পর্ব ২
অরিজিৎ লাহিড়ী
ঋতব্রত জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঠোঁটে আধজ্বলা সিগারেট। আশেপাশের জগতটা যেন দুলে উঠছে—দূরের আলো, হাওয়া, গাছপালা—সবই কোনও অচেনা ফ্রিকোয়েন্সিতে।
একটা মুহূর্তের জন্য তিনি বুঝতে পারলেন না কোথায় আছেন। কিংবা কখন। পায়ের নিচে কালো বালির মতো কিছু, মাথার ওপরে ছিন্নভিন্ন আকাশ। সময় অদৃশ্য।
আর ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক। সাদা ধুতি, খাটো চাদর। পায়ে খালি। মুখে অদ্ভুত নিষ্পৃহতা। চেনা লাগে, অথচ চেনা নয়।
লোকটা শুধু বললেন—‘চল। যুদ্ধ শুরু হবে।’
ঋতব্রত ঠোঁট থেকে সিগারেট নামালেন। কিছু বলতে গিয়ে গলা আটকে গেল।
লোকটা আবার বললেন—‘তুমি জানো না? আজ কলিঙ্গ আক্রমণ হবে।’
ঘন ধোঁয়ার মতো কিছু চারপাশে ঘুরছে। নদীর মতো একটা রেখা, কিন্তু জল নেই—শুধু বালি, পাথর আর ভাঙা ইমেজ। হঠাৎ মনে হল সব কিছু আট-বিট গ্রাফিক্সের মতো ফেটে যাচ্ছে।
🍂
ঋতব্রত ফিসফিস করে বলল— ‘তুমি কে?’
লোকটা তাকালেন। চোখ দুটো অসম্ভব কালো—যেন গহ্বর। আর মুখটা? কিছুটা চিনতে পারা যায়—পুরনো মুদ্রার গায়ে খোদাই করা মুখের মতো।
‘অশোক,’—লোকটা নাম বললেন।
‘অশোক...’ ঋতব্রত গুনগুন করে। ‘কিন্তু...’
অশোক বললেন— ‘কিন্তু আমি সেই অশোক নই। যে অশোককে জানো, যে যুদ্ধ করে অনুতপ্ত হয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে—সে মিথ্যে। আমি যুদ্ধ করিনি। কোনও যুদ্ধ হয়নি।’
ধোঁয়া ঘনিয়ে এল। শব্দ থেমে গেল। শুধু হাওয়া।
ঋতব্রত নিজের দিকে তাকালেন। তাঁর হাত গলে যাচ্ছে। আঙুলের সীমা নেই। শরীরের রেখা ভেঙে যাচ্ছে। সময় থেমে যাচ্ছে।
অশোক বলে চলেছেন, ঠান্ডা গলায়, ধীর গতিতে—‘ইতিহাস বানানো হয়। মানুষের বিশ্বাস দরকার। তাই কলিঙ্গ যুদ্ধের গল্প লেখা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের জন্য। নতুন সাম্রাজ্যের জন্য। আমি ছিলাম মুখ। চরিত্র। কিন্তু যুদ্ধ? শিলালিপি? সবটাই একধরনের নির্মাণ—সিম্যুলেশন। যেমন এখন তুমি।’
ঋতব্রত হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। কানে ভেসে এল বীভৎস যন্ত্রের শব্দ, গ্লিচ করা স্ট্যাটিক। আকাশ ছিঁড়ে পড়ল। পাখিরা উল্টো দিকে উড়ছে। আলো কালো হয়ে যাচ্ছে।
‘তবে কি... আমি...?’
অশোকের হাসি ঠোঁট ছুঁয়েও ছোঁয় না।
—‘তুমি একটা চরিত্র মাত্র। একটা স্ক্রিপ্ট। একটা ভুল। যেমন আমি।’
ধোঁয়া। ছায়া। শূন্যতা।
সব শেষ।
ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে অশোক এগিয়ে আসেন। তাঁর পা পড়ে না, যেন ভাসছে। শরীরের রেখাগুলো স্পষ্ট নয়—কখনও ভেঙে যাচ্ছে, কখনও গলে পড়ছে প্যারালাক্স লেয়ারের মতো।
ঋতব্রত উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পা যেন বালির মধ্যে ডুবে আছে। শরীরের ভার, সময়ের গতি—সব ভুলে গেছেন যেন। ঠোঁটে শেষ সিগারেটটা ঝলসাচ্ছে, অথচ আগুন ছড়াচ্ছে না। ধোঁয়া জমে উঠছে চশমার কাচে, মস্তিষ্কের কোষে।
‘আমি কি... মরছি?’ ঋতব্রত নিজের গলা চিনতে পারেন না।
অশোক এবার কাছে এসে থামেন। তাঁর মুখের ত্বক ঠান্ডা পাথরের মতো। ত্বক নয়, যেন কোনও থ্রিডি ম্যাপিং-এর ফল।
‘মৃত্যু একটা কনসেপ্ট,’ অশোক শান্ত গলায় বলেন। ‘যেভাবে জীবন একটা কনসেপ্ট। আসল বলতে কিছুই নেই।’
পেছনে দূরে কোনও কিছুর বিস্ফোরণ ঘটে। অথচ শব্দ নেই। কেবল আলো আর ছায়া।
‘তবে কলিঙ্গ?’ —ঋতব্রত ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন।
‘কলিঙ্গ ছিল না,’ অশোক বলেন, ‘আমাকে ব্যবহার করা হয়েছিল। নির্মাণ করা হয়েছিল এক রূপকথা। যুদ্ধ, করুণা, ধর্মান্তর—সবকিছুই একটা প্যাকেজড গল্প। সভ্যতার জন্য দরকার ছিল একজন নায়ক-ভিলেন। তাই আমাকে সাজানো হয়েছিল। যেমন আজও সাজানো হচ্ছে।’
একটা কাঁপুনি ঋতব্রতের শরীর ছুঁয়ে যায়। চোখের সামনে দৃশ্যগুলো ভাঙছে। পেছনের সমুদ্র হঠাৎ করে বাইনারি কোড হয়ে পড়ছে। ০ আর ১।পাথর ভেঙে যাচ্ছে পিক্সেলের মতো। আকাশ ফেটে যাচ্ছে—তার ফাঁক দিয়ে কালো শূন্যতা।
‘কিন্তু আমার জন্ম, আমার স্মৃতি?’ ঋতব্রত বলার চেষ্টা করেন।
অশোক তাঁর দিকে তাকান। চোখের ভিতর কোনও আলো নেই, কেবল প্রতিফলন—ঋতব্রতের মুখের।
‘তোমার জন্মও গল্প। স্মৃতিও গল্প। শুধু একটু বেশি “বিশ্বাসযোগ্য” করে লেখা হয়েছে।’
মাটির ফাঁক দিয়ে হাত বেরোচ্ছে। না, মানুষ না—মডেল, পুতুল, কাদামাটির অবয়ব। তারা ঋতব্রতের পা ছুঁয়ে দিচ্ছে।
‘তুমি যদি চাও, এখানেই শেষ করতে পারো। তুমি ফিরেও যেতে পারো। অথবা তুমি জানতে পারো আরও—সবকিছু। কে লিখেছে এই গল্প। কেন। কারা।’
ঋতব্রত হোঁচট খান। তাঁর ভেতরের কণ্ঠস্বর বলে ওঠে—‘আমি ফিরে যাব না।’
অশোক হেসে ওঠেন—চেনা নয়, ভাঙা হাসি।
—‘তবে চলো।’
হঠাৎ করেই চারপাশ বদলে যায়।আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে শত শত রক্তাক্ত মূর্তি। মুখ নেই, চোখ নেই, গলিত দেহ। অশোকের ঠান্ডা গলা—‘এই যে তোমার কলিঙ্গ। এই যুদ্ধ কেউ দেখেনি। কোনও যুদ্ধ হয়নি। অথচ রক্ত, লাশ, কান্না—সব আছে। কারণ এটা লাগবে। কারণ মানুষ গল্প চায়। গল্প না থাকলে ক্ষমতা থাকে না।’
ঋতব্রত চিৎকার করতে চান। গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোয় না।
—‘তুমি কি এখনও বিশ্বাস করতে চাও? নাকি তুমি দেখতে চাও সত্যের গর্ভ?’
শেষ শব্দগুলো ধ্বনিত হয় বহু প্রতিধ্বনির মধ্যে। ঋতব্রত টের পান—নিজের ত্বক খসে পড়ছে, মনে পড়ছে হাজার বছরের পুরনো স্মৃতি, যেগুলো তার ছিলই না। সে বুঝতে পারে—এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে তারও বানানো গল্পের মধ্যে।
সবকিছু ঘূর্ণায়মান। ছায়া। পিক্সেল। গ্লিচ।
অন্ধকার।
হাওয়া থেমে গেছে। শব্দ নেই। আলো নেই। কেবল অন্ধকারের শরীরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ঋতব্রত আর অশোক।
অথচ সে দেখতে পাচ্ছে—একসাথে সবকিছু। ভাঙা, গলে যাওয়া, পুনর্গঠিত।
তার চারপাশে ছায়া-মূর্তি। কারও মুখ নেই, কারও হাত নেই, কারও পায়ের বদলে ধোঁয়ার রেখা। কারও গায়ে টাঙ্গানো তাম্রলিপি—অশোকের শিলালিপি। কারও হাতে পুরনো ধর্মগ্রন্থ—সেই ‘অশোক’ এর আদেশ লেখা।
অশোক চুপ করেন। তাঁর শরীরের অর্ধেক গলে গেছে। পাথরের মত একপাশ। অন্য পাশে ছায়া।
—‘তুমি জানো, ইতিহাস কখনও ছিল না। ছিল না কোনও ঘটনা—শুধু গল্প। গল্পের পর গল্প। সেই গল্পের ভিতর নতুন গল্প। এবং সেই গল্পে জন্ম মানুষের।’
ঋতব্রত দাঁড়িয়ে থাকেন। হাঁটু কাঁপে। মুখের ভেতর একটা স্বাদ—কেমন যেন জং ধরা লোহা, ধাতুর স্বাদ।
‘তুমি কি জানো,’ অশোক আবার বলে ওঠেন, এবার গলা গভীর, রোবটের মতো—‘আমার মুখ ব্যবহার করেছে যারা, তারা আর আমার মধ্যে নেই। আমার স্মৃতি আর আমার নয়। আমি কে—সেটা আর আমি নিজেও জানি না। কারণ চরিত্রগুলোর আত্মা থাকে না। থাকে শুধু পুনরাবৃত্তি।’
কুয়াশা উঠে আসে মাটি থেকে। জল নয়, ঘোলাটে তথ্যের প্রবাহ। বার কোড, ডাটা স্ট্রিম, অসমাপ্ত কথোপকথন।
অশোক বললেন—‘তুমি দেখবে? আরও গভীরে?’
ঋতব্রত মাথা নাড়ে। বা না নাড়ে—তাও সে জানে না। শরীরের সীমা ঘোলাটে।
হঠাৎ করে আকাশ খুলে যায়। যেন একটা ফিল্মের পর্দা ছিঁড়ে গেছে। ওপারে—কিছু নেই। শূন্য। অথচ সেই শূন্যতায় ভাসছে ছবি।
—এক ফ্রেমে একজন হিটলার দাঁড়িয়ে আছে এক সমুদ্র সৈকতে।
—এক ফ্রেমে একজন গান্ধী হাত নাড়ছে।
—এক ফ্রেমে এক যুবক চিৎকার করছে—তার গায়ে এসে লাগছে পুলিশের বুটের লাথি।
—আর এক ফ্রেমে অশোক—দু'চোখ গহ্বর।
সবাই একই সঙ্গে, একই স্থানে, অথচ আলাদা। সব বাস্তব, সব মিথ্যে। সব একসাথে।
ঋতব্রতর মনে হয় সে কেঁদে ফেলবে। অথচ চোখে জল নেই। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না।
‘আমার দেখা প্রথম যুদ্ধ,’ অশোক বললেন, ‘হয়তো কোনদিনই হয়নি। হয়তো আমি শুধুই ভ্রান্তি। হয়তো তুমি, এই কথোপকথন—সবই।’
শব্দ ফেটে পড়ে।চারপাশে পাথর ভাঙে।আলো কালো হয়ে যায়।একটা কণ্ঠস্বর—হয়তো অশোকের, নয়তো কারও—বলে ওঠে:
‘যা দেখছ, তা দেখছ না। যা জানছ, তা জানছ না। কারণ সত্যি বলে কিছু নেই। আছে শুধু... স্মৃতি। আর স্মৃতিও এক ধরণের... শৈল্পিক মিথ্যা।’
ঋতব্রত পড়ে গেলেন। যেন গলে যাচ্ছেন। খসে পড়বেন।
তার মাথার ভিতর ভেসে ওঠে শুধুই ভাঙা ইমেজ—
‘ধর্ম’,‘রাজনীতি’,‘ইতিহাস’,‘পরিচয়’—সবই এলোমেলো কোড। সবই অশুদ্ধ, অসমাপ্ত, অসম্পূর্ণ।
চারপাশে কুয়াশা। আলো ফ্যাকাশে। শব্দ ভাঙা। স্ক্রিনের মতো দুলছে সময়, দুলছে দৃষ্টিভঙ্গি।
ঋতব্রত দেখতে পান—দূরে কোথাও একটা কিছুর রেখা। অন্ধকারের মধ্যে কোনও একটা পাঠ্য উঁকি দিচ্ছে।একটা চিঠি।হাতের লেখা।পুরনো কালি।বিস্মৃত প্যাঁচানো অক্ষর।
লালচে আলোয় ভেসে ওঠে সেই পাতাটি—
‘যুদ্ধ একটি মিথ্যা। সম্রাটের রূপ, ধর্মের উত্থান, সমস্ত ইতিহাস কেবলমাত্র একটি নির্মিত দৃশ্য।আমরা, যারা লিখেছি, তারাও জানি না আর সত্য কোথায়।কিন্তু তুমিই শেষ প্রত্যক্ষদর্শী।তুমি ছাড়া কেউ জানবে না এই বিশ্বের প্যাটার্ন ভেঙে গেছে।’
চোখের সামনে লেখা ঝাপসা হয়ে যায়।অক্ষর গলে পড়ে।চিঠির কাগজটা হঠাৎ বেজে ওঠে—বীভৎস হাসির মত এক আওয়াজে।
অন্ধকার কেটে গিয়ে সবকিছু পরিষ্কার হয়।
ঋতব্রত বিছানায় উঠে বসে। বুক ধকধক করছে। চারপাশে সিগারেটের ধোঁয়া। জানালা ফাঁকা।
কিন্তু—ঘড়ির কাঁটা চলে না।
আর ঠিক সামনে বসে আছেন ডক্টর হেমাঙ্গ হাজরা।
অস্বাভাবিক হাসছেন তিনি। সেই চিঠিটা তাঁর হাতে। চোখে চকচকে পাগলামি। ঠোঁটে আধজ্বলা ভেপ।
‘ভাই, শোন—সব ফেক, বুঝলি? সব... ফ্রিকিং ম্যানিপুলেশন!’—হাজরার গলায় জেন-জি-দের মত ঠাট্টা, ঠোঁট বাঁকানো, তাচ্ছিল্য।
তিনি কাঁধে জ্যাকেটটা এলোমেলোভাবে চাপিয়েছেন, একটা সিলভার চেইন ঝুলছে, চোখে সানগ্লাস তোলা। হাসছেন। হাসতে হাসতে চিঠিটা ধরে আছেন।
ঋতব্রত কথা বলতে পারেন না। গলা শুকিয়ে গেছে।
ডক্টর হাজরার শরীরের রেখা মিলিয়ে যাচ্ছে। যেন সিগন্যাল লস।তাঁর মাথার একপাশ ফেটে গিয়ে পিক্সেল বেরোচ্ছে।হাতটা গলে যাচ্ছে ট্রান্সপারেন্ট কাচের মতো।আরও হাসছেন তিনি। ঠোঁটে সেই ভয়ংকর বিদ্রূপ—‘ইতিহাস? হা হা হা... ভাই, গেট রিয়েল! উই আর অল এফিং এলগরিদম।’
সাথে সাথেই আলো নিভে যায়।
0 Comments