জ্বলদর্চি

আত্মনেপদী /চন্দন সেন

আত্মনেপদী

চন্দন সেন


…যবনিকার অনিবার্য সম্পাতের অদূরে দাঁড়িয়ে আছে পরমায়ু। আবহসংগীত অস্পষ্ট থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই তামাদি হয়ে যাওয়া জীবন আর তার সহস্র খুচরো সিকি আধুলি জড়ানো পরমায়ুর বিবর্ণ ছায়ায় বিলয়ের শব্দহীন আর্তনাদ মাঝরাতে ঘুম ভাঙায়। কোনো স্থির দৃশ্য নয়, শেষ পর্যন্তও বলেছি হয়তো কম, লিখেছি তার থেকেও বেশি। সে সবের অভিঘাত কী হতে পারে ভাবতে ভাবতেই সংলাপ নিয়ে এই আত্মজিজ্ঞাসা! নাটক যদি দেখা কিংবা পড়া অথবা কল্পনায় আঁকা দৃশ্যের অভিনয়যোগ্য প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকে তবে প্রতিটি মানুষই জীবনের কোনো না কোনো পর্বে একজন খণ্ডকালীন নাটককার, কাগজ কলমে তার সাক্ষাৎ প্রমাণ না থাক, সাতরঙা শৈশব থেকে মানুষ অজান্তেই যে কতবার নাটক বা নাট্যাংশ রচনা করে ফেলে- কখনো একান্তে, কখনো অনেকের মধ্যে, কখনো ঘুমভাঙা রাতে, কখনো বা অলস দুপুরে-এমন কী কাজ করতে করতে, চলতে চলতে, ঘুরতে ঘুরতে তারই চক্ষুষ্মান বাস্তবের সামনে চকিত চৈতন্যে নিঃশব্দে লেখা হয়ে যায় কত সরব সংলাপ আর স্বকল্পিত দৃশ্য, যার কুশীলবরা উঠে আসে ঘটমান বর্তমান থেকে, কোনো গল্প বা উপন্যাস থেকে, কিংবা পরিচিত কোনো অতীতের আখ্যান থেকে। ওইসব সবাক দৃশ্য যখন তার অবচেতনে সৃজিত হচ্ছে, তখন সে নিজে কিন্তু দৃশ্যত নির্বাক, বড়োজোর বিড়বিড় করে অস্পষ্ট ভাবে কথা বলে চলে সে, তবু সবাক, কারণ প্রতিটি শব্দ সে তার মত করে উচ্চারণ করে, শুনতেও পায় সে নীরব উচ্চারণ। তারপর সন্ধ্যার আকাশে ঘরে ফেরা উড়ন্ত পাখির মতো সেইসব দৃশ্য দ্রুত মিলিয়েও যায়। ছোটবেলায় স্কুল কলেজে অথবা জীবনের দুপুর থেকে বিকেলে আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় কতবার এমন অজস্র দৃশ্য সে তৈরি করে। অনুপস্থিত শত্রু, কুচুটে প্রতিবেশি, প্রিয়তম বন্ধু, ঝগড়াটে সহপাঠী, কারণে অকারণে রেগে যাওয়া শিক্ষক কিংবা ভালোলাগা মেয়েটিকে সামনে বসিয়ে সেই নাটকের সৃজন-লীলা চলে কতবার! সেইসব অলিখিত বিচিত্র সবাক দৃশ্য যা অন্যের কাছে প্রায়শই অশ্রুত, সেইসব স্বপ্নিল সংলাপ ঘন যামিনীর মাঝে কত না-লেখা নাটক তৈরি করে। সে সব নাটকের বেশির ভাগই অসম্পূর্ণ, কখনোবা সম্পূর্ণ মনে মনে।
🍂

অন্য মহৎ নাটককারদের কথা সঠিক বলতে পারি না, এই অভাজনের অলিখিত নাটক লেখার শুরু সেই সুদুর ছেলেবেলায়, যেমন হয় আর কি। সংলাপ লেখার আরম্ভ খানিকটা এমনই, সাধারণভাবে কাগজেকলমে সে সবই যথারীতি অলিখিত। অস্পষ্ট শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে দেখা যাচ্ছে প্রায় সবই ছিল সরব সংলাপ, উৎসে ছিল প্রতিবেশ আর চরাচর, পরবর্তীকালে কোনো পঠিত বা শ্রুত গল্প কিংবা অর্ধ কাহিনি। বাবা ছিলেন সরকারি হাসপাতালের একমাত্র চিকিৎসক। হাসপাতালের এক নার্সের কিশোরী কন্যা নীলাদির অফুরান কথা আর সবসময়ের হাসিমুখটা আমার খুব ভালো লাগত, আর সেই সুবাদেই সে আমার ওপর খুব খবরদারি করত। যে মানুষটা মাসে দু-একবার ওদের কোয়ার্টারে আসত সে কিন্তু আমার খুব একটা পছন্দের লোক ছিল না। মায়ের বারণ ছিল, তাই ওই দু-চারদিন নীলাদির ঘরে যেতাম না। এমনই একদিন নীলাদি আমায় ডেকে নিয়ে বলল, 'তুই আসিস কেন?' আমি সেদিন হঠাৎই সংকোচ ভেঙে বলে ফেলেছিলাম, 'নীলাদি তোর বাবা এলে তো আমি যাই না, যাবও না'। নীলাদি হঠাৎ রেগে গিয়ে আমায় এক চড় মেরে বলল, 'ও আমার বাবা, তোকে কে বলেছে?' আবাক হয়ে দেখলাম, নীলাদির চোখে জল। সেই বিকেলে আমাদের স্বরচিত সংলাপ স্মৃতিতে কেমন করে জানি না অনেকটাই বেঁচে আছে। পলাশির হাসপাতালের বেশ কিছুটা দূরে সেই প্রায় নির্জন রেল কালভার্ট, যার নীচে ছোট্ট এক নয়ানজুলি, তার দু'পাশের বিস্তীর্ণ সবুজ। যেখানে আমি প্রায়ই চলে যেতাম মেঠোপথ আর আল ভেঙে, যেখানে আমার দুই বন্ধুর সঙ্গে স্কুলের শেষ পরীক্ষার পর ধূমপানের অভিজ্ঞতা, যেখানে আমি শৈশবের ৮-৯ বছর প্রায়ই একা একা চলে যেতাম। সারাদিনের চার-পাঁচটা ট্রেন ছাড়া ওই কালভার্টে আর কোনো শব্দ জাগত না। সেই কালভার্টে পা দুলিয়ে বসে চরাচরকে সাক্ষী রেখে ক্লাস সিক্সের এক হাফপ্যান্ট বালক সেই বিকেলে চিৎকার করে উঠেছিল, 'নীলাদি আমি তোকে বিয়ে করব'। তারপর আরো কত সংলাপ! অদূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল ডাগর চোখের এক স্বপ্নভাঙা কিশোরী, তার নাচতে থাকা দুই ঝুলন্ত বিনুনির মধ্যে অদৃশ্য, তবু শেষরাতের স্বপ্নের মতো সুগন্ধি তেলের রহস্যময় ডাক।... 
কৈশোর থেকে লাফ দিয়ে যৌবনে আসি, ৩১ বছর বয়সে আজকের মত একটা ঘটনার বিবরণ পাই কাগজে। ১৯৭৫ -এ একটা মেয়েকে খুন করে ফেলে রেখে যায় আততায়ীরা নবদ্বীপের নদীর পারে। তখন মিডিয়া বলতে একমাত্র খবরের কাগজ। ঐ কাগজেরই কোনো একটি অংশে ছোট করে লেখা ছিল এই অগুরুত্বপূর্ণ খুনের খবর। কাগজের সিংহভাগ জুড়ে দেশের জরুরী অবস্থার শাসকদের মুল্যবান ভাষণ, আর পাল্লাদিয়ে রেডিওতে চলছে সুশৃঙ্খল দেশের জয়গান। এক তরুণ রাগী নাট্যকার, পরে যিনি দারুণ দারুণ ফিল্ম তৈরি করেছেন ছুটে গেলেন নবদ্বীপে, লিখে ফেললেন ঐ অজানা মেয়েকে নিয়ে এক আশ্চর্য আখ্যান - ‘সেই বিষ্ণুপ্রিয়া’। আমিও চমকে উঠেছিলাম অনেক কষ্টে সংগ্রহ করা সেই আখ্যান পড়ে। আমার ভেতর অক্ষরের আগুন জ্বালিয়েছিল এক কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যে কবি তরুণ নাট্যকার ও ভারতের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের ঐ আখ্যান পড়ে লিখেছিলেন এই ক’লাইন –

“কণ্ঠে ছিল আগুন, তাই সে
মিছিলে পা মিলিয়ে ছিল।
বুকে ছিল আগুন, তাই সে
সূর্যকে ডাক দিয়েছিল।
সূর্যে ছিল আগুন, তাই সে
আগুন নিয়ে খেলেছিল।”

তারপর থেকে ফুটবল ক্রিকেটের মাঠকে ছুটি দিয়ে আমার মনে হল, থিয়েটারের ভেতরে যে আগুন তাঁকে নিয়ে খেলতে পারি, হয়তো জয়ের কাছাকাছি যেতে পারি। হয়তো এতদিন পর বুঝতে পারছি, আমি যা বলছি তার তুলনায় যে স্বার্থপর আত্মবিলাসী আর মিডিয়ানন্দিত লেখককূল নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে যা বলছেন সেই সবকিছুই মানুষকে এখন বেশি টানছে। দারুণ স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্ন দেখানো কবিরা অচেনা অজানা হয়েই রইলেন, আর ঐ সব মিডিয়ানন্দিত রত্নরা পাপাচার মিথ্যাচার আর নৃশংস রাষ্ট্রীয় আক্রমণকে দেখেও না দেখে গোলের পর গোল করে চলেছেন, হ্যাট্রিকের পর হ্যাট্রিক। 

ইতিহাস কানের কাছে ফিসফিস করছে বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবিত বিধবা বিবাহের পক্ষে সই ছিল মাত্র ৯৮৭, আর বিপক্ষে সই ছিল ৩৬,৭৬৩... বাকিটা ইতিহাস – 

“ভর সন্ধেবেলা যারা গলির মোড়ে পথ 
আটকিয়ে
‘দেখে নেব’ বলে চলে গিয়েছিল, 
তাঁরা আর দেখা করতে আসেনি –
কয়েকদিন অপেক্ষা করার পর
পরস্পর জানা গেল, 
কারা যেন তাদেরই দেখে নিয়েছে।” (কবি তারাপদ রায়)

সরস গদ্য আর নীরস পদ্য সমন্বয়ে এইটুকুই – ‘আত্মনেপদী’। 


Post a Comment

0 Comments