জ্বলদর্চি

কাগজে মোড়া স্মৃতির লজেন্স/কমলিকা ভট্টাচার্য


কাগজে মোড়া স্মৃতির লজেন্স

কমলিকা ভট্টাচার্য


ঘাসের উপর ফড়িং দেখে মনে পড়ল ছোটবেলার কথা—
ফড়িং ধরতে গিয়ে জামা ভরে চোরকাঁটা, তারপর মার বকা!

লাল পিঁপড়ের বাসা আজ অনেক দিন পর দেখলাম।
কত ডানপিটে ছিলাম তখন—পেয়ারা গাছে চড়ে লাল পিঁপড়ে বাঁচিয়ে পেয়ারা পেড়ে খাওয়া।

খেজুর গাছের তলায় থাকত ছাগলের ভিড়।
দুষ্টুমি করে দাদা বলত, “যদি পোড়া বোঁদে খেতে চাস, চলে যা ওখানে!”
আমরা খেজুর পাতার ঘূর্ণি বানিয়ে তাতে খেজুর কাঁটা গুঁজে দৌড়ে বেড়াতাম—
পাখা ঘুরত বনবন করে!

পুকুরের ধারে ছিল এক বড় জামরুল গাছ।
সকালবেলা সাঁতার কেটে এসে চুপড়িতে ভরে জামরুল কুড়িয়ে আনতাম।
কালবৈশাখীর ঝড়ে ভোররাতে ঠাম্মার সঙ্গে হ্যারিকেন হাতে আম কুড়াতে যেতাম।

আমের সময় বাবা আশশেওড়া আর দেবদারু পাতার বিছানা পেতে খাটের তলায় আম রাখতেন পাকার জন্য।
আমাদের উঠোনে কত রকম আমগাছ—বোম্বাই, ল্যাংড়া, গোলাপখাস, জরদোয়ালু, মধুচুসকি…
আরও কত নাম, আজও মুখে লেগে আছে।

উঠোনে ছিল এক বড় ফলসা গাছও।
ইচ্ছা করলেই মাটি থেকে কুড়িয়ে খেয়ে নেওয়া যেত—কী মিষ্টি স্বাদ!
আমার খুব প্রিয় ফল—কত দিন খাইনি!
চেন্নাইতে পাওয়া যায় কিনা জানি না।

আরেকটা গাছ ছিল করমচা, সেটাও এখন আর দেখি না।
কদিন আগে হঠাৎ একদিন বকুলফুলের কথা মনে পড়ছিল,
আর সেইদিন বিকেলে চেন্নাইতে গোপালপুরের খাদি গ্রাম উদ্যোগের দোকানের বাইরে
গাড়িতে উঠতে যাব—
হঠাৎ মাথার উপর বকুলফুল ঝরে পড়ল!
জীবনে কখনো কখনো এমন কিছু ঘটে, যার ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না।

রথের মেলায় টাল দিয়ে সাজানো গজা, কটকটি, ভাজা আর রঙিন জিলিপি—
ঠাম্মার আঁচলের গিট খুলে দেওয়া পাঁচ টাকায় কত কিছু খেতাম!
নাগরদোলায় চড়তে খুব ইচ্ছে হতো,
কিন্তু ভয় পেতাম বলে কোনোদিনই চড়িনি।

বর্ষার সময় আশেপাশের ছোট পুকুরগুলো জলে ভেসে যেত।
পাড়ার ছেলেরা গামছা দিয়ে নালা থেকে মাছ ধরত—
খাবারের চেয়ে মজা বেশি ছিল!
কাদার মধ্যে ফুটবল ম্যাচ—কি যে আনন্দ!
আমি কোনোদিন খেলিনি,
তবে দাদাকে বকা খাওয়া থেকে বাঁচাতে গামছা হাতে পুকুরধারে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
তবে শুধু দাদা নয়—মা হাতপাখা ধরলে সেটা আমাদের চার ভাইবোনের পিঠেই পড়ত!

বর্ষাকালে উঠোনে খুব ছ্যাতলা পড়ত,
কতবার যে পা পিছলে পড়ে আলুর দম!
কুমীরডাঙা থেকে ক্রিকেট—কি না খেলতাম তখন!

আমার ছোটবেলা কেটেছে রামনারায়ণ তর্করত্ন, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য আর আরও অনেক গুণী মানুষের বাড়িতে।
তারা আমার পূর্বপুরুষ—যে বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি থেকে সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত সবার পায়ের ধুলো পড়েছে।
সবাই বলত, পরীক্ষার দিন ঐ বাড়ির দেওয়ালে মাথা ঠুকে গেলেই নাকি পাশ করা যায়।
সত্যি সত্যি ঠুকে যেতাম, আর মার উপর রাগ করতাম—
মা কেন সেই পিলারে মুড়িবালার হিসাব লিখতো!

একটা কাঁচের বাক্সে ছিল একটা পেঁচা, একটা পায়রা আর একটা টিকটিকির মমি।
উঠোনের কোণে লোহার ঢাকনার নিচে ছিল এক সুড়ঙ্গ—আমার ছোটবেলার কৌতূহলের উৎস।

লোডশেডিং হলে হ্যারিকেন জ্বেলে মাদুর পেতে পড়া, ছাই দিয়ে তার কাঁচ পরিষ্কার করা,
ছাদে শুয়ে তারায় তারায় ছবি আঁকা—সবই যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়।
কখনও দূরে সাইকেলে করে ঘুঘনি বেচতে আসা মানুষটার ডাক শুনে ছুটে যেতে গিয়ে
সিঁড়ির দরজার ছেকলে আমরা হাত পেতাম না।
তখন একজন একজনের উপর চড়ে ছেকল খুলতে গিয়ে পাকানো সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যেতাম নিচে—
একজনের উপর একজন!
এখন ভাবলে ভীষণ হাসি পায়।

আমার দিদিমা স্বদেশী করতেন, তিনি বাড়িতে একটি লাইব্রেরি চালাতেন।
পরে আমরা পাড়ার ছেলেমেয়েরা মিলে সেটা চালাতাম।
মাঝে মাঝে মামা আসতেন—মামা আসা মানেই ভূতের গল্প আর অনেক মজা।

মামার খুব মাছ ধরার শখ ছিল।
ছিল অনেক দামী ছিপ।
মামা এলেই শুরু হতো নতুন মজা—
পিঁপড়ের ডিম পাউরুটির সঙ্গে চটকে টোপ বানিয়ে মাছ ধরা।
মামা বলতেন, “একদম চুপ করে ফাতনার দিকে তাকিয়ে থাকবি।
একটু ডুবি ডুবি মানে মাছ খাচ্ছে। যেই পুরো ডুববে,
মুহূর্তের মধ্যে টান দিবি। সেই মুহূর্তটা মিস হলেই মাছ খেয়ে চলে যাবে।”
আমি তো এত এক্সপার্ট হয়ে গিয়েছিলাম—ছিপ ফেললেই একটা না একটা মাছ উঠতই!

পুজো মানেই নতুন জামা।
কেউ বাড়িতে এলেই নতুন জামা দেখাতে দেখাতেই পুরোনো হয়ে যেত।
পুজোর সময় একরকম চিনির ছাপা মিষ্টি পাওয়া যেত—
এখনও পাওয়া যায় কিনা জানি না,
কিন্তু স্বাদটা এখনও মুখে লেগে আছে।
🍂

দশমীর দিন সন্ধে হলে বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়াতাম—
একের পর এক ঠাকুরের বিসর্জন দেখতাম।

কালীপুজোয় মজা আরও বেশি হতো।
বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হতো—কত লোক আসত!
বাবা আর জ্যাঠু মিলে ছ্যাচড়া, চচ্চড়ি, খিচুড়ি নিজে হাতে বানাতেন।
সারা দুপুর বাবার সঙ্গে বসে রঙমশাল আর তুবড়ি বানাতাম।
বাবার আমিই ছিলাম হেল্পার।

বাবার মতো রঙমশাল আর তুবড়ি কেউ বানাতে পারত না।
বাবা বলতেন, “তোকে আমি এইসব বাজি বানানোর ভাগটা বলে দেব।”
কিন্তু বাবার কাছ থেকে সেই ভাগ আর শেখা হলো না—
তার আগেই বাবা চলে গেলেন।

বাবা ছিলেন এক অদ্ভুত প্রতিভাবান মানুষ—
রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা শুকনো ডালেও প্রাণ দিতে পারতেন।
গাছ ছিল বাবার প্রাণ।
কৌতুকনাটক, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, শ্যামাসংগীত—
বাবা যে কি পারতেন না!
আমরা ভাইবোন কেউই বাবার মতো হতে পারিনি।

শীতের সময় যাত্রাপালা আসত স্কুলের মাঠে।
চটের উপর বসে যাত্রা দেখা—
একজন লজেন্সওয়ালা কাঁচের জারে তিন রঙের লজেন্স বিক্রি করতেন।
কাঁধে ঝোলা, হাতে খবরের কাগজের কাটা টুকরো,
তাতে ২৫ পয়সায় ৫টা লজেন্স দিতেন।
পরনে ধুতি, হাফ ফতুয়া, বয়সের ভারে ঝুঁকে যাওয়া মুখ—
আজও চোখে ভাসে সেই মানুষটার চেহারা।
অনেকদিন পর কলকাতার বাসে বিক্রি হচ্ছিল, কিনে খেলাম—
ঝাল লজেন্সের স্বাদ নয়,
সে যেন ছোটবেলার টকঝাল-মিষ্টি স্মৃতি।

সত্যিই, ছোটবেলার কথা বোধহয় বলে শেষ হয় না।
তবু মাঝে মাঝে ভাবলে বড় ভালো লাগে—
আজকের এই যান্ত্রিক পারিপার্শ্বিকতা থেকে সামান্য মুক্তি,
শ্বাসের মাঝে একটু বেশি অক্সিজেন,
আর হৃদয়ের কোণে মায়াভরা সেই কাগজে মোড়া স্মৃতির লজেন্স।

Post a Comment

2 Comments

  1. ভালো লাগলো পুরনো অনেক কথা আমারও মনে পড়ে গেল

    ReplyDelete
  2. বড় ভালো লেখা, একদম ছোটবেলায় পৌঁছে দেয়

    ReplyDelete