জ্বলদর্চি

কয়েকটি কবিতা /জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

কয়েকটি কবিতা

জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় 


খাজার গল্প 


মিষ্টি হিসেবে খাজা কোনোদিন বিখ্যাত ছিল,
জানা নেই
ছোটোকালে দাঁত আর জিভের সঙ্গমে তাকে ফেলে
খুব করে চিবিয়েও তেমন মধু পাইনি, একালেও না।

অথচ খাজা-গজার নাম এককালে মিষ্টির গর্ব ছিল,
তা ধরা আছে ছড়া-কবিতায় 
থালায় সাজানো দেখি চমৎকার মাকাল ফল।

নববধূ বলে একটা আশ্চর্য ব্যাপার আছে, তাকে সঙ্গে  নিয়ে যাওয়ায়
আছে বেশ অদ্ভুত পুলক, তেমনই এক স্মৃতিময় দিনে মৌচাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে
বলেছিলুম, আপনাদের দোকানের স্পেশাল মিষ্টিটি কী ? 
বিক্রেতা চোখে খানিক অহংকার ঝুলিয়ে দু-প্লেটে দুটো করে
সাজিয়ে দেন প্যাঁটারি ফলের মতো সখাঁজ খাজা।

আমি তাতে মধু পাইনি, আর বলতে দ্বিধা নেই, পাশের
মধুবতীর তীব্রচোখে লেখা ছিল এক উন্মাদের উন্মাদনার ডায়াগনোসিস
দেয়ালের টিকটিকির মতো কয়েকটা প্রশ্ন টিকটিক করে,
ওকে মিষ্টি বাদ দিয়ে নোনতা ভাজলে কেমন লাগতো ? 
অথবা জিলিপির মতো রসময় করে দিলে জিলিপি কি হতো ? 
বিখ্যাত ময়রা জগাদার কাছে বসে একদিন মন্ত্রণা দেওয়া যেতে পারে
হয়তো সেটা বেশ হাতে গরম, মারমার-কাটকাট কাড়াকাড়ি চলবে
তারপর...  জি আই চেয়ে বসবো, বেশ নামটাম হবে,
খাস্তা খাজার নামে বাজারে রমরমায় রবরবায় ডানাও গজাবে
ফুরফুরে বিকেলে রূপকথা-রাঙা আকাশে একটু উড়ান দেবো
স্বপ্নের দেশে, পুলক আবেশে ভেসে যাবো আলাদিন।

🍂

কবিতা লেখার হিসাব


গত বসন্তে আমি দশটা কবিতা লিখেছিলাম
তার মানে এটা নয় মনে দশখানা প্রজাপতি উড়েছিল,
ডি এ পাইনি, বাজারময় ধার ডি এ-র হিসেবে সব
চেনায়িত বা শৃঙ্খলিত এটা অন্যেরা বোঝে না।
এই দুঃখ এবং রাগে দশখানা কবিতা লিখে ফেলেছিলাম।

গ্রীষ্মের কবিতা হয়েছিল চারটি,  তাতে হারানো প্রেম বা
সুখস্মৃতি ফেরার কোনো চান্সই ছিল না, চিরকেলে
চা-দোকানি গোবিন্দাও ঘরে এসি লাগিয়ে বলেছিল,
দ্যাখো ভাই, আর কষ্ট করতে পারি না, ঘরে সুখ চাই-ই চাই।
তুমি যে একটা চাকরি করতে ? জীবনে কী করলে ? 
আমার দুঃখের শেয়ালদের সঙ্গে সেও গলা মেলায়।
আর আমার গরম তিনগুণ বেড়ে যায়।
রেগে চারটে গরম কবিতা লিখে ফেলি।

শরতে দুটো কবিতা লিখেছি, ছেলের পুনেতে এক কোম্পানির
আঠারো হাজারি মনসবদার, মানে ইঞ্জিনিয়ার, নিজেরই কষ্টে চলে,
আমি কিছু দিই না, সে-ও দেয় না, মানে গায়ে-গায়ে হয়ে গেল।
এদিকে তিনবছর আগের সস্তা পোশাকে কাল্পনিক
আভিজাত্য লাগিয়েও শান্তি মেলে না।
দুটো উদাসী কবিতা লিখতে পেরেছি।

এখন হেমন্তদিন, ভাগচাষিরা একবস্তা ধান ও দেবে না,
সোনালি ধানের কবিতা লিখবো ? গন্ধ পাবো ? 
আমার জমিতে এত সুগন্ধভোগ ধান গন্ধ ছড়ায় তা আমার কপালে জোটে না,
একটা দানা মুখে আসার গল্পও নেই,
দাদুর মিনি জমিদারির গল্প লিখতে পারি কিন্তু কবিতা ? 
কবিতা আসবে কেন ? আমার এখনো লেখার টেবিল জোটেনি,
তার কি টেবিলের অভাব আছে ? সে সুসজ্জিত টেবিলে টেবিলেই যাবে।



যখন ঘুমচাঁদ জাগে সুরেলা নেশায়

উঠোনে মরাচাঁদ নেমে এলে আমার দোতারা ধানি রাগে সরগম ধরে
সেই আরোহে নক্ষত্রেরা উজ্জ্বল হয়, সেই অবরোহে ধানখেতের তারুণ্য 
মেপে নেয় প্যাঁচাপরিবার, সময়ের তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বেঁধে নেয় সুরেলা ঘণ্টা
শিউলি আর শিশিরের গন্ধ মেখে প্রাণ পায় মরাচাঁদ
তখন ধানিরঙে বাজে মালকোশ, শিশুচাঁদ শিউলিবিছোনো উঠোনে
ঘুম যায় দূর থেকে পুকুর ডোবা খালের জলতরঙ্গে ঘা খেয়ে 
আধোঘুম বালকের মতো টলমল ঠেলে আসে বাঁশি আর মাদলের বোল
সেই ধীরলয় স্রোতে নৌকো বায় হারু মাঝি আর হাল ধরে হেলু দাস
যা এই টিলাগাঁয়ের শ্রেষ্ঠ যুগলবন্দি ঝলমল আসর থেকে খুব দূরে
অন্ধকার আটচালায় সাপ ব্যাং গাছ পাখি ঘুম ভুলে জাগে
সেই সুরেলা নেশায় ধানি রাগে, মালকোশে, রামদাস-ই মল্লারে 
বাঁশি বাজে,  দোতারায় মিশে যায় জলের চলাৎছল, আর বুকের তুফান
এইসব নিয়ে ভাবি, বাংলার সারাদেহে যত রূপ আর কি কোথাও ?  আর কি কোথাও ? 

Post a Comment

0 Comments