জ্বলদর্চি

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি(ষোড়শ পর্ব) /চিত্রা ভট্টাচার্য্য

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি
(ষোড়শ পর্ব)                 
        
চিত্রা ভট্টাচার্য্য

গীতে সঙ্গীতে কবি নজরুল
রাতের আঁধার পেরিয়ে  আলোর তরণী বেয়ে ভোর নামছে ,মিশকালো আকাশের জঠর ভেদ করে ধীরেধীরে আত্মপ্রকাশ করছে টুকটুকে লাল সিঁদুরের গোলার মত রক্তিম সূর্য ,বালার্ক । ঘুম ভাঙা চোখে প্রত্যুষার সে অপরূপ রূপের দিকে তাকিয়ে এক অনির্বচনীয় সুন্দরের স্বর্গে প্রভাবিত হয়ে মন প্রভাতী সূর্যের বন্দনায় গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে----- --    

''তুমি আমার,সকাল বেলার সুর-,.
হৃদয় অলস,উদাস করা,অশ্রু ভারাতুর-,
ভোরের তারার মত তোমার সজল চাওয়ায় 
ভালোবাসার চেয়ে সে যে কান্না পাওয়ায় 
রাত্রি শেষের-,.চাঁদ তুমিগো-,
বিদায় বিধুর-,
 
 আনমনা মনে আনন্দের রেশ বইতে থাকে প্রণতি জানায় নতুন প্রভাত কে ---- 

''অরুণ তুমি তরুণ তুমি,
করুণ তারও চেয়ে-,.
হাসির দেশে,তুমি যেন,বিষাদ লোকের মেয়ে-,
তুমি ইন্দ্র সভার-,মৌন বীণা,.নীরব নূপুর-,''
 --- 
"তুমি আমার সকাল বেলার সুর" এই গানটিতে সর্বযুগের রোম্যান্টিক কবি নজরুল তাঁর  প্রিয়তমাকে  ভোরের স্নিগ্ধতা ও বেদনার সাথে তুলনা করেছেন।  সে যেন ভোরের শিশির ভেজা ফুল, বিদায়বেলার চাঁদ বা নিস্তব্ধ বীণার মতো, যার কাছে ভালোবাসার চেয়েও বেশি চোখে জল আসে, যা হৃদয়কে অলস ও উদাস করে তোলে, কিন্তু তাঁর এই বেদনাও এক প্রকার মধুর।  প্রভাতের  স্নিগ্ধতা, প্রেম এবং বিচ্ছেদের এক করুণ রাগিনী কবি নজরুল তাঁর প্রিয়তমার প্রতি ভালোবাসা এবং এক মিশ্র অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। 
মূলত ভৈরবী রাগের মাধ্যমে আরও বেশি মূর্ত হয়ে উঠেছে কবির ব্যথিত হৃদয়ের প্রেম, বেদনা এবং বিচ্ছেদের এক সুন্দর আবহ ,প্রেমিক কবির হৃদয়ের   সকরুণ নিবেদন ।   

রবীন্দ্র সংগীত এবং নজরুল গীতি শুনেই শৈশব থেকে কৈশোর যৌবনের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আজ বার্ধক্যের প্রান্তসীমায় পৌঁছে অন্তরের এক নিবিড় চাওয়া থেকে সচেষ্ট হয়েছি কবি নজরুলের জীবনী আলোচনায় ,তাঁর অসাধারণ  কাব্য  সংগীত সৃষ্টির সন্ধানে।  তাঁর গানের ভাব ভাষা শব্দ ছন্দ সুর তাল লয় যা কিছু ,সুরহারা গলায় গাইতে না পারলেও গভীর ভালবাসা থেকে এক অনন্ত জিজ্ঞাসার দুঃসাহস নিয়ে মননিবেশ করেছি  তাঁর সংগীত সৃষ্টির অসাধারণ বিস্তৃত জগতে।  
🍂

 
 কিশোরীর স্বপ্নময় চোখে লীন হয়ে থাকা কত যে গান প্রাণবন্ত হয়ে সুরে সুরে লহরী তুলে মনের বালুকা বেলায় আছড়ে পড়ছে তার কুল কিনারা খুঁজে পাইনা।  কোন যুগে সেই বালিকা বয়সে নজরুল গীতির সাথে পরিচয় নিবিড় হয়েছিল স্কুল বা পাড়ার সাংস্কৃতিক বিচিত্রা অনুষ্ঠানে স্টেজে চুমকি বসানো জরির কাজে বাহারি ঘন নীল ওড়না ,ঝিকিমিকি সুতোয় ফুলতোলা রঙিন সিল্কের ঘাগড়া পরনে ইরানী মেয়ের মত সাজে দল বেঁধে স্টেজে উঠে নূপুর পায়ে নাচ। হয়তো সেখানে বড়োরা তখন হারমোনিয়াম ও তবলাসহযোগে ''কাহারবা তালে  '' আহির ভৈরব রাগে গেয়েছিলেন   --- 

''রুম্ ঝুম্ ঝুম্ ঝুম্ রুম্ ঝুম্ ঝুম্
            খেজুর পাতার নূপুর বাজায়ে কে যায়।
ওড়না তাহার ঘূর্ণি হাওয়ায় দোলে
            কুসুম ছড়ায় পথের বালুকায়॥
তাহার ভুরুর ধনুক বেঁকে ওঠে তনুর তলোয়ার,
সে যেতে যেতে ছড়ায় পথে পাথর-কুচির হার।''
                                                                            খেঁজুর পাতার নুপুর বাজায়ে নৃত্যের ছন্দে তালেতালে হাত পা ভালভাবে নাড়তেও শিখিনি ,সেই সময় থেকে নজরুলের শিশুদের জন্য লেখা কত কবিতা,কত গান কেমন করে মনের মাঝে আপন আসনটি বিছিয়ে বসেছিল , গানের কথার মানে বুঝিনি ,শব্দ সম্ভার ও তত স্পষ্ট নয় তবু সে নজরুল গীতির সুরে ছন্দে বালিকা হৃদয়ে অহর্নিশ দোলা দিয়ে যেত। তন্ময় হয়ে সে সুরে গানে অবগাহনের পর হৃদয় যেন অবিরত পেখম মেলে নেচে উঠতো ময়ূরের মত। অদৃশ্য জলের বয়ে যাওয়া সুনীল সাগরের ফিরোজা রঙের তরঙ্গে নিজেই কখন সাঁতরে বেড়াতাম জলপরীর মত।    মনের আয়নায় ভেসে উঠতো অপরূপা জলপরীরা হাতে হাত ধরে অবিরাম জলে সাঁতার কেটে আলোড়ন তুলে খেলায় মত্ত । মধ্য গগনে যুবক সূর্যের কড়া চাহনিতে জলের ঢেউয়ে  ঝিকিমিকি তুলে একরাশ তরল সোনা গড়িয়ে চলেছে।   

''খেলিছে জলদেবী সুনীল সাগর জলে।
তরঙ্গ-লহর তোলে লীলায়িত কুন্তলে॥
ছল-ছল ঊর্মি-নূপুরস্রোত-নীরে বাজে সুমধুর,'---'
                   
অথবা, সেই সুদূরের ,আনমনা সুমন্দ ভাষিনী নিভৃত চারিণী দ্বীপবাসিনী সুন্দরীর মত,  সবুজ পাতার মুকুট মাথায় ,কপাল জুড়ে নেমে আসা গুচ্ছগুচ্ছ কালো চুলের ঢালে বুনো ফুলের মালায় সাজিয়ে নিজেকে কবির দারুচিনি দেশের নিস্বর্গ লোকের কাব্যিক নায়িকা ভাবতে কিশোরী মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।  ---

 দূর দ্বীপবাসিনী  
চিনি তোমারে চিনি
দারুচিনির ও দেশে, তুমি বিদেশিনী গো 
সুমন্দ ভাষিনী
 দূর দ্বীপবাসিনী,  
প্রশান্ত সাগরে, তুফানে ও ঝড়ে
 শুনেছি তোমারি অশান্ত রাগিনী------

 কবি রচিত গানে নিজেকে কল্পিত নায়িকা সাজিয়ে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সুর তুলে দারুচিনির সবুজ বনময় দ্বীপে একাকী পরিভ্রমণ ---
"বাজাও কি বন সুর পাহাড়ি বাঁশিতে
বনান্ত ছেয়ে যায় বাসন্তী হাঁসিতে  
তব কবরী মূলে, নব এলাচেরও ফুল
দোলে কুসুম বিলাসিনী।''

 কবি নজরুলের গান নিয়ে আলোচনায় বসে  বিভিন্ন তথ্যসূত্র অবলম্বনে  জেনেছি  , এই '' দূর দ্বীপবাসিনী ''গানটির মূল সুর কিউবান, যা "কাহারবা" তাল-এ রচিত। এই গানের মাধ্যমে কবি এক দূর দ্বীপের দারুচিনির দেশে বাস করেন সুন্দরী বিদেশিনীর বর্ণনা দিয়ে সেই নারীর রূপকে উপস্থাপন করেছেন। প্রশান্ত সাগরের তুফান ও ঝড়েও যে তার অশান্ত রাগিণী শোনা যায়, এমন এক চিত্রকল্প তিনি ব্যবহার করেছেন।  বনানীর বাসন্তী হাসি, এলাচ ফুল এবং বুনো বাঁশির সুরের মাধ্যমে এক অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের বর্ণনা দিয়েছেন। 

গানে গানে তিনি এক গভীর প্রেমের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, যেখানে তিনি প্রিয়ার প্রতি তার অসীম ভালবাসাকে চিত্রকল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এই গানটি ১৯৩৪ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে লেখা  "গানের মালা" গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত ছিল। নজরুল গবেষকদের মতে বাংলা গানের একটি অমূল্য সম্পদ" দূর দ্বীপবাসিনী গানটি  কবির লেখনীর অন্য্ আরেকটি  চমৎকার চিত্রকল্পময় উদাহরণ, যা কিউবান সুরের সাথে বাংলার ঐতিহ্যকে মিশিয়ে এক অনবদ্য সংগীত সৃষ্টির জগতে মনকে নিবিষ্ট করে ।  

কবির গানে মন ছোটবেলার মত এখনো চঞ্চল হয়ে ওঠে  যখন দেখি হারমনিয়াম বাজিয়ে  কিশোরী মেয়েটি স্টেজে আপন মনে গেয়ে চলেছে
 "খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে॥"
শিশু যেমন তার খেলনা নিয়ে আপন খেয়ালে নানা রকম ভাঙা-গড়ার খেলা খেলে, জগৎস্রষ্টা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে তেমনি আপন খেলায় মগ্ন। এই বিরাট শিশু সঙ্গীহীন, তাই তার খেলা চলে নির্জনে।

ভাঙিছ গড়িছ নিতি ক্ষণে ক্ষণে॥
তারকা রবি শশী খেলনা তব, হে উদাসী,
পড়িয়া আছে রাঙা পায়ের কাছে রাশি রাশি।
            
  এই বিরাট শিশু সঙ্গীহীন, তাই তার খেলা চলে মহাবিশ্বের অনন্ত আকাশ জুড়ে নির্জনে।আপন আনন্দে খেলা বিরমাহীনভাবে তাঁর খেলা চলেছে।  সেখানে মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের সৃষ্টি ও লয়, সুশৃঙ্খল গতিপথ সবই জগৎ স্রষ্টার খেলার অংশ। পরম যত্নের সৃষ্টিই যেন পড়ে থাকে চরম অবহেলায় তাঁর পায়ের কাছে। বিশ্বরাজ তাঁর আপন খেলায় নির্বিকার থাকেন। জাগতিক কোনো সুখ-দুঃখ তাঁকে স্পর্শ করে না। সৃষ্টি এবং ধ্বংসের ভিতর দিয়ে তাঁর লীলা এবং এর ভিতর দিয়ে তিনি বিরাজ করেন সদানন্দ রূপে।
 
 মনেপড়ে কবির আরেকটি  বিখ্যাত গান যা নজরুল উৎসব বড়োদের গাইতে শুনেছি --- 

আমি বনফুল গো
আমি বনফুল গো  
ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে---
বাসন্তিকার কণ্ঠে আমি
 মালিকার ও দুল গো
 বনফুলের মত এক সহজ, ছান্দসিক ও স্বাধীন, আনন্দময় জীবনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন কবি এ গানে। বনের পথের ধারে অযত্নে অবহেলায় ফুঁটে থাকা বনফুল প্রকৃতির অংশ হয়ে তার সাথে মিশে থাকে।এই গানটিতে সেই বনফুলের মতো তিনিও প্রকৃতির অংশ হতে চান। স্বাধীন ও আনন্দময়, প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা এক জীবন কবির কাম্য , যা ছন্দের তালে আনন্দের সাথে দোলে এবং প্রকৃতির সৌন্দর্যকে ধারণ করে।   
  মানুষের সরল, মুক্ত ও আনন্দময় জীবনের প্রতীক হিসেবে বনফুলকে তিনি এখানে উপস্থাপন করেছেন । তিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আনন্দ ও ছন্দ খুঁজে পেতে চান,  বনফুল যেমন প্রকৃতির সাথে ছন্দে বন্ধে আন্দোলিত হয়। বাঁধা বন্ধন হীন ভাবে স্বাধীনতা উপভোগ করে, কবিও তেমনই বন ফুলের এক বাঁধনহারা, স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন দেখেছেন।
 মনে পড়ছে নজরুল গীতির অসংখ্য মন ছুঁয়ে যাওয়া গান ,
১)নয়ন ভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল / ফুল নেবো না অশ্রু নেব ভেবে হই আকুল। 

২)তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সেকি মোর অপরাধ?
চাঁদেরে হেরিয়া কাঁদে চকোরিণী বলে না তো কিছু চাঁদ॥
        
৩)  আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনায়॥
আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি
আমারি তিয়াসী বাসনায়॥  

৪) অঞ্জলি লহ মোর সংগীতে /প্রদীপ শিখা সম কাঁপিছে প্রাণ মম তোমায় ,হে সুন্দর বন্দিতে সংগীতে সংগীতে। 

 পরম সুন্দরের কাছে আত্মনিবেদনের অর্ঘ অর্পণ করেছেন কবি তাঁর চেতনায় বিকশিত হয়ে ওঠে, ভক্তি-প্রেমের কম্পিত শতদল। মনে সংশয় জাগে,তাঁর পরম প্রিয় এ পূজা গ্রহণ করবেন তো ? তাই অর্ঘ নিবেদনে-  সংকোচে জড়ানো কম্পিত বাসনার প্রাণ-প্রদীপ কেঁপে ওঠে বারে বারে পার্থিব দীপ-শিখা'র মতো। এই গানে তিনি তাঁর পরম ভক্তি নিবেদন করেছেন সঙ্গীতাঞ্জলিতে।  কবির দেহ কোন এক অজানা সুখের অনুভূতিতে শিহরণ জাগায়।  যেন কবির গানের বাণী, তাঁর পায়ে ঝরা ফুলের মতো লুটিয়ে পড়ে।

বাংলার সারল্যে ভরা বিশাল জন জীবন যারা শুধুই গান শোনার আনন্দে সুখী যাদের সুর তাল লয় বা গানের ব্যাকরণ বোঝার মানসিকতা নেই বা ভাবার ও অবকাশ নেই , সহজ-সরল ভাষা বোঝার ক্ষমতা টুকু সম্বল করে গানে মুগ্ধ হয় ,তাদের অনুভবী মনের অনুভূতিকে শ্রদ্ধা ও স্মরণ করে কবি সংগীত সৃষ্টির আনন্দ ধারায় মেতে উঠলেন। নজরুলের সহজীয়া ভাষায় সৃষ্টি সংগীতের প্রতি এক অকৃত্রিম আকর্ষণ বোধকরে তাদের ভালোলাগা অনুরাগ প্রকাশ করে এসেছেন। কবি সাধারণ মানুষের আবেগ, কে অনুভব করে সহজ সরল কথায় ছন্দে সংগীতের ডালি অনবরত  ভরে তুলেছেন । ।

সংগীত জীবনে বাণী ও সুরের সাধনায় নজরুল যখন আত্মমগ্ন  , তাও প্রায় তাঁর কাব্য সাহিত্য সাধনার থেকে সময় একযুগ পার হয়ে গিয়েছে। তবে সেই সময়ে তিনি কিছু কবিতা রচনা করলেও সংগীতে সৃষ্টিতেই যেন তাঁর প্রাণের মুক্তি পরম আনন্দের সন্ধান পেয়েছেন। মানুষের অন্তরের সহজ-সরল আবেদন ছিল নজরুল সংগীতের ভাষায়। যে বোঝে এবং যে বোঝে না সুরের রাগ-বৈচিত্র্য, তারও হৃদয়ের ভাষা হতে পেরেছে নজরুল গীতি।
  
ধ্যানমগ্ন কবির কবিতার মতই  বিষয় বৈচিত্র্যে-ও সংগীতভাবনায়  মানুষই ছিল নজরুলের প্রথম  আরাধ্য, ভাব ও ভালোবাসার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু। রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা গানের রসগ্রহীতাদের জন্য নবপ্রেরণার উৎস এবং তৃপ্তিস্থল ছিল নজরুলের বহুমুখী প্রতিভার বিষয় বৈচিত্র্যে পূর্ণ অনবদ্য সৃষ্টির  গান। কবির সৃজন প্রতিভা দিকেদিকে প্রসারিত এবং জন সমাদৃত।  কবির অন্তর থেকে যে তাগিদ জনগণের জন্য অনুভব করেছেন, তাই ই নির্ভার হয়ে তিনি বিলিয়ে  গিয়েছেন। মানুষের অন্তরের সহজ-সরল আবেদন ছিল নজরুলগীতির  ভাষায়।  যার জন্যে সকল শ্রেণির মানুষের কাছে নজরুলসংগীত প্রাণময় ও আদৃত হয়েছে।  

‘জনসাহিত্য সংসদ’ নামে একটি সংস্থার অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে এমন আত্মপ্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন কবি নজরুল ":কাব্য ও সাহিত্যে আমি কী দিয়েছি, জানি না। আমার আবেগে যা এসেছিল তাই আমি সহজভাবে বলেছি।‘আমি যা অনুভব করেছি তাই আমি বলেছি। ওতে আমার কৃত্রিমতা ছিল না। কিন্তু সংগীতে যা দিয়েছি, সে-সম্বন্ধে আজ কোন আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে, ইতিহাস লেখা হবে তখন আমার কথা সবাই স্মরণ করবেন, এ-বিশ্বাস  আমার আছে। সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই। ‘তবে এইটুকু মনে আছে, সংগীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি।’ – (বসু, ২০০০ : ৪৩০)''
সংগীতে ‘কিছু দিতে পারা’র আত্মপ্রত্যয় কাজী নজরুল ইসলামের নিষ্ফল ছিল না। আধুনিক বাংলা গানের জগতে পঞ্চপ্রধান স্তম্ভ -- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), রজনীকান্ত সেন  (১৮৬৫-১৯১০), অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪) এবং সর্বকনিষ্ঠ কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। বিশ শতকের প্রথম চার দশকের মধ্যে এ পঞ্চরত্ন আধুনিক বাংলা গানকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা ছিলেন একাধারে কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ। অগ্রজ রবি ঠাকুরের মতো নজরুল  ও মূলত কবি এবং সংগীতসাধক ছিলেন। সাধনার ফলেই তিনি হতে পেরেছিলেন কালজয়ী সংগীতের বাণী-শিল্পী, সুরকার, সংগীত-পরিচালক ও রাগ-সংগীতের স্রষ্টা।                     
তথ্য সূত্র                               
১)কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলা সাহিত্য। আজিবুল হক। লেখা প্রকাশনী, কলকাতা।
.২) কাজী নজরুল। প্রাণতোষ ভট্টাচার্য। ন্যাশনাল বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড। 
৩). কাজী নজরুল ইসলাম। বসুধা চক্রবর্তী। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ইন্ডিয়া।   
৪). নজরুল জীবনী। অরুণকুমার বসু। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি। জানুয়ারি ২০০০।
৫). নজরুল-জীবনী। রফিকুল ইসলাম। নজরুল ইন্সটিটউট, ঢাকা। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ।
৬). নজরুল রচনা সম্ভার। আব্দুল কাদির সম্পাদিত। ইউনিভার্সল বুক ডিপো। কলিকাতা।                              ও অন্যান্য নজরুল সম্পর্কিত পত্র পত্রিকা।                  ক্রমশঃ

Post a Comment

2 Comments

  1. একরাশ মুগ্ধতা, আপনার বিশ্লেষণ ও লেখার মাধুর্য মন্ত্র মগ্ধের মতো পাঠ করি। কবি নজরুলকে জানার জন্য আপনার লেখা অনবদ্য।

    ReplyDelete
  2. এই প্রবন্ধটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ ও গভীর বিশ্লেষণের এক চমৎকার সংমিশ্রণ, যেখানে লেখিকা চিত্রা ভট্টাচার্য্য কবি নজরুল ইসলামের সঙ্গীতের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক তুলে ধরেছেন, যা কেবল কৈশোরের মুগ্ধতা থেকে পরিণত হয়েছে এক মননশীল ও গভীর ভালোবাসায়। লেখার শুরুতেই তিনি ভোরের সূর্যালোককে ‘টুকটুকে লাল সিঁদুরের গোলার মতো’ বলে যে কাব্যিক চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন, তা কেবল তার নিজস্ব অনুভূতিই প্রকাশ করে না বরং তা পাঠককে নজরুলের গানে প্রকাশিত প্রেম, বিষাদ ও স্নিগ্ধতার এক অন্য জগতে নিয়ে যায়, যেমনটি “তুমি আমার, সকাল বেলার সুর” গানে প্রতিফলিত হয়েছে। এই রচনাটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নজরুলের সৃষ্টিশীলতার বৈচিত্র্য তুলে ধরে, যেখানে "খেলিছে জলদেবী" গানের বালিকা সুলভ আনন্দ থেকে শুরু করে "দূর দ্বীপবাসিনী" গানের রহস্যময় রোম্যান্টিকতা এবং "খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে" গানের দার্শনিক গভীরতা পর্যন্ত প্রতিটি দিকই সুনিপুণভাবে আলোচিত হয়েছে।
    লেখিকার শৈশবের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ, যেমন 'চুমকি বসানো জরির কাজে বাহারি ঘন নীল ওড়না' পরে মঞ্চে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা, কেবল তার নিজস্ব জীবনকে তুলে ধরে না বরং এটি দেখায় কীভাবে নজরুলের গান বাঙালির সংস্কৃতি ও ব্যক্তিজীবনে মিশে গেছে, যা তার বিমূর্ত বিশ্লেষণকে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক করে তোলে। তিনি যখন গানের নির্দিষ্ট রাগ ও তাল (যেমন ভৈরবী, আহির ভৈরব, কাহারবা) নিয়ে আলোচনা করেন, তখন তার লেখাটি কেবল প্রশংসা স্তরে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং তা সঙ্গীতে নজরুলের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও শৈল্পিক গভীরতাকেও প্রকাশ করে, যা গানের আবেগীয় বিষয়বস্তুকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। প্রবন্ধে নজরুলের এই আত্মবিশ্বাসী বক্তব্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, তার সাহিত্যকর্ম ভবিষ্যতে কী মূল্যায়িত হবে তা তিনি না জানলেও সঙ্গীতজগতে তার অবদান অনস্বীকার্য এবং সেই আত্মপ্রত্যয় অসার ছিল না। কারণ তিনি এমন সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন, যা সহজ ভাষায় মানুষের হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে যায়। পরিশেষে, এই অসাধারণ প্রবন্ধটি নজরুলের এক কালজয়ী অবদানকে তুলে ধরেছে, যিনি তার সঙ্গীতের মাধ্যমে মানুষের আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিচ্ছেদ এবং ভক্তির মতো বিবিধ অনুভূতিকে এমনভাবে চিত্রিত করেছেন, যা একইসাথে সুগভীর এবং জনসাধারণের কাছে সহজ ও প্রিয়।

    চন্দন ভট্টাচার্য্য, নোহারী, গড়বেতা, পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত


    ReplyDelete