জেগে রই
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে রোজ। খরগ্রীষ্মের দগ্ধতা পেরিয়ে ঝরো-ঝরো কূলপ্লাবী শ্রাবণ কখন যে শিউলিবনে শিশির হয়ে ঝরে গেল, টের পেলাম না কেউ।
শীতের রোদে বসা কয়েৎবেল মাখার মতো আয়েসী দুপুরগুলো চুরি হয়ে গেল জীবন থেকে। আঙুলের ফাঁক গলে পড়ে গেল মার্বেলের গুলি, ভোকাট্টা ঘুড়ি, সাধের নুপুর—আরও কত কী! টেরও পেলাম না, টেরও পেলাম না গো।
আসলে আমরা যারা পঞ্চাশ পেরিয়ে ক্রমশই গোধুলির দিকে চলেছি, নব্য গতিময়তার এই দূরাবগাহী ব্যস্ততার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার অভ্যাস আমাদের এখনও বোধহয় রপ্ত করা হয়ে ওঠেনি। তাই এই অকারণ দোলাচল, অনাসৃষ্টি স্মৃতি-মেদুরতা—একে যে কোথায় লুকিয়ে রাখি, কী নামেই বা ডাকি!
বিলাসিতা তো নয়, এ যেন রোমন্থন; একেই কি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘সুখবেদনা’—অথবা ‘দুখমাধুরী’? জানি না।
আসলে, একই জীবনে বৈপরীত্যের কী বর্ণাঢ্য সমারোহ বয়ে চলতে হয় আমাদের!
এখনকার কম্পিউটারাইজড প্রিন্টেড মার্কশিটের বদলে আমাদের মাধ্যমিক-হায়ার সেকেন্ডারির মার্কশিটে এখনও জ্বলজ্বল করে প্রিয় দিদিমনিদের হাতের ছোঁয়া, কলমের কালিতে জড়ানো মায়া—যা কাটিয়ে বড় হতে চাইনি কখনও। তবু কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় পেন-পেন্সিলে রুল টেনে হাতে লিখে অ্যাডমিট-মার্কশিটের নকল জমা দেওয়া অর্বাচীনের দল কখন যে জীবিকার প্রয়োজনে ই-মেল-ইন্টারনেটে স্বচ্ছন্দ হয়ে গেছি, আনমনে কবিতার খাতাটি গোপন সিন্ধুকে তুলে জীবনবীমার প্রিমিয়াম, ইনকাম ট্যাক্সের সাবমিশন ইত্যাদি নুন-তেল সাংসারিক দায়ের হিসেব-নিকেশ জরুরি মনে করতে শুরু করেছি, তা ভাবার সময় আজ আর হয় না আমাদের।
🍂
তার মধ্যেও, হঠাৎ কোনো অলস বেলায় বারান্দার নতুন আসা গোলাপের কুঁড়ি হেমন্তের হাওয়ায় দুলে ওঠে। দূরের বন থেকে বয়ে আসা ঝোড়ো বাতাসে মহুলঘ্রাণ শিরশিরিয়ে ওঠে। ফেলে আসা জীবন ডাক দেয়—আমরা স্মৃতি লিখি।
ক্রমশই ঝাপসা হয়ে আসে দৈনন্দিন ব্যস্ততা। আনমনে রোদঢালা হেমন্তের বারান্দায় এসে বসে কবেকার চিলেকোঠার জানালাটি। বিবশ চোখ নতজানু হয়ে দেখে—কবেকার শ্যাওলা মাখা পাঁচিলের মাথায় ফুটে ওঠা শৈশবপথের অকৃপণ ঝিলমিল, দিগন্ত ছুঁয়ে আসা মেঘলোকে কৈশোরের অদৃশ্য ইশারা,নবযৌবনের দিকভ্রান্ত আহ্বান।
আমাদের পথ ভুল হয়, কাজ ভুল হয়, ব্যস্ততাও।
প্রাণের মাঝে যে সুধারস নিত্য সংবাহিত, তাই যেন কথা যোগায় কলমের আগায়। হিজিবিজি টানি, কাব্য না হোক—কিছু ছবি তো হয়! সেই যুগের, এ যুগের, জড়িয়ে থাকা সমাজের, প্রিয়জনদের। তাই লিখি অসমাপ্ত গানে।
হ্যাঁ—গান! গানের তানেই তো বাঁধা ছিল আমাদের প্রজন্মের প্রায় সকলের জীবনছন্দ। কারণ, আমাদের সকাল শুরুই হতো আকাশবাণীর প্রাত্যহিকীর সুরে; উঠোনময় বাবার ছড়িয়ে দেওয়া গমদানা খুঁটে খাওয়া পায়রাগুলির বকবকমে, আর রান্নাঘরের কয়লার ধোঁয়াকুণ্ডলীর গানে।
কে বলে, শুধু শব্দে-সুরে গান হয়? শুনতে জানলে দৃশ্যে-গন্ধেও গান ঘনিয়ে আসে। আর এই দেখাশোনার ইন্দ্রিয়গুলো বড় যত্নে তৈরি করে দিয়েছিলেন আমাদের অগ্রজরা।
আজ যখন হেমন্তের রাতে নৈঋতের পূজায় আকাশ-প্রদীপ জ্বালি, শুধু শ্রদ্ধা নয়—বড় কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করতে ইচ্ছে করে তাঁদের, রক্তের না হয়েও যাঁরা ছিলেন পরমাত্মীয়।
তখনকার মধ্যবিত্ত জীবন প্রতিবেশীকে ঈর্ষা করতে শেখায়নি আমাদের, ধর্মের আগলেও অন্ধত্ব ছিল না। তাই কেল্লাপুকুরপাড়ের সকাল-সন্ধ্যার আজানে আমাদের সময়লিপি নির্ধারিত হতো, আর বাড়ির পাশের দুর্গামন্দিরের মাঠে পাড়ার সব ছেলেমেয়ের খেলার কোনো বাধা ছিল না। ঈদের সময় পাশের মুসলিম বাড়ি থেকে ব্রাহ্মণবাড়িতে সেমুই-লাচ্ছা পৌঁছনোতেও অন্যায় কেউ দেখেনি।
হ্যাঁ, এমনই ছিল আমাদের শৈশব।
সেকালের মেদিনীপুরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে জন্মেছিলাম। বাবা ছিলেন শহরের নামী স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। অসংখ্য ছাত্রপরিবৃত ব্যস্ত জীবনে আলাদা করে সন্তানদের জন্য সময় তাঁর ছিল না—তবে তার জন্য খেদ আমাদের বিন্দুমাত্র ছিল না। পাড়ার জেঠু-কাকু-কাকিমা-বৌদিরা তো ছিলেন, অসুখে সমস্যায় সহায়।
তাছাড়া, স্কুল তো ছিল হাঁটা পথের দূরত্বে। ফার্স্ট বেল পড়ার শব্দ শুনেই সাদা সার্ট-সবুজ টিউনিক গলিয়ে কেডস পরে রেডি—বন্ধুরা এলেই এক দৌড়ে স্কুলগেট।
তারপর সারাদিনের আনন্দযাপন। পড়া, খেলা, খুনসুটি—শুধু নয়, বকুনি-শাসনও ছিল। গেটের গোড়ায় শসামাসীর চাটনি-চুরান ছিল, বঙ্কিমদাদার প্রশ্রয় ছিল, মনিটার হয়ে সহপাঠিনীদের ওপর দিদিগিরি ফলাবার সুযোগ ছিল, নাটকের রিহার্সালে গম্ভীর দিদির গানের গলা শুনে চমৎকৃত হওয়ার মুগ্ধতা ছিল।
এই সবকিছুর মধ্যেই ছিল প্রাণের টান—বড় থেকে বুড়ো হওয়ার পথেও যা সম্পদ বলে মানি। তাই আজও নিজের লেখা বইটি ছোটবেলার দিদিমনির হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাকুলতা প্রবল থাকে। বিজয়ার প্রণাম করতে গেলে নাড়ুর গন্ধ নাকে লাগে—হাজারো দামী কনফেকশনারির ভিড়ে।
আজ যখন প্রণাম করার পায়ের জোড়াগুলি আস্তে আস্তে কমে আসছে জীবন থেকে, অনপনেয় সামাজিক সমস্যাগুলি মানবতার কণ্ঠরোধ করে চলেছে অহর্নিশ, ভালো-কালোর আপাত দ্বন্দ্বে কালো জিতে যাচ্ছে রোজ। প্রতিকারহীন বিচারের দাবিতে উত্তাল হয়েও নিরুপায়তার উপরোধে খণ্ডিত হচ্ছে জনজীবন।
যৌবনের মদমত্ত উচ্ছ্বাসের মতো বর্ণিল পলাশ, গোলাপ, শিউলির পাশে চুপিচুপি এসে বসছে রজনীগন্ধার একলা সাদা। দূরবনের ঝোড়ো হাওয়ায় বুকের পাতা ঝরার মর্মরে কেঁপে কেঁপে উঠছে আসন্ন ফুরিয়ে যাওয়ার অশনিব্যথা,দেখি দুস্থ দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ছুটছে তথাকথিত এলিট যুবসমাজ, স্বার্থ দূরে সরিয়ে নামছে ত্রাণে,পরিত্রাণে, ক্ষতনিবারনে।
আমাদের মনের জলছবিতে আঁকা হয়ে থাকছে শূন্যতার মাঝেও অন্যতর পূর্ণতার ছবি—অথৈ কান্নার ঘাট পেরিয়ে আলো-দালানে পৌঁছে যাওয়ার এক সমৃদ্ধ অপরাজিতা লতাবন্ধনের।
এই জন্যই বাঁচতে ভালো লাগে, আরও বেশী ভালো লাগে রোজ।
তাই হয়তো মহানবমীর স্মৃতিতে আজও ভেসে বেড়ায় প্রথম শাড়ি পরার আনন্দ, অঞ্জলি দেওয়ার সময় গুরুজনের চোখ বাঁচিয়ে হাতে হাতটুকু ঠেকিয়ে ওঠার রোমাঞ্চ। যে সন্তানকে জন্ম দিয়ে জীবনপণ করতেও ভয় পাইনি, আজ আতুর বেলায় সেই সন্তানের এগিয়ে দেওয়া ভরসার হাতে হাত সঁপে চলা…
জীবন তো এইই, কালীদা! এই তো জীবন!
তাই হয়তো দেশ হারিয়ে যায়, সময়ের কালপ্রবাহে সমাজ, সংস্কার বা মূল্যবোধের তারতম্য হয়—তবু লক্ষ্মীপূর্ণিমার নান্দনিক রাতে পূর্ণস্ফুট রাকার আকাশময় মায়া জ্যোৎস্নার আলো বিছিয়ে দেওয়ার মতো, নতুন আকাশে চিরকালীন কালপুরুষের তলার লুব্ধক নক্ষত্রটিকে চিনে নেওয়ার মতো, চিরন্তন সুন্দরের আরতি করি মনের মন্দিরে—
‘অমল আলোর কমলখানি কে ফুটালে’—
0 Comments