সেই মিলে যাওয়াগুলো আরও যদি বিস্তার লাভ করে, তখন মনে হয় বাহ ভালো লাগল। মানে এইসবই অনুপ্রেরণার কাজ করে, এই আর কী…
স্বাগতা: পরিবারে কেউ অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?
স্বাগতা :অভিনেতা হিসেবে শুরুটা প্রথম কোথায়?
গৌতম : (হেসে উঠে) শুরুটা স্কুলেই বলা যেতে পারে। কলেজেও অবশ্যই। তবে প্রথমেই তো কেউ বলতে পারে না, যে সে অভিনেতা হবেই। বা ফুলটাইম অভিনেতা হব। একটু হয়তো সবে মনে হচ্ছিল। কলেজে পড়ার সময় বা পরে। কলেজে পড়ার পরে যখন চাকরি করছিলাম রেলওয়েতে— অভিনয়ের ইচ্ছে ছিল। তাই চাকরির সময়টা কমানোর চেষ্টা করছিলাম, যাতে থিয়েটারের সময়টা বাড়ানো যায়। তারপর একটা সময় চাকরিই ছেড়ে দিলাম।
স্বাগতা : সিনেমা না থিয়েটার— কোনটা বেশি ভালোবাসার ছিল— প্রথম থেকে?
গৌতম : অবশ্যই থিয়েটার। তার মানে এই নয় যে সিনেমা ভালোবাসি না। আমি প্রচুর সিনেমা দেখতাম আগে। সিনেমার অভিনয়ও ভালো লাগে। পরে সিনেমাতে অভিনয় করেছি।
স্বাগতা : থিয়েটার এর শুরুর অধ্যায় কি নান্দীকার?
গৌতম : না, ঠিক তা নয়, স্কুল কলেজের অভিনয় ছাড়াও করেছি স্ট্রিট ড্রামা, পলিটিক্যাল ড্রামা, Agitprop ড্রামা, ওপেন ড্রামা আর কী, এইসব করার পরে যখন পুরস্কৃত হতাম তখন নিজেরই মনে হতো আমি রেকগনাইজড হচ্ছি। এভাবেই উৎসাহ বাড়ে, তখন মনে হলো যে ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি, তখন থিয়েটারের নানান বিষয় জানার চেষ্টা করতাম, পড়াশোনা করতাম। আর থিয়েটারে যাঁরা জ্ঞানী বা পণ্ডিত তাঁদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করতাম, আর তার সাথে ছিল চর্চা। চর্চা মানে নানা ধরনের চর্চা।
স্বাগতা : আপনি আপনার অভিনয় বা চরিত্রকে সবসময় একটু অন্যভাবে আলাদা আঙ্গিকে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। সেটা একটা আলাদা স্বতন্ত্রতা এনে দেয়।
গৌতম : আসলে আমি অন্যদের দেখে বোঝার চেষ্টা করি যে তাঁরা তাঁদেরকে কিভাবে প্রকাশ করছেন। যেমন —শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত। এঁদেরকে দেখে বোঝার চেষ্টা করি তাঁরা কিভাবে করছেন বা কেন এইভাবে করছেন, এগুলো আমার মনের মধ্যে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি আমি ঠিক কীভাবে এটা করব, কেন করব এইভাবে, সেই কারণগুলো স্পষ্ট হয়। তখন নিজের ভেতরে নতুনভাবে খোঁজা শুরু হয়। অন্যের নকল না করে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার শুরু হয়। আসলে অন্যরা যেভাবে দেখেছেন অভিনয়কে বা জীবনকে, আমি তো সেইভাবে পারব না দেখতে, তবে তাদের থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়, আর সেটা নিয়ে নিজেকেই জীবন চিনতে হয়, অভিনয় চিনতে হয়, মানুষ চিনতে হয়, সমাজ চিনতে হয়, তারপর নিজের মতো করে কারণ বুঝতে শুরু করি বা অন্যরকম কিছু ভাবতে পারি।
স্বাগতা: আপনার এই অন্যরকম কিছু ভাবনা খুব স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে আপনার পরিচালনার মধ্যে। যেমন অন্যতম উল্লেখযোগ্য আমার কাছে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’।
গৌতম: হ্যাঁ, প্রায় তিরিশ বছর ধরে চলছে (হাসি)
স্বাগতা: এবার আপনার একক অভিনয় নিয়ে কিছু বলুন।’’ মেঘনাদবধ কাব্য’, ‘মরমিয়ামন’...
গৌতম : সত্যিকথা বলতে সব চরিত্রই আমার কাছে সমানপ্রিয়। তবে তার মধ্যেও বলতে পারি যেটা করতে গিয়ে মনে হয়, মানুষের মনের গভীরে গিয়ে ভালোবাসা কী অহং কাকে বলে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা কী, প্রতিশোধ কাকে বলে, এগুলোর যে প্রকাশ, এবং এগুলি মনের কোন গহনে তৈরি হয় সেটা খোঁজার এক অতলস্পর্শী নাটক বা চরিত্রটি সেটা ফিয়োদর দস্ত্যয়েভস্কির একটি ছোট গল্প ‘দ্য জেন্টেল স্পিরিট’ থেকে অনুপ্রাণিত নাটক ‘মরমিয়ামন’। এটি আমার একক অভিনয়। এই নাটকটি আমার কাছে জীবনের যে অনিশ্চয়তা—সেটাকে বার বার ছুঁয়ে দেয়, এই অভিনয়ের ভেতরে। এই চরিত্রটার ব্যাপ্তি ভীষণ গভীর। এই চরিত্রটা আমি বহুবার করেছি, প্রত্যেকবার চরিত্রটা আমার কাছে নতুন হয়ে আসে, আর নতুন হয় মঞ্চেও। আমার কাছেও চরিত্রটা অপরিচিতই থেকে যায়। আর দস্তয়েভস্কির লেখায় এতটাই মনের অবচেতনের কথা লেখা থাকে যে অভিনয়েও চরিত্রের অবচেতনে না গেলে করাটাই মুশকিল হয়ে যায়। কবি জয় গোস্বামী এই নাটকটা দেখে বলেছিলেন যে এটা মনের পাতালপ্রবেশ করার মত নাটক। 'মেঘনাদ বধ কাব্য’ও আমার একক অভিনয়, কিন্তু তাতে মিউজিক আছে, নানা ধরনের শেড আছে। তবে যে কোন নাটকে বা চরিত্র একশ শতাংশ না দিলে চরিত্র হয়ে ওঠে না। ‘মরমিয়ামন’ একটি ভালোবাসারই গল্প, বলা যেতে পারে ভালোবাসার খোঁজ, ভালোবাসার মৃত্যু এবং তার সঙ্গে নারী- পুরুষের সম্পর্কের কত রকমের স্তর, কত রকমের রঙ, নানা রকমের জটিলতা এবং সারল্য একই সঙ্গে বিরাজ করে, সেটা দেখা যায় এই নাটকে।
স্বাগতা: আপনার কাজ অভিনয়,পরিচালনা বাংলা নাটকে মাইলস্টোন তৈরি করে দিয়েছে।
গৌতম : ( প্রাণখোলা হাসি) না, না, সেরকম কিছু নয়, অনেক কবি, নট, পরিচালক তারা আরও অনেক বড় বড়ো কাজ করেছে, আমি অতি সাধারণ, কিছু কাজ করার চেষ্টা করছি মাত্র।
স্বাগতা: ‘নয়ে নাটুয়া’ সম্পর্কে কিছু বলুন।
গৌতম : হ্যাঁ, ২০০৯ থেকে বা তার কিছু আগে থেকে চলছে ২০১০-এ রেজিষ্ট্রেশন হয়েছে। এতে জসিমুদ্দীনের কাব্য সোজন বাদিয়ার ঘাট, ৫০ জনকে নিয়ে কর্মকাণ্ড, একেবারে বাচ্চারাও অভিনয় করছে। এখানে সারাক্ষণ মঞ্চ জুড়ে আছে এরকমও অনেক বাচ্চা আছে, তারা খুব আনন্দ নিয়ে কাজ করে। আমার ‘’ নয়ে নাটুয়া’তে সারাক্ষণই অভিনয় নিয়ে নিয়ে তার আগের কবিতা প্রস্তুতি নিয়ে কাজ চলে। যেমন তার মধ্যে গান আছে, নাচ আছে, অভিনয় আছে, কবিতা আছে। অভিনয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে চর্চা আছে। এখানে ক্লাস হয়, সেটা বিশেষ কোনো নাটকের রিহার্সাল নয়, সামগ্রিক অভিনয় নিয়ে চর্চা নিয়ে। এবং সেটা প্রতিদিনই হয়। এখানে অনেক ছাত্রছাত্রী আছে, তারা আনন্দ নিয়ে অভিনয়ের কষ্টের কাজগুলো করে। তা না হলে আনন্দ ছাড়া এই অভিনয়ের কাজগুলো করতে পারবে না বা করা যায় না।
স্বাগতা : নাটকের জন্য আপনি কত্থক, ভারতনাট্যম, আধুনিক নৃত্য সবই শিখেছেন…
গৌতম : আসলে এতে দেখেছি অভিনয়ের ক্ষেত্রে লাভই হয়েছে। সব কিছু শিখতে পারলে ভালো, তাতে অভিনয়ের দিকটা অনেকটা ধরা যায় বা ছুঁয়ে দেখা যায়। তবে আমি লয় বা তাল ছাড়া তেমন কোনো ইন্সট্রুমেন্ট বাজাতে পারি না, শুধুমাত্র আমার শরীরটা বাজাতে পারি, মানে অভিনেতা তার শরীরকে যেভাবে বাজায় আর কী (হাসি)! সেটাই চেষ্টা করেছি।
স্বাগতা: নাটক নিয়ে বাইরের দেশে যাচ্ছেন?
ওয়ার্কশপও কি থাকছে তাতে?
গৌতম: হ্যাঁ, একদম ওয়ার্কশপও আছে, সেমিনার আছে আবার পারফরম্যান্সও আছে। এগুলো আছে আগামী প্রায় একমাসেরও বেশি USA এর বিভিন্ন জায়গায়। প্রথমে যাচ্ছি আটলান্টা শহরে, সেখান থেকে যাব ডালাস, তারপর সানফ্রান্সিসকো সহ USAএর বিভিন্ন প্রান্তে। এতে আছে ফয়েদর দস্তয়েভস্কি'র গল্প, মুন্সি প্রেমচাঁদের গল্প আর আছে জসিমুদ্দীনের কাব্য ‘নকশী কাঁথার মাঠ’’। এটা পুরোপুরি মিউজিক্যাল একটা প্রোডাকশন। এই নাটকগুলো কোনওটা পনেরো বছর ধরে চলছে, কোনোটা সাত বছর, কোনোটা আবার দুবছর ধরে চলছে।
স্বাগতা: আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। এতটা সময় জ্বলদর্চিকে দেবার জন্য। ভালো থাকুন, আপনাকে ও আপনার দলকে জ্বলদর্চি পরিবারের পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই।
গৌতম : (হাসি) আপনারাও ভালো থাকুন। শুভেচ্ছা নেবেন।
🍂
0 Comments