স্মৃতির পাতায় সত্যজিৎ
সুমালী দাস চ্যাটার্জী
আনন্দ ক্ষণস্হায়ী কিন্তু স্মৃতি চিরস্থায়ী।
স্মৃতি হলো আমাদের ব্যক্তিগত সাহিত্য, জীবনের দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। স্মৃতিমেদুর একেকটি ঘটনা যেন আমাদের প্রত্যহ দিনযাপনের একঘেয়েমির মাঝে হঠাৎ আলোর ঝলকানি, আনন্দের চাবিকাঠি বা না পাওয়ার বেদনায় ভরপুর জীবনপাত্র। জীবনের মধ্যগগনে পৌঁছে উঁকি দিয়ে দেখি সযত্নে মনের গভীরে বহমান সেই স্মৃতিকে, যা আজও আমার কাছে ভিখারিণীর কুড়িয়ে পাওয়া লক্ষহীরার হার। এখনও মনে হয় এই ঘটনাকি সত্যিই ঘটেছিল আমার সাথে। নিশ্চয়ই কিছু ভালো কাজ করেছিলাম হয়তো পূর্বজন্মে,তাই আমার মতো এই সামান্যার জীবনে এই অসামান্য ঘটনাটি লেখা হলো।
🍂
আমি তখন কোলকাতার এক বিখ্যাত স্কুলের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। স্কুলের ম্যাগাজিনের ভার ন্যস্ত হয়েছে আমাদের ক্লাসের কয়েকজনের উপর।তার মধ্যে আমিও আছি। সবাই মিলে ঠিক করলাম এমন অভিনব কিছু করতে হবে যাতে পত্রিকাটি অনন্য হয়ে ওঠে। তখন নতুন নতুন আইডিয়া নেওয়ার জন্য আমাদের হাতে মুঠোফোন ছিলনা। যাইহোক সবাই মিলে ঠিক করলাম যে বিখ্যাত কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নেব এবং সেগুলিই লিপিবদ্ধ করব ম্যাগাজিনের পাতায়।শ্রদ্ধেয়া শিক্ষিকাদের কাছ থেকে প্রাথমিক অনুমতি নিয়ে কাজ শুরু করলাম। এক বন্ধুর মায়ের কিছু চেনাজানা ছিল, তাঁকে মাধ্যম করেই শুরু করলাম কাজ। বিখ্যাতরা কেউ জানান সময়ের অভাব, কেউ সময় দেন কিন্তু তা হয়তো অনেক দেরীতে। আমাদের হাতে অত সময় নেই। নিতান্ত চুনোপুঁটি আমরা,কে আমাদের পাত্তা দেবে? কি যে করি,এত বড় মুখ করে সবাইকে বললাম- সবই এখন বিশ বাঁও জলে। একরাশ মন খারাপ নিয়ে স্কুল ছুটির পর বাড়িমুখো হয়েছি, এক বন্ধু বলে উঠেছিল-'এই একবার সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি যাবি?' আমরা বাকি দুজন হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছি দেখে সে বললো-'আরে আমাদের স্কুলের পিছনেই তো ওনার বাড়ি। চল না একবার, ঢুকতে না দিলে চলে আসবো।' একবারও চিন্তা করলাম না রে দেরী হলে বাড়ীতে কি বলবো? সত্যজিৎ রায়- ফেলুদা,শঙ্কু,আরো বারো হাতের কাছে যা পাই গোগ্রাসে গিলি, শারদীয়া পূজোসংখ্যা হাতে পেলে আগে ওঁর লেখা পড়ি, বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক তিনি। সবাই তাঁকে দেখতে চায়,কথা বলতে চায়, দেশেবিদেশে বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন তিনি-এহেন মানুষটির সাথে আমরা দেখা করব। উনি আদৌ সেইসময় দেশে আছেন কিনা সেটাই জানিনা। তবু কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটা শুরু করলাম তাঁর বাড়ির উদ্দেশ্যে।
অবশেষে এলো সেই মহালগন। দুরুদুরু বক্ষে উপস্থিত হলাম তাঁর বাড়ির সামনে।তিনবন্ধুর মনের মধ্যে চলেছে মহাসমুদ্রের কলরোল। 'Do or Die' মন্ত্র নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম তাঁর বাড়ির দরজায়। মনে মনে ভাবছিলাম এই সিঁড়ি কত বিখ্যাত মানুষের পদধূলিধন্য। কাঁপা কাঁপা হাতে কলিং বেল বাজালাম।দরজা খোলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি- একেকটা যুগ যেন চলে যাচ্ছে। অবশেষে খুলে গেল সেই দরজা। না, তিনি নন। একজন এসে আমাদের আসার উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করল। সব বলার পর তিনি বললেন যে উনি বাড়িতেই আছেন কিন্তু আমাদের সাথে দেখা করবেন কিনা সেটা ওঁর কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে এসে জানাবেন। আবার শুরু হলো সময় গোনার পালা। মনে একরাশ উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল- যদি শুনি যে তিনি দেখা করবেন না তাহলে.....। অন্য দুই বান্ধবী প্রতিনিয়ত আমাকে আশ্বস্ত করছিল এই বলে যে-দেখা না করতে চাইলে চলে যাব। আমি তখন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে চলেছি যে এই ঈশ্বরের দেখা যেন আমি পাই। এমন সময় হঠাৎ পাশের একটি দরজা খুলে গেল। তিনজন আমরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখলাম স্বয়ং সত্যজিত রায় সেখানে দাঁড়িয়ে। জলদগম্ভীর স্বরে তিনি ভিতরে আসার জন্য আমাদের আহ্বান জানালেন। আমরা তখন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।কম্পিত পদক্ষেপে উপস্থিত হলাম তাঁর সেই বিখ্যাত ঘরে- যেটি আমরা ছবিতে দেখি। আমরা একে একে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। প্রবাদপ্রতিম মানুষটির সাথে কি ভাবে কথা শুরু করবো তা কেউ বুঝতে পারছিলাম না।উনি পরিবেশটা স্বাভাবিক করে তুললেন মৃদু হেসে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন যে তাঁর সাথে কেন দেখা করতে এসেছি? আমরা এত স্মার্ট ছিলাম না। তিনটি মেয়ে- পিঠে বইয়ের ব্যাগ, অনভ্যস্ত শাড়ীতে (স্কুলের ইউনিফর্ম), হাঁ করে তাঁকেই দেখতে ব্যস্ত। তিনজনই কথা জড়িয়ে তিনরকম উত্তর দিলাম। আসলে ছোটোবেলা থেকে যাঁর ছবি খবরের কাগজের পাতায় দেখে এসেছি (আমাদের বাড়িতে টি.ভি ছিল না) আজ হাত বাড়ালেই তাঁকে ছুঁতে পারবো এযে বিশ্বাস করতে পারছি না। তাড়াতাড়ি একটা খাতা বের করে তাঁর অটোগ্রাফ নিলাম। তারপর প্রায় আধঘন্টা ধরে কত গল্প..... আমরা কোন স্কুলে, কোন ক্লাসে পড়ি..... কোন বিষয় পড়তে ভালো লাগে, বাড়িতে কে কে আছেন, কোথায় বাড়ি, তাঁর কি কি লেখা পড়েছি, ফেলুদাকে কেন ভালো লাগে, সিনেমা দেখা হয় কিনা, পথের পাঁচালী দেখেছি কিনা ইত্যাদি। সবথেকে যেটা ভালো লাগলো যে তিনি চিন্তা করছিলেন যে দেরি দেখে আমাদের বাড়িতে বাবা মায়েরা কি ভাববেন। কথা বলার ফাঁকে একজন এসে সরবত আর মিষ্টি দিয়ে গেল। তিনি বললেন খেয়ে নিতে। কোথা দিয়ে সময় বয়ে গেল, চলে আসার সময় উনি নিজেই দরজা পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দিলেন। তখনও যেন স্বপ্নের ঘোর কাটেনি। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে তাঁর বাড়িতে গেছি, তাঁর সাথে কথা বলেছি। আমাদের কোনো ছবি হয়তো তাঁর সাথে নেই কিন্তু মনের মণিকোঠায় ওই কয়েক ঘণ্টার ছবি চিরস্থায়ী হয়ে আছে। আজো চোখ বুজলে দেখতে পাই। বাড়ি ফিরে সবার বকা খাওয়ার আগেই ঘটনাটা বলেছিলাম। কেউ আর কিচ্ছুটি বলেনি। বরং আমার বাবা পাড়ায় গর্ব করে বলেছিল ' আমার মাইয়্যা সইত্যজিৎ রায়ের লগে দেহা(দেখা) কইর্যা আইসে(এসেছে)।'
আজ বহুবছর হয়ে গেছে তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই। শিল্পী বেঁচে থাকেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে। উনিও বেঁচে রয়েছেন ওনার অসংখ্য মহৎ সৃষ্টির মধ্যে। আজ এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তাঁকে নিয়ে কত মাতামাতি। সকলেই তাঁর সম্পর্কে কিছু না কিছু জানে। তাই নতুন করে কিছু বলতে যাওয়া বৃথা। কিন্তু আমার লেখার মধ্যে দিয়ে আমি তুলে ধরতে চেয়েছি সেই সত্যজিতকে যিনি নিরহঙ্কার, সমুদ্রের মতো গভীর গাম্ভীর্য -তা সত্ত্বেও কিছুক্ষণের জন্য আমাদের মতো নিতান্ত সাধারণ কয়েকটি মেয়ের সাথে একেবারে আপনার জনের মতো আন্তরিক ভাবে কথা বললেন, হাসলেন, গল্প করলেন যেন কতদিনের চেনাজানা আমাদের। তিনি যে কত বড় ব্যক্তিত্ব সেটা তিনি আমাদের বুঝতে দেননি। তাঁর দেওয়া কত সাক্ষাৎকার আমরা পত্রপত্রিকায় পড়ি, কিন্তু এই সাক্ষাৎকার কোথাও প্রকাশিত হওয়ার নয়, এযে একান্ত নিজের। মনের গহীনে তারার মতোই ঝিকমিক করে প্রতিনিয়ত। কজন মানুষের সৌভাগ্য হয় জীবদ্দশায় ঈশ্বর দর্শনের? আমি সেই সৌভাগ্যশালিনী- একি কম নাকি। জীবনের উপান্তে এসে গর্ব করে বলতে পারি আমি দেখেছি তাঁকে। অনেক না পাওয়ার মাঝে সেইতো পরম পাওয়া।
0 Comments