শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ
প্রসূন কাঞ্জিলাল
প্রায় ২৫ বছর আগে, আজকের দিনেই (১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১) আমেরিকা সবচেয়ে ভয়াবহ ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হয়েছিল। ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা বিমান ছিনতাই করে বিশ্বখ্যাত টুইন টাওয়ারে বিধ্বস্ত করে, যা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটিকে হতবাক করে এবং কাঁপিয়ে তোলে। সমগ্র বিশ্ব এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় শোকাহত হয়। ভারতীয় হিসেবে আমরাও শোকাহত হই। কিন্তু পাশাপাশি ভারতীয় হিসেবে, এই বিশেষ দিনে আমাদের গর্ব করার মতোও কিছু আছে।
১১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ স্বামী বিবেকানন্দ ঐতিহাসিক বক্তৃতা প্রদান করলেন যেদিন টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলা হয়েছিল, ঠিক সেই দিনই, কিন্তু আজ থেকে ১৩২ বছর আগে, ভারতের একজন সন্ন্যাসী এক মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা দিয়েছিলেন যা পশ্চিমিদের চোখে ভারতের ধারণাকে বদলে দিয়েছিল। আমরা ভারতের হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের কথাই বলছি!
'আমেরিকার বোন ও ভাইয়েরা!'
১৮৯৩ সালে ধর্ম সংসদ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক এই অনুষ্ঠানে স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। স্বামীজির জন্য এটি ছিল এক উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত কারণ তিনি এত গুরুত্বপূর্ণ সভায় এত বিশাল সমাবেশে এর আগে কখনও ভাষণ দেননি। স্বামীজি যখন মঞ্চে উঠে "আমেরিকার ভাই ও বোনেরা" এই কথাগুলি উচ্চারণ করেন, তখন তিনি দুই মিনিট ধরে প্রচণ্ড করতালির মধ্য দিয়ে যান!
ভারতের ইতিহাসে কখনও কোনও রাষ্ট্রদূত এত উজ্জ্বল প্রশংসা পেতে পারেননি, তাও বিদেশের মাটিতে! ঠিক সেই মুহূর্তেই একজন বীরের আবির্ভাব ঘটেছিল যিনি ভারতের লুকানো জ্ঞানকে বের করে এনেছিলেন এবং মানবজাতির কাছে তা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন, বিদেশের মাটিতে!
ভাষণটি হলো : --
আমেরিকার ভাই ও বোনেরা, তুমি আমাদের যে উষ্ণ ও আন্তরিক অভ্যর্থনা জানাচ্ছ, তার প্রতি সাড়া দিতে আমার হৃদয় অবর্ণনীয় আনন্দে ভরে ওঠে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ভিক্ষুদের নামে আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাই; মায়ের নামে আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাই।
আজ থেকে প্রায় ১৩২ বছর আগে ১১ই সেপ্টেম্বর ১৮৯৩ সালে শিকাগোর ধর্মসভার প্রথম দিনে বক্তৃতায় উঠৈ দাঁড়িয়েছিলেন মাত্র ৩১ বছরের বাঙালি স্বামী বিবেকানন্দ। ধর্মসভার সবচেয়ে তরুণ এই বক্তাকে দেখে সন্ধিগ্ন হয়েছিলেন অনেকেই । তার মধ্যে ছিলেন দু'জন বাঙালি যারা এই তরুণের অস্তিত্বকে সহ্য করতে পারেন নি। কিন্তু প্রথম দিনের এই বক্তা তাঁর মাত্র বারো মিনিটের ভাষণে জয় করে নিলেন পুরো সভাটাকেই । প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে চলেছিল হাততালি তাঁর বক্তব্যের সম্মানে ।
কি এমন বলেছিলেন এই তরুণ তাঁর ঝরঝরে ইংরাজিতে ? যিনি কলকাতার স্কুলের ইংরেজি শিক্ষকের পদ থেকে বিতাড়িতও হয়েছিলেন ছাত্রদের অভিযোগে...
এই তরুণ সন্ন্যাসী প্রথমেই শুরু করেছিলেন উপনিষদের একটি কথাকে কেন্দ্র করে... "বসুধৈব কুটুম্বকম্" । সারা পৃথিবী আমার আত্মীয়। তিনি বলেছিলেন."......যে ধর্ম বিশ্বকে সহিষ্ণুতা ও সর্বধর্মের প্রতি শ্রদ্ধার আদর্শ শিখিয়েছে, আমি সেই ধর্মের লোক বলে গর্বিত। যে জাতি বিশ্বের সমস্ত জাতি ও ধর্মের নির্বাসিত ও আশ্রয়প্রার্থী মানুষদের আশ্রয় দান করেছে, আমি সেই জাতির মানুষ বলে গর্বিত। আমি একথা আপনাদের বলে গর্ব বোধ করছি যে, ইহুদী জাতির সেই পবিত্রতম বংশধরদের আমরা আমাদের দেশের বুকে আশ্রয় করেছি, যাদের যে বছর রোমের অত্যাচারে তাদের পবিত্র ধর্মমন্দির ভূমিস্যাত হয়েছিলো, সে বছর তারা তাদের দেশ থেকে এসে দক্ষিণ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলো। যে ধর্ম মহান জরাথুষ্ট্রের শেষ অনুগামীর আশ্রয় দান করেছিলো এবং এখনও তাদের লালনপালন করছে, আমি সেই ধর্মের লোক বলে গর্বিত। "
আজ সেই ঐতিহাসিক ১১ই সেপ্টেম্বর শিকাগো ধর্ম-মহাসভায় স্বামীজীর ভাষণ। ১৮৯৩, ১১ই সেপ্টেম্বর শিকাগো ধর্ম-মহাসভার প্রথম দিবসের অধিবেশনে সভাপতি কার্তিন্যল গিবন্স্ত শ্রোতৃমণ্ডলীর নিকট পরিচয় করিয়ে দিলে, অভ্যর্থনার উত্তরে স্বামীজী বলেনঃ
হে আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ, আজ আপনারা আমাদিগকে যে আন্তরিক ও সাদর অভ্যর্থনা করিয়াছেন, তাহার উত্তর দিবার জন্য উঠিতে গিয়া আমার হৃদয় অনিবর্চনীয় আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে। পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন সন্ন্যাসী-সমাজের পক্ষ হইতে আমি আপনাদিগকে ধন্যবাদ জানাইতেছি। সর্বধর্মের যিনি প্রসূতি-স্বরূপ, তাঁহার নামে আমি আপনাদিগকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি। সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের অন্তর্গত কোটি কোটি হিন্দু নরনারীর হইয়া আমি আপনাদিগকে ধন্যবাদ দিতেছি।
এই সভামঞ্চে সেই কয়েকজন বক্তাকেও আমি ধন্যবাদ জানাই, যাঁহারা প্রাচ্যদেশীয় প্রতিনিধিদের সম্বন্ধে এরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিলেন যে, অতি দূরদেশবাসী জাতিসমূহের মধ্য হইতে যাঁহারা এখানে সমাগত হইয়াছেন, তাঁহারাও বিভিন্ন দেশে পরধর্মসহিষ্ণুতার ভাব প্রচারের গৌরব দাবি করিতে পারেন। যে ধর্ম জগৎকে চিরকাল পরমতসহিষ্ণুতা ও সর্বাধিক মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়া আসিতেছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকেই সহ্য করিনা, সকল ধর্মকেই আমরা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করি। যে ধর্মের পবিত্র সংস্কৃত ভষায় ইংরেজী ‘এক্সক্লুশন’ (ভবার্থঃ বহিষ্হকরণ, পরিবর্জন) শব্দটি অনুবাদ করা যায় না, অমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া গর্ব অনুভব করি। যে জাতি পৃথিবীর সকল ধর্মের ও সকল জাতির নিপীড়িত ও আশ্রয়প্রার্থী জনগণকে চিরকাল আশ্রয় দিয়া আসিয়াছে, আমি সেই জাতির অর্ন্তভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমি আপনাদের এ-কথা বলিতে গর্ব অনুভব করিতেছি যে, আমরাই ইহুদীদের খাঁটি বংশধরগণের অবশিষ্ট অংশকে সাদরে হৃদয়ে ধারণ করিয়া রাখিয়াছি; যে বৎসর রোমানদের ভয়ংঙ্কর উৎপীড়নে তাহদের পবিত্র মন্দির বিধ্বস্ত হয়, সেই বৎসরই তাহারা দক্ষিণভারতে আমাদের মধ্যে আশ্রয়লাভের জন্য আসিয়াছিল। জরথুষ্ট্রের অনুগামী মহান্ পারসীক জাতির অবশিষ্টাংশকে যে ধর্মাবলম্বিগণ আশ্রয় দান করিয়াছিল এবং আজ পর্যন্ত যাহারা তাঁহাদিগকে প্রতিপালন করিতেছে, আমি তাঁহাদেরই অন্তর্ভুক্ত। কোটি কোটি নরনারী যে-স্তোত্রটি প্রতিদিন পাঠ করেন, যে স্তবটি আমি শৈশব হইতে আবৃত্তি করিয়া আসিতেছি, তাহারই কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করিয়া আমি আপনাদের নিকট বলিতেছি --
‘রুচীনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিলনানাপথজুষাং। নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব।।‘
🍂
বিভিন্ন নদীর উৎস বিভিন্ন স্থানে, কিন্তু তাহারা সকলে যেমন এক সমুদ্রে তাহাদের জলরাশি ঢালিয়া মিলাইয়া দেয়, তেমনি হে ভগবান্, নিজ নিজ রুচির বৈচিত্র্যবশতঃ সরল ও কুটিল নানা পথে যাহারা চলিয়াছে, তুমিই তাহাদের সকলের একমাত্র লক্ষ্য।
পৃথিবীতে এযাবৎ অনুষ্ঠিত সন্মেলনগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাসন্মেলন এই ধর্ম-মহাসভা গীতা-প্রচারিত সেই অপূর্ব মতেরেই সত্যতা প্রতিপন্ন করিতেছি, সেই বাণীই ঘোষণা করিতেছিঃ ‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্। মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।’–যে যে-ভাব আশ্রয় করিয়া আসুক না কেন, আমি তাহাকে সেই ভাবেই অনুগ্রহ করিয়া থাকি। হে অর্জুন মনুষ্যগণ সর্বতোভাবে আমার পথেই চলিয়া থাকে।
সাম্পদায়িকতা, গোঁড়ামি ও এগুলির ভয়াবহ ফলস্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল অধিকার করিয়া রাখিয়াছে। ইহারা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করিয়াছে, বরাবার ইহাকে নরশোণিতে সিক্ত করিয়াছে, সভ্যতা ধ্বংস করিয়াছে এবং সমগ্র জাতিকে হতাশায় মগ্ন করিয়াছে। এই-সকল ভীষণ পিশাচগুলি যদি না থাকিত, তাহা হইলে মানবসমাজ আজ পূর্বাপেক্ষা অনেক উন্নত হইত। তবে ইহাদের মৃত্যুকাল উপস্থিত; এবং আমি সর্বতোভাবে আশা করি, এই ধর্ম-মহাসমিতির সন্মানার্থ আজ যে ঘন্টাধ্বনি নিনাদিত হইয়াছে, তাহাই সর্ববিধ ধর্মোন্মত্ততা, তরবারি অথবা লিখনীমুখে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রকার নির্যাতন এবং একই লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর ব্যক্তিগণের মধ্যে সর্ববিধ অসদ্ভাবের সম্পূর্ণ অবসানের বার্তা ঘোষণা করুক।
ইতিহাসের তথ্য থেকে জানা যায় যে রোম সম্রাট নীরোর রাজত্ব কালে ৭০ খৃষ্টাব্দে টাইটাস কর্তৃক জেরুজালেম বিধ্বস্ত হলে ইহুদীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যায় এবং তাদের একটি অংশ দক্ষিণ ভারতে বসবাস করতে
থাকে। অন্য সব দেশে ইহুদীদের উপর অত্যাচার হলেও ভারতে তাদের ওপর নির্যাতন তো হয়েই নি বরং তারা ধর্মগত বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে শান্তিতে বসবাস করছে। ইতিহাসের তথ্য থেকে এটাও জানা যায় যে খৃষ্টীয় সপ্তম শতকে আরবরা পারশ্য আক্রমন করলে বহু সংখ্যক পারসীক তাদের ধর্ম রক্ষার উদ্দেশ্য ভারতে এসে আশ্রয় নেয়। আজও তারা বিনা বাধায় নিজেদের মূল ধর্ম বজায় রেখে শান্তিতে বসবাস করছে।
স্বামীজি এরপর বলেন - " যারা সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মগত গোঁড়ামিতে পৃথিবীকে হিংসায় পরিপূর্ণ করে চলেছে, বারবার মানুষের রক্তে পৃথিবীকে সিক্ত করে চলেছে, সভ্যতাকে ধ্বংস করছে-সেইসব ভয়ঙ্কর দানবগুলো যদি না থাকতো তাহলে মানব সমাজ বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশী উন্নত হত...."।
প্রথমদিনের শেষভাগে স্বামীজি তুলেছেন কুপমন্ডুকতার প্রশ্ন। সেই কুয়োর ব্যাঙ ও সমুদ্রের ব্যাঙের গল্পের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন যে আমরা হিন্দু বা মুসলিম বা খ্রীষ্টান, সবাই যে যার ধর্মের কুয়োর মধ্যে রয়েছি। তাই তিনি আমেরিকা বাসীদের বলেছেন"... আপনারা আমাদের এই ক্ষুদ্র জগতের বাধা ভেঙে ফেলবার জন্য যে মহান প্রচেষ্টা করে চলেছেন, তার জন্যে আমাকে আপনাদের ধন্যবাদ দিতেই হবে।.......।"
এরপর স্বামী বিবেকানন্দ এই ধর্মসভার শেষদিন, অর্থাৎ ৩০শে সেপ্টেম্বর ১৮৯৩ অবধি আরও চারটি দীর্ঘ ভাষনে সমস্ত আমেরিকা বাসীর শ্রদ্ধার পাত্র হন ও তাঁর ধর্মের পথে যাত্রার পথ প্রশস্ত হয়।
2 Comments
*আজ ১১ সেপ্টেম্বর স্মরণে*
ReplyDelete🙏🙏🙏
*শিকাগো ধর্ম-মহাসভায় স্বামীজীর ভাষণ*
_১৮৯৩, ১১ই সেপ্টেম্বর শিকাগো ধর্ম-মহাসভার প্রথম দিবসের অধিবেশনে সভাপতি কার্তিন্যল গিবন্স্ত শ্রোতৃমণ্ডলীর নিকট পরিচয় করিয়ে দিলে, অভ্যর্থনার উত্তরে স্বামীজী বলেনঃ_
*হে আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ, আজ আপনারা আমাদিগকে যে আন্তরিক ও সাদর অভ্যর্থনা করিয়াছেন, তাহার উত্তর দিবার জন্য উঠিতে গিয়া আমার হৃদয় অনিবর্চনীয় আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে। পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন সন্ন্যাসী-সমাজের পক্ষ হইতে আমি আপনাদিগকে ধন্যবাদ জানাইতেছি। সর্বধর্মের যিনি প্রসূতি-স্বরূপ, তাঁহার নামে আমি আপনাদিগকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি। সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের অন্তর্গত কোটি কোটি হিন্দু নরনারীর হইয়া আমি আপনাদিগকে ধন্যবাদ দিতেছি।*
এই সভামঞ্চে সেই কয়েকজন বক্তাকেও আমি ধন্যবাদ জানাই, যাঁহারা প্রাচ্যদেশীয় প্রতিনিধিদের সম্বন্ধে এরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিলেন যে, অতি দূরদেশবাসী জাতিসমূহের মধ্য হইতে যাঁহারা এখানে সমাগত হইয়াছেন, তাঁহারাও বিভিন্ন দেশে পরধর্মসহিষ্ণুতার ভাব প্রচারের গৌরব দাবি করিতে পারেন। *যে ধর্ম জগৎকে চিরকাল পরমতসহিষ্ণুতা ও সর্বাধিক মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়া আসিতেছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকেই সহ্য করিনা, সকল ধর্মকেই আমরা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করি। যে ধর্মের পবিত্র সংস্কৃত ভষায় ইংরেজী ‘এক্সক্লুশন’ (ভবার্থঃ বহিষ্হকরণ, পরিবর্জন) শব্দটি অনুবাদ করা যায় না, অমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া গর্ব অনুভব করি। যে জাতি পৃথিবীর সকল ধর্মের ও সকল জাতির নিপীড়িত ও আশ্রয়প্রার্থী জনগণকে চিরকাল আশ্রয় দিয়া আসিয়াছে, আমি সেই জাতির অর্ন্তভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি।*
_আমি আপনাদের এ-কথা বলিতে গর্ব অনুভব করিতেছি যে, আমরাই ইহুদীদের খাঁটি বংশধরগণের অবশিষ্ট অংশকে সাদরে হৃদয়ে ধারণ করিয়া রাখিয়াছি; যে বৎসর রোমানদের ভয়ংঙ্কর উৎপীড়নে তাহদের পবিত্র মন্দির বিধ্বস্ত হয়, সেই বৎসরই তাহারা দক্ষিণভারতে আমাদের মধ্যে আশ্রয়লাভের জন্য আসিয়াছিল। জরথুষ্ট্রের অনুগামী মহান্ পারসীক জাতির অবশিষ্টাংশকে যে ধর্মাবলম্বিগণ আশ্রয় দান করিয়াছিল এবং আজ পর্যন্ত যাহারা তাঁহাদিগকে প্রতিপালন করিতেছে, আমি তাঁহাদেরই অন্তর্ভুক্ত। কোটি কোটি নরনারী যে-স্তোত্রটি প্রতিদিন পাঠ করেন, যে স্তবটি আমি শৈশব হইতে আবৃত্তি করিয়া আসিতেছি, তাহারই কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করিয়া আমি আপনাদের নিকট বলিতেছিঃ ‘রুচীনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিলনানাপথজুষাং। নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব।।‘১_
*বিভিন্ন নদীর উৎস বিভিন্ন স্থানে, কিন্তু তাহারা সকলে যেমন এক সমুদ্রে তাহাদের জলরাশি ঢালিয়া মিলাইয়া দেয়, তেমনি হে ভগবান্, নিজ নিজ রুচির বৈচিত্র্যবশতঃ সরল ও কুটিল নানা পথে যাহারা চলিয়াছে, তুমিই তাহাদের সকলের একমাত্র লক্ষ্য।*
পৃথিবীতে এযাবৎ অনুষ্ঠিত সন্মেলনগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাসন্মেলন *এই ধর্ম-মহাসভা গীতা-প্রচারিত সেই অপূর্ব মতেরেই সত্যতা প্রতিপন্ন করিতেছি, সেই বাণীই ঘোষণা করিতেছিঃ ‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্। মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।’–যে যে-ভাব আশ্রয় করিয়া আসুক না কেন, আমি তাহাকে সেই ভাবেই অনুগ্রহ করিয়া থাকি। হে অর্জুন মনুষ্যগণ সর্বতোভাবে আমার পথেই চলিয়া থাকে।*
_সাম্পদায়িকতা, গোঁড়ামি ও এগুলির ভয়াবহ ফলস্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল অধিকার করিয়া রাখিয়াছে। ইহারা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করিয়াছে, বারবার ইহাকে নরশোণিতে সিক্ত করিয়াছে, সভ্যতা ধ্বংস করিয়াছে এবং সমগ্র জাতিকে হতাশায় মগ্ন করিয়াছে। এই-সকল ভীষণ পিশাচগুলি যদি না থাকিত, তাহা হইলে মানবসমাজ আজ পূর্বাপেক্ষা অনেক উন্নত হইত।_
*তবে ইহাদের মৃত্যুকাল উপস্থিত; এবং আমি সর্বতোভাবে আশা করি, এই ধর্ম-মহাসমিতির সন্মানার্থ আজ যে ঘন্টাধ্বনি নিনাদিত হইয়াছে, তাহাই সর্ববিধ ধর্মোন্মত্ততা, তরবারি অথবা লিখনীমুখে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রকার নির্যাতন এবং একই লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর ব্যক্তিগণের মধ্যে সর্ববিধ অসদ্ভাবের সম্পূর্ণ অবসানের বার্তা ঘোষণা করুক।*
এমন একটি দিন যার কাছে শ্রদ্ধায় অবনত হতে হয়।
ReplyDelete