শিক্ষক দিবসের খোলা চিঠি
সৌমেন রায়
চিত্র – সুকন্যা চক্রবর্তী
১) শিক্ষকের উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থী
শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই,
আজ শিক্ষক দিবস। মহান শিক্ষক তথা দার্শনিক ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন। ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতিকে ভারতবাসী স্মরণ করে রাষ্ট্রপতি হিসাবে নয়, শিক্ষক হিসাবে। আজ এই পবিত্র দিনে আমি সেই মহান শিক্ষক ও আপনাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। কিন্তু সমাজ ও ধর্ম নিয়ে সেই মহান দার্শনিকের মতামতের গুরুভার সহ্য করার মতো তৈরি নয় আমার মস্তিষ্ক। সুনির্মল বসুর কথা মতো আকাশ, বায়ু ইত্যাদি বিমূর্ত শিক্ষকের কাছে শিক্ষা নেওয়াও আমার পক্ষে সহজ নয়। তাই আমি শিক্ষা গ্রহণ করি আপনার মতো মূর্ত শিক্ষকের কাছে। না শুধু পাঠ্য বই থেকে নয়, আপনার প্রাত্যহিক উদযাপন থেকে। এমনকি বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ প্রভৃতির মত লোকশিক্ষকদের শিক্ষাও আমার মননে প্রবেশ করে আপনার কাছে প্রতিফলিত হয়ে। এতগুলি বর্ষ ধরে সর্বপ্রকার পরিস্থিতিতে তথাকথিত ভালো – মন্দ নির্বিশেষে আপনার নিরপেক্ষ থাকার ক্ষমতা আমাকে অবাক করে। আমাদের অগণ্য দুষ্টুমিতে আপনার সহিষ্ণুতা অজান্তেই আমাকে করে তোলে শৃঙ্খলাপরায়ন । হাজার ব্যাস্ততার মাঝে আমাদের অপ্রয়োজনীয় কথাও শোনার জন্য আপনার আগ্রহ আমাকে গড়ে তোলে এক উত্তম শ্রোতা রূপে। আপনার বিষয়গত প্রজ্ঞা আমাকে নিয়ে যায় তমসা থেকে আলোকে। আপনার দৃপ্ত ভঙ্গি আমার মনে জাগায় আত্মবিশ্বাস। আপনার বাক্য আমার মস্তিষ্কে আলোড়ন তোলে। আপনার আপোষহীন দৃঢ়তা আমাকে নেতৃত্বের প্রেরণা দেয়। আপনার চিন্তার মৌলিকত্ব, আপনার উদারতা আমাকে ভাবতে শেখায়। আপনার সারল্য আমার চেতনাকে উদ্ভাসিত করে, আমি ঈশ্বরত্বের সুঘ্রাণ পাই। আমি স্পষ্ট অনুভব করি আপনার ভালোবাসা। আপনার কর্মের মাধ্যমে আপনি হয়ে ওঠেন শ্রদ্ধেয়।
কিন্তু সর্বদা আমি সেই শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে সমর্থ হই না। অস্ফুট হৃদয় ভাব প্রকাশে অসমর্থ হয়ে শুধু অবলোকন করে আপনাকে। মনে হয় আপনি চলমান শিক্ষা। আমার বিশ্বাস আমার এই অপ্রকাশিত শ্রদ্ধা আপনিও অনুভব করেন।
আজ এই বিশেষ দিনে জীবন সংগ্রামের পাথেয় হিসাবে আমি আপনার বরাভয় প্রার্থনা করি।
শ্রদ্ধান্তে,
আপনার মত হতে চায় এমন এক শিক্ষার্থী।
২) শিক্ষকের খোলা চিঠি
প্রিয় সু-জন,
স্নেহাশিস নিও। তোমার পত্র পড়ে আমি যুগপৎ আনন্দিত ও শঙ্কিত। মা, বাবা, কৃষক, প্রকৃতি সবাই শিক্ষক। শুধু ছাত্র হওয়া শিখতে হয়। তবু তুমি আস্থা রেখেছো আমারই মতো চলমান, মূর্ত শিক্ষকের উপর। আমি জানি আমার মুখের কথার চেয়ে আচরণ থেকে তুমি অধিক শিক্ষা গ্রহণ করো। শুনতে খুব ভালো যে তুমি আত্মবিশ্বাস অর্জন করো, নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা, সহিষ্ণুতা শেখো আমারই প্রাত্যহিক উদযাপন থেকে। তোমার মন মৌলিক চিন্তায় অগ্রবর্তী হয় আমারই উদার ভাবনার প্রভাবে। তাইতো প্রাত্যহিক প্রচেষ্টায় থাকি আমার আমি কে ছাপিয়ে যেতে। কখনো হয় আবার কখনো ব্যর্থ হই অন্তর্লীন শয়তানের কাছে, কিম্বা পারিপার্শ্বিকের কাছে। তাইতো শঙ্কিত থাকি সর্বদা, আমার কোন খারাপ যাতে অনুনাদিত না হয় তোমার কোমল মনে। সর্বদাই প্রচেষ্টায় থাকি আত্মীয় হয়ে আত্মার সাথে যোগসূত্র গড়ে তোলার। কখনো কখনো তোমাদের চঞ্চলতা আমায় ব্যথিত করে, কখনো বা বিরক্ত। সবচেয়ে ব্যাথা পাই নৈতিক বিচ্যুতিতে। কারণ শৃঙ্খলা রক্ষা করে তোমাদের মনের শৃঙ্খল মুক্ত করাই আমার দায়িত্ব। যেনো ভালোবাসাই আমার শেষ অস্ত্র। জানি তোমার চঞ্চলতা অফুরন্ত প্রাণ শক্তির প্রকাশ যা শত ধারায় প্রবাহিত হয়ে প্লাবিত করতে চায় চরাচর। তবু মনে রেখো সংযত ও সংহত অগ্নিই খাদ্যকে পরিপক্ক করে, অন্যথায় তা সর্বনাশের বার্তাবাহী।
তোমার হয়ে অস্ত্র ধারণ করার অধিকার আমার নেই। তোমার মনের চকমকিটি ক্রমাগত ঠোকাঠুকি করে যাওয়াই আমার কাজ। বিনিময়ে প্রয়োজন বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা, ঘৃনা ও পক্ষপাতের আহুতি। তাই বরাভয় নয়, এসো তোমার মধ্যের ঈশ্বর ও আমার মধ্যের ঈশ্বরের অনুনাদ হোক। আমি রূপ আয়নাতে প্রতিফলিত হোক তোমার অন্তরের সব কটি উত্তম ক্ষেত্র। পৃথিবী বাসযোগ্য থাক।
শুভেচ্ছান্তে,
তোমার শিক্ষক, যে তোমারও ছাত্র হতে চায়।
4 Comments
অসাধারণ, কোনও বিশেষণই এর উপযুক্ত নয়--- এতোটাই----
ReplyDeleteধন্যবাদ নেবেন।🙏
Deleteসৌমেন বাবুকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা আজকের এই বিশেষ দিনে এমন একটি রচনা প্রকাশ করার জন্য। একাধারে ছাত্র ও শিক্ষকের দ্বৈত চাওয়া পাওয়ার স্বরূপ সন্ধানে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেয়েছেন তিনি। একথা মানতেই হবে যে সময়ের সাথে সাথে এই চাওয়া পাওয়ার স্তরে অনেকটাই বদল এসেছে। তবে মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রে খুব বদল হয়তো হয়নি। যা চিরকালের তার পরিবর্তন হয়না। আমরা যেন সেই সত্যে উপনীত হতে পারি।
ReplyDeleteধন্যবাদ নেবেন 🙏
Delete