লোভী ঘিওয়ালা
সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস
কথক- শম্ভু দাস, গ্ৰাম- যুগীশোল, থানা- নয়াগ্ৰাম, জেলা- ঝাড়গ্ৰাম
অনেকদিন আগে উদয়পুর গ্রামে শান্তি নামে এক দুধওয়ালী থাকত। শান্তির দিন শুরু হত রাত থাকতে থাকতেই। ঘুম থেকে উঠে তার প্রথম কাজ গোয়ালঘর পরিষ্কার করা, কমলাকে খেতে দেওয়া। এই কমলা হল শান্তির গরুর নাম। শান্তি কমলাকে খুব ভালোবাসত। এই কমলার একটা ছোট্ট ছানা ছিল। শান্তি তার নাম দিয়েছিল ধবলী। কমলা আর ধবলীকে নিয়ে শান্তির দিন কাটত। এরা ছাড়া তিনকুলে শান্তির আর কেউ ছিল না।
শান্তি দুধ দুয়ে ধবলীকে খাইয়ে দুধ জাল দিতে বসত। তারপর সেই দুধ দিয়ে ঘি তৈরি করত। শান্তির হাতের তৈরি ঘিয়ের খুব নামডাক আছে উদয়পুর গ্রামে। উদয়পুর গ্রামে সবাই শান্তির কাছ থেকে ঘি নেয়। শুধু উদয়পুর নয় আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্ৰামে শান্তির ঘিয়ের নামডাক রয়েছে।
শান্তি ঘি তৈরি করে বেলা থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়ে। গ্ৰামের পথে পথে সে ঘি বিক্রি করে বেড়ায়। আর সুর করে ডাক পাড়ে-“ঘি নেবে গো ঘি বিশুদ্ধ ঘি, তাজা ঘি, ঘি নেবে গো ঘি। ঘি নেবে গো ঘি ভালো ঘি, বিশুদ্ধ ঘি, ঘি নেবে গো ঘি।”
🍂
শান্তির গলার আওয়াজে গ্ৰামের সবাই ব্যাকুল হয়ে উঠত। কেউ বলে আমায় এক কিলো দাও, কেউ বলে আমায় তিন কিলো দাও। এইভাবে শান্তি ঘি বিক্রি করত। আর এমনিভাবেই তার দিন কেটে যেত।
শান্তির উন্নতি দেখে তার প্রতিবেশী কালু ও তার বউয়ের খুবই হিংসা হয়। তাই তারা বর-বউ মিলে পরিকল্পনা করে যে তারাও শান্তির মতো ঘিয়ের ব্যবসা করবে।
একদিন কালু তার বউকে বলে-“দেখ গিন্নি, আমাদেরও গাই গরু আছে। তাই আমরাও ঘিয়ের ব্যবসা শুরু করতে পারি।”
তখন তার বউ বলে-“কিন্তু শান্তির যেখানে এত নামডাক সেখানে আমাদের ঘি কী কেউ নেবে?”
কালু বলে-“নেবে না মানে, সবাই নেবে। শুধু আমাদের একটু বুদ্ধি খাটাতে হবে এই আর কী।”
তার বউ বলে-“কী বুদ্ধি শুনি?”
কালু বলে-“আমরা শান্তির থেকে কম দামে ঘি বিক্রি করব।”
তখন তার বউ বলে-“কিন্তু তাতে তো আমাদেরই লোকসান হবে।”
কালু তখন বলে-“কেন গো গিন্নি, আমরা খাঁটি ঘি কম দামে দিতে যাব কেন। আমরা যে ঘি বেচব তাতে অর্ধেক থাকবে ঘি আর অর্ধেক থাকবে ঘিয়ের গন্ধযুক্ত সুগন্ধি তেল। কেউ কিছুটি বুঝতে পারবে না হা হা হা।”
এইভাবে তারা ঘিয়ের ব্যবসা শুরু করল।
ঘি তৈরি করে কালু প্রথমে যায় মোড়ল গিন্নির কাছে। কারণ সে জানে মোড়ল গিন্নিকে খুশি করতে পারলে পুরো গ্ৰামকে সে তার কব্জায় আনতে পারবে।
মোড়লের বাড়ি পৌঁছে কালু ডাকতে থাকে-“গিন্নিমা, ও গিন্নিমা ঘি নেবে গো ঘি। একেবারে খাঁটি ঘি।”
কালুর ডাক শুনে মোড়ল গিন্নি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেন-“না গো কালু ভাই আমি ঘি নেব না। আমি তো শান্তির কাছ থেকে ঘি নিয়ে থাকি। তাই তোমার কাছ থেকে ঘি নেব না। শান্তির ঘি খুব ভালো।”
এই শুনে কালু বলে-“এই দেখুন গিন্নিমা, আমি কী আপনাকে খারাপ ঘি দেব নাকি? আপনি একবার আমার ঘিয়ের গন্ধটা শুঁকে দেখুন না দেখুন দেখুন।”
এই বলে কালু ঘি রাখা পাত্রের ঢাকনাটা খুলে। ঢাকনা খুলতেই সুগন্ধি তেলের গন্ধ মোড়ল গিন্নিকে মাতিয়ে তোলে।
মোড়ল গিন্নি বলেন-“বাঃ গন্ধ তো বেশ ভালো। কই শান্তির ঘিয়ে তো এরকম গন্ধ নেই।”
তখন কালু বলে-“আজ্ঞে গিন্নিমা, কী আর বলব। আমি কাউকে ছোটো করছি না তবুও বলছি ওই শান্তি দুধে এত জল মেশায় যে জাল দিলে ওই ঘিয়ের গন্ধটা একেবারে চলে যায়। তাই আপনি ওর ঘিয়ে গন্ধ পান না। আর একটা কথা গিন্নিমা আপনি যে দামে শান্তির কাছ থেকে ঘি নেন তার থেকে অর্ধেক দামে আমি আপনাকে ঘি দেব।”
এই কথা শুনে মোড়ল গিন্নি খুশি হয়ে যায়। আর মোড়ল গিন্নি সারা গ্ৰামে ছড়িয়ে দেন যে শান্তি একজন ঠক, জোচ্চর এবং মিথ্যাবাদী। সে দুধে জল মেশায়। আর এও বলেন যে কালু শান্তির থেকে অনেক কম দামে অনেক ভালো ঘি দেয়।
এই শুনে গ্ৰামের মানুষ আর শান্তির কাছ থেকে ঘি নেয় না। কালু হয়ে ওঠে গ্ৰামের শ্রেষ্ঠ ঘি ব্যবসায়ী।
এর জন্য শান্তির আয় কমে যায়। তাই সে খুবই অল্প পরিমাণ ঘি তৈরি করে অনেক দূর দূর গ্ৰামে বিক্রি করে। এরকম মিথ্যে অপবাদ বয়ে বেড়াতে শান্তির খুবই কষ্ট হয়। তাই ঘি বিক্রি করে আসার পর রাত্রে কমলা ও ধবলীকে জড়িয়ে ধরে সে কাঁদতে থাকে। আর বলে-“কমলা, কমলা বল তো আমার কী দোষ? সবাই আমাকে কেন ভুল বুঝলো?” এই বলে সে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে । আর তার কান্না দেখে কমলার চোখও ছলছল করে উঠে।
একদিন শান্তি দূর গ্ৰামে ঘি বেচতে যাচ্ছিল। তখন এক গ্ৰামবাসী তাকে ডেকে বেশ কড়াভাবে বলল-“এই যে শান্তি, তোমাকে তো আমরা ভালো বলে মনে করেছিলাম। কিন্তু তুমি এতদিন আমাদের ঠকালে। কালুর ঘিয়ের গন্ধ তোমার ঘিয়ের থেকে অনেক ভালো অনেক অনেক ভালো আর দামও তোমার থেকে অর্ধেক হ্যাঁ। ছি ছি শান্তি ছি।”
শান্তি মুখ বুজে সব কথা শুনে। সব শুনে সে ঘরে ফিরে এসে কমলাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। তার কান্না দেখে কমলাও আজ কেঁদে ফেলল।
এদিকে কালুর খুশি আর ধরে না। তার বিক্রি বেড়েছে। তাই সে আরও লাভের আশায় ঘিতে আরও বেশি পরিমাণ ভেজাল জিনিসপত্র মেশাতে থাকে এবং সেই ভেজালযুক্ত ঘি গ্ৰামের পথে পথে বিক্রি করতে বের হয়।
এইভাবে ঘি বেচতে বেচতে সে পৌঁছায় সত্য হালুইকরের কাছে। কালুকে দেখে সত্য তাকে ডাকতে থাকে-“কালু ভাই ও কালু ভাই, আজ আমাকে চার কিলো ঘি দাও তো।”
কালু সত্যকে বলে-“কেন গো সত্য আজ এত বেশি ঘি নিচ্ছ, কোনো অনুষ্ঠান আছে নাকি হে?”
সত্য বলে-“ওমা কালু ভাই, তুমি জান না আজ জমিদারবাবুর নাতির মুখেভাত? এর জন্য তো এত ঘি নিচ্ছি। জমিদারবাবু আমাকে বলেছেন দেশি ঘিয়ে ভাজা মিষ্টি বানাতে।”
কালু তখন বলে-“ও এই ব্যাপার।”
এরপর কালু চার কিলো ঘি ওজন করে সত্যকে দিয়ে দেয়। সত্য ওই ঘি দিয়ে মিষ্টি তৈরি করে।
সত্যর বানানো ওই মিষ্টি খেয়ে গ্ৰামসুদ্ধ সবার শরীর খারাপ হয়ে যায়। এমনকি জমিদারবাবু নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তলব পড়ে সত্য হালুইকরের।
সত্য জমিদার বাড়ি পৌঁছালে জমিদারবাবু সত্যকে দেখে বেশ কড়াভাবে বললেন-“কী সে সত্য, তোমার তৈরি মিষ্টি খেয়ে গ্ৰামের সবাই এমনকি আমিও অসুস্থ হলাম কী করে শুনি? তুমি তো জানো ভেজাল মেশানো কত বড়ো পাপ। শোন, এর জন্য আমি তোমাকে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দেব।”
এই শুনে সত্য খুবই ভয় পেয়ে যায়। একে রাসভারী জমিদার তার উপর এত গম্ভীর গলা সত্যর হাত পা ভয়ে কাঁপতে থাকে।
কোনোরকমে ঢোক গিলতে গিলতে সত্য বলে-“আজ্ঞে বাবু, খাবার খেয়ে আমিও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন বাবু আমি ছানাতে কোনো ভেজাল মেশাইনি। শুধু ঘি নিয়েছিলাম কালুর কাছ থেকে।”
এই শুনে গ্ৰামবাসীরা রে রে করে সত্যর দিকে তেড়ে আসে। তারা বলে-“বাঃ বাবা বাঃ নিজের দোষ ঢাকতে বেচারা কালুকে দোষ দিচ্ছ। তোমার লজ্জা করে না সত্য। আমরা সবাই তো ওর কাছ থেকে ঘি নি কই আমাদের তো শরীর খারাপ হয় না। নিজের দোষ স্বীকার করো যে ছানাই খারাপ ছিল।”
সত্য মনে মনে ঠিক করল কালুকে সে ধরবেই। তাই সে মোড়লমশাইয়ের কাছে গেল। আর মোড়লকে বলল-“মোড়লমশাই, আমি সত্যি বলছি আমার ছানায় কোনো ভেজাল ছিল না। আমার মনে হয় ঘিতেই কোনো সমস্যা ছিল। আপনি যদি দয়া করে আমার সঙ্গে একটিবার কালুর বাড়ি যান তাহলে কে সত্য বলছে কে মিথ্যা বলছে তা প্রমাণ হয়ে যাবে।”
মোড়লমশাই তখন বলেন-“আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে ঠিক আছে আমি যাব তোমার সঙ্গে।”
এর পরেরদিন কাকভোরে সত্য আর মোড়লমশাই দুজনে কালুর বাড়ি পৌঁছে যায়। আর তারা লুকিয়ে লুকিয়ে কালুর বাড়ির জানালা দিয়ে দেখতে থাকে কালু কী করছে? তারা দেখে কালু ও তার বউ ঘিয়ে সুগন্ধি দ্রব্য মেশাচ্ছে।
এই দেখে মোড়লমশাই ও সত্য ঘরে ঢুকে পড়েন। ঘরে ঢুকে মোড়লমশাই কালুকে বলে-“ছি কালু ছি তুমি এত নীচ যে খাবারের জিনিসে ভেজাল মেশাচ্ছে।”
এছাড়া সত্য বলে-“তোমার ভেজাল মেশানো ঘি খেয়ে গ্ৰামের সব মানুষ অসুস্থ হয়েছিল। আর সব দোষ আমার উপরে চাপিয়ে তুমি সাধু সেজেছিলে। চলো আজ জমিদার বাড়ি চলো সেখানেই তোমার বিচার হবে।”
এই বলে তারা কালুকে নিয়ে জমিদার বাড়িতে আসে। আর সত্য ও মোড়লমশাই যা যা দেখেছে তা জমিদারবাবুকে বলে।
তখন জমিদারবাবু বলেন-“খাবারের জিনিসে যারা ভেজাল মেশায় তারাও একধরনের খুনি। তোমাকে এবং তোমার বউকে আমি রাজার কারাগারে বন্দি করব। বাকি যে কয়েকদিন বাঁচবে ওখানে বসে বসে ভাববে যে লোভে পাপ পাপে মৃত্যু।”
তারপর রাজার পেয়াদা এসে কালু ও তার বউকে ধরে নিয়ে যায়। আর গ্ৰামবাসীরাও বুঝতে পারল যে তারা শান্তির প্রতি কতটা অন্যায় করেছে। তাই তারা দল বেঁধে শান্তির কাছে আসে।
মোড়ল গিন্নি শান্তিকে বলেন-“শান্তি আমরা সবাই মিলে তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। তুমি আমাদের ক্ষমা করো।”
এই শুনে শান্তি খুশি হয়ে যায়। সে ছুটে কমলার কাছে চলে যায়। আর কমলাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। কিন্তু এই কান্না তার কষ্টের নয় তা আনন্দের। এই আনন্দ হল তার জয়ের। কারণ শান্তি জানত মিথ্যের কখনো জয় হয় না। সত্য একদিন না একদিন সবার সামনে আসবেই। তাই সবাই চলে যেতে শান্তি কমলা ও ধবলীকে জড়িয়ে ধরে। এদিকে কমলার চোখেও জল সেও কাঁদছে। কিন্তু কমলারও এই কান্না দুঃখের নয় আনন্দের। কারণ সেও শান্তির জয়ে নিজেকে জয়ী মনে করেছে।
0 Comments