জ্বলদর্চি

চলিতে পথে… /দীপশ্রী সেনগুপ্ত

চলিতে পথে… 

দীপশ্রী সেনগুপ্ত


খুব বৃষ্টির দিনে যখন চরাচর ওলটপালট করা ধারাপাতে নিতান্তই কেজো মানুষগুলো ছাড়া সবাই গৃহবন্দী, তখন কেন জানি না বাইরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মনে হত, এই বৃষ্টির দিন, এই ঝুলে পড়া বিবর্ণ আকাশ - সব একদিন শুধু  "মনে পড়া ছবি" হয়ে থাকবে।  জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে উঠোনের জমা জলে ফেলা কাগজের নৌকা ভাসতো, অল্প জলে একটু দূরে গিয়েই সেই নৌকা হেলে পড়তো - কি জানি কেন মনে হ'ত এও একদিন ঠিক মনে পড়বে, পড়বেই।

ছোট থেকেই পরিপক্ক বা "পাকা" ক্লাস টু -থ্রি পড়ুয়া শিশুমন নিজের বাড়ি, আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে গুরুজনদের আলোচনা মন দিয়ে শুনতো,  সাহিত্য,  রাজনীতি, ধর্ম, সিনেমা - সব বোঝা না বোঝার আলো-ছায়ায় জাফরি কেটে চলতো মনে মনে;  শব্দ,  বাক্য,  তার্কিক বাচনভঙ্গির ঝঙ্কার অবসরে মেলে বসে নিজের মত ঠাসবুননের চেষ্টা চলতো ভালমত।

প্রত্যেক সন্ধ্যায় দাদু পড়ে শোনাতেন কৃত্তিবাসী রামায়ণ অথবা কাশীদাসী মহাভারত, তারই ফলশ্রুতি নিঝুম দুপুরে  বাগানে শিউলিতলায়  শরশয্যায়  শায়িত পিতামহ ভীষ্মের জন্য মাটি ফুঁড়ে তৃষ্ণার শীতল জলধারা আনয়ন,  পরিশেষে অন্যান্য  কৌরব ও পান্ডব ভ্রাতার প্রতি সগৌরব দৃষ্টিপাত ।  এরকম অবিরাম স্বপ্ন কল্পনার  আলপনা - শুয়ে, বসে, মনে মনে। কখনো অর্জুন, কখনো কৃষ্ণ,  কখনো রামচন্দ্র, সীতা, কর্ণ ; তবে দুঃশাসন,  কৈকেয়ী,  মন্থরা কখনো নয়।

তবে একলব্যকে  গুরু দ্রোণাচার্য কেন অস্ত্রশিক্ষা দিলেন না অল্পবয়সী বুদ্ধিতে সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনি।
🍂

মামার বাড়িতে বিরাট যৌথ পরিবার , অনেক ভাইবোন,  গরমের ছুটিতে আরও অনেকে জড়ো হত, তখনকার আকর্ষণীয় খেলা ছিল - রাজসভায় রাজার বিচারব্যবস্থা। রাজার বিচারে  প্রায়ই মুণ্ডচ্ছেদের আদেশ হত, বিরোধী পক্ষ ছিল না কিনা!

শীতের গাঢ় রাত নেমে আসতো খুব তাড়াতাড়ি।  একটু বড় হবার পর শীতকাল মানেই বার্ষিক পরীক্ষা, পুজোর  সিজন শেষ হতে না হতেই পরীক্ষার ঘন্টা।  এরপর নতুন ক্লাস, নতুন পড়া, নতুন বইয়ের রোমাঞ্চ (অনেক সময় অন্যদের পড়া পুরোনো বই) । ঋতু বদলের সাথে সাথে চলমান জীবন যাত্রার কিছু অদলবদল। সব কিছুর মধ্যে ধ্রুবতারার মতো জেগে থাকা বই, বই, আরো বই।

ছোট বেলাতেই লুকিয়ে লুকিয়ে শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ গোগ্রাসে গেলা।

সব কথা বলা যায় না, বলতে গেলে  হয় আত্ম-অহমিকার প্রকাশ হয় অথবা আত্ম-অবমাননা ঘটে। শৈশব , কৈশোর পেরিয়ে জীবন তারুণ্যে পা রাখে । চারপাশের জীবন বদলাতে থাকে।  পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি  সব  ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে , কারোর বোঝা না বোঝার তোয়াক্কা না করেই নিজের গতিতে এগিয়ে চলে জীবন।

একেবারে অজানা, অচেনা জগতে  নিজেকে  টিকিয়ে রাখা, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি না থাকলে হয়না। প্রতি পদক্ষেপে প্রতিদিন বিরোধিতা, ভয়, অবমাননাকে জয় করে নিজের কাছে ধৈর্যের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে পরাজয় মেনে নিতে হয়, সে বড় যন্ত্রণা! এরই মাঝে শুভানুধ্যায়ী অনেকে চিরতরে হারিয়ে যান।

মহামূল্যবান এ জীবনের জন্য খাজনা তো দিতেই হবে। নিরুদ্বিগ্ন, শান্ত হয়ে দিয়ে যেতে পারলেই ভাল।
মাঝে মাঝে জীবন যখন হেসে ফিরে তাকায়, তখন "ঝলমল করে চিত্ত "।
অনেক দেওয়ার পরেও  পূর্ণ পাত্র পূর্ণই থাকে, কখনো শূন্য হয়না। 
"পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে"।

Post a Comment

0 Comments