দূরদেশের লোক গল্প-- ২৫৮
জাঞ্জিবার (আফ্রিকা)
জাদুকর ও রাজার ছেলে
চিন্ময় দাশ
দেশের সুলতানের তিনটি ছেলে। কিন্তু সমস্যা হোল, কিছুতেই তাদের পড়াশোনা করানো যাচ্ছে না। সুলতান আর কী করেন? ঘোষণা করে দিলেন— ছেলেগুলোকে যে লেখাপড়া শেখাতে পারবে, উপযুক্ত পুরষ্কার দেওয়া হবে।
একদিন এক যাদুকর এসে হাজির। বলল—এ আর এমন কী কঠিন কাজ, জাঁহাপনা? আমি পারব। কিন্তু কী পুরষ্কার দেবেন এ জন্য?
সুলতান বলেন-- খাজাঞ্চিখানায় যা আছে আমার, তার অর্ধেক।
যাদুকর বলল—ওতে হবে না।
--আমার এই রাজধানির অর্ধেকটা তোমার।
--ওতেও হবে না।
--তা হলে তুমিই বলো, কী চাও।
--আমি ছেলেদের লিখতে আর পড়তে শিখিয়ে দেব। ফিরিয়ে আনলে, যে কোন দুজনকে আপনি বেছে নেবেন। বাকিজনকে আমি নিয়ে যাবো। একা একা থাকি। কথা বলবার একজন কেউ অন্তত থাকবে আমার।
সুলতান রাজি হয়ে গেলেন। ছেলেদের নিয়ে যাদুকর চলে গেল। হরেক রকম যাদু জানে মানুষটা। মজার মজার খেলা দেখিয়ে মনোযোগী করে তোলে ছেলেগুলোকে। তারই মধ্যে দিয়ে পড়তে আর লিখতে শেখায়।
বেশিদিন সময় লাগল না। তিনটি ছেলেই কোরাণ শরিফ পড়তে পারল। চিঠিপত্র মুসাবিদা করতে পারল। আর বেশি কী চাই? ছেলেদের নিয়ে যাদুকর হাজির হয়ে গেল সুলতানের দরবারে। বলল—নিন, হুজুর। যে কোনও দুজনকে বেছে নিন।
বড় আর মেজো দুজনকে নিলেন সুলতান। ছোট ছেলেটাকে নিয়ে যাদুকর ফিরে এল বাড়িতে।
একা মানুষ হলে কী হবে। বিশাল বাড়ি যাদুকরের। কুঠুরির পর কুঠুরি। সামনে এত্ত বড় উঠোন। সে ছেলেটাকে বলল—এখন থেকে তুমি এ বাড়িতেই থাকবে। এই নাও চাবির গোছা। যে কোনও একটা ঘর খুলে ঢুকে পড়ো। আমি একটু বের হচ্ছি। ফিরে আসতে দু-একদিন সময় লাগবে। খাবার-দাবার সব আছে। কোন অসুবিধা হবে না তোমার।
ছেলেটা ভাবল, একটা মানুষ। এতগুলো ঘর কী কাজে লাগে তার? হাতে চাবির গোছা। ঘরগুলো খুলে দেখতে গেল ছেলেটা। প্রথম যেটা খুলল, গামলা গামলা তরল সোনা সে ঘরে।
তাদের নিজেদের প্রাসাদেও এত সোনা নাই। কৌতুহলে আঙুল ডুবিয়ে পরখ করতে গেল ছেলেটা। কী ঝামেলা। সোনা জড়িয়ে গেছে আঙুলে। কিছুতেই ছাড়ানো যায় না। কী আর করে? নিজের পোষাক ছিঁড়ে জড়িয়ে নিল আঙুলে।
পরের দিনই যাদুকর ফিরে এসেছে। জিজ্ঞেস করল—তোমার আঙুলে কী হোল?
ছেলেটা তাড়াতাড়ি বলল—একটু কেটে গেছে। ও কিছু নয়।
পরের দিনই আবার বেরিয়ে গেল যাদুকর। বলল—আজ একটা ভোজসভা হবে বাড়িতে। বন্ধুবান্ধদের নেমন্তন্ন করে আসি। তুমি বাড়িতেই থাকো।
চাবির গোছা নিয়ে বাকি ঘরগুলো দেখতে শুরু করল ছেলে। আবার অবাক হওয়ার পালা। প্রথম ঘরটা ছাগলের হাড়গোড়ে ভরা। পরেরটায় ভেড়ার হাড়গোড়। এইভাবে পর পর ষাঁড়, গাধা আর ঘোড়ার হাড়গোড়। পরের ঘরটা খুলে দেখা গেল সেটা ভর্তি মানুষের হাড়গোড়ে।
ছেলেটার মাথায় কিছু ঢুকছে না। তার পরের ঘরটা খুলে দেখল, একটা জ্যান্ত ঘোড়া। ঘোড়া বলল—আরে, তুমি কে? কোথা থেকে এলে এখানে। এলেই বা কেন?
--এলাম কেন, মানে? এটা আমার বাবার বাড়ি।
--বাহ, সৌভাগ্যবান বলতে হয় তোমাকে। এমন একজনকে বাবা পেয়েছ।
ছেলেটা জানতে চাইল—মানে? কী বলছ তুমি?
--আমি কেন বলতে যাব? নিজের চোখে ঘরগুলো দেখে এসো। সব বুঝতে পারবে। যারাই এই ঘরে এসেছে, সব চিবিয়ে খেয়েছে লোকটা। এখন হাড়গোড়গুলোই পড়ে আছে কেবল।
মুখে কথা জোগাচ্ছে না ছেলেটার। ঘোড়া বলল—এই মূহুর্তে এ বাড়িতে তুমি আর আমি, জ্যান্ত বলতে এই দুজন। দু’-একদিন পরে আমরাও থাকব না। আমাদের হাড়গোড়গুলো অবশ্য থাকবে। কিন্তু জাদুকর লোকটা কোথায়?
ছেলেটা বলল—আজ নাকি ভোজসভা। নেমন্তন্ন করতে বেরিয়েছে।
ঘোড়া বলল—সর্বনাশ। আজই আমাদের যে কোনও একজনের শেষ দিন।
বুকের ভেতরটা ধকধক করছে ছেলেটার। বলল—এখন উপায় কী তাহলে?
--আগে আমার বাঁধন খোল। চলো প্রথম ঘরটাতে যাই। তাড়াতাড়ি করো।
ঘোড়ার বাঁধন খোলা হোল। দুজনে প্রথম ঘরে গিয়ে ঢুকল। সোনাভর্তি গামলা সব। একটাতে মুখ ডুবিয়ে দিল ঘোড়া। চোঁ-চোঁ করে, তরল সোনা গিলে নিল পেট ভরে। বলল—কিছু কথা বলছি। মন দিয়ে শোন। যা বলছি ঠিকঠাক করতে হবে কিন্তু। নইলে, আজই প্রাণটি যাবে।
কিছু কথা বুঝিয়ে দিয়ে, ঘোড়া বলল—আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। খানিক দূরে বড় একটা গাছ আছে। আমি তার আড়ালে লুকিয়ে থাকব। তুমি পৌঁছে যেও। কাজ শেষ হলেই, বেরিয়ে পড়তে হবে তোমাকে। নিমন্ত্রিতরা আসবার আগেই কিন্তু।
কী হতে যাচ্ছে, কী করতে হবে, বুঝিয়ে দিয়ে ঘোড়া চলে গেল।
দুপুর গড়াতে না গড়াতে, যাদুকর ফিরে এলো। ছেলেকে বলল—বিকেলে রান্নাবান্না আছে। চলো, জ্বালানি জোগাড় করে আনি।
পুরো ছকটা ঘোড়া বুঝিয়ে গেছে তাকে। ছেলে বলল—এসব কাজ আমি জানি না।
যাদুকর নিজেই গেল জ্বালানি আনতে। ফিরে এসে, বড় একটা ডেকচি উনুনে চাপিয়ে, ছেলেকে বলল—এবার আগুন ধরাও উনুনে।
--আগুন ধরাবার কাজ কি আমি জানি না কি? পারব কী করে?
যাদুকর নিজেই আগুন জ্বালাতে বসল। আগুন গনগনে হয়ে উঠলে, বলল—এক গামলা মাখন আছে ঘরে। ওটা ঢেলে দাও ডেকচিতে।
--আমি কি শিখেছি না কি এ কাজ? পারব কী করে?
যাদুকর নিজে মাখনের গামলা এনে ডেকচিতে ঢেলে দিল। এবার একটা টুল এনে রেখেছে উনুনের পাশে। বলল—এবার উঠে পড়ো এটাতে। ভোজের আগে একটু নাচ না হলে চলে। নাচো মনের আনন্দে।
উনুনে ততক্ষণে মাখন ফুটছে টগবগ করে। ফন্দিটা বুঝতে বাকি রইল না ছেলের। সে নিরীহ মুখ করে বলল—কী যে বলেন আপনি, আব্বা। এ নাচ আমি জানি না কি? আপনিও তো শেখাননি। আপনি একটু দেখিয়ে দিন। আমি ঠিক পেরে যাবো। চিন্তা করবেন না।
যাদুকর উঠে দাঁড়িয়েছে টুলের ওপর। নাচ শুরু করার ফুরসৎটুকুও হল না ধূর্তটার। পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে ছেলেটা। অমনি ঝপাং। ফুটন্ত মাখনের মধ্যে পড়ে গেল যাদুকর।
এক মূহুর্তও দেরি নয় আর। নেমন্তন্ন খাওয়ার লোকজন আসা শুরু হয়ে যাবে এক্ষুণি। ছুট – ছুট – ছুট। রাস্তার মোড়ে পৌঁছেছে। বুড়ো গাছটার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে ঘোড়া। ছেলেটা হাসছে, মানে কাজ শেষ। খেল খতম হয়ে গেছে বদমায়েসটার।
ঘোড়া বলল—এবার নিশ্চিন্ত। দাও লাফ। পিঠে চড়ে বসো আমার। সরে পড়া যাক এখান থেকে।
এদিকে হয়েছে কী, লোকজন এসে গেল যাদুকরের বাড়িতে। কিন্তু গৃহকর্তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এদিকে নাই, ওদিকে নাই। কোত্থাও নাই মানুষটা। এদিকে খিদেও লেগেছে সবার। ডেকচি তো চাপানোই ছিল উনুনে। গামলা ভর্তি স্টুও তৈরি। ভাগ বাঁটোয়ারা করে খেয়ে নিল সকলে। লম্বা লম্বা ঢেকুর তুলতে তুলতে বাড়ির পথ ধরল সকলে।
ওদিকে ঘোড়া আর ছেলেটা অনেকটা পথ পেরিয়ে, একটা বড় শহর দেখে থেমে পড়ল। ছেলেটা বলল— বেশ তো শহরটা। একটা বাড়ি বানিয়ে, এখানেই থেকে যাই, এসো।
ঘোড়া বলল— সেই ভালো। কত আর ঘুরে বেডাবে?
যতটা সোনা গিলে এনেছিল ঘোড়া, সব উগরে দিল। অগাধ অর্থ এল সোনা বেচে। বিশাল অট্টালিকা, দামি দামি আসবাবপত্র, চাকর-বাকর, লোকলস্কর, খামারে হাজার হাজার ছাগল-ভেড়া নিয়ে জমিয়ে বসল ছেলেটা।
এমন একটা ব্যাপার সচরাচর ঘটে না। গুপ্তচরেরা গিয়ে সে দেশের সুলতানের কানে তুলে দিল ব্যাপারটা। তিনি বললেন—বলো কী হে?
--হ্যাঁ, হুজুর। বেশ কেউকেটা কেউ একজন হবে।
--তাহলে তো একবার কথা বলে দেখতে হয়।
--ঠিক বলেছেন আপনি। নিজের চোখে দেখাই ভালো।
সুলতান বললেন—তুমি গিয়ে খবর দিয়ে এসো। কালই যেন দরবারে এসে দেখা করে।
এক পেয়েদা এসে ছেলেটাকে খবর দিয়ে গেল— স্বয়ং সুলতান ডেকেছেন। কালই দরবারে পৌঁছে যাবেন।
ছেলেটা তো আকাশ থেকে পড়ল। রাজ্যের সুলতান বলে কথা! আমার মতো একজনকে তিনি এত্তেলা পাঠালেন কেন?
ঘোড়া বলল—একেবারেই ঘাবড়ে যেও না। উদাসিন ভাবে কথা বোল। তাতে ভালোই হবে তোমার। তাছাড়া, আমি তো থাকব সাথে। চিন্তা কোর না কিছু।
এই ঘোড়ার জন্য প্রাণ বেঁচেছে তার। এত যে আজ ধনসম্পদ, লোকলস্কর—সবই তো এই ঘোড়ার দৌলতে। তার মতো হিতৈষীর কথা অবহেলা করা যায় না। মাথা নেড়ে দিল ছেলেটা।
দরবারে পৌঁছতে, সুলতান চেয়ে দেখলেন। দেখা তো নয়। আগাপাশতলা জরীপ করে নিলেন ছেলেটাকে। বললেন—কে তুমি? পরিচয় জানতে পারি?
লম্বা করে একটা সেলাম ঠুকে দিল ছেলেটা। বলল—আমি আবার কে, হুজুর? আর পাঁচজন সাধারণ প্রজারই একজন।
--- কিন্তু তুমি এলে কোথা থেকে?
--নির্দিষ্ট কোথাও থেকে তো নয়। ঘুরে ঘুরে বেড়াই। কোথাও ভালো লেগে যায় যদি কখনো, থেকেও যেতে পারি।
সুলতানের মাথায় চিড়িক করে উঠল। --ওহ, আল্লা। আপনি মেহেরবান। এমন সৌভাগ্য কি হবে আমার?
ছেলেকে বললেন--তাহলে, আমার রাজ্যেই থেকে যাও। ঘুরে বেড়িয়ে লাভ কী? কোথাও একটা থিতু হও। ঘর-সংসার করো। জীবনের স্বাদ বদলে যাবে।
ছেলেটার গলায় সেই উদাসীন ভাব— দেশটা কেমন, দেখে নিই কয়েকদিন।
--তাহলে, কাল এই প্রাসাদে তোমার নেমন্তন্ন রইলো। আমাকে দিয়েই দেশ দেখা শুরু হোক তোমার। কাল আসবে কিন্তু।
ফেরার পথে ঘোড়া বলল—কপাল খুলে যাচ্ছে তোমার। কাল সুলতান যা বলবেন, মাথা নেড়ে দিও। না কোর না।
পরের দিন। এলাহি খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন। অনেক আদর আপ্যায়ন। আহার, বিশ্রাম সব সেরে, ফিরছে যখন, ছেলে বলল—কই, সুলতান তো তেমন কিছু বলেন নি?
--ব্যস্ত হয়ো না। সবুরে মেওয়া ফলে, জানো না? সবে কুঁড়ি এসেছে। ফুল ফুটুক। ফল ধরুক। সে ফল পুরুষ্টু হোক, তবে না?
এদিকে সুলতানের প্রাসাদে হুলুস্থুলু। একটিই মেয়ে সুলতানের। তাঁর বুকের ধন। নয়নের মণি। পর্দার পেছন থেকে ছেলেকে দেখেছে সে মেয়ে। ছেলেটিও তো এক সুলতানেরই ছেলে। যেমন যুবক বয়স, তেমনই সুন্দর আর সুপুরুষ।
ভোজসভা সেরে সবে ভেতরে ঢুকেছেন সুলতান। আদরের কন্যাটি এসে গলা জড়িয়ে ধরল—আব্বাজান, এই ছেলেকে আমি শাদি করব।
সুলতান তো আহ্লাদে আটখানা। তাঁর মনের ভাবনা, মুখের কথাটি কেড়ে নিয়েছে মেয়ে। নিজেই বলে দিয়েছে।
মেয়ের আবদার কি আর ফেলা যায়। ধুমধাম করে শাদি হয়ে গেল দুজনের। রাজ্যশুদ্ধ লোক ভোজ খেল কবজি ডুবিয়ে।
ওহো, বলা হয়নি। বিয়ের আসরের আগে, বাবাকে খবর পাঠিয়েছিল ছেলে। নিজের বেগম, দুই ছেলে, তাদের বিবি-- সবাইকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন সুলতান। আট-দশ দিন পরে, যখন তাঁদের ফেরার আয়োজন হচ্ছে, বেয়াই সুলতান এসে বললেন—একটি আর্জি ছিল আমাদের। তিনি হেসে বললেন—বলুন, শুনি কী আর্জি।
--সন্তান বলতে একটিই তো মেয়ে আমার। ছেলে নাই। এদিকে বয়সও হচ্ছে। এ রাজ্য কার হাতে দিয়ে যাবো? আমি মেয়ে দিয়েছি। আপনি ছেলেটিকে দিন আমাকে। তাকে বসিয়ে, চলুন, আমরা দুটিতে হজ্বে চলে যাই নিশ্চিন্তে।
এ কথার উপর কথা চলে না। সম্মতি দিয়ে, নিজের রাজ্যে ফিরে গেলেন সুলতান।
0 Comments