জ্বলদর্চি

কেঁউ/ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৯০
কেঁউ

ভাস্করব্রত পতি

'অন সরিষা কাঁকুড় নাড়ি  
যা রে পোক ধানকে ছাড়ি 
এতে আছে শুকতা 
ধান ফলবে মুকতা 
এতে আছে কেঁউ 
ধান হবে সাত বেঁউ 
এতে আছে হলদি 
ধান ফলবে জলদি 
এতে আছে ওল 
মহাদেবের ধ্যান করি, 
বোল হরিবোল'‌। 
এই কেঁউ বা কেউতারা গাছ আমাদের বসতবাটির ধারেকাছে জন্মালেও আমরা এদের চিনিনা। বাংলার অন্যতম এক লৌকিক উৎসব নলসংক্রান্তির সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত এই গাছের নাম ও ব্যবহার। ভূত চতুর্দশীতে যে ১৪ শাক খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে, তার মধ্যে এটি একটি। নলসংক্রন্তির আরও একটি ছড়ায় আছে এই কেঁউ গাছের কথা--
'এতে আছে কেঁউ 
ধান হবে আড়াই বেঁউ 
এতে আছে শুকতা
ধান হবে গজমুক্তা 
এতে আছে ঝোটপাট 
সব পোকার মাথা কাট'।
বৃষ্টিস্নাত কেঁউ গাছ

এটি দক্ষিণ এশিয়া পার্শ্ববর্তী এলাকার উদ্ভিদ। ভারত, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কোস্টারিকা, চিন, মরিশাস, বাংলাদেশ, ফিজি, ইন্দোনেশিয়া, কুইন্সল্যান্ডেও বিস্তৃত। আমাদের রাজ্যে রাস্তার আশেপাশে অযত্নে বেড়ে ওঠে এই গাছ। এছাড়াও নিচু জমি, স্যাঁতসেঁতে জঙ্গল, নদীর ধারে, ছোট ঝোপঝাড় এলাকায় ভালোই জন্মায়। রাইজোম বা কন্দ থেকে এর নতুন গাছ জন্মায়। পাখিরা এই গাছের ফল খেয়ে ফেললে তার মাধ্যমেও এই গাছের বংশবৃদ্ধি ঘটে। 

কেঁউ গাছকে ইংরেজিতে Wild Ginger Plant, Spiral Ginger, Crepe Ginger, Malay Ginger, Cane Reed, Spiral Flag, Insulin Plant ও বলে। সংস্কৃতে কেমুক, হিন্দিতে কেউ, কুষ্ঠা, ওড়িয়ায় কউকউকা, কুষ্ঠা, গুজরাটিতে পেভাটো, মিজো ভাষায় সামবুল, নেপালিতে বেতালাউরি, মারাঠিতে পেভ, মালয়লামে কানাক্কুভা, আনাক্কুভা, তেলুগুতে কাশ্মিরামু, কিমুকা, কোস্টামু, তামিলে কোস্টাম, মনিপুরীতে খোঙবান তাখেলেই, ওকচাক খোম্বি, অসমীয়াতে যম লাখুটি, কন্নড়ে নারী কাব্বু, নায়ি কাব্বু, পুষ্করা, পুষ্করামুলা, পদ্মাপত্র, নীরাজা, চঙ্গলাকোস্টা, চঙ্গলাকোষ্ঠা বলে। চট্টগ্রামের লোকেদের কাছে এটি টিয়াটুই গাছ। একে চেনা যায় Costus speciosus, Cheilocostus speciosus, Amomum arboreum নামে। Costaceae (Spiral Ginger Family) পরিবারের এই গাছটি খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত আদা গাছের সাথে দূরসম্পর্কের মিল রয়েছে। কিছু কিছু উদ্ভিদবিদ অবশ্য এর নতুন বিজ্ঞানসম্মত নামকরণ করেছে Hellenia speciosa নামে। 
কেঁউ গাছ

প্রায় ৪ হাত লম্বা হয়। এর পাতাগুলো সাপের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কুণ্ডলাকারে বিন্যস্ত থাকে। চওড়া পাতা। গ্রীষ্মের শেষের দিকে বা শরতের শুরুতে সাদা সাদা ফুল ফোটে। এগুলি শঙ্কু আকৃতির ব্র্যাক্টে লাল ৪ টি ব্র্যাক্টে তৈরি হয়, প্রতিটি শঙ্কু থেকে বেশ কয়েকটি ২ টি বিশুদ্ধ সাদা কুঁচকে যাওয়া ফুল ফুটতে দেখা যায়। প্রতিটি ফুলের তিনটি আসল পাঁপড়িগুলি অদৃশ্য থাকে, যা ঘণ্টা আকৃতির পুংকেশরচক্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। সাদা ফুলগুলি ঝরে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে, আকর্ষণীয় লাল শঙ্কু আকৃতির ব্র্যাক্টগুলি গাছেই থেকে যায়। 

সাধারণত পেটে ব্যাথা, বদহজম ইত্যাদি হলে এই গাছের মূল থেকে রস বের করে খাওয়া হয়। অনেকটা ইনসুলিন গাছের মতো দেখতে হলেও এটি অবশ্য ইনসুলিন গাছ নয়। কেউ কেউ খেলার ছলে এর বীজ মুখে দিয়ে রাখতো। আর তা জিভের তাপে টাস করে ফুটে উঠতো। এটি একটি ভেষজ উদ্ভিদ। যার শিকড় ও পাতার রস কুকুরের কামড় প্রতিষেধক হিসেবে এবং গাঁটেব্যথা ও কৃমি নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। গাঁটের ব্যথার নিরাময়ে এই গাছের শিকড় ছেঁচে গরম জলের বাষ্পে গরম করে ব্যথার জায়গায় লাগালে গাঁটের ব্যথার উপশম হয়। কৃমি নিরাময়ে এই গাছের মূল বেটে রস করে সকাল বিকেল খেলে কৃমি মারা পড়ে। এর মূলের রস জলের সাথে মিশিয়ে খেলে অগ্নিমান্দ্য বা হজমের সমস্যা কমে। এছাড়াও এর ফুল ও কন্দ থেকে বিভিন্ন ঔষধি গুণ পাওয়া যায়। বাগানের শোভাবর্ধক উদ্ভিদ হিসেবেও লাগানো হয়। বিস্মৃতিনাশক গাছ।
🍂

Post a Comment

0 Comments