বিড়ম্বনা
সজল কুমার মাইতি
“নন্দীদা, এই দেখুন। অ্যাকে ট্রেন লেট, তার ওপর স্টেশন মাস্টারের কাছ থেকে লেট স্লিপ জোগাড় করতে আরও কুড়ি মিনিট লেগে গেল। আর বলবেন না! এই হয়েছে যত ঝক্কি!”
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে তার অফিস চেয়ার টেনে বসে পড়ে এলডিসি ক্লার্ক দত্ত।
যার উদ্দেশ্যে এই সব কথা সেই নন্দীদা সরকারি অফিসের এক বিভাগের বড় বাবু। নন্দীদার সংক্ষিপ্ত উত্তর
“হুম”
নন্দীদা হায়ার হেকেন্ডারি পাশ করে এই বিভাগেই এলডিসি হিসেবে জয়েন করেছিলেন। মধ্যিখানে দু একবার অন্য বিভাগে যে ট্রান্সফার হন নি তা নয়। কিন্তু আবার এই বিভাগেই ফিরে এসেছেন। ধীরে ধীরে এলডিসি থেকে ইউডিসি, তা থেকে সিনিয়র ইউডিসি। আর এখন চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে প্রান্তিক প্রমোশন ও পোস্টিং এই বড়বাবুর চেয়ার।
তা এই নন্দীদা কিন্তু সবার প্রিয়। তিনি স্বল্পবাক, অত্যন্ত পাংচুয়াল, ভদ্র ও বিনয়ী। চাকরি জীবনের এতদিন অন্য ছুটি তো দূরের কথা, চোদ্দটা ক্যাজুয়াল লিভ ই নেওয়া হয়ে ওঠে নি। এমন দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ কর্মচারি একালে সত্যিই হাতে গোনা কিছু হয়তো আছে। এজন্য হয়তো সংসার, পরিবারের প্রতি তিনি কম দায়িত্বশীল নন কিন্তু। আবার সহকর্মীদের সঙ্গে ও নিয়মবিধি মেনে সুসম্পর্ক ও বজায় রাখতে পেরেছেন এ বাজারে। অনেকেই আবার নিজেদের মধ্যে মজা করে বলে “নন্দী আঁটে যত ফন্দি”। তা এই নন্দীদা সামাজিক অনুষ্ঠানে ও সমানভাবে অংশগ্রহণ করে থাকেন। কোনো বাহানা দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার মানুষ তিনি নন। বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, এমনকি সহকর্মীদের কোনো অনুষ্ঠানে ও নন্দীদা আমন্ত্রিত হলে নিশ্চিত হাজির।
অনুষ্ঠানের নাম করতেই অনুষ্ঠান হাজির। অফিসের সহকর্মী ঐ দত্তর মেয়ের বিয়ে। নন্দীদার স্পেশাল নেমন্তন্ন। দত্ত সবার নজর এড়িয়ে নন্দীদাকে আলাদা করে নিজের হাতে কার্ড তুলে দেয়। বলে
“দাদা, আপনাকে অবশ্যই আসতে হবে। আমার মেয়েকে আশীর্বাদ করবেন।”
বিনয়ী নন্দীদা
“ অবশ্যই। আপনার মেয়ের বিয়ে। তাছাড়া এত করে বলছেন। না গিয়ে থাকতে পারি?”
একটু ইনিয়ে বিনিয়ে দত্ত বলে
“ নন্দীদা, একটা কথা বলবো? না, যদি মনে কিছু না করেন!”
“না না না। এতে মনে করার কি আছে? মন খুলে বলুন।”
“না, বলছিলাম। আপনি তো কিছু গিফট দেবেন।”
“হ্যাঁ। তা তো দেব ই। আমার ক্ষমতা মতো তো দেব।”
“তা, বলছিলাম কি দাদা। এখন প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতে এইসব জিনিস বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কল্যাণে একাধিক করে আছে।”
“ হ্যাঁ। তা একদম ঠিক বলেছেন। এই তো আমাদের বাড়িতেই প্রেশার কুকার তিনটে হয়ে গেছে।”
“ আমাদের ও। তাই বলছি কি এখন এসবের জন্য কেউ গিফট কিনে দেয় না। তার চেয়ে ক্যাশ দিয়ে দেওয়া ভাল। তাই না? আপনি কি বলেন?” দত্তের অনিসন্ধিৎসু প্রশ্ন।
🍂
“ বলছেন? তাহলে তাই দেব।”
“ আর বলছিলাম কি? লোকে তো আবার গিফটখামে করে টাকা দেয়।”
“ হ্যাঁ তো। এমনি খোলা দেওয়া যায় নাকি?” নন্দীদার বিস্ময় মিশ্রিত প্রশ্ন।
“ তা ঠিক। কিন্তু আমি বলি কি? এই একটু ভাল খামের দাম এখন পঞ্চাশ টাকা।”
“ তা হবে হয়তো?” নন্দীদার সারল্য ভরা সায়।
“ তা ঐ খামে খরচ না করে ঐ পঞ্চাশ টাকা আপনার ক্যাশ গিফটের সঙ্গে জুড়ে দিলে ভাল হয় না?” দত্তর ডিপ্লোমেটিক চাল।
“ ঠিক আছে। তাহলে তাই করবো।“
“ নন্দীদা, আর একটা অনুরোধ করবো?”
“ করুন না!” নন্দীদার মনে অজানা অনিশ্চয়তার দোদুল্যমানতা।
“ আপনি বরং একটা ছোট্ট কাগজে আপনার নাম ও কত দিচ্ছেন লিখে দেবেন। আসলে অনেকেই তো দেবে। তা লেখা থাকলে বোঝা যাবে কোনটা কার।”
নন্দীদা মাথা নেড়ে সম্মতি জানান।
এরপর একসময় বিয়ের দিন আসে। যথারীতি নন্দীদা হাজির। পাঞ্জাবির পকেটে পনের শ পঞ্চাশ টাকা একটি গার্ডারে বাঁধা। তার সঙ্গে একটুকরো কাগজে নিজের নাম ও টাকার পরিমাণ লেখা। বিয়েবাড়িতে কন্যা দর্শন হলো। পরিচিতর আনুষ্ঠানিকতা শেষে কন্যাকে নন্দীদা সযত্নে টাকার উপহার তুলে দিলেন। সহকর্মীদের অনেকের সঙ্গে দেখা, কথাবার্তা হলো। সবশেষে খাওয়া দাওয়ার পালা। নন্দীদা স্বল্পাহারি। নিজের পছন্দ মতো যৎকিঞ্চিৎ খেয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
পরের দিন রবিবার। অফিস ছুটি। নন্দীদা সকালের পেপার নিয়ে পড়ছিলেন। সঙ্গে চায়ের কাপ। এমন সময় মোবাইলে দত্তর ফোন।
“ গুড মর্নিং নন্দীদা। কাল সব ঠিক ছিল?”
“ হ্যাঁ হ্যাঁ। সব ঠিক ছিল। বেশ ভাল ই ছিল। সব ব্যবস্থা খুব সুন্দর ছিল।“ নন্দীদার আন্তরিক স্বীকৃতি।
“ কিছু যদি মনে না করেন, একটা কথা বলবো?”
“ বলুন।”
“ মনে হয় তাড়াহুড়োয় একটা ভুল হয়ে গেছে।”
“ কি ভুল হলো?” নন্দীদার বিস্ময় জিজ্ঞাসা।
“ আপনার কাগজে লেখা ছিল পনের শ পঞ্চাশ টাকা। মনে হয় একটা পাঁচ শ টাকার নোট গার্ডারে ঢোকাতে ভুল হয়ে গেছে। আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আপনি পাঁচ শ টাকা আমায় ইউপিআই করে দিতে পারেন।”
কিছুক্ষণ নন্দীদা মোবাইল হাতে অকস্মাৎ বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে থাকেন। ওপার থেকে তখন দত্ত বলতে থাকে
“ হ্যালো, হ্যালো। হ্যালো নন্দীদা। শুনতে পাচ্ছেন?”
দত্তর চিৎকার বিস্ময়াবিষ্ট নির্বাক নন্দীদার কর্নকূহরে প্রবেশ পথ খুঁজতে ব্যর্থ হয়ে মুঠোফোনের দেওয়ালে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে…….
0 Comments