দূর দেশের লোকগল্প— ২৬২
যাদু কেটলি
ব্রহ্মদেশ, এশিয়া)
চিন্ময় দাশ
গাঁয়ের একেবারে একটেরে একটা মন্দির। বেশ বড়সড়ই মন্দিরটা। ঠাকুরের ঘর তো আছেই। ভাঁড়ার ঘর, থাকবার ঘরও আছে দু-তিনটে। জনাতিনেক ছাত্র নিয়ে মন্দিরে থাকে এক পুরোহিত ।
বয়স হয়েছে পুরুতের। সাধাসিধে মানুষ। তবে, বাতিক আছে একটা। দিনে চার-পাঁচবার চা খাওয়া চাই-ই চাই তার। অবশ্য সেই চা সে নিজেই তৈরি করত। ছাত্রদের ফরমায়ের করত না। চায়ের জন্য যে বাসনপত্র ব্যবহার করত, তা নিয়ে ভারি খুঁতখুঁতে ছিল পুরুত ঠাকুর।
একদিন বাজারে গিয়েছে পুরুত। একটা পুরনো বাসনপত্রের দোকানে গিয়ে ঢুকেছে। হঠাৎ একটারে চোখ পড়তেই চমকে গেল ঠাকুর। দোকানের এক কোণের একটা র্যাকে একটা কেটলি রাখা আছে। লোহার কেটলি। তবে, পুরোটাই জং ধরা। অনেক কাল কেউ যে সেটা নাড়াচাড়া করেনি, বেশ বোঝা যাচ্ছে।। কিন্তু তার জহুরির চোখ। বেশ দেখতে পেল, মরচের আড়ালে ভারী সুন্দর একটা কেটলি লুকিয়ে বসে আছে।
পুরুত ঠাকুরের বেশ পছন্দ হয়ে গেল জিনিসটা। দোকানিও খুশি। অনেক কাল এটার দিকে কারো চোখ পড়েনি। নামমাত্র দামে ঠাকুর মশাইকে বিক্রি করে দিল কেটলিটা।
মন্দিরে ফিরে সারাদিন ধরে কেটলিটা মাজতে বসল ঠাকুর। ঘষে ঘষে যতক্ষণ না মরচের শেষ দানাটা উঠে যায়, ততক্ষণ কাজে লেগে রইল ঠাকুর। এক সময় বেশ ঝকঝকে হয়ে উঠল জিনিষটা। মন ভারি খুশি। তিনজন ছাত্রকে ডেকে পাঠাল। বলল—দ্যাখো, কী সুন্দর একটা জিনিস আমি আর জোগাড় করে এনেছি। চায়ের জল ফোটাবো এটাতে। সকলেই আমরা দারুণ চা খাব এবার থেকে।
ছেলেরা ভারি খুশি। কাঠ কয়লার উনুন ছিল পুরুতের। উনুন জ্বেলে কেটলিতে জল চাপিয়ে দেওয়া হলো। তিন ছাত্রকে নিয়ে গোল হয়ে ঘিরে বসলো পুরুত। জল গরম হচ্ছে একটু একটু করে। সবাই অপেক্ষা করে আছে চায়ের জন্য।
হঠাৎই এক অবাক করা কান্ড। কেটলি নয়, কার যেন ছোট্ট একটা মাথা জেগে উঠল উনুনের উপর। তারপর একটা ঝাঁকড়া লেজ। সবশেষে ছোট্ট ছোট্ট চারটে পা। একটা গলা উঠলো-- বড্ড গরম। আমি পুড়ে যাচ্ছি। আমি পুড়ে যাচ্ছি। আমার সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে।
চেঁচাতে চেঁচাতে একটা খরগোশ উনুন থেকে লাফিয়ে নেমে এলো। নেমেই ঘরময় ছুটে বেড়াতে লাগলো।
ছোট্ট ছোট্ট পায়ে লাফাচ্ছে। ঠাকুর মশাই তো ভারি অবাক। কিন্তু মাথা ঠান্ডা রাখল। দেঁচাতে লাগল—ধর, ধর। তাড়াতাড়ি কর। দ্যাখ, বেরিয়ে যেতে না পারে। এমন একটা জিনিষ, হাতছাড়া করা যায় না।
ছেলে তিনটেও লাফিয়ে উঠেছে তড়াক করে। চমকে গিয়েছে তারা। তাড়াহুডড়ো করে হাতের কাছে যা পেয়েছে তুলে নিয়েছে। একজন নিয়েছে একটা ঝাঁটা। একজনের হাতে দুটো জ্বালানি কাঠ। আর একজন তুলে নিয়েছে খুন্তিটা। বেশ কিছুক্ষণ ঘরময় ছুটাছুটি করা হলো খরগোশের পিছনে। শেষ পর্যন্ত যখন ধরা পড়ল, তখন আরেক অবাক কান্ড। দেখা গেল, খরগোশ নয়। তিনজনে মিলে যেটা জাপটে ধরে আছে, সেটা আর কিছু নয়। একটা লোহার কেটলি।
চারজন মানুষ ঘরে। সবাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কোথায় গেল একটু আগে দেখা আস্ত খরগোশটা। মাথাটা কোথায় তার! ফুলোফুলো লেজ কোথায়! আর কোথায় বা খুদে খুদে চারটে পা!
একেবারে সাধারণ একটা কেটলি ধরে আছে তারা।
ভারি অবাক ব্যাপার তো! দুনিয়ায় এমনটা ঘটেছে, কেউ কখনো শোনেনি। পুরুত বলতে লাগলো-- এ নিশ্চয়ই কেটলি নয়। নির্ঘাৎএকটা ডাইনি। ছদ্মবেশ ধরে এসেছে আমার ঘরে। একটা মন্দিরে এমন জিনিস রাখা যায় না। এর হাত থেকে রেহাই পেতেই হবে আমাদের।
পুরুত ঠাকুর ভাবলো, কাল সকালে উঠেই যাবো দোকানে। বিদায় করে আসবো একে।
সেদিনই সবে বিকেল হয়েছে। একটা লোকের হাঁকডাক শোনা গেল-- পুরণো ঘটি-বাটি বাসন-কোসন কিছু বিক্রি করবে নাকি গো-ও-ও-ও--।
এই গলা প্রুতের চেনা। গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে, গেরস্তবাড়ির ফেলে দেওয়া এটা-ওটা অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নেয় লোকটা। তারপর দোকানে গিয়ে বেচে দিয়ে আসে। তাতেই পেট চলে তার। হাতে যেন চাঁদ পেয়ে গেল পুরুত। লোকটাকে ডেকে বলল-- এই কেটলিটা দ্যাখো। এটা বেচবো। এটা নিয়ে যাও তুমি। এটা নিয়ে যাও।
--দাম কত দিতে হবে? মুখের কথা শেষ হলো না মানুষটার। পুরুত বলল-- সে তুমি নিজে যা ভালো বোঝো, তাই দাও। লোকটা কেটলিটা হাতে ধরে ওজন পরখ করল। কয়েকটা পয়সা পুরুতের হাতে তুলে দিল।
দামের কথা কাজ করছে না পুরুতের মাথায়। মারাত্মক জিনিসটার হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেছে, এতেই সে খুব খুশি।
কেটলি পেয়ে, ফেরিওয়ালাও খুশি। কোন দরদাম করতে হলো না। একেবারে জলের ধরে জিনিসটা জুটে গেছে। দিনের শেষে ঘরে ফিরে, একটা তাকে রেখে দিয়েছে কেটলিটাকে।
তার ঘরেও আবার সেই অবাক করা কান্ড। রাতে ঘুমোচ্ছে, হঠাৎ যেন কার গলা শোনা গেল—ফেরিওয়ালা, ও ফেরিওয়ালা!
ঘুম ভেঙে গেল মানুষটার। এই ঘরে তো আমি ছাড়া কেউ নেই। এই তল্লাটেও নেই মানুষজন। তাহলে আমাকে ডাকে কে? একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে যা দেখল, তার চোখ ছানাবড়া। একেবারে তার বালিশের পাশটিতে একটা খরগোশ দাঁড়িয়ে আছে।
একেবারে খরগোশের মতো মাথা, পুরু লেজ আর চারটে ছোট ছোট পা। ফেরিওয়ালা অবাক হয়ে বলল—আরে, তুই সেই কেটরিটা না?
খরগোশ হাসি মুখ করে বলল-- হ্যাঁ গো হ্যাঁ। আমি সেই কেটলি। তবে সত্যি সত্যি আমি কিন্তু কেটলি নয়। আমি একটা খরগোশ। কেটলির ছদ্মবেশে থাকি। আর, আমার নাম হলো বুমবুকু।
কথা সরছে না ফেরিওয়ালার মুখে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে জীবটার দিকে। খরগোশ বললো-- বুমবুকু মানে জানো? ফেরিওয়ালা বলল—না, বাপু! এমন অদ্ভুত নাম শুনিনি কখনো।
--বুমবুকু মানে হলো সৌভাগ্য।
--তাই নাকি?
হ্যাঁগো, তাই। বিশ্বাস করো আমাকে। তুমি যদি পুরোহিতের মতো আমাকে আগুনে না চাপাও কখনো, যদি যত্ন করে রাখো, খেতে দাও—দেখবে, তোমার ভাগ্য ফিরবে। তোমার জীবন গড়ে দেবো আমি।
খরগোশ আবার বলল-- লোকটা গনগনে আগুনে চাপিয়েছিল আমাকে। তাই তো চলে এলাম ওর বাড়ি থেকে।
ফেরিওয়ালা বলল-- জীবন গড়ে দেবে আমার? কী করে করবে?
--শোন, বলি তোমাকে। অনেক খেলা জানি আমি। তুমি একটা খেলার আয়োজন করো। আসর বসাও। টিকিট বিক্রি করো। বহু লোক তো থিয়েটার দেখতে যায়। সার্কাস দেখতে যায়। ম্যাজিক দেখতে যায়। তুমি বলে দাও, খেলা দেখানো হবে মাঠে। তারপর দেখো তোমার কপাল ফেরে কি না।
ফেরিওয়ালা ভাবছে, খরগোশ হোক, বা একটা লোহার কেটলি। সে আবার কী খেলা দেখাবে? টিকিট বেচে, শেষমেশ আবার কোন অসুবিধায় পরবো না তো
খরগোশ বলল-- অত ভাবছো কেন? একটা আসর বসিয়ে দেখো। তার পরে বুঝতে পারবে আমার কেমন কেরামতি।
রাজি হয়ে গেল লোকটা। পরদিনই শুরু হয়ে গেল কাজ। একটা মঞ্চ বাঁধলো। সামনে মেরাপ বাধা হলো। ঢেঁড়া পিটিয়ে দিল এলাকায়। একটা নতুন জিনিষের ঘোষণা শুনে, মানুষজনেরও কৌতুহল হল। টিকিট কাটতে লাগলো লোকজন এসে।
বড়সড় একটা ফেস্টুন ঝুলিয়েছে। তাতে একটা লোহার কেটলি অদ্ভুত খেলা দেখাচ্ছে সেই ছবি আঁকা।
বেশ আলোড়ন পড়ে গেল গোটা এলাকায়। এমন অদ্ভুত ব্যাপার এর আগে কেউ দেখেনি এখানে। টিকিটও বিক্রি হচ্ছে ভালোই।
প্রতিদিন লোক সংখ্যা বাড়তে লাগলো আসরে। টিকিটও বিক্রি হতে লাগলো সেই হারে। যতক্ষণ না আসরে দর্শক ভরে যাচ্ছে, মঞ্চের বাইরে দাঁড়িয়ে লোক ডাকতে থাকে ফেরিওয়ালা। আসর ভর্তি হয়ে গেলে, সে ভিতরে ঢুকে পড়ে। ঢোলক আছে একটা। জোর জোর শব্দ তুলে বাজাতে শুরু করে।
ঢোলকে ঘা পড়লেই বুম্বুকু বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। শুরু হয় তার খেলা দেখানো। কিন্তু সে যখন মল্লযুদ্ধ দেখায় হাসির রোল ওঠে, আসল জুড়ে। ভারী মজা পায় লোকেরা। হাততালি দেয় বুম্বুকুর নাম ধরে চেঁচায়।
আসর মাতোয়ারা হয়ে ওঠে শেষ খেলায়। একটা টানটান দড়ির ওপর উঠে পড়ে বুম্বুকু। দু’হাতে ছোট্ট একটা ছাতা ধরা। ছোট্ট ছোট্ট দুটো পায়ে টলমল করে যখন দড়ির উপর হাঁটতে থাকে আর কসরত দেখায়, ছাতাটা তার টাল সামলায়। গোটা আসর আনন্দের উৎসাহে মেতে ওঠে।
আসর শেষ করে ঘরে ফেরে দুজনে। বুম্বুকুকে খুব আদর করে ফেরিওয়ালা। যত্ন করে তার জন্য পিঠে বানায়। পিঠে খেতে খুব পছন্দ প্রাণীটার।
বেশি দিন গেল না। আসরে টিকিট বিক্রি করে প্রচুর টাকা-পয়সা জমে গেল ফেরিওয়ালার হাতে। সে বুম্বুকুকে বলল-- আমার যা প্রয়োজন ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা জমে গিয়েছে। আমার আর প্রয়োজন নেই। তোমাকেও আর এত খাটাখাটনি করতে হবে না। আমি বলি কী, তোমাকে আমি এবার পুরোহিত ঠাকুরের কাছে মন্দিরে ফেরত দিয়ে আসি।
খরগোশ বলল-- খারাপ বলোনি। আমারও পরিশ্রম হয়ে যাচ্ছে খুব। কিছুদিন বিশ্রাম দরকার আমার। মন্দিরে থাকলে ভালই থাকবো।
খরগোশ আবার বলল-- আমার ভয় হচ্ছে, পুরোহিত ঠাকুর আমাকে না আবার গরম উনুনে চাপিয়ে দেয়। তাছাড়া, তোমার মত কি আর মিষ্টি পিঠে খাওয়াবে পুরোহিত ঠাকুর? আমার তো মনে হচ্ছে না।
ফেরিওয়ালা বলল-- সেসব তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। সব ব্যবস্থা করে, তবে আমি তোমাকে রেখে আসব।
সেদিন রাত জেগে ভারী যত্ন করে বেশ কিছু মিষ্টি পিঠে বানালো ফেরিওয়ালা। সকাল হতে পুটলি ভরা পিঠে আর এক থলি টাকা নিয়ে, মন্দিরের দিকে রওনা হলো।
ফেরিওয়ালা আর তার হাতে কেটলিটা দেখে, পুরোহিত বলল—কী, রাখতে পারলে না তো? ফেরত দিতে এসেছ?
ফেরিওয়ালা হাসতে হাসতে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল পুরোহিতকে। টাকার থলি ধরিয়ে বলল-- এটা তুমি রাখো, ঠাকুর। তোমার মন্দিরের কাজে লাগবে। আর, এই পিঠেগুলো রইল। এইটা বুম্বুমুর খুব প্রিয়। প্রতিদিনই একে পিঠে বানিয়ে খাওয়াবে তোমরা। তুমি রাখো একে। আমার নিজের জীবন থেকে বলছি, এতে তোমার ভালই হবে। এর অযত্ন করো না। অনেক উপকার পাবে এর কাছ থেকে। তবে হ্যাঁ, দেখো কোনদিন যেন ভুলেও উনুনে চাপিয়ো না একে।
পুরোহিত সব শুনল নিজের কানে। বলল—না। আমি কথা দিচ্ছি, একে আমি যত্ন করেই রাখবো। মন্দিরের সবচেয়ে সেরা যে জায়গা, সেখানেই হবে এর জায়গা। দু’বেলা খাবার দাবারেরও কোন দুশ্চিন্তা করো না তুমি। আমি ঠিক যত্ন করব এর। এবার আমি বুঝতে পেরেছি, এটা একটা সাধারণ কেটলি নয়। সত্যিই এটা হল সৌভাগ্যের প্রতীক। আগে যদি আমি জানতাম, কখনোই উনুনে চাপাতাম না। ভুল হয়ে গিয়েছে আমার
পুরোহিত ঠাকুর তার ছাত্রদের ডেকে পাঠালেন। সব কথা বুঝিয়ে বললেন তাদের। একটা কাঠের চেয়ার বানানো হলো। তাতে যত্ন করে বসানো হলো বুম্বুকুকে। মন্দিরে সিন্দুক যে ঘরে থাকে, সেখানে টেবিলের উপর রাখা হলো চেয়ারটা। পাশে রেখে দেওয়া হল মিষ্টি পিঠের থালা
সেই থেকে মন্দিরেই থাকে কেটলিটা। বেশ আনন্দই থাকে সে সেখানে। উনুনে চাপাবার কথা পুরোহিতের মাথাতেও আসে না আর।
0 Comments