জাতীয় সড়ক-৪৪ তথা ০৮
মৌসুমী ভট্টাচার্য্য
ভারতবর্ষের জাতীয় সড়কদের মধ্যে অন্যতম এন্.এইচ.৪৪, (বর্তমানে জাতীয় সড়ক ০৮), ত্রিপুরা থেকে আসাম পর্যন্ত গেছে। কখনো পার্বত্য আঁকাবাঁকা ,কখনো সমতলের উপর দিয়ে এই জাতীয় সড়ক চলে গিয়েছে । ভাগ্য আমাকে নব বিবাহিত জীবনের বেশ কয়েক বছর এই এন.এইচ.৪৪ এর সাথে জড়িয়ে দিয়েছিল।ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে ২০ কিমি(উত্তর দিক থেকে) পেরোলেই শুরু হয় পাহাড়ী রাস্তা। পাহাড়ের উচ্চতা খুব বেশী নয়।আসাম বর্ডার পর্যন্ত যেতে এন.এইচ.৪৪ এর পাশে যে অঞ্চল গুলো আছে,তাদের বেশীর ভাগই আদিবাসী নাম।‘বড়মুড়া’, ‘আঠারোমুড়া’ ইত্যাদি। বড়মুড়া আর আঠারোমুড়ার মধ্যবর্তী সমতল অঞ্চলটির নাম ‘তেলিয়ামুড়া’।আঠারোমুড়া যেখান থেকে শুরু হয়,সেই জায়গায় এক দুরন্ত পাহাড়ী নদীর(খোয়াই নদ)উপর ব্যারেজ বানানো হয়,উদ্দেশ্য গ্রামীণ সেচ ব্যবস্থা।
এই ব্যারেজের শিশু অবস্থায় আমার স্বামী সেখানে কর্মরত ছিলেন।
সদ্য বিয়ের পর আমাকেও তিন চার বছর থাকতে হয়। ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতা। যে সব দুর্ভাগা সিভিল ইঞ্জিনীয়ারদের ভারতবর্ষের নানা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে বাঁধ,ব্যারেজ বানাতে হয়,তাদের আর তাদের পরিবারকে যে কষ্টের সম্মখীন হতে হয়,কত অসুবিধার মধ্য দিয়ে যেতে হয়,তা যারা থেকেছেন,তারাই বুঝবেন।
আমাদের দু জনেরই খুব কম বয়েস,আমি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি মাত্র,আমার স্বামী সদ্য ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করে কেন্দ্রীয় সরকারের এই সংস্থায় জয়েন করে আর চাকমাঘাটে পোস্টেড হন। সেই বয়সে ঐ রকম স্থানে থাকা মানে ‘সীতার বনবাস’ বললেও ভুল বলা হবে না। চারপাশে সবুজ জঙ্গল,পাহাড়,নদী। কি নেই সেই জঙ্গলে!বিষাক্ত সাপ, পোকামাকড়, শেয়াল, হরিণ, অজগর।কতদিন কোয়ার্টারে সাপ ঢুকে গেছল,অল্পের জন্য পা ফেলতে ফেলতে বেঁচে যাই।কত সন্ধ্যায় কোন আদিবাসী হয়ত হরিণ মেরেছে,হরিণের মাংস ইঞ্জিনীয়ারদের দিয়ে গেছে।সেই রাতেই ঐ মাংস রান্না করে পুরো কলোনীতে সবার সাথে ভাগাভাগি করে খেতাম।কারো ফ্রিজ ছিল না ,আমি নিজেও পরে আনাই। পাওয়ার থাকত না,একটু ঝড় বৃষ্টি হলেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ।
🍂
এখন হয়ত হরিণেরা নেই,মেরে নিশ্চিন্হ করা হয়েছে। সবচেয়ে ভয়ংকর সমস্যা ছিল ‘উগ্রপন্থীদের’ সমস্যা। এন.এইচ.৪৪,আর আশেপাশের পাহাড়ে,পাহাড়ী পথে থাকত বারুদের আর রক্তের গন্ধ । ১৯৮০ থেকে শুরু হয়ে প্রায় দু দশক ছিল ত্রিপুরার সেই রক্তঝরা ইতিহাস।এর পেছনে অনেক নোংরা রাজনীতি ছিল।কত যে রক্ত ঝরেছে,কত যে ইঞ্জিনীয়ার প্রাণ হারিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।কত জনকে কিডন্যাপ করা হয়েছে,মোটা টাকার বিনিময়ে প্রাণ নিয়ে ফিরেছেন,অনেকে ফেরেন নি।
আমার একটি ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা মনে হলে শিউরে উঠি। জানুয়ারী মাসের রাত প্রায় বারটা,ব্যারেজের পাশে ,নদীর ওপারে একটি গ্রামে আচমকা হানা দেয় উগ্রপন্থীরা। নদীর এপাশে এন.এইচ.৪৪,উল্টোদিকের গ্রামে কয়েকঘর বাঙ্গালী বসতি।বেশীর ভাগই ওপার বাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তু,বিক্ষিপ্ত ভাবে এখানে সেখানে বসবাস করে।বহু বছর আগে বাংলাদেশ থেকে এসে ,এই পার্বত্য ত্রিপুরাতে যে যতটা পারে জমি নিয়ে বাড়িঘর বানিয়ে সেট্ল হয়ে যায়। এরকম ই একটি বাঙ্গালী পরিবারকে উগ্রপন্থীরা আক্রমণ করে,কয়েকজনকে গুলি করে মারে,কাউকে দা দিয়ে কুপিয়ে মারে। অন্তঃসত্তা মহিলা ও নিস্তার পান নি। যখন অপারেশন চলছিল,তখন ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১ কিমি দূরে কোয়ার্টারে আমরা গুলির শব্দ শুনে ভয়ে কাঁপছিলাম । কোথায় প্রশাসন,কোথায় মিলিটারী! কয়েকদিন আতংকিত হয়ে কাটাই,মনে হত,এই বুঝি হামলা হল।
উত্তর ভারতের যে সব কর্মচারীরা থাকতেন,তাদের বক্তব্য ছিল “ ইহা কা অন্ধেরা ভি জাদা কালা হ্যায়”। সংবাদপত্র দুদিনে পৌঁছত,কোনো লাইব্রেরী ছিল না,ছিল না ৫ কিমিঃ এর মধ্যে কোনো বাজার । গ্রামের বটগাছের নীচে,রাস্তার পাশে কেউ কখনো শাকের আঁটি,ডিম,মাছ নিয়ে বসত । আমি আমার কাজের মাসীকে দিয়ে মাঝে মাঝে ডিম,নদীর তাজা মাছ আনাতাম। এমন স্নেহশীলা মাসী আর পেলাম না।
দু বছর আগে প্রায় বাইশ বছর পর সেই স্থানে গেলাম।প্রভূত উন্নতি হয়েছে এসব অঞ্চলের।রাজ্য সরকার প্রচুর উন্নতিমূলক কাজ করেছে।প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে চিরদিনই ধনী ত্রিপুরা।সুন্দর ব্যারেজ,ব্যারেজের পাশে যেসব টিলা জমি ছিল,ছিল নিঝুম জঙ্গল।এখন সবুজ সুন্দর পার্ক হয়েছে।আশেপাশের ঘর গুলিতে সমৃদ্ধির ছাপ স্পষ্ট,আগের ভাঙ্গাচোরা বাঁশবেতের ঘর আর নেই।এন.এইচ.৪৪ অনেক প্রশস্ত হয়েছে। আগে বর্ষাকালে রাস্তার দু পাশের মাটি গাড়ির চাকার চাপে গর্ত হয়ে ভীতিপ্রদ অবস্থা সৃষ্টি করত। আমরা যে কোয়ার্টারে থাকতাম,সেগুলো ত্রিপুরা স্পেশাল পুলিস ফোর্সের ব্যাটেলিয়ন থাকে। আগে রাস্তা থেকে দেখা যেত কোয়ার্টার। এখন যায় না। একটি বুড়ো বটগাছ ছিল,নীচে শিবমূর্তি ,তা দেখে আন্দাজ করলাম ,কোয়ার্টার এখানেই ছিল। ।এক মাঝবয়সী লোক গরু চরাচ্ছিল,তাকেই জিজ্ঞেস করলাম, “ ভাই,কোয়ার্টার গুলো ঘুরে দেখা যাবে?অনেক আগে থাকতাম।’’ গরু বেঁধে লোকটি বলল, “ম্যাডাম,আমায় চিনতে পারছেন? আমি আপনার স্বামীর কাছে টুকটাক কাজ করতাম। আপনি অমুক সাহেবের স্ত্রী নন?” আমি চিনতে পারলাম না,কোন তরুণ চেহারাকে বের করতে পারলাম না। কিন্তু রমেশ পেরেছে,আমার বর্তমান ‘আমি’র ভিতর তন্বী তরুণী ‘আমি’কে বের করতে। ওর সাথেই কোয়ার্টারের দিকে এগিয়ে গেলাম।এখানে কোন সিভিলিয়ানরা যান না।পরিচ্ছন্ন রাস্তা,কোয়ার্টারগুলো শ্রীহীন হয়ে আছে।‘নস্টালজিক’ হয়ে গেলাম। আমার নব বিবাহিত জীবন,আমার কর্মজীবন দুই এখানে শুরু। অংক ওবিজ্ঞান শিক্ষিকা হয়ে ২কিমি দূরে এক সরকারী স্কুলে যোগ দিই। হাট বারে রিক্সা পেতে ভীষণ অসুবিধা হত। কখনো শেয়ারে,চালের বস্তার উপর বসেও গেছি। স্ট্যাটাস সচেতন হলে চাকরী করতে পারতাম না। আজ অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি ।
আদেখলার মত যখন দেখছিলাম,জওয়ানেরা উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছিল। রমেশ ওদের বলল, “ বহুত সাল পহেলে ইয়ে মেমসাব ইহা রহতী থী,উনকা পতি ব্যারেজমে ইঞ্জিনীয়ার থে।আভি বিদেশ মে রহতে হ্যায়।’’ প্রচুর স্মৃতি দু হাতে ঠেলে সরিয়ে স্কুলের দিকে এগোলাম। সেই গ্রাম্য স্কুলের কায়া পালটে গেছে।দিব্য দোতালা বিল্ডিং। নিঝুম দুপুরে রিক্শা নিয়ে জাতীয় সড়ক দিয়ে ফিরতাম,হয়ত শনিবারের দুপুর,রিক্সাওয়ালা ভাটিয়ালী ,কি মন কেমন করা লোকগীতি গাইত । মাঝে মাঝে দুরন্ত গতিতে মাল বোঝাই লরী ছুটে আসত,মনে হত থেৎলে যাব। একটি ত্রিশোর্ধ লোক এগিয়ে এসে বলল, “ দিদিমনি,আপনি ! চিনতে পারলেন ?’’ না, পারলাম না । বিশ বছর আগের কোন কিশোরকে তার মধ্যে খুঁজে পেলাম না।সাধারণত মেধাবীদের মনে থাকে। হাসলাম,এত বড় হয়ে গিয়েছে আমার ছাত্র ! আজ বেঙ্গালুরু, মাস্কেটে অনেক প্রতিষ্ঠানে চাকরী করেছি,করি । দক্ষিণ ভারতীয়,আরবী,পাকিস্তানী,কত ছাত্রের সংস্পর্শে এসেছি,সমৃদ্ধ হয়েছি,হচ্ছি । নিজেও প্রচুর পড়াশুনা করে এই জায়গায় পৌঁছেছি ।কিন্তু প্রথম শিক্ষকতার পাঠ শুরু হয় এখানেই ।
0 Comments